নখদন্ত, একটি পোস্টমডার্ন সাতকাহন
নখদন্ত, একটি পোস্টমডার্ন সাতকাহন
উৎসর্গ
সুরজিৎ সেন
রতন বিশ্বাস
হরপ্রসাদ সাহু
প্রিয়বরেষু
ভূমিকা
দেশাচারে খুব দোষ আছয়ে এখন ।
দেশীয় বিদ্যার কেহ করে না যতন ।।
বাঙ্গালা জানিনে বলে বাঙ্গালি হইয়ে ।
মনে-মনে ভাবি কারে কিছু না বলিয়ে ।।
আবকারি, অসভ্যতা, বেশ্যা, অত্যাচার ।
যদেচ্ছা আহার, আর অন্যায় বিচার ।।
অপব্যয় উচুচাল অন্য প্রতি দ্বেষ ।
বোসেচে উচ্ছন্ন দিতে এই বঙ্গদেশ ।।
দেখেও দেখে না যাঁরা আছেন অন্তরে ।
অন্তরে আছে কি বোলে রবেন অন্তরে ।।
রহিবে কি বঙ্গদেশ মন্দাচারে ভরা ।
সবার উচিত ইহা সংশোধন করা ।।
ঐক্য অর্থ পরিশ্রম এই তিন বলে ।
কতকাণ্ড হইতেছে দেখ কত স্হলে ।।
চেষ্টার নিকটে ইহা সামান্য বিষয় ।
অসাধ্য কি আছে বল চেষ্টা যদি হয় ।।
( ‘আপনার মুখ আপুনি দেখ’ । লেখক ভোলানাথ মুখোপাধ্যায়, ১৮৬৩ )
১. সোমবার, ধরা যাক আদিকাণ্ড
হরিবোল, তাও অনুচ্চ, বলতে গেলে জনা দশেকের ফিসফিসে গলায়, শুনে ঘুম ভাঙতে, টর্চ জ্বেলে দেখি, রাত্তির আড়াইটে । প্রতিরাতে আজকাল অসময়ে ঘুম ভাঙছে । সলিলা যথারীতি আগে টের পেয়ে, রাস্তার দিকের গোল বারান্দার জানালায়, আলো জ্বালেনি । বলল, ‘ওপরের ফ্ল্যাটের সাধন চৌধুরীকে নিয়ে যেতে মীরা সৎকার সমিতির গাড়ি এসেছে ।’ গ্রিলের বাইরে মুণ্ডু বের করে দেখলুম, শুকিয়ে চার ফিটের টেকো চশমা-পরা শব হয়ে গেছেন সাধনবাবু, এক কালের ফ্লপ সিনেমার উত্তম-ছাঁট প্রযোজক । উনি আর ওনার পুত্রবধু মিলে আমাদের চাটগাঁ-সিলেটি গালাগাল বিতরণ করতেন । সেটা ভাগ্যক্রমে ঘটিদের কানে অশ্লীল শোনালেও দুর্বোধ্য । ক’দিন ধরেই ঝি-চাকরদের ওনারা ফ্ল্যাটের মধ্যে যেতে দিচ্ছিলেন না । দিনকতক আগেই মারা গেছেন সম্ভবত, চিলবক্সে সংরক্ষিত ছিলেন । ছেলে ছিল জাপানে ট্যুরে, আজকে এগারোটায় ফিরেছে । ক্লাবের সবজান্তা ছেলেরা পৌঁছে গেছে । সব কিছু লুকোছাপা গোপন । সকলেই নিচু গলায় বাঙাল বুলিতে কথা বলছিল ।
ঘুম আসছিল না । শ্রীধর মুখোপাধ্যায়কে যে গল্পটা দেবো, পড়ে দেখলুম আরেকবার । যেসব কমরেডদের নিয়ে ও গোমর করে, তাদের নিয়েই গল্পটা । ঘুম আসছিল না । টিভি খুলে বসলুম । স্টার মুভিজে হরর গপপো । চ্যানেল ভি দেখতে-দেখতে ঘুম এল ! চারটে । সাতটায় ঘুম ভাঙল । ওপরতলায় সৌজন্য ভিজিট দিতে গেলে সদ্য বিধবা জানালেন, ‘মড়া বাসি হতে দিলাম না, তাই রাতে-রাতেই ।’ সত্যি, এই বঙ্গসংস্কৃতির সঙ্গে আমাদের পরিচয় ছিল না । মন খারাপ হয়ে যায় এমন দেখেশুনে ।
ঘুম হয়নি । ফিজিওথেরাপি করতে ইচ্ছে হল না । হাতের লেখার ব্যায়ামও নয় । দেয়ালে স্লেট টাঙিয়ে অ আ ক খ এ বি সি ডি ।
চে খেতে-খেতে সানডে টাইমসটা ওলটালুম । এটা পড়ার সময়ে মুম্বাইতে চলে যাই । একটা ওয়ানরুম ফ্ল্যাট ওখানে কিনে রাখলে মাঝে-মাঝে গিয়ে থাকা যেত । ওখানকার দ্রুতির জন্যে মনকেমন করে ।
আজকে অফিস ডিসপেনসারিতে গিয়ে চেকআপ করানো আর ওষুধ নেবার দিন । চান করে বেরোলুম । রিকশায় নাকতলা । অটোতে টালিগঞ্জ । মেট্রোয় পার্কস্ট্রিট । রবীন্দ্র সরোবরে উঠলেন ধপদোরস্ত আমলা মঞ্জুষ দাশগুপ্ত, সঙ্গে মহিলা, অফিস যাত্রার অতিগাম্ভীর্য । মেট্রোয় কেউ কথা বলে না । বোঝার উপায় সম্ভবত, যে, অকুস্হলে ক্যানসার পুষছেন ।
ডিসপেনসারিতে আমরা পৌঁছোবার পর ভিড় বাড়ল । অবসর নেবার পর বিশেষ পাত্তা পাই না বলে আগেভাগে গিয়ে বসে-বসে হাই তুলি । হাই তোলার মজা নিই । আমাদের দুজনেরই ব্লাডপ্রেশার বেড়েছে । ওষুধের মাত্রা বাড়ল । নিচে দোতলায় যেতে মুরলিধরণ বলল, সমবায়ের সেমিনার হচ্ছে, আমায় যেতে হবে । অবসর নেবার পর নিজের অফিসটাই অচেনা হয়ে গেছে । শেষ দু’বছর আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলুম । অজয় মালহোত্রা হাসি ঠোঁটে বলল, ‘লখনউতে মমতা অবস্হি আত্মহত্যা করেছেন ।’ শুনে কী প্রতিক্রিয়া হল ? কিচ্ছু হল না, আশ্চর্য, কিচ্ছু হল না । ট্যুরে যাবার সময়ে একদিন বাসস্ট্যাণ্ডে আমার জন্যে অপেক্ষা করেছিলেন । পৌঁছোতেই বললেন, ‘চলুন দুজনে পালাই ।’ কী ভয়ানক । কাঠমাণ্ডুতে ভূবনমোহিনী রাণার আত্মহত্যার সংবাদ পেয়েও কোনো প্রতিক্রিয়া ঘটতে দেখিনি নিজের মধ্যে । অতীত নিজের সঙ্গে নিজেকে নিয়ে উধাও ।
একতলায় নেমে, আইওবিতে টাকা তুলতে আর চেক বই নিতে ভেতরে গেল সলিলা । আরথ্রাইটিসের কারণে আমার সই মেলে না বলে প্রতিবার তিরস্কার জোটে । কবি সুভাষ গঙ্গোপাধ্যায়কে দেখতে পেলুম না ওর সিটে । নির্ঘাত ইউনিয়ানবাজি করতে বেরিয়েছে ; মানে কোনো ইউনিয়ান স্যাঙাতদের আড্ডায় ঠ্যাং ছড়িয়ে ধোঁয়ার উড়াল । এসিতে সোফায় বসে রইলুম । সকালের মৃত্যু আর দুপুরের মৃত্যু সংবাদ দুটোর মধ্যে কত তফাত । একটা সংবাদ গোপন ক্ষতের মুখ খুলে দেবে টিম টিম টিম টিম । আরেকটা গুড রিডেন্স অব ব্যাড রাবিশ ।
পার্ক স্ট্রিটের মোড়ে হট কাটি রোল থেকে দুটো চিকেন-রোল কিনে খেতে-খেতে বাসে উঠে পড়েছিলুম । প্রাইভেট বাসে সবাইকে দেখিয়ে-দেখিয়ে বুড়ো-বুড়ির চকেন-রোল খাবার আহ্লাদটাই আলাদা । রাসবেহারির মোড়ে নামতে হল, বাসটা সোজা যাবে না । বইয়ের স্টলটায় চোখ বুলিয়ে প্রথম আলো, কবিতা পাক্ষিক, দাহপত্র, বিতর্ক, নাট্যচিন্তা, কোরক, এবং জলার্ক, শীলিন্ধ্র কিনলুম, লখনউ-দিল্লিতে পড়ার সময় পাব বলে । সলিলা লেক মার্কেট থেকে সজনেফুল আর লিকলিকে ডাঁটা কিনে আনল । আর রোলের অ্যান্টিডোট ডাইজিন । রোল আর ডাইজিন দুটোই ডাক্তারের বারণ ।
বাড়ি ফিরে, রোদ লাগায়, ঘুমিয়ে পড়লুম । চাষার রোদঘুম ।
ঘুম থেকে উঠে কেদার ভাদুড়ির আস্তানায় গেলুম । মনে ছিল না । আজকে ওনার হেভি টিউশানির দিন । কচি মেয়েরা থাকায় ফিরতে হল । কেদারের নিজের সম্পর্কে অতিকথাগুলো থ্রিলিং । ওনার একটা সাক্ষাৎকার নেব, অন্যরকম সাক্ষাৎকার । চালু ডেফিনিশানে কেদারের কবিতা কোথাও ফিট হয় না । কলকাতার কাব্যজগতে অপাঙক্তেয় । প্রাক্তন উদ্বাস্তু হওয়া সত্ত্বেও উনি অপাঙক্তেয় ।
Note : ১) দি ন্যারেটার হ্যাজ টু অ্যামিউজ, অ্যাসটনিশ, প্রুভ । ২) হিজ গিফ্টস হ্যাভ অ্যাডোলেসেন্স । ৩) দি ক্যারেক্টার্স আর আনএবল টু ওভারকাম দ্য এবসেন্স অব দি অথর । ৪০ দি প্রলেতারিয়েত পোয়েট সাফার্স ফ্রম পেনিস এনভি । ৫) লাইক অল হিসটরিকাল ক্যারেক্টার্স, দি পোয়েট ইজ অলওয়েজ অপরচুনিস্ট । হি উড মেক হিজ মার্ক, ইফ নট ইন দিস ট্রি, দেন অন দ্যাট ওয়াল ; ইফ নট উইথ ক্লজ অর টিথ, দেন উইথ পেন-নাইফ অর রেজর অন ফ্লেশ । ৬) শুড দি সুইওসাইড অব ভূবনমোহিনি রাণা বি রিগার্ডেড অ্যাজ দি লাস্ট স্টেজ অব এ সিরিজ অব স্মল অ্যাক্টস এগেইনস্ট সেলফ ? ৭) সুইসাইড অব মমতা অবস্হি ইজ এ রিভেঞ্জ শি ডিড নট লিভ টু এনজয় । ৮) সাম কলকাতা কফিহাউস রাইটার্স সিম্পলি থিংক অব ডেথ অ্যাজ দিন এবসেন্স অব দি প্রেজেন্ট । ৯) ড্রিমি ফ্রিকোয়েন্সিজ । ১০) ক্যালকাটা সিমস লাইক এ হসপিটাল অব কনটেজিয়াস ডিজিজেস । ওয়ান সিজ ওনলি হররস : লাইফ লাইক স্পিটল অন এ ওয়াল, ফিয়ার অ্যাজ জেনারাল অ্যাজন এয়ার — ইন ফেসেস হুইচ ফেল অ্যাওয়ে ইনটু দি হ্যাণ্ডস হুইচ হেল্ড অ্যান্ড হিড দেম, ইন দি ইউরিনেটিং নার্ভাসনেস অব ডগস ( জীবনানন্দ বলেছেন শেয়াল, শকুন, শুয়োর ), ইন সাইলেন্সেস হুইচ ব্রোক দি নয়েজ অব এভরিডে লাইক মিররস ইন দি স্পুনেবল এম্পটিনেস অব আফটার-মিডনাইট নাকতলা, ইন লিটল শপস হুইচ সিমড সিরিন অ্যাণ্ড সেফ অ্যাজ গ্রেভস ।
‘মেধার বাতানুকূল ঘুঙুর’ আমার কাছে এক কপিও নেই । খুঁজে পেলুম না । শুদ্ধ চেতনার রহস্য, বিজ্ঞানসম্মত কীর্তি, দালাল, বাজারিণি, পরবর্তী সর্বনাশ, উৎপাদন পদ্ধতি, ধনতন্ত্রের ক্রমবিকাশ, কাঠামোতত্ত্ব, কবিতাগুলো কি সফল হল সত্যিই আত্মহত্যা করিয়ে ? পনেরো বছর পর, মমতা ?
বাকার্ডি নেয়ে বসলুম, সমীর বসুর ‘প্রবাসী’ সংখ্যার জন্যে সিরাজুল ইসলামের ‘বাংলাদেশের ইতিহাস ( ১৭০৪ – ১৯৭১ ) বইটার প্রথম খণ্ড থেকে কিছু পাব ভেবে । সিরাজুল বোধহয় দাড়িঝোলা তবলিগি । ঢাকার এসট্যাবলিশমেন্ট পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে অনেক বেশি পচেছে । ঢাকা-চাটগাঁ যাইনি আজও । গেলে কি স্বপ্নভঙ্গ হবে, জীবনানন্দ ? সম্ভবত । নিজে যা ভেবেছি, যা অভিজ্ঞতা, তাই দিয়েই শেষ করলুম । পদ্মিনী মোঙ্গিয়ার বইটা অনেক কাজে দিল ।
পাশের বাড়িতে অঞ্জলিদি শাস্ত্রীয় গান গাইছেন, হারমোনিয়াম বাজিয়ে, সম্ভবত সাধন চৌধুরীর মৃত্যুর আনন্দে । লোকটা মরায়, আর দ্বিতীয় মৃত্যুর খবরে, কেমন রিলিফ অনুভব করছি । এই ফ্ল্যাটে এসে ওব্দি বৃদ্ধা রোগা কালো স্কুল শিক্ষিকা অঞ্জলিদির গান শুনছি । ওঁর বাড়িতে চুরি হয়েছে যেদিন, সেদিনও গেয়েছেন । অত বড় বাড়িতে একা । পক্ষাঘাতে পঙ্গু ওনার মাকে ঘুম পাড়াবার জন্যে মাঝরাতে চাপড়াতেন, মনে হত থাবড়ে রাগ আর অসহায়তা প্রশমিত করছেন । মা মারা যেতে, সৎকার সমিতির গাড়ি ডেকে, একাই নিয়ে চলে গেলেন । সাইকেল চালিয়ে বাঁশদ্রোণী বাজারে মাছ আর সবজি কিনতে যান । ওনার বাগানে স্যানিটারি ন্যাপকিন দেখতে পেয়ে, আমাদের নিচের ফ্ল্যাটের বউটিকে বকুনি দিতে, বউটি অঞ্জলিদিকে বলেছিল, ‘ওটা আমার নয়, আমি ট্যামপুন নিই, আর আমার কাজের বউরা কানি বাঁধে ।’ অঞ্জলিদি বোধহয় ট্যাম্পুনের কথা প্রথম শুনলেন, মুখ দেখে তেমনই মনে হয়েছিল ।
বাড়ি দশ লাখ টাকায় বেচে দিয়ে অঞ্জলিদি চলে যাচ্ছেন শুনেছি । বলেন, রিফিউজিদের পাড়ায় থাকা যায় না । এ পাড়ায় সবাই জবরদখলওয়ালা পরিবার, প্যালেসটাইনে ইজরায়েলাইটস । উনি বলেন, ‘যারা অন্যের জমি দখল করে নিয়েছিল, তারা এখন দায়বদ্ধতার কথা বলে ! তোরা আবার কিসের দায়বদ্ধ রে ? দিব্বি তো প্রোমোটারদের প্যাঁচ মেরে টাকা আর ফ্ল্যাট নিচ্ছিস । যাদের জমিজমা দখল করে নিয়েছিলিস তারা আজ কোথায় মুখ থুবড়ে পড়ে৪ছে তা দেখেছিস ?’
আজকাল অঞ্জলিদির রাগ বেড়েছে । দশ লাখ টাকা থেকে দু’লাখ প্রফুল্ল চক্রবর্তীর ‘মার্জিনাল মেন’ বইয়ের নায়কদের দিতে হবে । নয়তো বেচতে পারবেন না । পশ্চিমবঙ্গের খাঁজে-খাঁজে ঢুকে গেছে এইসব নায়কেরা । পশ্চিমবঙ্গের এথনিসিটি তো নষ্ট হয়েই গেছে । সুতরাং পশ্চিমবঙ্গের নাম পালটাতে অসুবিধা কোথায় ! অঞ্জলিদি নিশ্চই বুঝে গেছেন যে সারাটা পশ্চিমবঙ্গ দখল হয়ে গেছে । জবরদখল ।
‘মার্জিনাল মেন’ বইতে প্রফুল্ল চক্রবর্তী আসল প্রান্তিকদের কথা লিখতে ভুলে গেছেন একেবারে । যাদের দণ্ডকারণ্যের মালকানগিরি, গডচিরোলি, ছত্রপুর আর হিমালয়ের তরাই, আন্দামান, মোতোহারি, বেতিয়া কোথায়-কোথায় আদিবাসিদের মধ্যে পুঁতে হাত ধুয়ে ফেলেছিলেন জওহরলাল ।
কোথাও কেক তৈরি হচ্ছে । ভ্যানিলার গন্ধ আসছে । ইউরোপ ঢুকে গেছে বাঙালির জিনসে । রাজাভাতখাওয়ার বাঙাল আর পুরিলিয়ার মাহাতও সনেট, লিরিক, এপিটাফের জেলগারদে । আর সেসব নিয়ে কতই না অধ্যাপকীয় হম্বিতম্বি ।
কেবলে ‘শেক্সপিয়ার ইন লাভ’ দেখলুম । আমার মগজের মধ্যেকার শেক্সপিয়ার ভেদ করে প্রেমের গল্পে পৌঁছোতে অসুবিধে হল । কিন্তু কমপ্লেক্সটা ভাঙা কত জরুরি ছিল । উপনিবেশ ? নেশা করলে মগজটা বেশ ঝরঝরে হয়ে যায় । শরৎচন্দ্র ?
