ডিটেকটিভ নোংরা পরির কংকাল প্রেমিক
- Get link
- X
- Other Apps
টেকটিভ নোংরা পরির কংকাল প্রেমিক
উৎসর্গ : কবি অসীম অধিকারী, প্রিয়বরেষু
অলৌকিক প্রেম ও নৃশংস হত্যার রহস্যোপন্যাস ( ১৪টি পর্বে আছে )
অক্টোবর 2, 2012 – 1:33 অপরাহ্ন ক্যাটাগরিসমূহ: Detective story | Comments (2)Tagged ডিটেকটিভ উপন্যাস |
Tagged ডিটেকটিভ উপন্যাস |
১. পলাতকার উড়াল
তারিখটা আজও মনে আছে : পয়লা সেপ্টেম্বর ।
মেট্রো রেল স্টেশানের চত্বরে দাঁড়িয়ে, মোবাইলটা পকেটে আছে কিনা চেক করছি, একজন তরুণী খপ করে বাঁ হাত ধরে বলে উঠল, ‘চলুন পালাই’ । খপ, এই শব্দটাই মাথায় এলো , অব্যর্থ শব্দ । ডেস্কটপের কি-বোর্ড পর্যন্ত শব্দটাকে নতুন মানে দিয়ে ফেলছে , স্পষ্ট অনুভব করছি । মুখে বললে অশ্লীল শোনাবে এই খপ শব্দটা ; কিন্তু হাত ধরার প্রক্রিয়ায় তো ওই আধ্যাত্মিক ইন্দ্রজাল লুকিয়ে ছিল । ইঁটের তলাকার ঘাসের মতন, রহস্যময় ।
‘চলুন পালাই’ কথাটার জন্যে নয় , বা, ডান হাতের কব্জিতে শক্ত মুঠোয় ধরার, ধরে থাকার কারণে , আমার মুখমন্ডলে যে ভাব ছড়িয়ে পড়েছিল, তা ভয়, ভীতি, অতিপরিচিত ভীতি, রক্তশূন্যতা, অথচ অজানা আশঙ্কা, বিপদের পূর্বাভাস না অন্য কিছু , তা স্মৃতিতে আর ফিরিয়ে আনতে পারছি না যদিও । ব্রহ্মাণ্ড নিশ্চই ভয় থেকে সৃষ্টি হয়েছিল । শব্দহীন, বর্ণহীন, গন্ধহীন, বাতাসের স্পর্শহীন, স্বাদবস্তুহীন পূঞ্জীভূত ভয় , সীমাহীন অন্ধকারে শূন্যবিন্দুতে ঘন হয়ে ওঠার ভয় । স্টেশানের বাইরে দাঁড়িয়ে আমি নিজেকে আবিষ্কার করলুম সেই শূন্যবিন্দুতে । হঠাৎ । আচমকা, এক নিঃশব্দ হিমশীতল বিস্ফোরণ । পয়লা সেপ্টেম্বর ।
তরুণী ফোটোক্রোমেটিক চশমায় , কাচের নিচের দিকটা ফিকে বলে গভীর চোখ দুটোয় প্রশ্নময়তার ঝিলিক । মাথাভরা কোঁকড়ানো চুল । আমার চেয়ে চার-পাঁচ ইঞ্চ ছোট ; দামি ব্র্যান্ডেড ফেডেড জিনসের ওপর সিল্কের ঢিলেঢালা টপ । আমার চেয়ে এক পোঁচ কম ফর্সা , কানে ছোট-ছোট হীরের তারা, ডান হাতে পুরুষালি ঘড়ি, বিদেশি দামি ঘড়ি — ওই হাতেই লুকিয়ে ছিল খপ শব্দটা । পাতলা ঠোঁটে হালকা গোলাপি লিপ্সটিক ছাপিয়ে শ্লেষের মৃদু হাসি, বলল, কী হল ? লেট আস রান অ্যাওয়ে, চলুন পালাই ।
বিন্যস্ত, মনস্হিতিকে শান্ত করতে , স্বাভাবিকভাবে, সময় লাগছিল । আমার প্রতিক্রিয়া উপভোগ করছিল স্মার্ট তরুণী । স্পষ্ট করে বলল, দেখুন, কত কাওয়ার্ড আপনি । নিজের কাওয়ার্ডাইসের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন না বুঝি ? প্রতিদিন তো তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেন আমায় । সারাদিনে বেশ কয়েকবার কাছাকাছি ঘোরাফেরা করেন , বুঝতে পারি কথা বলার সুযোগ খুঁজছেন ; এখন কী হল !
সম্বিত ফিরে পেতে যতক্ষণ । আমাদের ডিপার্টমেন্টের মায়া পাল । কয়েক মাস হল এই বিভাগে জয়েন করেছে । অফিসে তো ইংরেজিতে ছাড়া কথা বলে না , কনভেন্ট স্কুলের ইংরেজি । ওদের সেকশানে গেলে ফিরে-ফিরে চোখ চলে যেত তরুণীটির দিকে । চার্মিং । সুন্দরী না হয়েও আকর্ষণীয়া । হাঁটার, কথা কইবার ঢঙে গর্ব ছলকায় , সম্ভবত উচ্চশিক্ষায় ভালো ফলাফল করার, অঢেল মাইনে পাবার, গোমর , তখন ভাবতুম । মানুষের ভেতরের আলোর খবর সেসময়ে আমার জানা ছিল না । শুনেছিলুম, নানা চাকরি বদল করার অভ্যাস আছে তরুণীটির , একটি থেকে আরেকটিতে লাফিয়ে-লাফিয়ে বর্তমানে বছরখানেক আমাদের অফিসে । প্রতিষ্ঠান হিসাবে অফিস জিনিসটার আর গুরুত্ব নেই । চাকুরিজীবি নিজেই নিজের ব্র্যান্ড । তা সে যে সংস্হায় কাজ করছে সেটি যতই বিখ্যাত হোক ।
আমি জীবনে ওই একটি চাকরিই করেছি , এ ছাড়া কী করব জানি না বলে চাকরি করা শুরু করেছিলুম । বাপ-ঠাকুর্দা যা ছেড়ে গেছে তা যথেষ্ট । বিয়ে-করা, সংসার পাতা ইত্যাদি সম্পর্কে আমার কমিটমেন্ট ভীতি ছিল । আমি জানতুম যে আমি পলিগ্যামাস । একজন নারীর বাঁধনে নিজেকে আটকে ফেলার আশঙ্কায় প্রেমে পড়ার ব্যাপারটা চিরকাল এড়িয়ে গেছি । আকর্ষিত হয়েছি, কিন্তু গড়াতে দিইনি বেশিদিন । কলগার্লদের তাই আমার ভালো লাগত ; কল গার্ল বলতে আমি আমাদের দেশের বেশ্যালয়ের বেশ্যাদের কথা বলছি না । আমাদের দেশের কথাটা এইজন্যে মনে এলো যে পৃথিবীতে আমাদের দেশের বেশ্যালয়গুলোর মতন ্রকম নংরা পরিবেশ বোধহয় আর কোনো দেশে নেই । শহরের সবচেয়ে উপেক্ষিত পাড়াটি তাদের জন্য বরাদ্দ ; ভারতবর্ষে ।
আমি নিজেকে বলতে শুনলুম, আপনি ঠিক কী বলতে চাইছেন, মানে আপনার কথার আড়ালে কী লুকিয়ে রেখেছেন, ডেসিফার করতে পারছি না । এমনিতেই আমার গলা শুকিয়ে জল বা কোল্ড ড্রিংক্সের চাহিদায় তখন । তার ওপর যারা আসপাশ দিয়ে যাতায়াত করছে তারা যাতে কথপোকথন শুনতে না পায় তাই স্তিমিত কন্ঠস্বরে উচ্চারিত হয়েছিল আমার বোকামি ।
কোনোই হেঁয়ালি করিনি আমি ; জাস্ট লেট আস গেট লস্ট । এবার বুঝতে পেরেছেন ? আমি বলছি, চলুন পালাই, আমাদের এই চেনাজানা ম্যাডনেসের বাইরে পালাই, এমন পরিবেশে যেখানে আধুনিক জগত অনুপস্হিত, যেখানে ভিড় একদম নেই, মানুষ দেখতে পাওয়া যায় না সচরাচর, চেঁচামেচি নেই , আওয়াজ নেই, মানুষের গ্ল্যান্ডের দুর্গন্ধ নেই । অ্যাম আই ক্লিয়ার নাও ? আমার হাতের কব্জি ধরে রেখেই বলছিল মায়া । মনে হয়নি কখনও, ও এরকম চিন্তাকে প্রশ্রয় দিতে পারে, ওকে দেখে কখনও মনে হয়নি যে ও মহানগরীর বিতৃষ্ণায় আক্রান্ত ।