ছবিসূত্র-শব্দসূত্র : পাক খুলে যারা বেরোতে পারেনি । প্রশ্নবোধক শীত । ঝিনুক-সাপের চামড়া । নৃত্যপটিয়সী বাদুড় । শিক্ষকরা প্রতিবাদী ছাত্রকে বেঞ্চে দাঁড় করায় । উৎকন্ঠা অর্জনের শ্রম । পাইলট মাছ । তোরা সব কোন আঠায় জোড়া । হাড়ের দেশের নাগরিক । আজকে ওনার পা দুটো কেটে বাদ দেয়া হবে । থুতনি নেড়েছিল আরশোলা । হাতের রেখার অন্ধকার টানেল । মাকড়সার ওৎপাতা একাকীত্ব । পুরুষ হাঙরের গান । দুঃখি পদচিহ্ণ । সদিচ্ছার নিশিডাক ।
লিট্যানি : এ পোয়েম সলেম ইন ক্যারেক্টার, বেসড অন চার্চ প্রেয়ার, বিল্ডস ইটস এফেক্ট স্টভানজা বাই স্ট্যানজা । সো প্রোনাইন্সড ইজ দি মুড দ্যাট ইট ইজ লাইকলি টু রিমেইন ইন মেমরি লং আফটার দি ইমপ্যাক্ট অব ইনডিভিজুয়াল ইমেজেস ফেড ।
টোন : অ) টোন ইন এ পোয়েম ইজ অ্যান আসপেক্ট অব স্পিকিং ভয়েস, এসপেশিয়ালি দি ইনফ্লেকশান্স অব দি ভয়েস ফ্রম হুইচ উই ইনফার দি অ্যাটিচুড অব দি স্পিকার । উই মে সেন্স দ্যাট এ স্পিকার্স টোন ইজ গে, ন্যাস্টি, মেলাংকলি, সুদিং, বিটার, সোম্বার, অ্যাংরি, অর মোটিভেটিভ, অ্যাজ দি কেস মে বি, অ্যানহদ দি মোর অ্যাটেনটিভ উই আর টু দি প্রিসাইজ ইনটোনেশান, দি ক্লোজ উই সিম টু কাম টু অ্যান এগজ্যাক্ট নোশান অব দি স্পিকার্স অ্যাটিচুড টোয়ার্ডস দি সাবজেক্ট । আ) টোন ইন এ পোয়েম ইজ এ প্রোডাক্ট অব মেনি ফ্যাক্টরস — চয়েস অব ওয়র্ডস অ্যাণ্ড ডিটেইলস ; অ্যাসোশিয়েশান অব ইমেজারি, রিদমস অ্যাণ্ড সাউন্ড এফেক্টস, স্পিকার অ্যাণ্ড সিচুয়েশান । ই ) টোন ইজ মোর দ্যান অ্যান ইনফ্লেকশান অব দি স্পিকিং ভয়েস ; ইট ইজ মুড অর কোয়ালিটি অব ফিলিং দ্যাট ইনফর্মস দি পোয়েম অ্যাজ এ হোল ।
অভিধানে টোনের বাংলা দেয়া আছে স্বরভঙ্গি, স্বন, স্বরগ্রাম । শ্যামাপদ চক্রবর্তীর ‘অলঙ্কার চন্দ্রিকা’, অশোক মুখোপাধ্যায়ের ‘ব্যাকরণ অভিধান’-এ পেলুম না । প্রাগাধুনিক বাঙালির সঙ্গে ইউরোপীয় আধুনিক প্রতিস্বর ফারাক খোঁজা যেতে পারে এখানে ।
সুব্রত রুদ্র এক কপি ‘অ’ চেয়েছেন । কুচবিহার থেকে । সলিলাকে বলেছি প্যাক করে দিতে । পার্ক স্ট্রিট পোস্ট অফিস থেকে সাধারণ ডাকে পাঠালে মারা যায় না ।
শর্মী পাণ্ডের নরম টেলিফোন । দীপঙ্কর দত্তর যেমন ইনটেনসিভ সাক্ষাৎকার নিয়েছি, তেমন অরূপরতন বসু, শুভঙ্কর দাশ, ওদের ইনটারভিউ নেবার প্রস্তাব । নেয়া যায় । দীপঙ্করের মতন নৈকট্য দরকার । শর্ঞীর সাক্ষাৎকার বরে আই ওপনার হবে ।
চোখে আই ড্রপ দিলুম । মশারি টাঙালুম । টেলিফোনের হ্যাণ্ডসেটটা রেখে দিলুম সলিলার বালিশের পাশে । কাল সকালে উঠে সবচে আগে পায়খানার কমোডটা পরিষ্কার করতে হবে ।
‘মল্লার’ পত্রিকার জন্যে একটা গল্প চেয়েছে অলোক গোস্বামী । শ্রীধরকে দেবার জন্যে যে গল্পটা লিখেছি, তার সঙ্গে অর্গানিক লিংক রেখে এই গদ্যটার খসড়া ভাবতে লাগলুম ।
২. মঙ্গলবার, অরণ্যকাণ্ড
রাত দুটোয় ঘুম ভেঙে গিয়েছিল । একগাদা লোকের কথাবার্তা । সলিলা বলল, ‘ওই বাড়িটায় ছোঁড়া-ছুঁড়িদের ফুর্তি-ফার্তা চলছে ।’ আলো না জ্বলে, পুকুরের দিকের জানলায় দাঁড়ালুম । নতুন যে বাড়িটা আধখ্যাঁচড়া হয়ে পড়ে আছে, তার ছাদে পাড়ার কয়েকটা ছেলে গোল হয়ে বসে, মাঝখানে তিনটি মেয়ে নাচছে, কন্ঠে ‘কুছকুছ হোতা হ্যায় ।’ সম্ভবত তৃণমূল, সিপিএম দুটো গোষ্ঠীরই । অনেকক্ষণ চলছে নিশ্চই, সবার অঙ্গভঙ্গিতেই মাতলামি । এদের সুখ, আহ্লাদ, যৌনতা সম্পর্কে কারোর রাজনৈতিক দায় নেই যখন, এরা নিজেরাই তা পুষিয়ে নিচ্ছে । নতুন তৈরি হয়েছে বাড়িটা । জমি কিনে কর্তা মারা যেতে ওনার স্ত্রী, যিনি গৌহাটিতে চাকরি করেন, তৈরি করিয়ে ফিরে গেছেন । পুকুরে যাবার পথে স্নানার্থীরা এক খাবলা কাদা তুলে বাড়ির দেয়ালটায় ছুঁড়ে মারে, নান্দনিক জবরদখলের প্রকাশ হিসেবে । এরাই রবীন্দ্র জয়ন্তী, নজরুল জয়ন্তী করে । রিরুটিং । গানের ডেসিবেল বাড়তে থাকায় ঘুম আসতে ঘণ্টা দেড়েক লাগল ।
ঘুম ভাঙল মুম্বাই থেকে বাপ্পার টেলিফোনে । সলিলাই কথা বলল ।
ঘুমিয়ে পড়েছিলুম । এবার ঘুম ভাঙল আচমকা লাউডস্পিকারে । কারোর বাড়ি অনুকূল ঠাকুরের কিছু আছে । তার মানে সারাদিন চলবে । লাউডস্পিকার কেন, অনুকূল ঠাকুরের জন্যও লাউডস্পিকার কেন, তার ব্যাখ্যা নেই । যে-ধর্মগুরুরা লাউডস্পিকার ব্যবহার নিষিদ্ধ করে যাননি, তাঁদের ক্ষমা কে করবে ! আধুনিকতা এসে ঈশ্বরকে মেরে ফেলেছে বটে, কিন্তু ছড়িয়েছে ধর্মের মড়ক । এই পাড়াটায় ধর্মই সামাজিকতার প্রধান মঞ্চ । ফলে আমরা আউটসাইডার । সন্দেহজনক পরিবার । কোনো ‘পাড়ায়’ না থাকলে কলকাতাকে চেনা যাবে না । সব সময় মনে হয় এখানে আমরা টেম্পোরারি ।
এক্সারসাইজ করে দাঁত মেজে চা বসালুম । ফাইনাল চায়ের শেপ দেবার কাজ সলিলার । দাড়িটা ট্রিম করলুম, নখ কাটলুম । ফুলের টবে মাটি খোঁচালুম । বেলি, জুঁই, অপরাজিতা ফুটছে প্রতিদিন । শুকনো পাতাগুলো ছাঁটলুম কাঁচি দিয়ে । জল দিলুম গাছগুলোয় । কলের জল নোনতা বলে গাছগুলো সুখি নয় ।
আবার টেলিফোন । সলিলার ছোটোমামা-মামি, মুম্বাই থেকে সুখচর এসেছেন কার বিয়ে অ্যাটেণ্ড করতে, দুপুরে দেখা করতে আসবেন । চা খেয়ে বাজার গেলুম । মেথিপাতা দিয়ে মাংস ছোটোমামার প্রিয় । ছোয়ারা কিসমিস দেয়া চাটনি । মিষ্টি দই । গর্ভমোচা । কাগজি লেবু । গুড়ের রসোগোল্লা উঠে গেছে । ফিরে মেথিশাক বাছলুম । সলিলা মশলা রেডি করে দিতে, মিক্সিতে পিষলুম । টোমাটো কেটে দিলুম । চাটনিতে একটু আদার রস আর পাতিলেবু নিংড়ে দিতে শিখিয়েছে সলিলা ।
ব্রেকফাস্টে রুটি-তরকারি খেয়ে ‘যুক্তাক্ষর’ পাঠাবার জন্যে সঞ্জিত ঘোষকে চিঠি দিলুম, ‘স্বপ্নদেশ’ এর ভূদেব করকে, ‘আজকের কবিতা’র প্রবীর রায়কে । শিবুর চায়ের দোকান থেকে রিকশাঅলাদের ময়দার উপাদেয় পরোটা আর আলুমটরের দম খাবার নরমগরম গুলতানি আসছে । শিবুর দোকানে সময়ের শ্রেণি বিভাজন আছে । ভিকিরি, মুটে, ছাত্র, ঠিকেদার, ক্যাডার-মস্তান, বাবু । ওর দোকানটা তৃণমূল আর সিপিএম-এর ফল্ট লাইনে । কৌশিক রায়কে পোস্টকার্ড লিখলুম, প্রবন্ধটা হারিয়ে ফেলল কিনা কে জানে ।
কার্তিক লাহিড়ির টেলিফোন এল, ‘আধুনিকতার বিরুদ্ধে কথাবাত্রা’ অ্যাপ্রিসিয়েট করলেন । শুভঙ্কর দাশের টেলিফোন, পেলিং যাচ্ছে, ফিরে পাঁচ কপি গঁগা দিয়ে যাবে । দীপঙ্কর দত্তর সাক্ষাৎকারটা ওর উচিত ছিল বইমেলায় ছাপা । ওরও বোধহয় কমপ্লেক্স আছে । দীপঙ্করেরও উচিত ছিল শুভঙ্করকে অর্থসাহায্য করা । রজতেন্দ্র মুখোপাধ্যায়কে ফোন করে জানলুম ‘দিশা’ বেরিয়েছে । কোথাও আর আড্ডা মারতে যাবার ইচ্ছে হয় না, মনে হয় কেউ আমায় ঋদ্ধ করতে পারছে না, কারোর কাছ থেকে কিচ্ছু পাচ্ছি না । সবকটাই তো বৌদ্ধিক উদ্বাস্তু ।
রাজা সরকার এল । আগে পরিচয় ছিল না । বদলি নিয়ে এসেছে । মেয়েকে ভর্তি করেছে যাদবপুরে । বইপত্র দিলুম যা ছিল । ধঅরীতি বক্তৃতা দিয়ে ফেললুম । মনে হল উত্তরবঙ্গ ব্র্যাণ্ডের ডায়াসপোরা ।
রান্না সেরে সলিলা হাত দিয়েছে ফ্ল্যাট ঝাড়পোঁছে, মামা-মামি আসছেন বলে । আমিও কিছি হেল্প করে চান করে নিলুম । শর্টস পরে থাকা যাবে না । মদের খালি বোতলগুলো খাটের তলায় ঢোকাতে বলল সলিলা, বেলুন গ্লাসগুলো আলমারিতে । সলিলা বিদর্ভের হকি ক্যাপটেন ছিল, আর কাপ জিতলে তাতে রাম ভরে পুরো টিম খেতো, জানেন মামা-মামি । তবুও । দেখনশ্রদ্ধা । কোনো কবিলেখকের স্ত্রী স্পোর্টস সম্পর্কে আগ্রহী নয় বলে সলিলা তাদের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে মিশতে পারে না ।
বসেছিলুম মামা-মামির অপেক্ষায় । কলিংবেলে দরোজা খুলে দেখি আমার ব্রাহ্মস্কুলের ল্যাঙোটিয়া বন্ধু সুবর্ণ উপাধ্যায় । সুবর্ণকে পঁয়ত্রিশ বছর পর মাসখানেক আগে আমার আরেক ল্যাঙোটিয়া দোস্ত ওর মেয়ের বিয়ের সময় খুঁজে বের করেছে, লেক রোডে । বারীন, মানে বারীন্দ্রনাথ গুপ্ত । পাটনায় বারীনকে ‘জলাঞ্জলি’ উপন্যাসটা দেবার সময় তরুণ শুরের লিউকেমিয়ায় মৃত্যু আর সুবর্ণর হারিয়ে যাওয়া নিয়ে অনেক কথা হয়েছিল । সুবর্ণকে দিলুম ওর কপিটা, আর আমার অন্যান্য বই । স্কুলের, কলেজের, হাংরি আন্দোলনের স্মৃতিচর্চা করলুম । তখন ও পাইকপাড়ায় থাকত । মেথিমাংস খেল । ওর বাড়িতে মাংসের চল উঠে গেছে, ধর্মের কারণে । হয়ত রান্নার ঝক্কিকে ধর্ম দিয়ে সামলেছেন শ্রীমতী উপাধ্যায় ।
সকাল থেকে খাটুনি আর সুবর্ণ আসার উত্তেজনায়, চেতনাটা এক মুহূর্তের জন্য দপ করে হৃদযন্ত্রটা ফরফর করে উঠল । ওষুধ তো খেয়েইছি সকালে । সুবর্ণ চলে যেতে শুয়ে পড়লুম । শরীর আবার গোলমাল পাকাবার জন্যে তৈরি হচ্ছে । এর আগে লেক মার্কেটে হয়েছিল মাস চারেক আগে । মৃত্যুর নয়, অথর্ব অকর্মণ্য হয়ে পড়ার ভীতি।
দেরি হয়ে যাচ্ছে দেখে খেয়ে নিলুম । মামা-মামি এলেন তিনটেয় । বললেন, ঘণ্টাখানেক যাবৎ তোমাদের বাড়ি খুঁজছি, পাড়ার লোকেরা ঘুরিয়ে মারল, ওখানে লাউডস্পিকারেরশিষ্যরাও বলতে পারেনি, শেষে সিপিএমের কোন মলয়দার বাড়ি পৌঁছে গিয়েছিলাম । পশ্চিমবঙ্গকে মানুষ হিসাবে তুলে ধরে ঝাল মেটালেন । মুম্বাই ছেড়ে এখানে কি করে আছি, সত্যিই আশ্চর্য হলেন । রাজলক্ষ্মী দেবীও বইমেলার সময়ে বলেছিলেন, শিবসেনা সমস্ত মূল্যবোধ নষ্ট করে দেবার পরেও মহারাষ্ট্রের তুলনামূলক শ্রেয়তা আছে । কিন্তু কলকাতাকে, পশ্চিমবঙ্গকে নষ্ট করার জন্য তো আর আমি দায়ি নই । তা সত্ত্বেও কেন অপরাধবোধ হয় ?
কলকাতায় থাকার আলাদা মজা আছে, যা ডাকাতদলের ডাকাত বোঝে, বেশ্যাপাড়ার বেশ্যা বোঝে, লাশ ঘিরে থাকা শকুন বোঝে, বাঁদরের লোমের উকুন বোঝে । বাইরে যারা থাকে তারা বুঝবে না । এখনকার বঙ্গসংস্কৃতি রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর আগের বঙ্গসংস্কৃতি নয় । শঙ্খ ঘোষ অমোঘ বলেছিলেন : পেছন দিকে এগিয়ে যান । অবশ্য যাদের উদ্দেশ্যে বলা, উনি তো তাদেরই লোক । পশ্চিমবঙ্গে এসে অ্যাকাডেমি-বিশ্ববিদ্যালয় তো ওনারাই দখল করেছেন ।
মামা-মামিকে ওনাদের ট্যাক্সিতে লেক গার্ডেন্সে আমার শালী পাপার সঙ্গে দেখা করাতে নিয়ে গেল সলিলা । আমি গেলুম না, একে ক্লান্ত তায় পাপাদের ডোবারম্যানগুলোর সঙ্গে আমার অসদ্ভাব । কুকুরদের সঙ্গে আমার কেন যে সদ্ভাব হয় না, এ এক রহস্য । লাউডস্পিকারে জ্ঞান ছেটানো বজায় আছে । ফলে ন্যাপ নেয়া গেল না । টিভিতে চ্যানেল সারফিং করে খেললুম কিছুটা সময়, হাই তুলতে-তুলতে ।
Note : ১) হোয়াট ইস দি জার্নি, অ্যান অ্যাসেন্ট অর ডিসেন্ট ? ২) উই পুশ আওয়ার ওয়ে থ্রু ভার্বস অ্যান্ড অ্যাডজেকটিভস হুইচ গ্যাদার লাইক অনলুকার্স অ্যাট অ্যান অ্যাকসিডেন্ট । ৩) ইউ ফিল দি বাজিং অব দি ড্রোন হোয়েন ইউ টাচ হার । ইউ ফেল্ট লাইক হেটিং ইওর স্টাবি ক্লামজি হ্যাণ্ডস । দি হ্যাণ্ডস হ্যাভ দেয়ার ওন মিন উইল । ৪) ইচ অব আস হ্যাজ সিন স্ট্রিট টকার্স ডিপ ইন কোয়ার্ল উইথ ইনভিজিবল কমপ্যানিয়ান্স । ৫) প্রফেসিজ ইন লেবেলস, ওমেন্স ইন এমব্লেমস, স্পাইজ ইন লোগোজ, হুইস্পার্স ইন সিগনাল্স, থ্রেটস ইন সাইনস । ৬) রাইটার্স লাই দেয়ার লাইফ টু মেক ইট সুটেবল ফর ফিকশান । দে রিভিজিট সাচ লাইফ টু রিভাইজ দেয়ার ড্রাফট । রিপিট দি সেম ডিফিকাল্ট প্যাসেজ অব এগজিসট্যান্স ইন অর্ডার টু প্লাঞ্জ ফার্দার ইনটু ইট । পেইন্ট এগজিসট্যান্স উইথ দেয়ার ওন স্টেট অব মাইণ্ড । ৭ ) পোয়েট্রি কনফার্মস সামথিং আননোন টু পোয়েটস লাইফ। অ্যান্ড লাইফ কনফার্মস সামথিং আননোন টু হিজ পোয়েমস ।
উর্মিলেশ-এর লেখা ‘বিহার কা সচ – কৃষিসঙ্কট অওর খেতিহর সংঘর্ষ’ বইটা পড়ছিলুম । টেলিফোন বাজল । তুলতে, পুতুলের ওঁয়াউ-ওঁউ কান্না শুনলুম । প্রতিশোধেত্মক টেলিফোন, নিঃসন্দেহে । ‘কী বলার আছে’ জিগ্যেস করায় পৌঢ় কন্ঠে শোনা গেল, ‘এমন মিনমিনে গলা কেন, সেই নায়কোচিত কন্ঠস্বর শুনছি না।’ মেয়ে অনুশ্রীর বাচ্চাটা মারা যাওয়ার ঘোর কাটেনি বলে পুতুলের যান্ত্রিক কান্নায় স্তম্ভিত ছিলুম কিছিক্ষণ । কিন্তু কথা শুনে আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, ‘এমন হিন্দি গালাগাল জানি যে স্ত্রীর পোঁদ থেকে স্বামীর পদবি খসিয়ে দিতে পারি।’ বলে ফেলে, মন খারাপ হয়ে গেল । সলিলা ফিরলে, চেপে গেলুম, নয়তো এখনই ব্লাডপ্রেশার মাপতে দৌড়োবে ।
সন্ধ্যায় নাকতলার শক্তি সংঘের লাইব্রেরি গেলুম । যে-বইই চাই, কেউ না কেউ মেরে দিয়েছে । আমার দেয়া বইগুলোও মেরে দিয়েছে । এরা শুনেছি সিপিএম করে, মানে মসনদে যে দল থাকে, তার প্রতি অনুগত । কিন্তু পাল্প ফিকশান ছাড়া কেনে না । পশ্চিমবঙ্গের সবকটা লাইব্রেরিই পাল্প ফিকশানের গুদাম, কেন না সরোজ বাঁড়ুজ্জেরা ওগুলো পাল্প ফিকশান মনে করেন না । রিডিং রুমে খবরের কাগজগুলোর পাতা ওল্টালুম । নিখিলবাবু বললেন, ‘আজকাল আর আসেন না ? কয়েকটা বই বেরিয়েছে শুনলাম ।’ বললুম, ঋদ্ধ হই না ।
ফেরার সময় একটা সিনজোনা কিনলুম সলিলার জন্যে, গোলকুণ্ডার রুবি স্ট্রং নেই । সুজিত রিকশাঅলাকে কবে থেকে অটো চালাবে, জানতে চাইলে বলল, রিকশার লাইন বেচার ভালো দাম পাচ্ছে না । লাইন কেনা-বেচা হয় জানতুম না । বলল, পার্টিকেও দিতে হয় কেনা-বেচার সময়ে । ফি মাসে চাঁদা, মানে তোলা, দিতে হয় পার্টিকে ; পার্টি মানে যে পার্টির কর্পোরেটর এই তল্লাট থেকে জিতে মালকড়ি কামাবার বরাত পেয়েছে । অনুষ্টুপ-নন্দন-অনীক-গণশক্তিতে যে-সব গপপো বেরোয় তা পড়ে এসব শোষণ প্রক্রিয়ার কিছুই জানতে পারি না । যারা তোলা আদায় করে তারা লেখক হলে যা হয় । সুজিত আমায় ঋদ্ধ করে, আর নাকতলার আলু-রুটির ঠেকের প্রমোদ । ভাতৃমিলন সংঘের মাঠে নাটকমেলার সময়ে এদের দুজনের কাছে অনেক তথ্য পেয়েছি । আগামী উপন্যাসটা এবারে ভাবা আরম্ভ করতে হবে । ‘নামগন্ধ’ উপন্যাসে পশ্চিমবঙ্গকে নায়ক করেছিলুম ।
প্রমোদকে অ্যাকাডেমিতে নাটক দেখাবার প্রতিশ্রুতি পুরো করতে হবে ।
শেতলা মন্দির পেরোতে সুজিতকে বললুম, ‘কপালে হাত ঠেকালে যে ?’ ও বলল, ‘ধুসস।’ কলিম খান সেদিন বলছিলেন, সুকুমারী ভট্টাচার্য ওঁরা একটা পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা বের করছেন, বিষয় ‘ঈশ্বর আছে না নেই ‘। পশ্চিমবঙ্গের মাটিপৃথিবী থেকে বিদ্যায়তনিক ভাবুকরা বিচ্ছিন্ন । কিন্তু কেন ? বাইনারি বৈপরীত্যের বাইরে তো সুজিতে গাট ফিলিং পৌঁছে গেছে ।
ভাড়া মেটাবার সময় সুজিত বলল, ‘আপনি অন্তত দুটো-চারটে কথা বলেন, অনেক প্যাসেঞ্জার নিজের হাত-টেলিফোনের সঙ্গে বকবক করে । অন্য লোকের সঙ্গে সামনাসামনি কথা বলার দিন ফুরিয়ে এল।’
লেটারবক্সে একটাই পোস্টকার্ড । হলদিয়া থেকে তপনকুমার মাইতি লিখেছেন, ‘হাংরি জেনারেশান পত্রিকাটা কি আবার বের করা যায় না ? অন্য ভাবে একটু চিন্তা করে ? অমরেন্দ্র গণাই, আপনার, আমার চিন্তার মিল আছে । সুনীল তো ‘কৃত্তিবাস’ আবার বের করল ।’ দেয়ার আর টু এক্সট্রিম ইউজেস অব লিটারেচার : পোটেন্ট অ্যাণ্ড লিথল । প্রথমটা ছিল কৃত্তিবাসের, দ্বতীয়টা হাংরির ।
পাখিটা বলল, ‘আমার বাসা কী দিয়ে তৈরি দেখে যান ।’
সিনজানোর সঙ্গে রয়াল স্ট্যাগ মিশিয়ে বসেছিলুম । সুবিমল বসাকের টেলিফোন, বলল, রাহুল পুরকায়স্হ আর চিরঞ্জীব শূরকে নিয়ে শনিবার আসবে, দু-বোতল বাকার্ড আর বোনলেস কিনে রাখতে । যেটুকু পাবার তা আমার থেকে কমবয়সিদের থেকেই ।
‘যুক্তাক্ষর’-এ প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রবন্ধ ‘আত্মপরিচয়ের দ্বান্দ্বিকতা ও আগামী রণাঙ্গন’ বাকি অংশটা পড়া শেষ করলুম । অসাধারণ প্রবন্ধ । কিন্তু উদ্বাস্তুবাদী দ্বিধা কাটাতে পারেননি ।
লোডশেডিং । বাইরে তাকালুম । সেলেকটিভ অন্ধকার ।
মোমবাতি জ্বালে ডিনার ।
শ্রীধর ‘অনার্য সাহিত্য’ পত্রিকার জন্যে গল্প চেয়েছে । বসি লিখতে ।
শেষ হাসি
‘হালায় আমাগো পইসচিম বঙে আইসা…’
কথাটা বাক্যে প্রকাশ অপ্রয়োজনীয় মনে করে, ডান পায়ের বুট জুতো, আজকে সকালেই পালিশ-করা, পায়ের গোছে যত শক্তি জড়ো করা যায়, কড়িকাঠ থেকে উল্টো করে ল্যাংটো ঝোলানো, সাঁইত্রিশ বছর বয়সি হাড়গিলে চটকল শ্রমিক কাংগাল চামারের বিচির ওপর হাঁকড়ালেন কন্সটেবল পতিতপাবন পোড়েল । পায়ের জুতো দিয়ে, সরকারি জুতো দিয়ে, অভিব্যক্ত হল বাকি কথাগুলো । অত্যন্ত বিরক্ত হলেন পতিতপাবন পোড়েল, কালো, বেঁটে, মোটা, টাকমাথা । কাংগাল চামারের লিঙ্গে, কাল রাত থেকে, তখন তিরিশে অক্টোবরের রাত এগারোটা ছিল, আজকের একত্রিশে অক্টোবরের রাত্তির একটা পর্যন্ত, এই দু-ঘণ্টায়, নাইলনের হলুদ দড়ি বাঁধা শ্রমিকটার ওপর সরকারি দায়িত্ব পালন করার বাধ্যবাধকতায়, তেরোবার লাথাবার দরুণ, রক্ত আর বীর্যে জুতোটা নোংরা হয়ে গেলে, ঘরের কোনে ফেলে রাখা গামছাটা দিয়ে প্রতিবার পুঁছেচেন । আর রক্তবীর্যের ক্রিমপালিশে, বাঁ-পায়ের তুলনায়, ডান পায়ের জুতোটার মুখ ঝিকমিক করছে ।
কাংগাল চামার, হাত দুটো পিছমোড়া করে বাঁধা, লাথির ধাক্কায় স্যাঁতসেতে দেয়ালে তাঁর মাথা সশব্দে ঠুকে গেলেও, ঠোঁটের হাসিটি বজায় রেখেছিলেন বলেই হয়তো, ক্রুদ্ধ করে তুলছিলেন তাঁকে ঘিরে থাকা ডাকবাবু বুপিন নামহাটা, কন্সটেবল পবিত্র সরখেল, এ এস আই তারক জানা, এস আই পরমেশ্বর দত্ত, এস ডি পি ও সঞ্জয় কুমার, অ্যাডিশানাল পুলিশ সুপার জংবাহাদুর সিং প্রমুখ আধিকারিকদের ।
‘বাঞ্চোৎ দ্যাখাইতাসি তর হাসি…।’
এস আই পরমেশ্বর দত্ত, বাঁ হাত দিয়ে কাংগাল চামারের শিড়িংগে ঠ্যাংটা ধরে, দোল খাওয়া থামিয়ে, ডান থাতের ব্যাটনখানা এক ঝটকায় প্রায় ছয় ইঞ্চি ঢুকিয়ে দ্যান চটশ্রমিকটির পোঁদে, টেনে বের করেন এবং আবার ঢুকিয়ে দ্যান এবং বের করেন । কাংগাল চামারের ঝুলন্ত শরীরটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে ব্যাটনটা তার মুখের ঘহ্বরে চালান করেন ।
‘হাঃ হাঃ, এরেই কয় জোরকা ঝটকা ধিরে সে লাগে’, পরমেশ্বরবাবুর আত্মতৃপ্ত উক্তিতে উপস্হিত ঊর্ধতন আধিকারিকের হোয়াঃ হোয়াঃ হোয়াঃ হাসিখানি, খাকি ভুঁড়ি দুলিয়ে শেষ হলে, অধস্তনরা হাসবার অনুমতি পায় । মুখের মধ্যে, ব্যাটনসুদ্দু নিজের নিঃশব্দ হাসি বজায় রাখেন কাংগাল চামার । শ্রমিকের সহ্যশক্তি অপরিসীম । সরকার শ্রমিকদরদি হলে সহ্যশক্তির কুলকিনারা থাকে না ।
‘মাদারচোদকা বাচ্চা পচছিম বাংগালে এসচে তো ভাবচে বরাব্রি করচে আমাদের রাজপুতদের সঙ্গে’, বললেন জংবাহাদুর সিং, ‘রাজপুতকে উপর হাত উঠায় ।’ তারপর, ডাকবাবু বিপিন নামহাটাকে তিরস্কার করলেন, ‘আভি তক পে সিলিপ মহাজন থিকে এনক্যাশ করাও নি ? এখানে খড়ে-খড়ে কী মু তাকচো ? যাও, নিজের কাজ করো ।’ হুকুম দিয়ে থানার সিঁড়ি ভেঙে জিপে উঠতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু ফিরে এসে কাংগাল চামারের মুখ থেকে ব্যাটনখানা টেনে, ‘ই তো আমার আছে, মাই লাকি ম্যাসকট’, তারপর দ্রুতি বজায় রেখে বসলেন গিয়ে জিপে । তেলে ভেজাল দেয়া ধোঁয়া তুলে চলে গেলেন ঊর্ধতন আধিকারিক ।
কাংগাল চামার তবুও হাসি বজায় রেখেছেন । রুলের বাড়ি খেয়ে-খেয়ে তাঁর পায়ের তলা, খালি পায়ে জীবনের অধিকাংশ সময় কাটাবার দরুণ, নীল হতে সময় লেগেছিল । তবে তাঁর পাঁজরের অপলকা হাড়, ডানদিকের তিনটে আর বাঁদিকের একটা, তাঁকে ধরে এনে যখন সর্বজনীনভাবেভ পেটানো হচ্ছে, বেদম, বরফের জলে ভেজানো কম্বলে দেহ মোড়া থাকা সত্ত্বেও, পেতল-মোড়া সোঁটার আঘাতে, ভেঙে গিয়েছিল প্রথম দু-মিনিটেই । বাঁ দিকের হাড়টা ভেঙে বেরিয়ে এসেছে চামড়া ভেদ করে, গোলাপি-শাদা মেশানো ।
‘হালায় আমাগো পইসচিম…’
‘আরে কী তখন থেকে পশ্চিমবঙ্গ-পশ্চিমবঙ্গ করছেন’, বলে ওঠেন তারক জানা, এ এস আই, যাঁর ভাতখোর ভুঁড়ির নিচে নেমে-যাওয়া বেল্ট তাঁকে আই পি এস সুলভ চর্বিতে খোলতাই দিয়েছে, ‘কুত্তির বাচ্চাটার মুচি ঠাকুদ্দা এসেছিল সায়েবদের জুতো পালিশ করতে, তখন পশ্চিমবঙ্গ ছিল না’। এই কথাগুলো পতিতপাবন পোড়েলের দিকে তাকিয়ে বললেন তিনি । কাংগাল চামারের দিকে তাকিয়ে, পতিতপাবন পোড়েলের উদ্দেশে তিনি বললেন, যদিও উচ্চারণ করলেন না, ‘বাঞ্চোৎ তোর দাদু তখন বগুড়ার পুকুরে পাটকাঠি চুবিয়ে পাটের এঁশো বের করত।’
যা বলা হল না তা শুনতে না পারায়, যা বলা হল তা শুনে, কিছুটা চিন্তিত হলেন পতিতপাবন পোড়েল । কাংগাল চামারের মুচিদাদুর পালিশকরা বিলিতি সায়েবের পায়ে ঝকঝকে কালো জুতোজোড়া ভেসে ওঠে ওনার কল্পনা-প্রকল্পে, এবঢ নিজের ডান পায়ের জুতো বাঁ পায়ের জুতোর চেয়ে অধিকতর ঝকঝকে হহোয়ায়, তাঁর খেয়াল হল যে, পাথরপ্রতিমা স্কুলকে, তিনি ক্লাস নাইনে পড়ার সময়ে, বাঁ পায়ে মারা গোলে এক-শূন্যতে হারিয়েছিলেন । বাঁ পা দিয়ে একটি লাথি হাঁকড়ালেন কাংগাল চামারের বিচিতে । উৎফুল্ল হলেন জুতোয় যথোচিত ক্রিম লেগেছে দেখে । কাংগাল চামারের গামছা দিয়ে বাঁ পায়ের জুতোটা কয়েকবার ঘষতে, আলোকিত হয়ে উঠল জুতোর এবং পতিতপাবন পোড়েলের মুখ ।
কাংগাল চামার তবুও হাসিটি বজায় রাখলেন । কষ্ট ও যন্ত্রণার সামান্যতম অভিব্যক্তি প্রকাশ করলেন না । না বাংলায়, না হিন্দিতে, না ভোজপুরিতে, না চটকল শ্রমিকের জারজ বাংলা বুলিতে । কাংগাল চামারের দাদু ভুখমারন চামার যখন ১৮৯৭ সনে এসেছিলেন এ তল্লাটে, তখন ভোজপুরি বলতেন । তাঁর বাবা দুখিচাঁদ চামার বলতেন দোআঁসলা । কাংগাল চামার বাংলায় কথা বলতেন । নিজের যন্ত্রণা কোনো ভাষায় প্রকাশ না করে তিনি নিঁশব্দে হাসছেন ভাষাহীন ঝুলন্ত হাসি ।
তখনও কেউ ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’ আওয়াজ না দিলেও, মুচিগিরির জন্যে নয়, ভুখমারন চামার এসেছিলেন এলিজাবেথ জুট মিলে কাজ করার জন্যে । বাংগাল-এর লোকেরা কল-মিলে কাজ করতে চায় না বলে বিলাইতি দাল্লাল হরিরাম পরসাদ তাঁদের গাঁয়ে গিয়ে কলকাত্তা যাবার লোভ দেখালে, তাঁদের সীতামড়হি জেলার হিদায়েতপুরের হরিজন বস্তির সব মরদ হরিরামের সঙ্গে চলে এসেছিলেন । ব্যাইরাক-বস্তিতে চুলহা-চাক্কির জায়গা নিশ্চিত হলে, যে যার মেহরারু আর বাচা-বুতরুদের এনে, থেকে গিয়েছিলেন এই হুগলি জেলায় । গ্রামের রাজপুত-ভূমিহার বাবু সাহেবরা যখন ইচ্ছে ওদের বোউ, বোন, মেয়েকে দাবি করলে পাঠিয়ে দিতে হত বলে, বিশেষ কেউ আর ফেরেননি গ্রামে । ভুখমারন চামার কখনো এলিজাবেথ জুট মিলের মালিক টমাস ডাফকে দেখেননি, তবে শুনেছেন যে মালিকের নাম কম্পনি বাহাদুর । তাঁর নাতির,বর্তমান আসল মালিক, রেজিনাল্ড জন ব্রেইলিও কম্পনি বাহাদুর, এবং সেকারণে গর্ববোধ ছিল কাংগাল চামারের । ব্রেইলির কোনো নির্দিষ্ট স্বদেশ নেই ।
বিদেশ থেকে যেসব সায়েব-মেম পয়সাকড়ি কামিয়ে নেটিভদের মগজে মনীষী আর বিলেতের পার্লামেন্টে লর্ড হবার স্বপ্নে কলকাতা বন্দরে নেমেছিলেন, তাঁদের একজন টমাস ডাফ, যিনি চারটে চটকল পত্তন করেছিলেন, তার মধ্যে ব্রিটেনের রানির নামে এলিজাবেথ জুটমিল সবচে বড়ো । তখন, এখনকার মতন, পাটখেতে চায়ের নার্সারি করার রেওয়াজ হয়নি । পাটখেতে পাট, ধানখেতে ধান, আলুখেতে আলু হত । বারো হাজার মজুরের সবাই ছিল কুলি । ক্যাজুয়াল, বদলি, স্পেশাল বদলি, স্হায়ী, জিরো নম্বর এমনতর শ্রেণিবিভাগ ছিল না । কেননা তখনও বিলাইত থেকে শ্রেণিতত্ত্ব আসেনি । তখনও বাংগালিবাবুরা চটকলগুলোয় লিড্রি করতে আসেননি । তখন তো চটকলে শ্রম যার, নেতৃত্ব তার ছিল । ঠিক যেমন লাঙল যার জমি তার । এখন আর নেতা হবার জন্যে শ্রমিক হবার দরকার হয় না । লড়াকু বাংগালিবাবু হতে হবে, লড়াকু, কথায়-কথায় লড়বে, বাতলে দেবে কারা কারা শত্রু । তখন শত্রু বলে ছিল না কিছু ।
‘হ্যাঃ হ্যাঃ, কাগজে আবার লিকেচে মুখ্যমন্ত্রী বলেচেন, মালিকরা চটশিল্পে জঙ্গলের রাজত্ব কায়েম করেচে ।’ কাংগাল চামারকে পাঁচ ঘণ্টা আগে ফুসলিয়ে ধরে আনার পর এই প্রথম কথা বললেন ডাকবাবু বিপিন নামহাটা ।
‘উস জঙ্গল মেঁ তুম সালে হো জংলি খুংখার কুত্তা ।’ বিপিন নামহাটা হেঁঃ-হেঁঃ হেসে অনুমোদন করলেন এস ডি পি ও সঞ্জয় কুমারের দেয়া পদ্মশ্রী ।
‘আর হামলোগ কেয়া হায় শ্যার ?’ আবদার জানান কন্সটেবল পবিত্র সরখেল ।
‘তুম লোগ হো চুতিয়া । সালে সব কোই কাম ঢংসে নহিঁ কর সকতে ।’
‘কেন স্যার ?’
‘আরে ইস গাণ্ডু কাংগাল চামারকে ঘরকে সামনে ওয়হ সালা রাজপুত সিপাহি মরা পড়া থা তো অপনে কো বাল উখাড়নে কা কেয়া জরিরত ?”
‘সাহেব তো বলেছিল যার ঘরের সামনে লাশ পড়েছিল তাকে তুলে আন ।’ জানান বিপিন নামহাটা ।
‘কাউকে তো একটা আনতেই হত’, এস আই পরমেশ্বর দত্ত অধস্তনদের আড়াল দেবার চেষ্টা করেন ।
‘হাট্টা-কাট্টা লানা চাহিয়ে থা ।’
‘হাট্টা-কাট্টা মজুরের দিন আর নেই স্যার । তাই তো এদের আমরা বলি শ্রমিক । যেমন বেশ্যাগুলোকে বলি যৌনকর্মী ।’
‘হ্যাহ্যা।’
‘এবার তাহলে কী করতে হবে স্যার ?’
‘মুঝে নহিঁ মালুম । নামহাট্টা সে পুছো । য়হি সালা চামচাগিরি করতা হ্যায় জংবাহাদুর সাহবকা ।’
বিপিন নামহাটা বাড়ি থেকে ডেকে এনেছিলেন কাংগাল চামারকে । যে-গামছা পরে কাংগাল চামার ঘুমোচ্ছিলেন, তা পালটাতে দেয়া হয়নি । অর্থাৎ একবস্ত্রে ফাঁড়িতে । বস্ত্রখানা এখন অন্য কাজে নিয়োজিত । এলিজাবেথ জুট মিলের ফিনিশিং ডিপার্টমেন্টের মজুর, মানে শ্রমিক, রাত্তিরে সেদিন তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরেছিলেন, তিরিশ তারিখে, মাইনে পেয়ে । সব মজুররা, মানে শ্রমিকরা, মাইনে পাননি, তাই পে-স্লিপের বদলে তাঁরা টাকা পাননি । পে-স্লিপ ভাঙানো যায়নি, কেননা এলিজাবেথ চটকল কোম্পানির ব্যাঙ্ক অ্যাকাউণ্ট থেকে টাকা তোলা যায়নি, অ্যাকাউন্টে টাকা ছিল না বলে । চেক ফেরত এসেছিল । মাঝে-মাঝে হয় এরকম । তা নতুন কিছু নয় । সব চটকলেই হয় ।
মহাজনরা, অনেক ইউনিয়ান নেতা মহাজনি করেন আজকাল, তাঁরা, সস্তায় কিনে রাখেন পে-স্লিপগুলো, আর মিলের ক্যাশে টাকা এলে থোক ভাঙান । মজুররা, মানে শ্রমিকরা, পে-স্লিপ বেচে দিয়ে নিশ্চিন্ত । কে জানে পরে আবার ভাঙানো যাবে কি না । মহাজনদের হয়ে পে-স্লিপ সংগ্রহের কাজ বিপিন নামহাটার । কুলি ব্যারাকের, মানে শ্রমিক আবাসের, তাই সবাইকে চেনেন উনি । জানেন কে কোন ইউনিয়ানের সদস্য । রেস্ত থাকলে ওনারা, মানে শ্রমিকরা, সবকটার সদস্য হয়ে যেতেন । বেশির ভাগ মজুররা, মানে শ্রমিকরা, কোনো ইউনিয়ানের নন । আঠারোটা ইউনিয়ানের বারোশো মোটে সদস্য । বিপিন নামহাটা জানতেন যে শালা খোট্টার বাচ্চা কাংগাল চামারটা সদস্য নয় কোনো ইউনিয়ানের । চটকল-ফটকল আর বেশিদিন চলবে না ভেবে অনেকেই সদস্য হন না, বিশেষ করে খোট্টাগুলো । চল্লিশটা চটকল প্রভিডেন্ট ফাণ্ডের টাকা জমা দেয়নি । ছাপ্পান্নটা জমা দেয়নি ই এস আইয়ের টাকা । সেসব কোটি-কোটি টাকা । সোনালি তন্তু না শালা শিবঠাকুরের বাল ।
‘এই কাঙাল, তোকে সায়েব ডেকে পাঠিয়েছে’, বলতেই সাইকেল চালিয়ে চলে এসেছেন কাংগাল চামার । কোন সায়েব, কোথায়, কেন, এসব প্রশ্নও তোলেন না শালারা । রাস্তায় এসে পড়তেই, থাপ্পড় মারতে-মারতে, সাইকেলটা নর্দমায় ঠেলে দিয়ে, জিপগাড়িতে তোলা হয়েছিল । তারপর চলন্ত গাড়িতেই সবাই মিলে দেম্মার দেম্মার । তেমন হাঁউ-মাউ করেননি কাংগাল । একাধটা শ্রমিক হন তিলে খচ্চর । কেঁদে-চেঁচিয়ে লোক জড়ো করার তালে থাকেন । গেল বার সাব্বির মণ্ডল করেছিলেন । শালার হাতের সবকটা নখ উপড়ে নিতে চুপ মেরেছিলেন । সামান্য প্যাঁদানি খেলে বাঞ্চোৎরা চেঁচামেচি করেন । সহ্যশক্তির বাইরে নিয়ে যাও তো একদম চুপ মেরে যাবেন । এই তো, চামারবাবু কেমন ঝুলতে-ঝুলতে হাসছেন ।
‘সায়েব তো নিজের ডাণ্ডা হাতে নাচতে-নাচতে চলে গেলেন আহ্লাদে আটখানা হয়ে, এখন এটাকে হাসপাতালে পাঠাতে হবে তো,’ প্রস্তাব করেন পোড়েল ।
‘যা, জিপ নিয়ে যা, আর খগেন ডাক্তারকে নিয়ে আয় সঙ্গে, ও এসব ঝক্কি সামলাতে ওস্তাদ । সুদে টাকা খাটায় তো কুলিগুলোর মাথায় হাত বুলিয়ে ।’
মিলের লকআউটের দিন থেকে ডাক্তার তো কলকাতায়’।
‘কেন ? লকআউট তো মে মাসে উঠে গিয়েছিল ।’
‘গেলেই বা । মজুররা বকেয়া পাচ্ছে তো এখন । আসবে ঠিক সময়ে গন্ধ পেয়ে ।’
শ্রম কমিশনারকে বসিয়ে তাঁর সামনে আঠারোটা ইউনিয়ানের সঙ্গে চটকল কর্তৃপক্ষ একটা চুক্তি করেছিলেন মে মাসে । অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে বকেয়া মাইনের অর্ধেক দেয়া হয়েছিল শ্রমিকদের । দ্বিতীয় হপ্তায় দুশো করেনিকে পুরো, পঁচাত্তরজন দারোয়ান আর ছশো দক্ষ শ্রমিককে দেয়া হয়েছিল অর্ধেক মাইনে । চুক্তি অনুযায়ী তৃতীয় হপ্তায় বাকি মাইনেটা পাবার কথা ছিল সবায়ের । কিন্তু যেদিন তা দেবার কথা, সেদিন দেয়া হয়নি পে-স্লিপ । শ্রমিকরা মিলের জেনারাল ম্যানেজার রুস্তমজির কোয়ার্টারে চড়াও হতে উনি বললেন, ‘চেক ভাঙানো যায়নি, পরশু যাবে ।’
পে-স্লিপ পেয়ে, ভাঙাতে গিয়ে, মজুররা, মানে শ্রমিকরা, জানতে পারলেন টাকা আসেনি, কিন্তু দেখতে পেলেন যে সশস্ত্র পুলিশ ঘিরে রেখেছে অফিস-বাড়ি ।
‘পুলিশ কেন ?’ জানতে চাইলেন সোমবারি মাহাতো, ‘মাইনের বদলে পুলিশ ?’