আজ বুঝতে পারি, মহানগরীয় বিতৃষ্ণা নয়, অন্য এক অজানার সন্ধান করেছিল মায়া পাল, যা জানতে পারা আমার ক্ষমতা ওজ্ঞানের বাইরে । আজও জানি না তা কী ।
একজন তরুণী তার সঙ্গে কোথাও উধাও হয়ে যেতে বলছে । কলকাতা শহরে, সকাল নটায়, অফিস যাত্রার দৈনিক ব্যস্ততার মাঝে এরকম একটা অ্যাবসার্ড প্রস্তাব দিয়ে বসল । ঠাট্টা-ইয়ার্কি নাকি হিউমিলিয়েট করার উদ্দেশ্যে, তা স্পষ্ট করার জন্যে বললুম, অকারণে অপমান করবেন না প্লিজ, তরুণীরাই আমার দিকে তাকান, তাকিয়ে থাকেন, কেউ-কেউ কথা বলতে চান, কিন্তু আমি কখনই কাউকে ডিমিন করি না, আমি প্রেমে পড়া ব্যাপারটাও ঠিক অনুমোদন করি না , তা ঘটে বলে তো মনে হয় না ।
হাত ধরে রেখেই মায়া বলেছিল, স্ট্রেঞ্জ, গলার টোন থেকে ধরতে পারছেন না যে আমি সিরিয়াস ? আমি বলছি, চলুন, সব কিছু পেছনে ফেলে চলে যাই কোথাও ; আমরা পরস্পরের সঙ্গে সেরকম পরিচিত নই, সেটা একটা প্লাস পয়েন্ট । কিছুটা তো চিনি একজন আরেকজনকে । বিকেল পর্যন্ত আমরা পরস্পরের পরিচিত হয়ে উঠব । পালাতে হলে এভাবেই পালাতে হয় , হঠাৎ । হঠাৎ একদিন কাউকে না জানিয়ে , এক পোশাকে, পরিচিত জগত থেকে ফ্রিক-আউট করে যাওয়া , বিকামিঙ আননোন, অ্যাননিমাস, ফরগটন । প্রেমে পড়ার কথা তো আসছে না । কী ? ভাবছেন, আমার মাথা খারাপ ? মেন্টাল কেস ? তাহলে এরকম চাকরি পেতাম নাকি ? কত স্মার্ট ক্যান্ডিডেট তো ছিল , তা থেকে মাত্র আমি সেলেক্ট হয়েছিলাম , আপনি তা জানেন নিশ্চই ? এই ধরণের চাকরি আমি চাইলেই পেতে পারি । ভাববার সময় নেবেন না । আমিও ঠিক এক্ষুনি ভাবলাম , পালানো যাক । কাউকে বলি, চলুন পালাই , আপনাকেই সামনে পেলুম । ভাবতে চেষ্টা করবেন না । অত্যধিন চিন্তা মানুষকে দুশ্চরিত্র করে । ও , আমার মুখ দেখতে পাচ্ছেন না ? চশমা খুলে মায়া বলল, নিন, চলুন পালাই, আই অ্যাম ডেড সিরিয়াস ।
আমার মুখ দিয়ে আমতা-আমতা কন্ঠস্বরে বেরিয়েছিল, আমি কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি বক্তা হিসাবে গণিত সম্পর্কে বক্তৃতা দিতে যাচ্ছি ।
ফরগেট ইট, বলেছিল মায়া, জানি আপনি গণিত বিশেষজ্ঞ । ওসব ভুলে যান । গণিত কাজে লাগে না , ইংরেজিরও প্রয়োজন নেই , এরকম জনহীন অঞ্চলে চলে যেতে চাই । তাড়াতাড়ি করুন । আমার কাছে এটিএম কার্ড, ক্রেডিট কার্ড আছে ; আপনার কাছেও আছে নিশ্চই । চলুন, যতটা পারা যায় তুলে নিই , তারপর নিরুদ্দেশের পথে ওগুলোর আর প্রয়োজন হবে না ।