জবাবে ইউনিয়ান নেতা জানালেন, ‘যাতে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা না বাধে ।’
‘কিন্তু আর কোনো নেতাকে দেখতে পাচ্ছি না আমরা ! তাঁরা কোথায় গেলেন ?’
‘কলকাতার অফিসে মালিকপক্ষের সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছেন ।’
‘এখন আবার কিসের আলোচনা ?’
‘আরে এরাই গদ্দারি করছে ।’
‘তলে-তলে ষড় ।’
‘লুট রহা হ্যায় মাদারচোদ লিডার সব ।’
‘মারো সালোঁকো ।’
‘চল দেখি ইউনিয়ান অফিসে কে বাঞ্চোৎ বাল ওপড়াচ্ছে ।’
আড়ং ধোলাই । দে ছুট । পড়ি কি মরি ।
আঠারোজন ইউনিয়ান নেতার অভিযোগে সাতজন শ্রমিক গ্রেপ্তার ।
ডি এস পি : ‘আমাদের বলে কী হবে ? ইউনিয়ান নেতাদের কাছে যাও ।’
‘ইউনিয়ান অফিসগুলোয় তালা । সব লিডার পালিয়েছে ।’
‘আগুন লাগিয়ে দে ।’
‘ভেঙে ফ্যাল দরোজা । যা আছে আগুন লাগিয়ে দে ।’
‘খুঁটি থেকে উপড়ে ফ্যাল ।’
ডি এস পি : ‘আপনারা সংযত হোন । এ অঞ্চল থেকে চলে যান । নয়তো আমরা গুলি চালাতে বাধ্য হবো । আপনারা উপদ্রব করবেন না । শান্তি রক্ষা করুন । নয়তো পুলিশ গুলি চালাতে বাধ্য হবে ।’
‘ফায়ার।’
‘আরে । শালারা গুলি চালাচ্ছে ।’
‘গির গিয়া । সাউজিকো গোলি লগা ।’
মার বাঞ্চোৎ সিপাইগুনোকে ।’
‘মার মাদারচোদ ইউনিয়ান লিডার মালিকের খোচোরগুলোকে ।’
‘দুনিয়ার মজদুর এক হও ।’
‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ ।’
‘মারো ।’
‘মাআআআআআরোওওওওওওওও……’
‘ইসহাক খানের গুলি লেগেছে ।’
‘মারো শালাদের ।’
বিশাল জনসমুদায়ের তাড়া খেয়ে, খাকি উর্দি আর বন্দুক সত্ত্বেও, পালাতে থাকেন সরকার বাহাদুরের প্রতিনিধি নগণ্য কয়েকটা সেপাই । জনতার হাতে ধরা পড়লে কী গতি হবে তা তাঁদের জানা । ছিটকে যে যেদিকে পারেন দৌড়োন । পেছনে নিরস্ত্র জনতা । ক্ষমতার উৎস থ্রি নট থ্রি রাইফেল হাতে দৌড়োন । পেছনে অসংখ্যা ছুটন্ত মানুষ । দৌড়োন । পেছনে অগুন্তি শ্রমিক । দৌড়োতে থাকেন হাঁসফাঁস । পেছনে ক্যাজুয়াল, বদলি, স্পেশাল বদলি, স্হায়ী, জিরো নম্বর জনসমুদায়, ঘামে চটের চটচটে গন্ধ । কোথা থেকে ঢুকে কোথা দিয়ে বেরোতে হবে জানানেই কনসটেবলগুলোর, নাদাপেটা ভুঁড়ির ওজনে ধরে রাখতে পারছেন না গতি । পেছনে রোগা, হাড়গিলে, ডিগডিগে, ছেঁড়া জামাকাপড়, মাইনেহীন আধপেটা শ্রমিকদের গতি বাড়তে থাকে । শ্রমিকদরদি সরকারের সিপাই দৌড়োন । পেছনে মজুরের দল । দৌড়োন । পেছনে মজুরেরা । দৌড়োন । পেছনে শ্রমিকেরা । দৌড়োন সরকার বাহাদুর । পেছনে জনগণ । দৌড়োন, দৌড়োন, দৌড়োন, দৌড়োন, দৌড়োন, দৌড়োন, দৌড়োন, দৌড়োন, দৌড়োন, কুলি ব্যারাকের এগলি-ওগলি, শ্রমিক বস্তির ঘিঞ্জি ভুলভুলাইয়ায় । একজনকে ধরে ফ্যালেন জনগণ । শ্রমিকদরদি সরকারের প্রতিনিধিকে ধরে ফ্যালেন জনগণ ।
‘মার শালাকে…’
‘প্যাঁদা ধরে…’
‘রামধুলাই….’
‘হাম কুছ নহিঁ কিয়া । হাম গোলি নহিঁ চলায়া । হামকো ছোড় দো । অঁক । হামকো জানে দো ।
‘শালা গোলি নহিঁ চলায়া ? পোঁদের চামড়া তুলে নেব । ব্রেইলির কুত্তা ।’
‘সে ব্যাটা বিলেতে পাইলেচে ।’
১৯৮৮ সালে রেজিনাল্ড জন ব্রেইলি এলিজাবেথ জুটমিলের দশ লক্ষ শেয়ার কিনে কোম্পানির ছাপ্পান্ন ভাগ মালিকানা পেয়েছিলেন । তার আগে মিলটা চালাতেন মালহোত্রা, ব্রেইলির কাছ থেকে চটকলটা ভাড়া নিয়ে । মিলটাকে ছিবড়ে করে, ইউনিয়ানের নেতাদের খোরপোষ দিয়ে, কাঁচা পাট পাওয়া যাচ্ছে না অজুহাতে, লক-আউট করে দিয়েছিলেন তিনি ।
এলিজাবেথ মিল ছাড়া আর কোথাও যাবার ছিল না কাংগাল চামারের । দাদুর গ্রামে আর কিছুই ওঁদের নেই যে খেতিহর কিসানের মজদুরি করতে যাবেন । আগে রাজপুত-ভূমিহাররা ওঁদের বোউ-বোন-মেয়েকে তুলে নিয়ে যেতেন । এখন যাদব কুর্মিরা নিয়ে যান । আগে ছিল কাংরেস । এখন কাংরেসের নাম সস্তা, জন্তা, রাষ্ট্রিয় জন্তা ইতয়াদি । এলিজাবেথ মিলের কুলি ব্যারাকে ওঁর দাদু এসেছিলেন, এই ঘরেই, বাবাও ছিলেন, এই ঘরেই, ওঁর যে ছেলে হবে মাসখানেক পরে, তিনিও থাকবেন, এই ঘরেই । ছেলের পদবি চামার রাখবেন না উনি । ওঁর দাদু ছিলেন কুলি । ওঁর বাবা ছিলেন মজুর । উনি এখন শ্রমিক । কতবার তো লকআউট হয়েছে, কিন্তু উনি কোথাও যাননি । ওঁর মা আর বোউ তো বাংগালিবাবুদের বাড়িতে চৌকাবর্তন-ঝাড়ুপোছা করে চালিয়ে দ্যান ওই সময়টায় । ডাফ,ম মালহোত্রা, ব্রৈইলিরা আসেন আর যান । চটকলটা তো থাকে, হোক না ভাড়ার চটকল । ভাড়াটেদের স্বার্থ, দেশভাগের পরে, সবার উপরে ।
বিদেশি মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইনে ১৯৯০ সালে ধরা পড়েছিলেন রেজিনাল্ড জন ব্রেইলি, অনেক টাকার ঘাপলা করেছিলেন বলে । হাইকোর্টের বিচারপতির বাড়িতে মাঝরাত্তিরে কোর্ট বসিয়ে, আংরেজিতে সওয়াল-জবাব করে, সাম্যবাদী আইনজীবী ছাড়িয়ে এনেছিলেন ব্রেইলিকে । টিটাগড় গ্রুপের চটকলের চেয়ারম্যান ব্রেইলি । বেচারা । এলিজাবেথ জুট মিলে ঘাপলা করে আট কোটি টাকা হাপিস করে আর দু-কোটি টাকার স্হাবর সম্পত্তি বেচে ব্রেইলি হাওয়া । শ্রমিকদের পি এফ আর ই এস আই টাকা মেরে দিয়ে হাওয়া । বাংগালি শ্রমিকদরদি মন্ত্রীদের সঙ্গে ঘনঘোর মেলমিলাপ ছিল বিলাইতি সায়েবের ।
বিলেতেই, স্কটল্যাণ্ডে, ১৮৮৫ সালে, এলিজাবেথ জুট মিলের রেজিস্ট্রি করিয়েছিলেন টমাস ডাফ । তারপর তো সাতচল্লিশ সালে স্বাধীন হয়ে গেল দেশটা । স্বাধীনতা নিয়ে কাটাকাটি-মারামারি হল । চটকল রইল এই পারে, পাটচাষ গেল ওই পারে । এলিজাবেথ জুট মিলের হিন্দু ব্যারাকে আর মুসলমান ব্যারাকে এখনও সেই মুলতুবি মারামারি-কাটাকাটিটা চালু হয়ে যায় মাঝে-মধ্যে । হাতিয়ারবন্দ পুলিশ তাই কাছেপিঠে থাকে, যতদিন না আবার লাগছে ততদিন বসে-বসে হাই তোলে, খইনি ডলে । স্বাধীনতা পেয়ে, ১৯৫৬ সালে, কোম্পানি আইন পাস করে দিলেন জবাহিরলাল । কোনো বিলাইতি কোম্পানি, সেই আইন অনুযায়ী, এদেশে ব্যবসা করতে চাইলে, শতকরা উনপঞ্চাশ ভাগের বেশি শেয়ারের মালিক হতে পারবে না । ব্যাস । গির্ধারিলাল মালহোত্রা, যে লোকটা মিলটাকে পাট যোগাতেন, যাঁর পূর্বপুরুষ সিরাজউদ্দৌলার পোঁদে বাঁশ করার জন্যে মীরজাফর আর কোম্পানি বাহাদুরকে টাকা যুগিয়েছিলেন, টমাস ডাফের চৌত্রিশভাগ শেয়ার সস্তায় হাতিয়ে নিলেন এই তালে । জবাহিরলাল আগেই খবর করে দিয়েছিলেন দিকে-দিকে, বিল পাস হচ্ছে, তৈরি থাকো, হড়পে নাও । মালহোত্রদের সঙ্গে গলগোটিয়ারাও নিলেন খানিক । বাজোরিয়া, নিসানি, সারদা, পাসারি, জৈনও নিলেন কয়েক খাবলা । বাংগালিরা ভয়ে কিছুই নিতেন না তখন, মালকড়ি থাকলেও । রিফিউজিরা হু-হু করে আসছিলেন আর পোঁদে বাঁশ করে দিচ্ছিলেন বাংগালিদের ব্যবসা আর কল-মিল-কারখানায় । সেই থেকে বাংগালিরা ব্যবসা থেকে ভাগলবা, লিখাপড়হি-গানা-বাজানা-নাচ-নৌটাঙ্কি নিয়ে থাকেন ।
চটকলগুলোয় মরচের মতন ঢুকে গেলেন মালহোত্রারা, গলগোটিয়ারা । লোক লাগিয়ে ঠেঙিয়ে দিতেন জুট কর্পোরেশানের সংগ্রহকারী কর্মীদের । অসুখে পড়ে গেল জুট কর্পোরেশান । কর্মীরাও মালহোত্রা-গলগোটিয়াদের বখশিশে খুশি । কে শালা চট সংগ্রহের ধান্দায় জান দেবে । চাষিরা আর কী করবে, পাট বেচতেই হবে মালহোত্রাদের ছড়ানো দালালবাহিনীর কাছে । ওঁরা যে দামে কিনতে চাইবেন, সেই দামেই বেচতে হবে । পাটকাঠি তো আর বাড়িতে রেখে খাওয়া যায় না । কচি-কচি পাটচারার ডগা ফুটিয়ে খেয়ে থাকা যায় ক’দিন । শুকিয়ে গেলেই সেসব পাটকাঠি চাষার পিঠে পড়ে । কাঠি থেকে পাট বের করায় কত হ্যাঙ্গাম । কাঁচাপাটের বাজারে এখন অনেক গোলমাল । কেউ বেশিদিন জুট সাপলায়ার থাকতে চান না । তার ওপর জুট সাপলায়ারদের কাছ থেকে ইউনিয়ানগুলোর নেতারা ভাগা খান । ইউনিয়ানের নেতারা সাপলায়ার নিয়ে গোঁ ধরে থাকলে মালিকের সঙ্গে ঠোকাঠুকি । চটকলগুলোর লাশ ছিঁড়ে-ছিঁড়ে খেয়ে ফেলার এই সুযোগ । আর কাঁচা পাটই হয় না অত, তো চটকলগুলো না-খেতে পেয়ে মরবেই । মরা হাতি বলে কথা । দাঁত পেতে হলে মারতেই হবে ।
পশ্চিমবঙ্গের সব চটকলগুলো চালু থাকলে এক কোটি বেল কাঁচা পাট দরকার । এক বেল মানে একশো আশি কিলো । সত্তর-আশি লক্ষ বেলের বেশি পাট হয় না । পুকুর আর ডোবাগুলো এত পচে থাকে যে ভাল জাতের কাঠি থেকে পাটকে সোনালি করা যায় না, পেঁকো রঙ হয়ে যায় তাদের । যেটুকু বা পরিষ্কার ডোবায় সোনালি হবার সুযোগ পায়, সব বিদেশে পাচার কিংবা চালানিতে সাফ । মিলমালিক নিজে জুট সাপলায়ার হলে মিলকে সাপলাই না দিয়ে বিদেশে সাপলাই করে দ্যান । ধান আর তেলবীজ রুইলে তবু সমবায় সমিতি কিংবা গ্রামীণ ব্যাঙ্কের দাদন পাওয়া যায় । পাট রুয়ে কোনো সাহায্য পান না চল্লিশ লাখ চাষি । মহাজনের কাছ থেকে ধারদেনা করে পাটচাষ । মহাজন মানে কাঁচা পাট কেনার দালাল । পাটচাষে লোকসান । পাঁচ লাখ হেক্টর জমি অন্য চাষের কবলে চলে যাওয়ায়, কুড়িলাখ পাটচাষী খেতমজুর ছিতরে গেছেন । যেসব কাজহীণ পাটচাষি দালালদের ধরেকয়ে বদলি হিসেবে কাজ করতে আসেন, তাঁদের কাছ থেকে অনেককিছু জেনেছিলেন কাংগাল চামার, তাঁদের দুখদারি ।
পাট চাষ হোক, মিলে কাঁচা পাট আসুক, মিল পুরোদমে চলুক, মিলের মাল বিক্রি হোক, সবাই নিয়মমত মাইনে পাক, এইটুকুই কেবল চেয়েছিলেন কাংগাল চামার । অথচ এর কোনোটাই হয় না । দাদুর আমলে তো হত । বাবার আমল থেকে দেখা দিয়েছে গোলমাল । বাড়িভাড়া দেবার মতন করে চটকল মালিকরা ভাড়া দিয়ে দেন মিলটাকে, বাবার আমল থেকে । ৫৯২ শ্রমিকের সঙ্গে ছাঁটাই করে দেয়া হয়েছিল বাবাকে, স্হায়ী হওয়া সত্ত্বেও । অবসর নেবার টাকাকড়িও পাননি । কম মাইনেতে একই কাজ করতে রাজি হয়ে আবার ঢুকেছিলেন ক্যাজুয়াল লেবার হয়ে । ভাড়াটে মিল মালিক যখন যাকে ইচ্ছে ছাঁটাই করে দিতে পারেন, বাংগালিবাবুদের ইউনিয়ানের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী । ইউনিয়ান দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করে প্রতিদিন আশি টন উৎপাদন বাধ্যতামূলক করেছিল, যা দত্যিদানোর শক্তি দিয়েও করা অসম্ভব । যেখানেই দ্বিপাক্ষিক চুক্তি হয়েছে, সেখানেই খেপেছেন শ্রমিকরা । অম্বিকা, আগরপাড়া, কানোরিয়া, কেলভিন, বরানগর, হনুমান, ভিক্টোরিয়া, ভারত, বালি, প্রেমচাঁদ, তিরুপতি, নর্থব্রুক, গ্যাঞ্জেস, প্রবর্তক, এম্পায়ার, হুকুমচাঁদ, ফোর্ট উইলিয়াম । কুলিরা, মানে মজুররা, মানে শ্রমিকরা, আর বিশ্বাসকরেন না ট্রেড ইউনিয়ান নেতাদের । ভিতর সে খোখলা কর দেতা হ্যায় মাদারচোদ সব ।
কাংগাল চামারও বিশ্বাস করেননি । ওনার বাবা চটের আঁশে ফোঁপরা ফুসফুসে যক্ষ্মা নিয়ে মারা যাবার আগে হুশিয়ার করে দিয়েছিলেন, ‘ই সালা বাংগালি লিডার সবকো কভি ভি বিসওয়াস মত করিহো । সালা সব অপনা দেশ কা বটওয়ারা করকে গাঁড় মারায়া হ্যায়, দুসরে কা ভলাই কহাঁসে করেগা ! ই লোগ পচছিম বাংগালকা গাঁড় মার-মারকে বরবাদ কর ডালেগা, দেখ লিহো ।’
বিশ্বাস না করলে কী হবে ! লিডারদের আর মালিকের চুক্তি তো মানতে হবেই, তাতে শ্রমিকদের চিন্তা ওরা করুক বা না করুক, চুক্তি হেন কথা । তাই মাইনে থেকে কাটৌতি মেনে নিতে হয়েছে । কাংগাল চামারের কাটৌতি তবু কম হয় । প্রেমচাঁদ, তিরুপতি, অম্বিকা, হনুমান, নর্থব্রুক, কানোরিয়ায় তো অর্ধেক মাইনে কাটৌতিতে চলে যায় । চটকল অসুস্হ বলে রোগ সারাতে শ্রমিকদের মাইনে কাটা যায় । বিমা, ব্যাঙ্ক কি সরকারিও চাকরিতে একদিনের মাইনে কাটলে পোঁদে হুড়কো করে দেবেন বাবুদের লিডাররা । চটকলের বেলায় একই নেতা অন্য ধুন কেন গাইতে থাকেন তা বুঝতে পারেননি কাংগাল চামার । ওসব চাকরিতে কাটৌতি করলে দ[পতর বন্ধ হয়ে যাবে । চটকলে কাটৌতি না করলে মিল বন্ধ হয়ে যাবে । আজব দেশ !
ন্যূনতম মজুরির চেয়ে কম মাইনে দিলে কুলি, মানে মজদুর, মানে শ্রমিক, চটকলের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে পারেন, পেমেন্ট অব ওয়েজেস কোর্টে । কয়েকবছর থেকে কোর্টটায় কোনো বিচারপতি নিয়োগ করেননি শ্রমিকদরদি পচছিমবঙ্গ সরকার, মতলব, বাংগাল সরকার । তাছাড়া কাংগাল চামার এসব ঝুটঝামেলায় যেতে চাননি । ফালতু খিচখিচ । কাটৌতি সামলাতে অনেক মজদুর নিজের কুলি লাইনের ঘর কোনো বাবুকে ভাড়া দিয়ে নিজেরা গিয়ে ঝুগগিঝোপড়িতে সস্তায় থাকেন । যে-মজদুর একা থাকেন, তিনি কাটৌতির পয়সা তুলতে নিজের ঘরটা কোনো রাণ্ডিকে ছেড়ে দ্যান, সন্ধ্যাবেলায় ধান্দা করার জন্যে । সে-মজদুর হাতজোড় করে আকাশকে অনুরোধ করেন, হে ভগওয়ান, রাণ্ডিটাকে আরও খদ্দের পাইয়ে দাও, যাতে আমারও আরেকটু রোজগার হয় ।
মা, ভাই গর্ভবতী বউ নিয়ে অন্য কোথাও যেতে চাননি কাংগাল চামার ।
মজুর জনগণের তাড়া খেয়ে কনসটেবলটা এসে কাংগাল চামারের ঘরের সামনেই ধরা পড়ে গেলেন ভিড়ের ঘেরাটোপে । দরোজার ফাঁক দিয়ে ডেখতে-দেখতে উনিও উত্তেজিত হয়ে বেরোতে যাচ্ছিলেন সরকারি গণশত্রুকে প্যাঁদাতে, কিন্তু মা ভেতরে হিঁচড়ে দরোজা বন্ধ করে দিলেন । বউ এখন গর্ভবতী । এখন এসব কাজে অংশ নিলে পাপ লাগবে । হল্লাগুল্লা, ভিড়ভাড়, কিচাইন ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল কিছুক্ষণ পর । অক্টোবরের হালকা-মেজাজ শীতের চাঁদ বেরিয়ে এসেছিলেন মিলের তেলচিটে আকাশে ।
কনসটেবলের থ্যাঁতা লাশ পরের দিন ভোরে কাংগাল চামারের ঘরের সামনে প্রথম দেখতে পান বিপিন নামহাটা । উনি ভোর থেকেই বেরিয়েছিলেন পে-স্লিপগুলো কিনতে । ভোরবেলা মগ হাতে হেগে ফেরার সময় চিহ্ণিত করতে সুবিধা হয়, বোঝানো যায়, হাগবার পরে মানুষের মাথা পরিষ্কার থাকে, বুঝতে সুবিধা হয় । জমঘট হয় না । লাশ দেখতে পেয়ে তখুনি দৌড়োতে হল ওনাকে । ফাঁড়িতে খবর পৌঁছোতেই ফাঁড়াফাঁড়ি শুরু হয়ে গেল সেপাই আর সেপাই কত্তাদের মাঝে ।
‘মরে গেছে ?’
‘একেবারে মেরে ফেলেছে ?’
‘কারা মেরেছে খোঁজ নিয়েছেন ?’ জানতে চান শার্লক হোমসের সেপাই সংস্করণ ।
‘কাদের বাড়ির কাছে হয়েছে ক্রাইমটা ?’ জানতে চান ডক্টর ওয়াটসনের বাঙালি ডুপলিকেট ।
‘সবকটাকে ধরতে হবে ।’
‘ধরাধরির দরকার নেই, ইন্সট্যান্ট অ্যাকশান নিতে হবে । ড্রাইভারদের ডেকে পাঠান, আর সবাইকে বলুন এক ঘণ্টার মধ্যে রিপোর্ট করতে । সন্ধ্যাবেলা অ্যাকশান ।’
সন্ধ্যায় আরম্ভ হয় হিন্দি সিনেমা । কুলি ব্যারেকের গলিপথগুলোর মুখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে যায় জিপ । চলমান কোনো কিছু দেখলেই সোঁটা । দরোজায় কুঁদো । মেয়েদের চুলের ঝুঁটি । উনুন-বাসনকোসনে লাথি, ঝনঝনাঝনঝন । বাচ্চাদের বুকের ওপর জুতো । কর্ণেল ডায়ার যুগ-যুগ জিও । বুড়ো-বুড়িদের কিল-চড়-থাপ্পড়। শ্রমিকদের পেটে, বুকে, মাথায়, পিঠে লাথি । ব্যাকগ্রাউণ্ড মিউজিক শিশুদের আতঙ্কিত কান্না । কিন্তু সিনেমার মতন ঢিশুম-ঢিশুম আওয়াজ ওঠে না, অনুশীলিত সাউন্ড ডিজাইনারদের দক্ষতায় ।
‘কোন বাঞ্চোতের বাড়ির সামনে লাশ পড়েছিল ?’
‘এইটে স্যার ।’
‘ধরে আনুন, স্যার বলে দিয়েছেন এটাকে স্পেশাল ট্রিটমেন্ট দিতে হবে ।’
‘ঘরে নেই স্যার।’
‘এই বিপিন, লক্ষ রাখ, ব্যাটা ফিরলেই নিয়ে আয় ।’
‘নাম কি মজুরটার ?’
‘কাংগাল চামার ।’
‘চামার ? কী বলছেন কী ! চামার হয়ে রাজপুত কনসটেবলকে মেরে ফেলল ? জংবাহাদুর সিং সায়েব নিজে রাজপুত বলে একজন রাজপুত কনসটেবলের মৃত্যুতে মুষড়ে পড়েছেন । এর পর যখন শুনবেন যে চামারের হাতে…ছি ছি ছি, পশ্চিমবঙ্গের তো মুখ লোকাবার জায়গা রইল না ।’
‘হালায়, আমাগো পইসচিম বঙে আইসা…’
অ্যাডিশানাল সুপার রাজপুত কনসটেবলের মৃত্যুতে ব্যথিতচিত্ত ছিলেন । বিহার থেকে ডোম চামার দুসাধ কোইরি কাহার এসে এখানেও ইজ্জত নষ্ট করতে পারে বলে ধারণা ছিল না ওনার । পরপর কয়েকদিনের সংবাদপত্রে পশ্চিমবঙ্গের মণীষীদের উক্তি পড়ে নিজেকে মুগ্ধ করছিলেন তিনি :
সুব্রত মুখোপাধ্যায়, আই এন টি ইউ সি রাজ্য সভাপতি । ‘এরপর তো ভিখিরিরা মিষ্টির দোকান দখল করবে । মিলের গেটে চায়ের কাপে তোমাকে চাই গাইলেই মিল খুলবে না ।’
চিত্তব্রত মজুমদার, সিটু রাজ্য সম্পাদক : ‘যদি বেশিরভাগ শ্রমিকও ওদের সঙ্গে থেকে থাকেন, তাও ওদের নেয়া হবে না । কারণ ওপথ ভুল । ওদের পথা চললে এ রাজ্যে কেউ শিল্প গড়তে আসবে না । ওপথ আসলে এ রাজ্যে শিল্প ধ্বংসের চক্রান্ত ।’
নীরেন ঘোষ, সিটু রাজ্য সভাপতি : ‘কারখানা দখল হয় বিপ্লবের পর । ফুলেশ্বরে কি বিপ্লব হয়ে গেল নাকি ? এই পথে শ্রমিক আন্দোলন হয় না । এটা কোনো পথ নয় । ওরা তো লম্বা লম্বা কথা বলছে । তা করে দেখাক । মিল চালাবে । চালাক তাহলে ।’
ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত, সিপিআই সাধারণ সম্পাদক : ‘শ্রমিকদের টাকা মেরে কারখানা বন্ধ করছেন মালিকরা । রাজ্য সরকার এদের গ্রেপ্তার করছে না কেন ? তেলেনিপাড়ায় লালঝাণ্ডার দপতরে শ্রমিকদের হামলা অভাবনীয় ঘটনা । ফ্রন্ট নিষ্ক্রিয় হলে শ্রমিকদের ক্ষোভ তো বাড়বেই ।’
নিখিল দাস, আর এস পি সম্পাদক : ‘রাজনৈতিকভাবে বামফ্রন্ট ঠিকমতো ভূমিকা পালন করছে বলে মনে করি না ।’
খবরের কাগজগুলো পড়তে-পড়তে জংবাহাদুর সিং এর মুচকি হাসি ঠোঁতে ধরে রাখতে বেশ ভালো লাগছিল । তাঁর টেবিলের ওপরেই রয়েছে আইবির রিপোর্ট । দুর্গাপুজোর ষষ্টির দিনে এলিজাবেথ জুট মিলের শ্রমিকরা তাঁদের ইউনিয়ান নেতাদের গলায় জুতোর মালা পরিয়ে ঘুরিয়েছিলেন চটকল এলাকায় । নেতারা শ্রমিকদের কাছে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন যে তৃতীয়ার দিন সন্ধ্যাবেলা কলকাতার লিটন হোটেলে তাঁরা পাঁচজন চল্লিশ হাজার টাকা করে মালিকের কাছ থেকে ঘুষ খেয়েছেন । ট্রেড ইউনিয়ান এখন ইউনিয়ান ট্রেড । এই টাকা কতটা ওপর ওব্দি ভাগাভাগি হয়েছে তা লেখা আছে রিপোর্টে ।
সিঁড়িতে বুটজুতোর আওয়াজে, মৃদু হাসি বজায় রেখে, তাকালেন স্মার্ট অফিসারটির দিকে ।
‘লোকটাকে ফাঁড়িতে আনা হয়েছে স্যার, নাম কাংগাল চামার ।’
শোনামাত্র, প্রকৃতির কী অদ্ভুত লীলা, মুহূর্তে উবে গেল তাঁর হাসি, লোমশ ভুরু একটার সঙ্গে আরেকটা ধাক্কা খেয়ে বিস্ফোরণ ঘটাল জংবাহাদুর সিং-এর মস্তিষ্কে । টুপি পরে, ব্যাটন হাতে উঠে দাঁড়ালেন, বললেন, ‘চল্লো ।’
এত ভোরে উঠি না । ঘুম ভাঙল মশারির মধ্যে বালিশের পাশে রাখা টেলিফোনের হ্যাণ্ডসেট বেজে ওঠায় । আগে আমি তুলতুম । ১৯৯৬ সনে আগস্টের মাঝরাতে ঘুম ভেঙে টেলিফোন ধরতে বেরিয়ে হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল বলে বিছানায় হ্যান্ডসেট নিয়ে শুই । হাসপাতাল থেকে আসার পর অসময়ের ফোনগুলো রিসিভ করার কাজ সলিলার ওপর বর্তেছিল । কিন্তু ফোনে বাঙালি কবি-সাহিত্যিক অনামাদের গালমন্দ-খিস্তিখেউড় আসতে থাকায় আমিই ধরছি আবার । বাংলা যৌন শব্দগুলো সলিলা জানে না বলে গালমন্দগুলোর মানে বুঝতে না পেরে কী বলছেন, ঠিক বুঝতে পারছি না, ইংরেজিতে বলুন না, ইত্যাদি অনুরোধ করত । ও হিন্দি মারাঠি ইংরেজি খিস্তিখেউড়গুলো জানে । বাংলাগুলো ওকে বুঝিয়েছি, কিন্তু প্রত্যঙ্গ বা ক্রিয়ার গোলমাল করে ফ্যালে । তাছাড়া ছোটোবেলা থেকে শোনেনি বলে কথাগুলোকে ওর খিস্তি মনে হয় না । ফানি মনে হয় । হিন্দি-মারাঠির তুলনায় শ্রাব্য বিকল্প মনে করে । কানাড়া ভাষায় যোনির গালাগাল শব্দ তুলু । মিঠুন চক্রবর্তী আর দক্ষিণ ভারতীয় অভিনেত্রী মধুর একটা বিখ্যাত নাচ আছে বার-বার তুলু-তুলু গেয়ে । মিঠুন দক্ষিণ ভারতে থাকেন ।
সলিলা অ্যারোবিক্স করছিল । আমি হ্যাণ্ডসেট ওঠাইনি দেখে স্পিকার অন করে হ্যালো-হ্যালো করতে থাকলেও সাড়া পাওয়া গেল না । আমিও হ্যাণ্ডসেট কানে দিয়ে বুঝলুম যিনি রিং করছেন তিনি ধরে আছেন, অথচ কথা বলছেন না । মলয় বলছি, বলতেই রেখে দিলেন । সলিলা বলল, ‘এটা সাহিত্যিক-কবি নয়, স্বজনজ্ঞাতি হবে । সাহিত্যিকদের বদলা নেবার পিরিয়ড বোধহয় ওভার হয়ে গেছে, তিরিশ-চল্লিশ বছর আগে করা তোমার ফোনের বদলি খিস্তিখেউড় যথেষ্ট হয়ে গেছে হয়তো, অবশ্য আবার যদি না তোমার সাম্প্রতি৯ক লেখা চটিয়ে থাকে কাউকে-কাউকে ।’
বার্তাকারীর বার্তাও অনির্ণেয় হতে পারে ।
যান্ত্রিক গোলোযোগে বেজে উঠে থাকে যদি ? অভিপ্রায়হীন বার্তা !
সলিলা নিজের অর্ধসমপাপ্ত ব্যায়াম শুরু করল আবার । আমার ষাঠোর্ধ ভায়রা আর শ্যালিকা মুম্বাইতে বাজনা বাজিয়ে ব্যায়াম করে । কলকাতায়, বুড়োবুড়িদের, বাজনা বাজিয়ে ব্যায়াম করতে শুনিনি । সকালে বাজনা আমার পছন্দ নয় । জানলার বাইরে পলাশ, শিউলি, নিম, বাতাবি, বেল, আমগাছে, পাশে অঞ্জলিদির বাড়িতে, ভোরের অন্ধকার থেকে অনেক পাখি ডাকছে । প্রতিদিন শুনি ।
উঠে, মশারি খুললুম । সলিলা পাট করবে, বিছানা ঠিক করবে ।
পলাশের গাছময় পাখি, ফুলের মধ্যে চোখসুদ্দু ঠোঁট ঢুকিয়ে দিচ্ছে । হলুদ, সম্ভবত ওরিয়ল । ছোট্টো টুনটুনি । দোয়েল, ময়না, শালিখ, একটা নীলডানা অচেনা পাখি । কোকিল ডাকছে, কিন্তু দেখতে পেলুম না ।
গাছে উঠে কচি নিমপাতা পাড়ছে কেউ, বেচবে বোধহয় বাঁশদ্রোণী বাজারে । সলিলা ওটা রেলিশ করে না । তেতো মানে শুক্ত । লালচে শাড়ি মোটা বউ পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে ডুমুর পেড়ে নিল প্লাসটিকের বালতিতে । এত ভোরেও পুকুরে স্নান চলছে ।
বিছানায় ফিরে ফিজিওথেরাপি করলুম । পিয়ারলেসে অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টির সময়ে ভুল ওষুধে আর্থারাইটিস হয়েছিল । উঠে, দেয়ালে স্লেট টাঙিয়ে এবিসিডি ১২৩৪ অআকখ অভ্যাস করলুম মিনিট কুড়ি, যাতে হাত কাঁপা নিয়ন্ত্রণ হয়, ডা ডি কে দাসের নির্দেশ । উপদেশ দিয়ে স্বর্গগামী হলেন উনি ।
চায়ের জল দুধ গরম বসিয়ে দাঁত ব্রাশ করলুম । সলিলাকে বললুম জলখাবারে ‘আলুপোহা’ বা ‘সাবু-খিচুড়ি’ বানাতে । কাড়ি পাতা হিং ফোড়ন দিয়ে । সঙ্গে চিনেবাদাম ।
টেলিফোন, ‘অতএব ভাবনা’ সম্পাদক শংকর সরকারের । শনিবার দুপুরে আসবেন ।
ভোলা, দুধ দেয়, জানালো, নিচে, সিঁড়ির মুখে আমাদের কলিং বেলের সুইচটা ছিল, কেউ উপড়ে দিয়েছে । বললুম, ‘আজকে দেখলে ? ওটা তো পুজোর সময় ছিলুম না বলে চাঁদা পার্টিরা তারসুদ্দু উপড়ে নিয়ে গেছে’ । ভোলা নিজের নামসইও শেখেনি । মুম্বাইতে যে ছেলেটা দুধ দিত, ক্যালকুলেটার রাখত । যে ছেলেটা পুরনো খবরের কাগজ কিনতে আসত, সেও রাখত ।
কাগজের জন্যে অপেক্ষা করছিলুম । বাংলা কাগজ এড়িয়ে যাই । খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, ডাকাতি, ছিনতাই, গণলুঠ, তছরুপ, কারচুপি, আর কত পড়া যায় রোজ-রোজ । কালকের খাস খবরে বলেছিল, শঙ্খ ঘোষ বলেছেন, অটলবিহারীর হাত থেকে বিড়লা পুরস্কার নেবেন না । কিন্তু আনন্দবাজারে কিছুই বেরোয়নি । টাইমস অফ ইনডিয়াতেও নেই । ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারলুম না । বিড়লার পুরস্কার নেয়া যায়, অথচ যে দলটাকে তারা ফাইনান্স করে, তার নেতার হাত থেকে সেটা নেয়া যায় না । তরুণ কবিরা এই জন্যই শঙ্খ ঘোষকে ভয় পান । শঙ্খ বোধহয় জানেন না, তাঁর সম্পর্কে তরুণদের মনে কেমনধারা আতঙ্ক । তারাপদ আচার্য শঙ্খ সম্পর্কে ঠিকমতো বিশ্লেষণ করতে পারেননি । তারাপদর লেখাটাও আতঙ্কপ্রসূত একটি পলিটিকালি কারেক্ট গদ্য । মাল্টি ডিসিপ্লিনারি চিন্তা নেই ।
এখন যেতে হবে ব্যাঙ্কে । পড়া বা লেখার সময় হবে না । ব্যাঙ্কে আমার সই মেলে না । বাপ্পাকে টাকা পাঠাতে হবে এমটি করে । ব্যাঙ্ক অফ বরোদায় তবু কাজ হয় । এলাহাবাদ ব্যাঙ্ক, ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক তো আলঝিমার রুগিরা চালায় । কলকাতায় হেড অফিস মানেই আমাগো দাদারা তাকে ছিবড়ে বানিয়েছেন । আসার সময়ে চাল ডাল ইত্যাদি কেনাকাটা করে নিলুম । সলিলা বইবে কিছুটা । ডাক্তারের নির্দেশে এক-দু কিলোর বেশি বই না, সাধারণত ।
বাড়ি ফিরতে উৎপল ভট্টাচার্যের ফোন । বলল, দু-ঘণ্টা যাবৎ ফোন করছি, রিং হয়েই চলেছে । সন্ধ্যাবেলা আসবে । বাড়িতে কেউ আসলে, কিছুই থাকে না খাওয়াবার, মদ ছাড়া । উৎপল খায় না । কলিম, ধুর্জটি চন্দ, পার্থ, জহরও খায় না । মদ খাই বলে, যারা খায় না, তাদের ভালোলাগে, শ্রদ্ধা হয় ।
সলিলাকে হেল্প করতে চচ্চড়ি কাটতে বসলুম । শাকের শেকড় দেয়া চচ্চড়ি আমার দারুণ লাগে । শেকড়গুলো ছুরি দিয়ে চাঁছলুম । শাকের পাতা কুচোলুম কাঁচি দিয়ে । আলু, বেগুন, শিম, বরবটি, বিন, কুড়ো, রাঙাআলু কেটে রান্নাঘরে দিয়েলুম । চচ্চড়ির জন্যে সর্ষের তেল কিনি । বাদবাকি ফ্লোরা । পাটনায় থাকতে, মা আমের আচারের তেলে চচ্চড়ি রাঁধতেন ।
শিবুর চায়ের দোকানে গুলতানি শুনে উঁকি মেরে দেখলুম, কচি-কচি কচ্ছপ কাটা চলছে । সিপিয়েম আর তৃণমূলের এই বুঁদির কেল্লায় বেতোরুগিরা আইন মানে না । জীবন যাপনটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে আইন অমান্য । একতলার যুবক-যুবতী দম্পতি চাকরিতে বেরিয়ে যাবার পর যে দুজন তরুণী ওদের বাচ্চা সামলায়, তারাও কচ্ছপ-কাটা ভিড়ে পাড়ার তরুণ হুকিং করার চেষ্টায় নিজেদের আলগা করেছে । বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভিড়টার কুশীলবদের হরকতগুলো উপভোগ করা গেল । একে ফ্লার্ট করা বলে না । এ একেবারে আসল দাঁতনখের অদৃশ্য ছেঁড়াছিঁড়ি । জানুয়ারির শীতের সন্ধ্যায় অবশ্য প্রতিটি ল্যাম্পপোস্টের তলায় র্যাপার গায়ে পাড়াতুতো প্রেম চলে । প্রেম রিডিফাইনড ।
‘যুক্তাক্ষর’ পত্রিকায় প্রকাশিত ওর কবিতা সম্পর্কে মতামত জানিয়ে শঙ্করনাথ চক্রবর্তীকে চিঠি লিখলুম । রবীন্দ্র গুহকে চিঠি দিলুম গুরগাঁও যাচ্ছি জানিয়ে । ঋতব্রত মিত্রকে ওর কাব্যগ্রন্হের প্রাপ্তি জানালুম । ‘ক্লেদজ কুসুম’-এর জন্য প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রবন্ধ চেয়েছে । সময় হবে না, বাইরে যাচ্ছি । কবিতা কপি করলুম ওর জন্য ।
মাইকেল পোলন-এর ‘দি বটানি অব ডিজায়ার’ বইটা পড়ছিলুম ।
সলিলা চান করার তাড়া দিতে উঠতে হল । ভাতও হয়ে গেছে । খাবার টেবিল সাজিয়ে ফেলেছে । আমি চান করতে গেলে ও একতলায় চিঠি আনতে গেল । ট্যাঙ্কের জল বেশ গরম । চিন্তা আরামকে নষ্ট করে ।
আজ চিঠি নেই । বা, চিঠি-দিদিমণি আসেননি ।
এন থিয়স, দ্য গড উইদিন, হয়ে গেছে ‘এনথু’ । কতভাবে বাঙালির পালটে যাওয়া সমাজটাকে টের পাচ্ছি । ডেভিড লেহম্যানের ‘সাইনস অফ টাইমস’ । আরও আছে । প্রেম ব্যাপারটাই তো সৌন্দর্যের ধারণাকে নস্যাৎ করে । একটা চরিত্র যে ইসকুল থেকে, কলেজ থেকে, পরিবার থেকে, চাকরি থেকে এক্সপেলড । বিদঘুটে চরিত্ররা ভয় দেখায় । টেপ চালানো হয়েছে, সবাই রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনবেন বলে নাক ফুলিয়ে গম্ভীর । টেপটা গানের বদলে শ্রোতাদের যাচ্ছেতাই গালমন্দ আরম্ভ করল, মহিলাকন্ঠে । রবীন্দ্রসঙ্গীতকে এলিট গৃহবধু গায়িকারা ফিউনারাল সং করে ফেলেছেন বলে তাঁদের জন্যে চোখা-চোখা । শহরটা আগাপাশতলা উই, কেঁচো, বিছে, আরশোলা, উচ্চিংড়ে, ইঁদুর, ছুঁচো, ভিমরুল, মাছিতে ঠাসা, তারা বাংলায় কথা বলছে । ‘স্যার’ বলতে লজ্জা করে বলে ‘বস’ । অন্ধত্বের চাক্ষুষ প্রমাণ ওর ছড়ি ।
কলিম খান, অরবিন্দ প্রধান এলেন বিকেলে । আজকাল বড় বক্তৃতা দিয়ে ফেলি । কলিমের কাছে সনাতন সূত্রগুলো পাওয়া যায় । ডলি দত্তর ‘নরক’ সংখ্যা দিলেন । ডলি দত্ত নরক সম্পর্কে লেখা চেয়েছেন, বই বার করবেন । অরবিন্দ ওঁর বই দিলেন । নরক সম্পর্কে আমার কিছুই জানা নেই ।
ওঁরা যেতে সমীর বসুর পদক্ষেপ পত্রিকার প্রবাসী সংখ্যায় দেবার জন্য লেখাটায় চোখ বোলালুম । শিরোনাম দিয়েছি ‘ক্ষুধা প্রেম আগুনের সেঁক’ । কাল রেজিস্ট্রি করে দেব । ওঁদের তো আমার মতামত রোচে না, অরবিন্দ বললেনও সে কথাটা । তবে লেখা চাওয়া কেন ?