মায়ার পরিবারে কে-কে আছে জানি না , কখনও জানিনি, জানতে চাইনি । আমার তো মা-বাবা মারা যাবার পর কেউ নেই , কেউই নেই । বিশাল বাঙলোবাড়িতে আমি একা । দাদুর বাবার ঘর, দাদুর ঘর, বাবার ঘর, বাবা-মা মারা যাবার পর আর খুলিনি । মায়ের চব্বিশ ঘন্টা কাজের বই সেলিমা বেওয়াকেও ছাড়িয়ে দিয়েছি , কেননা একা একজন যুবতীর সঙ্গে, সে কাজের মেয়ে হলেও, একই বাড়িতে থাকা যায় না । বস্তুত কেউ নেই বলেই চাকরি করি । নয়তো চাকরি করার দরকার ছিল না । মায়া পালকে বললুম, আমি অসৎ, জোচ্চোর, বিশ্বাসঘাতক, দুশ্চরিত্র, ফেরেববাজ, বেপাড়ার যাত্রী কিনা তা তো আপনি জানেন না ।
তরুণী হাসির মৃদু ঝিলিক খেলালেন, ঠোঁট সামান্য খুলে, বললেন, অ্যাডাম আর ইভের গল্প জানেন ? তাদের নাভি ছিল না । আমাদেরও অতীত ঠিক এই মুহূর্ত থেকে আর নেই । আমরা এক্ষুনি স্বর্গোদ্যানে নেমেছি । আপনি অ্যাডাম, আপনি নিষ্পাপ । আমরা তাদের মতনই শাকাহারী । এসব কথা বলার জন্যে তো সারাজীবন পড়ে রইলো । এখন চলুন, যেদিকে পথ নিয়ে যায়, সেইদিকে ।
জানি না কে কাকে সন্মোহিত করেছিল । আমরা নিজেদের অ্যাকাউন্ট থেকে যত বেশি সম্ভব টাকা তুলে, দমদম বিমান বন্দরে পৌঁছে, প্রথম ফ্লাইটের খোঁজ করে, চেন্নাইয়ের বিমানে দুটো সিট পেলুম । টিকিট মায়াই কেটেছিল, মিসেস মায়া পাল আর নিরঞ্জন পালের নামে । বিমানে বসে, মায়া চুপচাপ, হয়তো নিজের ফেলে আসা অতীতকে সম্পূর্ণ মুছে ফেলার চেষ্টায় একাগ্র । মেয়েদের অতীত পুরুষদের চেয়ে ভিন্ন হয় বলে আমার অনুমান । আমি অপেক্ষা করছিলুম ওর কথার, কথা বলার, কেননা নুরুদ্দেশে যাবার আকস্মিক পরিকল্পনাটা ওরই , আমি তো তাতে সঙ্গদান করছি মাত্র । আমার দিকে না তাকিয়েই মায়া বলেছিল, আমরা সারা জীবন নিজেদের সম্পর্ক আপনি-আজ্ঞের পবিত্র গভীরতায় রাখব । তুমি-তুমি ওগো-হ্যাঁগোর ছেঁদো নোংরা রুটিনে বাঁধা পড়ব না
বলেছিলুম, পবিত্র ? এই ধরণের অস্পষ্ট শব্দ ব্যবহার করবেন না প্লিজ ।
মায়া বলেছিল, ঠিক বলেছেন, এবার থেকে করব না ; এই রকম শব্দও তো অতীতকে ধরে রাখার ষড়যন্ত্র ।