আজকে আর হুইস্কি খাওয়া যাবে না । ঘুমের ওষুধ খেতে হবে । মদ খাওয়া ছেড়ে দিতে হবে । আজকাল বড় হাত কাঁপে ।
অ্যালেন গিন্সবার্গ সম্পর্কে লেখাটা আধখ্যাঁচড়া হয়ে পড়ে আছে তথ্যের অভাবে । গ্যারি স্নাইডার আর সিটি লাইটসে লরেন্স ফেরলিংঘেট্টিকে ই-মেল করেছিলুম । গ্যারি জানিয়েছে ও বব রোজেনথালকে লিখেছে । ববের জবাব না পেলে আর কিছু করার নেই । অশোক চট্টোপাধ্যায়, কাজল সেন, শিমুল আজাদ, অনেকেই চেয়েছেন লেখাটা । উৎপল ভট্টাচার্য এলো । ‘নাটকসমগ্র’ এনেছে গোটা বিশেক । ভালোই । অনেকে চেয়েছেন । ‘আধুনিকতার বিরুদ্ধে কথাবাত্রা’ উৎসর্গ করেছি উৎপলকে । ছাপা, বাঁধাই, গেট আপ ভালো হয়নি বলে ও ক্ষুণ্ণ । ‘পোস্টমডার্ন জীবনানন্দ’ যেটা ‘দিশা’য় বেরিয়েছে গ্রন্হাকারে বের করতে চায় ও । কিন্তু লেখাটায় আরেকটু শাঁস ঢোকাতে হবে । অতএব বৈশাখে হবে না । মে মাসে ফিরলে, তখন । ‘ভালো’ প্রবন্ধগুলো নিয়ে একটা প্রবন্ধের বইও বের করতে চায় । এঁচোড়ের তরকারি খেয়ে ও থ্রিলড । গিন্সবার্গ সঢম্পর্কে রচনাটা ওর ‘কবিতীর্থ’ পত্রিকায় দেব ।
সলিলা রান্নাঘরে ব্যস্ত । এ এক্স এন-এ পামেলা অ্যান্ডারসন লি-র ভি আই পি দেখলুম । সিনেমা ব্যাপারটাই রিডিফাইনড । গল্প নেই, বিশেষ ঘটনা নেই, যৌনতাও নেই । কেবল একজন বিদেশিনীর বুকের মাপের ওপর নির্ভরশীল চলচ্চিত্র । বুকটা প্যাকেজিং করা প্রডাক্ট । পাছার প্যাকেজিংও চলছে । শিল্পা শেট্টি নাকি তিনচার বার নাক পালটিয়েছে । বাপ্পার দেয়া তথ্য ।
ড্রইংরুমেই খাবারের সবকিছু নিয়ে এল সলিলা । খেতে-খেতে চ্যানেল সারফিং চলল । সিংহ হরিণ খাচ্ছে, আমরা রুটি ।
Note : জেগে থাকার জন্যে বেনজেড্রিন, স্বপ্ন দেখার জন্যে মেসকালিন, ঘুমোবার জন্যে পেথিড্রিন ।
একজন মানুষের সৌম্যকান্তি ধ্বংসাবশেষ ! ইনোসেন্স রিক্লেইমস হিম । কেমিকালস অব হুইস্কি কনকক্টস আ কনশাসনেস । ব্লাড বটল্ড ইন পেনিস । উই সিংক ডাউন সফ্টলি ইন আওয়ার ওন প্রবলেমস । দি রাইটিং ওয়েইলস লাইক অ্যান এণ্ডলেসলি এক্সপায়ারিং সোপ্রানো । দি হোপলেস লুজার হোপস টু উইন বাই লুজিং বিগ ।
ঘুমের ওষুধ আর হুইস্কিতে অনেক তফাত ।
মশাল বাহকরা বেরিয়েছে । চৌঠা এপ্রিল ব্রিগেড চলো । থার্ড জেনারেশান ডায়াসপোরা ।
শুভময় সরকারের ‘মল্লার’ পত্রিকার জন্যে লিখতে বসলুম । ভেবে নিয়েছি লেখাটা । নাম দিচ্ছি ‘শহিদ’ । আশা করছি শুভময় আর ওর পাঠকরা ডিসকোর্সের ইমপোর্টটা হজম করতে পারবে ।
শহিদ
লুঙ্গিতে জিভছোলা গুঁজে, দাঁট-ব্রাশ অর্ধেক বাকি রেখে, থানার ডাকবাবু বিপিন নামহাটা, চটকল, মানে এলিজাবেথ জুটমিল, বছর খানেকের বেশি বন্ধ থাকা সত্ত্বেও, যিনি ভোরবেলা রোঁদের এই বদভ্যাস বজায় রেখেছেন, একদা যে-অভ্যাসে উনি মগ হাতে রেল লাইনের ধারে হাগতে-আসা কুলি ব্যারাকের শ্রমিকদের তোলা জমা দেবার শেষ নোটিস দিতেন, বা মহাজনের হয়ে মজুরদের মাইনের ডিউ স্লিপ কিনে নিতেন, তিনচথুর্তাংশ বা আধা দামে, কেননা সকালবেলায় এই জায়গাটিতে আসতেই হবে যাঁরা বিহার-উড়িষ্যায় নিজের গাঁয়ে ফিরে যাননি, তাঁদের । উনি, বিপিন নামহাটা, রেল লাইনের ধারে পড়ে থাকা শবের কেবল ধড়টুকু দেখে চিনে ফেললেন যে, সেটা হাজিরাবাবু, চটকলের পে ক্লার্ক সত্য আচাজ্জির ।
তাঁর, ডাকবাবুর, আতঙ্কিত চিৎকারে, যাঁরা উদাসীন চাউনি মেলে কয়লা আর ছাইগুঁড়োর ওপরে বসেভ হাগছিলেন, তাঁদের অনেকেই, মগ হাতে বা ফেলে রেখে, ছুটে এলেন । আদপে বিহারি বা উড়িয়া হলেও, তৃতীয় পুরুষে পৌঁছে, এই শ্রমিকেরা হয়ে গেছেন হাইব্রিড বাঙালি । মিল বন্ধ হতে, লালু যাদবের দলের র্যালি, র্যালা, রঙ্গরলিয়াতে অংশগ্রহণ করে যৎসামান্য রোজগারের ধান্দায় বহু শ্রমিক চলে গেছেন বিহারে । কিছু শ্রমিক গমের কাটাই করতে, কুলি ব্যারাকে পরিবারকে রেখে, না রাখলে জবরদখল হয়ে যেতে পারে, চলে গেছেন পাঞ্জাব-হরিয়ানায় । রিকশা চালাতে শহরে, কাছাকাছি শহরগুলোয়, চলে গেছেন অনেকে ।
মিলে লকআউট হবার দুবছর আগে থেকেউ উৎপাদনের গোলমাল চলছিল । গানিং আর স্যাকিং বিভাগ তো কবেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল । কাঁচা পাট কেনা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল গুদামে আগুন লাগার পর । পাট হয় উত্তরবঙ্গে । মিলটা হুগলি জেলায় । গুদামগুলো অধিকাংশ মালদহ জেলায় । মালদহ থেকে চোরাচালান হতো বাংলাদেশে । তিনটে পাচাররত ট্রাক ধরা পড়ে যাওয়ায়, গুদামগুলোয়, ফাঁকা অথচ কাগজে-কলমে স্টক ভর্তি গুদামগুলোয়, আগুন ধরাতে হয়েছিল । ভুয়ো স্টক অবশ্য বিমা করা ছিল ।
হাজিরাবাবু সত্য আচাজ্জির কোথাও যাবার ছিল না । দেশ-গাঁ খেয়েছে জিন্না-নেহেরুরা । পাকা গমের গোছা কীভাবে কাটতে হয় জানেন না । খালেদালি মণ্ডলের মতন ফকির বা বাউল সেজে গান গেয়ে ভিকখে করার কৃৎকৌশল জানানেই । প্যাংলা মধ্যবিত্ত চেহারায় রিকশা চালাবার উপায় আর মানসিকতা ছিল না । পার্টিতে ঢুকে রোজগারের হিল্লে খুঁজেছিলেন, পাত্তা পাননি । চটকল বন্ধ বলে ইউনিয়ান নেতারা ওব্দি যে-যার দালালখুরির ফিক্স ডিপোজিট ভাঙিয়ে খাচ্ছেন । ধারে কিনে-কিনে মুদির দোকান দুটোর লালবাতি জ্বালিয়ে দিয়েছেন চটকল কর্মীরা ।
এরকম অবস্হায় বেঁচে থাকার একটিমাত্র পথ খোলা ছিল । আত্মহত্যা করা ।
চিৎকার পাড়ার পর ডাকবাবু বিপিন নামহাটা খুঁজে পেলেন মুণ্ডুটা । রেল লাইনের পাশের ডোবায় ।
–তোরা ভোরবেলা থেকে ডোবাটায় ছোঁচাচ্ছিস, কেউ দেখতে পাসনি ?
–ডোবার কাদাঘোলা জলে আর কেউ ছোঁচায় না , আমরা মগ আনি ।
–আরে, এ তো হাজিরাবাবু । শালা জিরো নম্বর মজুরদের থেকে দশ পারসেন্ট খেত ।
–কেউ খুন করেনি তো ? সকলের পোঁদে এমন বাঁস করত ।
–এ শালা লম্বরদার ইউনিয়ানের আর মালিকের খোচর ছিল ।
–বাঞ্চোৎটা নিশ্চই আত্মহত্যা করেছে । আর তো কেউ ধার দিচ্ছিল না । না খেতে পেয়ে মরেছে । অত বাচ্চা পয়দা করার মজা বোঝো এবাএ !
–রাত্তিরের কোনো মেল ট্রেন ছিল মনে হয় । অত দূরে গিয়ে ছিটকে পড়েছে মুণ্ডুটা ।
–শেয়াল-শকুন তো আর নেই । নইলে দিত ছেঁড়াছিঁড়ি করে ।
–কেউ হাত-টাত দিসনি লাশে । আমি থানায় গিয়ে খবর দিচ্ছি ।
–আরে এই পাপী লাশ ছোঁয় কেউ ! পচুক রোদ্দুরে ।
একটা মজুর মরলে দুটো মজুরের চাকরি জুটছে । তা থেকে ইউনিয়ান নেতাদের, চটকল মালিকের আর আমারও লাভ ; হাজিরাবাবু সত্য আচার্য, মানে সতে আচাজ্জি, কথাটা ভেবে অবাক হলেন । অবাক হলেন বলে ওনার অবাক লাগছিল । অবাক হলেও মনে-মনে আনন্দ হয় ! কাংগাল চামারটা মরে যেতে, সবাই বলেন, সবাই মানে মজুররা, কাংগালটাকে ফুসলিয়ে থানায় নিয়ে গিয়ে তুলেছিলেন ডাকবাবু বিপিন নামহাটা, তারপর এমন খাকি থার্ড ডিগ্রি, ফোর্থ ডিগ্রি, ফিফথ ডিগ্রি, সিক্সথ ডিগ্রি, সেভেন্হ ডিগ্রি, নাইন্হ ডিগ্রি দিয়েছিলেন বামপন্হী মজুরদরদী সরকার বাহাদুর, যে, থেঁতলে একেবারে মাধ্যমিক পাস । লাশ নাকি পাথর বেঁধে মাঝ-গঙ্গায় এমনভাবে ফেলার ব্যবস্হা করেছিলেন, মাছেরা ওব্দি খুবলে-খাবলে ভাসাতে পারেনি ।
কাংগাল চামারকে নিয়ে এসব গালগল্প কিংবদন্তি মজুররা বিশ্বাস করেন । চটকল মালিক করেন না । চটকলের ম্যানেজমেন্ট কর্মীরা করেন না । যাঁরা কাঁচা পাট মিলকে সরবরাহ করেন সেসব ফড়েরা করেন না । ইউনিয়ান নেতারা করেন না । মন্ত্রী আর আমলারাও করতেন না আগে, কিন্তু সিবিআই তদন্ত করে কয়েকজনকে চার্জশিট দেয়ায়, করতে বাধ্য হয়েছেন । আসলে যা সত্যি তা যদি কারোর ভাল্লাগে তাহলে কেনই বা বিশ্বাস করবে । ভালো না লাগলে তা কী করে সত্য হবে ! মজুরের সত্য তো আর সত্য নয় ; সত্যের মালিকানার জন্যে চাই ক্ষমতা ।
হাজিরাবাবু সতে আচাজ্জি মনে-মনে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না প্রথমটায়, যখন কাংগাল চামার লোপাট হওয়ায় গোলমাল বেধেছিল কুলি ব্যারাকে । যদিও উনি ম্যানেজমেন্ট কর্মী । কিন্তু সিবিআই যখন সত্যিকে আইনত সত্য বলে প্রমাণ করে দিলে, আর কাংগাল চামারের পোস্টে দুটো মজুর রাখার প্রস্তাব নিয়ে এলেন জনাকয় ইউনিয়ান নেতা, তখন পে ক্লার্ক মশায় সত্য আচার্য নিজের আহ্লাদে আহ্লাদিত হয়েছিলেন ।
কাংগাল চামারটা রেগুলার শ্রমিক ছিলেন । ওনার ই বি নম্বর ছিল । ই বি ০০৫৭, কেন না, উনি ছিলেন টানা আট ঘণ্টার মজুর । এখন ওনার জায়গায় দুটো বিনা নম্বরের মজুর রাখা গেল, খালেদালি মণ্ডল আর বৈকুন্ঠ নস্কর । নম্বর দেয়া শ্রমিক হলে তার মাইনে থেকে কাটৌতি করে মিল । কাটৌতি করে মিলের লোকসান সামলান মিল মালিক । রেগুলার শ্রমিক হলে ইউনিয়ানকে চাঁদা দিতে হয় । যা দিনকাল পড়েছে, শ্রমিকেরা এক সঙ্গে অনেকগুলো ইউনিয়ানের সদস্যতা নিয়ে ফ্যালেন । কেউ-কেউ আবার কোনোটারই সদস্য হন না । হাজিরাবাবুকেও দিতে হয় ফি-হপ্তায়, বোনাসের সময় ছাড়া ।
সর্বহারার সংজ্ঞা তো দাদারা পালটে ফেলে তা সংরক্ষিত রেখেছেন কেরানি আর ইসকুল মাস্টারের জন্যে । বিনা নম্বরের শ্রমিক তো শ্রমিকই নয় । দিনের মজুরি ভাউচারে সই করে ক্যাশ দিয়ে দিলেই হল । খালেদালি মণ্ডল পাঁচ ঘণ্টার কাজ করতেন । বৈকুন্ঠ নস্কর তিন ঘণ্টা । হাজিরাবাবু এঁদের দৈনিক মজুরি থেকে পাঁচ-দশ টাকা কেটে নিতেন প্রতিদিন, ইচ অ্যাকর্ডিং টু হিজ এবিলিটি । ইউনিয়ান নেতাদেরও, প্রতিটি চটকলে, বিনা নম্বরের মজুররা, কড়ার অনুযায়ী দ্যান । হাজার হোক কাজটা তো ওনারাই পাইয়ে দিয়েছেন । মজুরি বিলির সময়ে ওনারা টুল পেতে বসে থাকেন । মুখ বুজে দিয়ে দ্যান মজুররা । গাঁইগুঁই করে লাভ নেই । করলে, কাল থেকে অন্য লোক ঢুকে যাবেন ; ঢুকিয়ে দেবেন ওঁয়ারা ।
মালিকের চিন্তা শুধু নম্বরঅলা মজুরদের নিয়ে । বিনা নম্বরের মজুর মালিকের নথিতে থাকেন না । নথিতে যাঁরা থাকেন তাঁদের প্রভিডেন্ট ফাণ্ড, ই এস আই, দুর্ঘটনা ভাতা এসবের ঝক্কি পোয়াতে হয় মালিককে । মালিক তো আসলে মালিক নন, মিলটাকে ভাড়া নিয়ে চালান । ঝক্কি-ঝামেলা পোয়াতে না পারলে অন্য কাউকে ভাড়া দিয়ে কেটে পড়েন । এভাবে ভাড়াটে বদল হতে-হতে ঝক্কি-ঝামেলা থেকে যায় মিলের খাতায়-কলমে, আর রেগুলার শ্রমিকের ঘাড়ে । রেগুলার শ্রমিক যত কমেন তত সবায়ের মঙ্গল । সতেবাবু মনে করেন, মানে, মনে করতেন আরকি, সরকারেরও মঙ্গল, কেননা শ্রমিক যটা কমবেন, সেই অনুপাতে শ্রমিকদরদি সরকারের দরদও কমবে । দরদের ভার কম ভার নয়, গদি ফসকে যায় ভারের টাল সামলাতে না পারলে ।
হাজিরাবাবু নিজেকে বামপন্হী মনে করেন, মানে করতেন । পঞ্চায়েত নির্বাচনে পার্টির টিকিট পাননি বলে বিক্ষুব্ধ সিপিএম তকমা নিয়ে হেরেছিলেন নিজের কোতলবেড়িয়া গ্রাম পঞ্চায়েতে । এতে একটা সুবিধে হয়েছে যে, মানে হয়েছিল আরকি, সতেবাবু, আচাজ্জিবাবু, পে-ক্লার্কবাবু, ক্যাশবাবু না বলে, সবাই ওনাকে এখন কমরেড বলে ডাকে । আড়ালে, কাটৌতি কমরেড । ওনার আশেপাশের বাদবাকি কমরেডদের মতন উনিও মার্কস এঙ্গলস লেনিন স্তালিন মাও পড়েননি । রাশিয়ায় ছাপা বিটকেল গন্ধের অনুবাদেও পড়েননি । ওই ইশকুল মাস্টারমশায় জ্ঞান দেবার সময়ে যেটুকু পড়িয়েছিলেন ।
কমরেড নামটা উনি এদান্তি ঝেড়ে ফেলতে চাইছিলেন । তৃণমূলে দহরম-মহরম করতে শুরু করেছেন একটু-আধটু । তা ওখানে আবার কমরেড চলে না ; লাল রঙ দেখলেই তেলে-বেগুন । না চলুক । বিনা নম্বরের মজুর বাড়ছেন দিনকে দিন । নির্বাচনে খরচ করার মতন রেস্ত চাই । গণতান্ত্রিক পদ্ধতির অপরিহার্য অঙ্গ হল রেস্ত, জানেন উনি, মানে জানতেন আরকি । ইউনিয়ানের লোকগুলো ওনাকে খাতির করেন বটে । কিন্তু ওনারা সব কলকাতা-বর্ধমান-ব্যাণ্ডেল-চুঁচড়োর লোক, কোতলবেড়িয়ার নন । আসলে তো ওনারা তো আর মজুর নন, ওনারা নেতা ।
চটকলের মজুরগুলো ইউনিয়ানগুলোকে বলেন এক লম্বর, দোলম্বর, তিন লম্বর, চার লম্বর, এভাবে আটঠারা পর্যন্ত । সদস্যসংখ্যা দিয়ে নির্ণীত নয় ইউনিয়ানের নম্বর । কুলি ব্যারেকে ফেরার পথে যে ইউনিয়ান দপ্তরের সাইনবোর্ড সবচে প্রথমে পড়ে, সেটা এক লম্বর । মিল থেকে যে সাইনবোর্ডটা সবচে দূরে অথচ কুলি ব্যারাকের কাছে সেটা আটঠারা লম্বর । অ্যাতো ইউনিয়ান আত তার অ্যাতো আংরেজি খটমট নাম বাড়ছে দিনকে দিন, যে, নামের বদলে লম্বর মনে রাখা সহজ । তাছাড়া মনে রেখেই বা কী হবে ! সব কটা তো মালিকের চামচা । অনেকে একই সঙ্গে মালিক আর সরকারের চামচা ।
চামচাদের বাদ দেবার জন্যে কিছু মজুর একটা নতুন ইউনিয়ান চালু করতে চাইছেন । সরকার অবশ্য ওনাদের দরখাস্ত মঞ্জুর করেননি । এক লম্বর ইউনিয়ানের নেতা নীরেন মজুমদার আর দুলম্বর ইউনিয়ানের নেতা সুব্রত দাশমুন্সি বলেছেন যে আমরা পশ্চিমবঙ্গকে ডি-ইনডাসট্রিয়ালাইজ হতে দেব, কিন্তু এসব বিকল্পবাজির নামে ডি-ইউনিয়ানাইজ করা চলবে না । চটকল থাকুক বা না থাকুক, ট্রেড ইউনিয়ান না থাকলে নেতা খাবেন কি ? অ্যাঁ ? আগে চটকল না আগে আদর্শ ? অ্যাঁ ? আদর্শের জন্যে প্রাণ যায় যাবে । ওই তো এলটিটিই উলফা জেকেএলএফ আলউমমা সিমি ওনারা তো জান লড়িয়ে দিচ্ছেন আদর্শের জন্যে । ওনারা কি নিজেদের দেশের চটকল আগলে বসে আছেন ? অ্যাঁ ? তবে ? আদর্শের বিকল্প হয় না । তবে হ্যাঁ, ইচ্ছে করলে আদর্শকে এক থেকে আটঠারা লম্বরে ভাগাভাগি করে নেয়া যায় । যখন যে আদর্শের সরকার বাহাদুর, তখন সে আদর্শ বেশি তোলা আদায় করবে । তোলা মানে দান । দান মানে কিন্তু তোলা নয়, পার্থক্যটা বুঝতে হবে, না বুঝলে আদর্শকে হৃদয়ঙ্গম করা যাবে না ।
মিলগুলোও তোলা আদায় করে । এলিজাবেথ জুট মিলে কাটৌতি হয় । সব মিলে হয় না তা বলে । যেখানে লম্বরদার ইউনিয়ানদের সঙ্গে মালিকে কাটৌতির চুক্তি হয়েছে, সেখানে হয় । কোন চটকলে কত কাটৌতি হয়, তা লেখা আছে হাজিরাবাবুর ব্যক্তিগত ডায়েরিতে :-
প্রেমচাঁদ : মাসিক ৯০০ টাকা
তিরুপতি : মাসিক ৮০০ টাকা
শ্রীহনুমান : মাসিক ৩৭৫ টাকা
নর্থব্রুক : মাসিক ১২৫ টাকা
কানোরিয়া : মাসিক ৩৩০ টাকা
শ্রমিকরা তাই লম্বরদারদের ছেড়ে নিজেদে বিকল্প ইউনিয়ান গড়তে চাইছেন । শালা প্রলেতারিয়েত, তোর এত বড় বুকের পাটা ? পাতিবুর্জোয়াদের নেতৃত্ব অস্বীকার করে তুই নিজেই ইউনিয়ান গড়তে চললি ? এ যে কি বিপদ তা সত্য আচার্য জানেন । মিলে চাকরিকরছেন আজ প্রায় তিরিশ বছর হতে চলল । এলিজাবেথ জুট মিলের দেখাদেখি অন্য মিলগুলোতেও বিকল্প ইউনিয়ানের ভুত শ্রমিকদের ঘাড়ে চাপেছেন । মিলের শরীর যত খারাপ হয় তত বেশি বিকল্প ইউনিয়ানের সম্ভাবনা । বিকল্প ইউনিয়ানের নামে কোনো সংস্হাকে যাতে রেজিস্ট্রেশান দেয়া না হয়, তাই মন্ত্রীর দরবারে তদবির করেছিলেন এক থেকে আটঠারা লম্বরের সব লম্বরদাররা। দরখাস্ত এখন মাকড়সার জালে । মন্ত্রীরা জানেন মাকড়সার জাল এক রকমের শিল্প, কত যত্নআত্তি করতে হয় তাকে টিকিয়ে রাখতে ।
মন্ত্রী কথা দিয়েছেন । বলেছেন, উনি নিজেও এককালে লম্বরদার ছিলেন । কোনো লম্বরদারের পোঁদের তলা থেকে কুর্সি সরিয়ে নেয়া যে কত বড় বজ্জাতি তা তিনি জানেন । ফলে এলিজাবেথ জুট মিলে সাসপেনশান অব ওয়ার্কের নোটিস নিশুতিরাতে ঝুলে যায়, কিন্তু লম্বরদারদের কুর্সি বজায় থাকে । সাসপেনশান অব ওয়ার্কের নোটিস ঝুললে, মজুররা মাইনে না পেলে, সতে আচাজ্জির উপরি তো গেলই, নিজের চাগরিটা হারাবার ভয়ও চাগিয়ে ওঠে । এসব ভাড়াটে মালিকদের মতিগতি শেয়ার বাজারের ওঠানামার মতন চলে । কখন যে কে ছাঁটাই হয়ে যাবেন ঠিক নেই । পি-এফ এর টাকা কাটে মাইনে থেকে, সরকারে জমা না দিয়ে মালিক নিজে হড়পে নেন । ই এস আই এর টাকা হড়পে নেন । তারপর কেটে পড়েন ভাড়াটে মালিক । মারা টাকায় কোথাও মল বা মাল্টিপ্লেক্স খোলেন। অন্য ভাড়াটে মালিক আসেন । এভাবেই চলতে থাকে । কোন চটকল কতটা হড়পে নিয়েছে সেসব লেখাজোখা আছে হাজিরাবাবুর ব্যক্তিগত ডায়েরিতে ।
চটকলের নাম………..কত টাকা প্রভিডেন্ট ফাণ্ড হড়পেছে……কত টাকা ই এস আই হড়পেছে
অম্বিকা………………২৩৯ লাখ………………………………… -……………………………
মেঘনা………………..৫২৪ লাখ…………………………………২০৫ লাখ…………………..
অ্যাঙ্গাস……………….৭৭৬ লাখ………………………………..৩১৩ লাখ…………………
ভিক্টোরিয়া……………৭২৪ লাখ…………………………………২ লাখ……………………..
নদিয়া…………………২০৯ লাখ……………………………….২০১ লাখ……………….
কাঁকিনাড়া……………..৫৩৮ লাখ……………………………..৪৯ লাখ……………..
ইস্টার্ন…………………..৭০ লাখ……………………………….১৩০ লাখ………..
গৌরীশঙ্কর……………….১০৯ লাখ……………………………১৬৭ লাখ……….
হাওড়া…………………….১৯৩ লাখ…………………………..১৬৭ লাখ……..
বরানগর………………….৫৭৮ লাখ…………………………..২৭৮ লাখ………
ডেল্টা……………………..৮২ লাখ……………………………১৮ লাখ…………..
নৈহাটি…………………….৪০ লাখ……………………………৩ লাখ………….
আগড়পাড়া………………২৯১ লাখ…………………………..১২৭ লাখ………….
শ্যামনগর………………….৬৯৮ লাখ………………………. – ………………..
গৌরীপুর……………………১২৩৬ লাখ……………………..২৫৮ লাখ………
কেলভিন……………………৪৯৪ লাখ………………………….২৫২ লাখ………
টিটাগড়…………………….৭৫১ লাখ………………………….৩৩৬ লাখ……..
নিউ সেন্ট্রাল……………….৭৫২ লাখ…………………………..১২ লাখ……..
নর্থব্রুক…………………….৮৫ লাখ……………………………৬০ লাখ……
বজবজ……………………….২০৭ লাখ…………………………২৬ লাখ……
কামারহাটি……………………২২ লাখ…………………………..৮৪ লাখ…..
অ্যাংলো ইন্ডিয়া……………….২৫ লাখ………………………..১৬ লাখ……………….
কানোরিয়া……………………..৭৭ লাখ………………………..৩৬ লাখ…
হাজিরাবাবু নিজের ডায়েরিটার মলাট দেখলেন । পাঁচ বছর আগের । ওঃ । এই পাঁচ বছরে তো সংখ্যাগুলো নির্ঘাত দ্বিগুণ হয়ে গেছে । তাঁর নিজে, এলিজাবেথ জুট মিলে, উনি জানেন, কোনো হিসেব-নিকেশ নেই এসব খাতে । জেনারাল ম্যানেজারকে জিগ্যাস করেছিলেন একবার । উনি বললেন, ফি নির্বাচনে পার্টি ফাণ্ডে যে দান করা হয়, তা তো এই সব অ্যাকাউন্ট থেকেই বের করতে হয় । হক কথা । মালিক কেনই বা গাঁটের কড়ি খরচ করে এইসব পার্টিগুলোর নির্বাচনী তহবিলে টাকা ঢালবেন । কেন্দ্রে যাঁরা সরকার গড়বেন তাঁদের দিতে হবে, যাতে আয়কর বিক্রয়কর আবগারি করের ঝূঠঝামেলা না পাকায় । যাঁরা রাজ্যে সরকার গড়বেন, তাঁদের না দিলে টিকে থাকা মুশকিল করে দেবেন । তার ওপর আবার নেতাদের খাইখরচ মদ-মাগি আছে ।
হাজিরাবাবু এই বছর দশেক হল রোজনাচা লিখে রাখছেন নিজের ডায়েরিতে, কেননা ওনার দাদুর একটা অনিয়মিত ডায়েরি ওনাকে উৎসাহিত করেছিল । ঠাকুর্দা পুলিশে চাকরি করতেন, সুরাবর্দি সাহেবের পুলিশে, বিশেষ লেখাপড়া করেননি । কিন্তু তাঁর ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৭-এ লেখা রোজনামচা পড়ে বেশ গদগদ হয়েছিলেন হাজিরাবাবু, দাদুর ডায়েরির পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেছিলেন বিশে ফেব্রুয়ারির খতিয়ান পড়ে ।
সতে আচাজ্জির দাদু লিখেছিলেন :
“অদ্য মনের সুখে মানুষ হত্যা করিলাম। খাঁপুর গ্রামে কতিপয় চাষা এক অদ্ভুত আন্দোলন করিতেছিল । তাহার নাম তেভাগা আন্দোলন । দারোগাবাবু আমাদিগে চিরির বন্দর থানার বাজিতপুরে গত চৌঠা জানুয়ারি কৃষকগণ কর্তৃক পুলিশ হত্যার ঘটনা সবিস্তারে বর্ণনা করিয়া উত্তপ্ত করিয়া রাখিয়াছিলেন । জিপে বসিয়া আমরা গুলি ভরিবার সময়ে নির্ণয় লইয়াছিলাম যে চিরির বন্দরে নিহত দারোগাবাবুর আত্মার সদ্গতির উদ্দেশে অদ্য প্রতিশোধ লইব । আমরা ১২১ রাউণ্ড গুলি চালাইয়া মাত্র কুড়িজনকে হত্যা করিলাম, করিতে বাধ্য হইলাম । গাড়ি যাহাতে ভিতরে প্রবেশ না করিতে পারে, সেহেতু গ্রামবাসীগণ গ্রামের কাঁচা রাস্তা কাটিয়া রাখিয়াছিল । তির ধনুক দা বল্লম লইয়া গ্রামবাসীগণ আমাদের দিকে ছুটিয়া আসিতেছে দেখিয়া আমরা গাড়িতে বসিয়াই গুলি চালাইলাম । আমার গুলির টিপ অব্যর্থ বলিয়া আমিই প্রথম গুলি চালাইলাম । থ্রি নট থ্রি রাইফেলের ম্যাগাজিনে পাঁচটি বুলেট ছিল । চাষাদিগের নেতা চিয়ারসাই শেখ আমার গুলি খাইয়া লুটাইয়া পড়িল । তারপর আমাদের গুলি একে একে ভেদ করিল গুরুচরণ বর্মণ, কোল কামার, হপন মার্ডি, কৈলাস ভূঁইমালিকে । আমি উহাদের শহিদ করিলাম । আমার জন্যই উহারা শহিদ হইল, হয়ত অমরত্ব প্রাপ্ত হইবেক । এতদ্বারা প্রমাণিত হয় যে কোনো মানুষই স্বেচ্ছায় শহিদ হইতে পারে না । তাহাতে অন্যের অবদান থাকে । তাং ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৭ ।”
দাদুর ডায়েরি বহুবার পড়েছেন হাজিরাবাবু । রোজনামচার এই কুড়ি তারিখের লেখাটা যে কতবার পড়েছেন তার ইয়ত্তা নেই । সত্যি তো । কোনো লোকই নিজে থেকে শহিদ হন না । শহিদ হতে হলে প্রতিপক্ষ চাই । প্রতিপক্ষ দিয়ে বিচার হয় যে কে শহিদ আর কে শহিদ নন । চিরির বন্দরে দারোগাবাবুর ওভারকোট ফুঁড়ে ওনার বুকে তির ঢুকে গিয়েছিল ; অথচ উনি শহিদ হলেন না, ওনার নামও মনে রাখেন না কেউ । যাঁরা ওনার দিকে তির ছুঁড়েছিলেন, তাঁদের দলের সমিরুদ্দিন মিয়াঁ আর শিবরাম মাঝি ওনার গুলিতে মরে অমর হয়ে গেলেন । কার জন্যে অমর হলেন শুনি ? প্রতিপক্ষের জন্যে । কলকাতা শহরের নর্দমার ধারে-ধারে যে লাল বা কালো বা শাদা মিনি শহিদবেদি আছে, সেগুলো কার কেউ জানে না, কিন্তু সবাই জানে যে ওগুলো হবু-শহিদ বনাম প্রতিপক্ষের খুনোখুনির পরিণাম ।
কাংগাল চামার কিন্তু শহিদ হতে পারেননি । প্রতিপক্ষ পুলিশ হওয়া সত্ত্বেও হননি উনি শহিদ । একজন নয়, দুজন নয়, পুরো থানার কন্সটেবল আর অফিসাররা ওনাকে কড়িকাঠ থেকে উল্টো টাঙিয়ে এত মার মেরেছিলেন, যে হাড় গুঁড়ো-গুঁড়ো হয়ে গিয়েছিল, মুখ বেঁকে গিয়েছিল । উনি শহিদ হতে পারলেন না, কেননা এক্ষেত্রে প্রতিপক্ষের হাতেই তো শহিদ নির্ণয়ের ভার । শহিদের তকমা দেয়ার দায়িত্ব যাদের হাতে, তাঁরাই কাংগাল চামারের খুন হবার ঘটনাটা ভুলে যাবার, চেপে দেবার, কেস হাপিশ করার চেষ্টায় মশগুল । লোকে দিনকতক পর ভুলে যাবে যে কাংগাল চামার নামে ছিলেন কেউ । এ এক অদ্ভুত ধাঁধা ।
ধাঁধার এখানেই শেষ নয় । গুরুচরণ বর্মনের নাতি, মানে মেয়ে পার্বতীর ছেলে ভাদু রাজবংশি, এখন ঢাকা-বগুড়া থেকে চিনা বোমাবন্দুক এনে কামতাপুরি আন্দোলন করছেন, ব্যাঙ্ক ডাকাতি করছেন বোমাবন্দুক কেনার জন্যে । উনিও মরলে শহিদ হয়ে যাবেন নিজের রাজবংশি লোকেদের মধ্যে, যদিও যে প্রতিপক্ষ পুলিশ কাংগাল চামারকে খুন করেছেন সেই একই প্রতিপক্ষ ভাদু রাজবংশির । ভাদুর দাদামশায় তেভাগা করেছিলেন । ভাদু করছেন কামতাপুরি । মানুষের পৃথিবীটা এরকম কেন ? ফৌজে যেতে চায় না, ছেলেকে কিংবা ভাইকে ফৌজে পাঠাতে চায় না, অথচ লাল ফৌজের গান গায় । রাস্তায় মিছিল বের করে বিপ্লব চাই বিপ্লব চাই বলে চেঁচায়, অথচ মহাকরণের বাইরে বদলি চায় না ।
হাজিরাবাবু বেশ তোতলা । কথা কম বলেন । কম কথা বলেন বলে ভাবেন বেশি । চটের সুতলির মতন বিনা পাকের ভাবনা ।
চটকলের আধুনিকীকরণের জন্যে কেন্দ্র সরকার এক কোটি টাকা দিয়েছিলেন । সেটা হুণ্ডিতে খাটাতে পাঠিয়েছিলেন মালিক । বলেছিলেন সুদ থেকে শ্রমিকদের মজুরি দিতে হবে । সুদ আর আসল এখন দুটোই আটকে আছে হুণ্ডিতে । ম্যানেজার বলেছেন ক্যাশ টাকা না দিয়ে পে-স্লিপগুলো সস্তায় কিনে নেন কয়েকজন লম্বরদার যাঁরা মহাজনি কারবার করেন । মাইনের দিন মানে মদ খাবার দিন । মিলগেটের বাইরেই মদের দোকান । সেটার লাইসেন্স ওই লম্বরদারদের সবচে ঘাগুর । সবাই জানেন ভেজাল দিশি । তবু কিনতে বাধ্য হন শ্রমিকরা কাছেপিঠে অন্য দোকান নেই । অন্য দোকানের লাইসেন্স দেয়া হয় না । আবগারি কর্তারা সমাজকে সুস্হ রাখার কথা ভাববেন, না কি লাইসেন্স দিয়ে খাঁটি মদ খাইয়ে মারবেন শ্রমিকদের । তাছাড়া, চটকলটার শরীর খারাপ হলে মদের দোকানটারও শরীর খারাপ হয় গো ।
এল;ইজাবেধ চটকল আর খুলবে না । শরীর এত খারাপ যে বাঁচবে না । একের পর এক ভাড়াটে মিলমালিক এসে জুটমিলটাকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করেছেন । বি আই এফ আর, মানে বোর্ড অফ ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড ফিনান্সিয়াল রিকন্সট্রাকশানকে ৯৯৪ কোটি টাকার লোকসান দেখিয়েছে মালিক । আই এফ সি আই এর মিল সমীক্ষার ভিত্তিতে চটকলটাকে বন্ধ করার সুপারিশ করবেন কি না ভাবছেন বি আই এফ আর । কোনো ব্যাঙ্ক কিংবা অর্থলগ্নী সংস্হা মিলটাকে টাকা ধার দিতে চান না । আগেকার দেনাই শোধ করতে পারেননি এখনও । কাটৌতি বাবদ শ্রমিকদের তিন কোটি টাকা মেরে কেটে পড়েছেন আগেকার ভাড়াটে মালিক । তার আগের ভাড়াটে মালিক তো শ্রমিকদের ই এস আই, প্রভিডেন্ট ফাণ্ড, গ্র্যাচুইটি, বোনাস বাবদ দুকোটি টাকা মেরে কেটে পড়েছেন ।
বাঁচার এখন একটাই উপায় । আত্মহত্যা ।
উলুবেড়িয়া স্টেশানে বসে আত্মহত্যার চিঠিটা লিখলেন সত্য আচার্য । কিছু একটা না লিখলে বাড়ির লোকেদের নিয়ে টানাটানি করবে পুলিশ-প্রশাসন । তাঁর মৃত্যুর জন্যে যাঁরা দায়ি তাঁরাই টানাটানি করবেন । একজন তো নয় । অনেক । মিল মালিক, কাঁচা পাটের দালাল, লম্বরদার নেতারা, শ্রমিকরা, অর্থলগ্নী সংস্হা, বি আই এফ আর, রাজ্য সরকার, আদালত, কেন্দ্র সরকার, সবাই, সব্বাই ।
চিরকুটটা পকেটে পুরে, রেল লাইনের ধার বরাবর, হাঁটা দিলেন, কোতলবেড়িয়ার দিকে ।
কোতলবেড়িয়ার পঞ্চায়েত প্রধান, জনাকয় লম্বরদার নেতা, জনা পঞ্চাশেক শ্রমিক, গ্রামের বউ-বাচ্চায় এত ভিড় জমে গিয়েছিল যে নিত্যযাত্রীবাহী ট্রেনগুলো জ্ঞানান্বেষণের জন্যে গতি কমিয়ে পার হচ্ছিল অঘটনের জায়গাটুকু ।
ওসি আর কয়েকজন কন্সটেবল অপেক্ষা করছিলেন লাশ তোলার ভ্যান রিকশার জন্যে । পঞ্চানন পাইককে খবর দেয়া হয়েছে । ভ্যান এনেছিলেন পঞ্চানন, কিন্তু থানা থেকে কাতাদড়ি আর ঢাকা দেবার তেরপল আনতে ভুলে গিয়েছিলেন । পঞ্চায়েত প্রধান ঘটনার খবর জানিয়ে দিয়েছেন জেলা কমিটিকে । জেলা কমিটি জানিয়ে দিয়েছেন এম পি আর ডি এমকে । হাজিরাবাবু বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীর হহোয়ায় ব্যাপারটা যাতে রাজনৈতিক না হয়ে ওঠে, তা সামলাতে বলেছেন প্রশাসন ।
কাকগুলোকে কে খবর দিয়েছিলেন কে জানে । নেমন্তন্ন খাবার আশায় সার বেঁধে আসন পেতে বসে গেছেন ইলেকট্রিকের আর টেলিফোনের তারে । একটা কুকুরীও পৌঁছে গেছেন নিজের বাচ্চাগুলোকে কিছু পাইয়ে দেবার আশায় । ধড় আর মুণ্ডু নিয়ে যাবার পর দুচার কুচি মাংস পড়ে থাকবে নিশ্চই ।
বেঁটে মোটা কালো পঞ্চায়েত প্রধান বললেন, চিরকুট-টিরকুট পেলেন নাকি ?
ওসি তাকালেন কন্সটেবলের দিকে, কেননা মর্গে পাঠাবার আগে প্রতিটি মৃতের পকেট হাতড়ানো আর হাতানোর দায়িত্ব তাঁদের ।
–বুক পকেটে একটা কাগজ আছে শ্যার । অন্য পকেটগুলোয় কিছু নেই ।
–দেখুন’দেখুন । আমি আবার তাড়াহুড়োয় চশমাটা ভুলে এসে্ছি ।
একজন কন্সটেবল বুক পকেট থেকে চিঠিটা বের করে দিলে, ওসি সেটি এগিয়ে দ্যান পঞ্চায়েত প্রধানের দিকে । পঞ্চায়েত প্রধান পড়েন চিঠিটা, প্রথমে মনে-মনে, তারপর চেঁচিয়ে সবাইকে শুনিয়ে, “আমি অদ্য স্বেচ্ছায় শহিদ হইলাম, ইতি শহিদ সত্য আচার্য ।”
৪ সুন্দর সুন্দর কাণ্ড-কারখানা, বৃহস্পতিবার
অজস্র কাকের ডাকে ঘুম ভাঙল । বেশি রাত হওয়ায় স্লিপিং পিল খেয়েছিলুম কাল । ভালো ঘুম হয়েছে । মশারির ভেতরে বসেই দেখলুম অঞ্জলিদির বাড়ি, কাস্টমসের চ্যাটার্জির বাড়ি, কাকে চেয়ে আছে । কাকেদের র্যালি । সলিলা নিজের যোগব্যায়াম আরম্ভ করে দিয়েছিল । বলল, পাঁচ-ছ’টা হনুমান এসেছে, আমার ফুলগাছগুলোর দফারফা করে দিয়েছে নিশ্চই এতক্ষণে । পুকুর পাযের দিকের জানলা দিয়ে দেখলুম, অঞ্জলিদির আমগাছে ফিকে-সবুজ বহুলের গন্ধে মৌতাত মৌমাছিরা দোল খেত, তার আর বিশেষ-কিছু অবশিষ্ট নেই । ওপরতলা থেকে স্বর্গীয় সাধনবাবুর নাবালক নাতি দিগন্তর চেঁচামেচি শুনতে পেলুম, স্কুলের গাড়ির অপেক্ষা করার জন্য হনুমানের ভয়ে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াতে চাইছে না । রাস্তার দিকে এসে দেখলুম, দোতলায় দীপ্তিদির বারান্দায় একটা কেঁদো হনুমান শিবুর চায়ের দোকানের দিকে তাকিয়ে বসে আছে । চায়ের ঠেকের বেঞ্চ ফাঁকা । দীপ্তিদি আর ওনার স্বামীর একই সঙ্গে মৃত্যু হওয়ায় দোতলাটা বন্ধ পড়ে আছে ক’বছর । রাত্তিরে ইঁদুর রাজত্বের আওয়াজ পাই।
ফিজিওথেরাপি করতে ইচ্ছে করছিল না । করলুম । কতকাল হনুমান দেখিনি । দেখে মামার বাড়ির কথা মনে পড়ল । ছোটোবেলাকার । পাটনাতে ছোটোবেলায় বাঁদর আসত । ছোটোবেলাকার স্মৃতি আপসেট করে দিলে ।
দুধ গরম করতে আর চায়ের জল বসিয়ে দাঁত মেজে নিলুম । ফ্রিজে দেখে নিয়েছি, বাজার যাবার দরকার নেই, অনেককিছু মজুত ।
চা খেতে-খেতে কালকে যে চিঠিগুলো এসেছে, সেগুলো রেসপণ্ড করলুম ।
আশুরালি গ্রামোন্নয়ন পরিষদের সম্পাদক অমৃতলাল পাড়ুই, পরিষদের পত্রিকার জন্য ‘বর্তমান গ্রামজীবনে হাংরি আন্দোলনের প্রাসঙ্গিকতা’ বিষয়ে একটা প্রবন্ধ চেয়েছেন । ভালো লাগল । এভাবেও তাহলে চিন্তা করা হচ্ছে । লখনউ থেকে মে মাসে ফিরে ভাবব কী করা যায় । গ্রামোন্নয়নের বিষয়ে পরামর্শদাতা হবার অনুরোধ করেছেন। অবসর নেবার পর গ্রামোন্নয়ন আর তার রাজনীতির সঙ্গে যোগাযোগ কমে এসেছে । উত্তর লিখে দিলুম ।
কমল চক্রবর্তী ‘কৌরব’-এর জন্যে সপ্তার সাত দিন কী ভাবে কাটাই লিখে পাঠাতে বলেছে । এক সপ্তাহের রোজনামচা । সব্যসাচী দেব ‘দেশ’ পত্রিকায় পঞ্চাশজনের তালিকায় কমলের পাঠকৃতি উল্লেখ করেননি । প্রাক্তন নকশালরা পশ্চিমবঙ্গের লায়াবিলিটি । বিভিন্ন রাজ্যের দুর্গম অঞ্চলে এঁদের পুনর্বাসন দেয়া যায় না কি ? অভিজ্ঞতার জন্য ? কমল বড় দয়ালু, কাউকে আঘাত দিতে চায় না । যদিও সবাইকে তোয়াজ তদবির করে । ‘আজকাল’ পত্রিকা পুজো সংখ্যার জন্যে কমলের উপন্যাস চেয়েছিল । সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় ল্যাং মেরে দিয়েছেন ; অথচ কমল কত-কত চিঠি দিয়েছে সন্দীপনকে আনুগত্য জানিয়ে । কমলকে পরে চিঠি লিখব ।
‘অজন্তা’ পত্রিকার সম্পাদক রজতশুভ্র গুপ্ত অনুমতি চেয়েছেন আমার পাঠানো কবিতা ‘পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে বাঁচাতে হলে লিরিক লেখকদের হত্যা করতে হবে’ শিরোনামটা ছোটো করে ‘লিরিক লেখকদের হত্যা করতে হবে’ অংশটা বাদ দেবার জন্য । এমব্যারাসমেন্টের কারণটা বুঝতে পারলুম না । আমি কি বার্ধক্যে আক্রান্ত ? রজতশুভ্র তো আমারই বয়সী !
সকালে চিঠিপত্র নিয়ে বসলে পড়াশুনা ব্যহত হয় । একটু পরে সম্ভবত সুকান্ত ঘোষাল আসবে ‘চারুলতা’ পত্রিকার জন্য কবিতা নিতে । কপি করলুম কবিতাটা । ‘চারুলতা’ বইমেলা সংখ্যাটা পড়িনি এখনও । অনেক পত্রিকা জমে গেছে । সবকটা পুরো পড়া হয়ে উঠবে না । সুকান্ত কাজ করে কলকাতা পুরসভায় । অমন একটা পাঁকে চাকরি করে মিষ্টি-মিষ্টি কবিতা লেখা চাড্ডিখানি কথা নয় ।
বিশ্বাসকারীরা অবিশ্বাসীদের মগজে ঈর্ষার উদ্রেক করে কেন ?
তাবৎ শ্রোতাকে ‘বন্ধুগণ’ সম্বোধন কবে থেকে শুরু হল ? বন্ধুগণ, পোঁদে লাথি নিন ।
সলিলা বলল, ‘আজ বোধহয় সরস্বতী আসবে না ।’ কালের বউ । দু’জন মাত্র । তাই অসুবিধে নেই । সরস্বতী হিন্দু না মুসলমান, সলিলার সন্দেহ আছে, কেননা বাংলাদেশি মুসলমান ছাড়া সস্তার ঝি পাওয়া যায় না । হিন্দু ঝিদের রেট আর ন্যাকরা বেশি ।
ব্রেকফাস্ট সলিলাই রেডি করল, আমি কাগজপত্র ছড়িয়ে বসে আছি দেখে । শশা, পাঁউরুটি । ব্লাডপ্রেশার আর হার্টবিটের অ্যাংমলোপিন, লোপ্রিন, ডিলকনটিন, অ্যানজিনেক্স, লিসটিরিল, ফ্ল্যাভিনডন ।
টেলিফোন বাজল । প্রতিবেশী চৌধুরীর স্ত্রী । কাজের বউ এসেছে কি না জানতে চাইলেন । বললেন, ‘আজকে আবার চাদর-মশারি ডুবিয়েছি।’ এ-পাড়ার যাংবতীয় গাছগাছালি কাটিয়ে সাফ করে দিচ্ছেন চৌধুরীবাবু । কলকাতার ওপর অধিকার ব্যক্ত করার অবচেতন ডায়াসপোরিক বহিঃপ্রকাংশ ।
কলিংবেল । ‘কাভিতা’ পত্রিকার ষাটোর্ধ সম্পাদক সুপ্রিয় বাগচি । ওর দাদা নারায়ণ বাগচি মারা যাওয়ায় বেশ বিপর্যস্ত । দশ-পনেরোটা বেড়ালের মধ্যে একটা কাল মরেছে, আর একটা পালিয়েছে, তাই মন খারাপ । দাদা মারা যেতে নিচেতলার জবরদখলকারী পরিবারগুলো ওকে উৎখাত করে ওপরতলাটা দখল করতে চাইছে । রাতদুপুরে টালি খুলে নিয়ে চলে যায় । কাঠের সিঁড়িটার কয়েকটা ধাপ ভেঙে দিয়েছে তারা । নে, এবার ওঠ ওপরে । গেটে তালা মেরে দ্যায় যাতে ও বেরোতে না পারে । অভিযোগ নিয়ে এক কমরেডের কাছে গিয়েছিল । তা তিনি নাকি বলেছেন, ‘দ্যাখেন আমি তো উদ্বাস্তুদের নেতা আর আপনে এ-দ্যাশের লুক…।’ বেচারা সুপ্রিয় । নিজের কথা বলে চলল । প্রতিবার একই কথা । যেতে-যেতে বলল, একা থাকতে-থাকতে পাগল হয়ে যাচ্ছে ও । তারপর হঠাৎ, ‘বিয়ে করছি ।’
সুপ্রিয় বাগচি যে বাড়িটার ওপরতলায় থাকে তার নাম ডালগিশ হাউস । ডালগিশ নামে এক ব্রিটিশ সায়েব থাকতেন বাড়িটায় । সুপ্রিয়র ঠাকুর্দা তাঁর সচিব ছিলেন । দাদু মারা যাবার পর সুপ্রিয়র মা-বাবা থাকতেন ওদের নিয়ে । তারপর তো দেশভাগ হল ; অত বড় বাড়ির নিচেতলাটা দখল করে নিলে উদ্বাস্তু পরিবাররা । সেসব পরিবারকে খাবার-পরার খরচ যোগাতেন তাঁরা । তাঁরা মারা যেতে সুপ্রিয় আর ওর দাদা পড়েছিল বেকায়দায় । দাদা তো দিব্বি কেটে পড়ল । এখন অনাথ সুপ্রিয় বিয়ে করে সনাথ হতে চাইছে ।
মুর্শিদকে টেলিফোন করলুম । ‘নামগন্ধ’ উপন্যাসটা ঢাকা থেকে এসে গেছে জানাল । ‘ক্যাম্প’-এ পাওয়া যাচ্ছে । শনিবার এনে দেবে । ‘দিশা’ পত্রিকার দামটা দেয়া হয়নি ওকে । জহর সেনমজুমদার আর শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিল ‘দিশা’ পত্রিকা নিয়ে আসবে আড্ডা দিতে । ওদের বলা হয়নি মাসখানেকের জন্যে বাইরে যাচ্ছি । ‘রক্তকরবী’ পত্রিকার প্রদীপ ভট্টাচার্য ‘নামগন্ধ’ উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি পড়ে বলেছিলেন, ‘ও তো সেই একঘেয়ে অরিন্দম আর অতনু।’
পুরো সকালটা নষ্ট হল । লেখা, পড়া, কিছুই হল না । সওয়া বারোটা বাজে । ঝুল হয়েছে বেশ, দেখে, ঝেড়ে ফেললুম । সিঁড়ির মুখটাও ।
রান্না সেরে সলিলা বাথরুমে । বলল, ভাত চাপিয়ে দাও, আর জামাকাপড় কি আছে কাচাকাচির দিয়ে দাও । শর্টস আর গেঞ্জি খুলে দিয়ে দিলুম । উলঙ্গ । ভাতের জল চাপালুম । এই ফ্ল্যাটটার চারিদিক খোলা হওয়া সত্ত্বেও উলঙ্গ থাকা যায় । এই সময়টা উলঙ্গ থাকার অভ্যাস হয়ে গেছে । আঠারো মিনিটে হয়ে গেল ভাত । ফ্যান গেলে উপুড় করে রাখলুম ডেকচি । ফ্রিজের জল বাইরে বের করে রাখলুম যাতে খাবার সময়ে নাতিশীত লাগে ।
তোয়ালে পরতে হল । কাচা কাপড়গুলো শুকোতে দিলুম বারান্দায় । সামনের বাড়ি থেকে মনুর বিধবা ননদ, একা থাকেন, রোজই দেখেন কাপড় সোকাচ্ছি, আজও দেখলেন । আমার হার্টঅ্যাটাক হতে সলিলাকে বলেছিলেন, ‘একা কী করে কাটাবে?’ মনু সলিলার জামাইবাবুর বোন । উনিই এই ফ্ল্যাটটা কিনিয়েছিলেন । স্বামী, যিনি অতীব সুপুরুষ এবং বেকার ছিলেন, মারা গেছেন । মনু অফিসে চলে গেলে ওর বড় ছেলে নিজের বাজনাদলের মহড়া জমায় । ‘ম্যায় তো রাস্তে পে যা রহি থি’ চলছে পুরো দমে ।
তোয়ালে কাঁধে ফেলে ডাইনিং টেবিল সাজালুম । চান করলেই খিদে পায় । কালকের চচ্চড়িটা ফ্যানের ডেকচির ওপর রেখে দিলুম । সামান্য আচারের তেলে সাঁতলে নিলে চচ্চড়ির স্বাদ-সুগন্ধ হত । কিন্তু বারণ । ইলিশ, চিংড়ি, রেডমিট, কাঁকড়া, আচার, তেলেভাজা, বিয়ার, ভেরমথ, ওয়াইন, মাখন, ডিম ।
চান করে খেয়ে নিলুম । অনেক আইটেম । নিমবেগুন, পালংশাক ভাজা, চচ্চড়ি, বেগুন আলু সজনেডাঁটা, কাতলা মাছ, টমাটোর চাটনি, দই । শেষের দুটো যদিও বারণ ।
নিচে থেকে ডাকবাক্স খুলে ‘সাহিত্য সেতু’ আর ‘অনুত্তর’ পত্রিকা নিয়ে এলো সলিলা । আর অড্রীশ বি৯শ্বাস, কাজল সেন, নাগপুর থেকে বড়দির চিঠি । মনু এই বড়দিরই ননদ ।
কার্তিক ঠাকুর সম্পর্কে অসাধারণ প্রবন্ধ ছেপেছেন জগবন্ধু কুণ্ডু ; জানতুম না কলকাতার উকন্ঠে কার্তিকের এমন রমরমা । সমুদ্রগুপ্তের ষণ্ডামার্কা কালোপাথরের কার্তিককে নিজের ছোটোছেলে মহাদেবের আদলে ফর্সা আর সৌম্যকান্তি জমিদারি রূপ দিয়েছিলেন লক্ষ্মীকান্ত । ‘নামগন্ধ’ উপন্যাসের ব্যাকড্রপ রাঢ় রেখেছিলুম । এই এলাকায় সবচেয়ে বেশি ঘোরাঘুরি করেছি । আমাদের পূর্বপুরুষ রত্নেশ্বর রায়চৌধুরী শ্যাওড়াফুলির রাজা মনোহর রায়চৌধুরীর কাছ থেকে চকবালির অংশ পেয়ে উত্তরপাড়া শহরের পত্তন করেছিলেন । তাও একটা কারণ । তাছাড়া ঠাকুর্দার বাবা বিধবা বিয়ে করেছিলেন । লক্ষ্মীকান্ত রায়চৌধুরী, যিনি সাবর্ণ চৌধুরীদের আদিপুরুষ, তাঁর ঠাকুর্দা পঞ্চানন গঙ্গোপাধ্যায় হুগলির গোহাট্য-গোপালপুরে থাকাকালে যোগ দিয়েছিলেন হুমায়ুনের সৈন্যবাহিনীতে ।
এখন তো প্রেমে না পড়লে ছেলেরা বিধবা বিয়ে করবে না । আর তখনকার দিনে নিগোশিয়েট করে বিধবা বিয়ে । সামাজিক সাহস এখন মস্তানিতে এসে ঠেকেছে । অধঃপতনের নাম প্রগতি । অনুশ্রী পাঞ্জাবি ছেলে প্রশান্তকে বিয়ে করে উচিত কথাই বলেছিল, ‘দ্য ব্লাড স্পিকস ফর ইটসেল্ফ’ ঠাকুর্দার বাবার দ্রৌঐর সঙ্গে সম্পর্ক জুড়ে ।
যৌধেয়, কুষাণ, গুপ্ত সম্রাটদের কালো রণদেবতা কলকাতার উপকন্ঠে এসে ফর্সা লালটুশ চেহারায়, কোঁচানো জরিপাড় ধাক্কা-দেওয়া ধুতি আর কল্কাদার পাঞ্জাবি গায়ে মোমমাজা গোঁফে কার্তিক ঠাকুরে রূপান্তরিত । দেবতার নামও বাবু কার্তিক, হুগলির বাজার ঘাতে আড়াইশ বছর পুজো হচ্ছে । মহাকালীতলা, রথতলা, সুরকিমিল, খামারপাড়ায় পূজিত দেবতার নাম জামাই কার্তিক । রাজা কার্তিক, অর্জুন কার্তিকও রয়েছেন । মাল্টিভোকাল কার্তিক ঠাকুরের অঞ্চলে সাহিত্যভাষার উদ্ভব স্বাভাবিক । জামাই কার্তিক আসলে লক্ষ্মীকান্তর বড় জামাইয়ের আদল । দেবী-দেবতারা যখন প্রকৃতির অংশ ছিলেন, তখন তাঁদের মুখাবয়ব-আকার ছিল অস্বাভাবিক, অলৌকিক । ইংরেজরা এনলাইটেনমেন্ট এনে পুরো ব্যাপারটা মানবিকে পালটে ফেলেছে ।