মায়ার পাশে বসে একই ভাবনা ঘুরছিল আমার মগজে, যা বহুকাল থেকে বাসা বেঁধে আছে । তা এই যে, আমি একজন কুকুর । যে মালকিনির হাতে পড়েছি, সে যেরকম চেয়েছে, যেরকম গড়েছে, তা-ই হয়েছি : প্রেমের কুকুর, কাজের কুকুর, সেবার কুকুর, গুপ্তচর কুকুর, ধাঙড় কুকুর, কুরিয়ার কুকুর, প্রেডাটার কুকুর , পাহারাদার কুকুর, মানসিক থেরাপির কুকুর, অনধের কুকুর, শোনার কুকুর, শোঁকার কুকুর, চাটার কুকুর, রক্ষক কুকুর, গাড়িটানার কুকুর, আদরের কুকুর, এই কুকুর, ওই কুকুর ইত্যাদি । কিন্তু আমার লেজটা জন্মের সময়ে যেমন আকাশমুখো ছিল, আজও তেমনই আছে । থাকবে । এখন টাইপ করতে বসেও জানি, লেজটা অমনই রয়েছে ।
কুকুরের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আমার । টাকা ফুরোলে তো ফিরতেই হবে আরামের শহুরে জীবনে । না ফেরা পর্যন্ত নিরঞ্জন পাল হয়েই থাকা যাক । মায়া হয়তো সংসারের বেড়ি-শেকল থেকে কিছুদিনের জন্যে মুক্তি চাইছে । চেন্নাইতে নেমে, আমার প্রস্তাবমত, দুটো সস্তা ক্যারিব্যাগ, মোটা চাদর, ফোলাবার দুটো বালিশ, মশারি, দক্ষিণ ভারতীয় সস্তা শাড়ি, স্হানীয়দের মতৌ শাদা আর চাককাটা লুঙ্গি কিনে, স্টেশানের কাছে হোটেলে উঠলুম । মিসেস মায়া বণিক আর নিরঞ্জন বণিক নামে । মায়া কারণ বলেনি এই নতুন পদবির । আমি অনুমান করলুম, পেছনের যাবতীয় ছাপ মুছে ফেলতে চাইছে, প্রতিটি পদক্ষেপের, যাতে কেউ খুঁজে না পায় আমাদের । দক্ষিণ ভারতীয় সাপড়া, মানে ভাত সাম্বর রসম পাঁপড় পাতলা দই খেয়ে মায়া দিব্বি ঘুমোলো সারারাত । কোনো তরুণির পাশে শুয়ে ঘুমোনো , আমার মতন জার্মান শেপার্ড বা কুন হাউন্ডের পক্ষে অসম্ভব ছিল । জেগে রইলুম সারারাত । লক্ষ করলুম, মায়ার কানের হীরের টপ, আর হাতের মোটা চুড়িটা নেই । মায়ার পারফিউমের মায়াবিনী সুগন্ধের স্বপ্নিল পরিমণ্ডলে শুয়ে-শুয়ে সেদিন ভেবেছিলুম, এ কিরকম সম্পর্ক ! এ তো প্রেম নয়, কয়েক ঘন্টার জন্যে কেনা মেয়েমানুষের সঙ্গে শোয়া নয় ল সম্পূর্ণ অচেনা একজন মহিলার পাশে শুয়ে আছি , কেন তার কারণ নিজেই জানি না । মগজে ঘুরঘুর করছে ভাবনার ধোঁয়া ।
কে এই মহিলা ? কী চায় ? ধর্মের ঘেরাটোপে পাগল রমণী ?
পাল যখন তখন বৈষ্ণব নয় বলেই তো মনে হচ্ছে যে গোপন বৈরাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়ল ? ফেডেড জিন্স পরে !
একজন প্রায় অচেনা পুরুষের পাশে শুয়ে নিশ্চিন্তে কী করে ঘুমোতে পারে একজন যুবতী , যে দেখতেও ভাল, এমনকি আকর্ষক ?
জীবন থেকে কিছু চাই ? চাইলে আমার তো তাতে কোনো ভূমিকা থাকার কথা নয় ?
হয়তো আমার ভূমিকা ছকে রাখা আছে, ক্রমশ প্রকাশ্য । দেখাই যাক । একটা উদ্দেশ্য তো হল । বেঁচে থাকার উদ্দেশ্য !
আমি একজন যধবতীর পাশে শুয়ে আছি , অথচ আমার শরীরে কোনো যৌন প্রতিক্রিয়া ঘটছে না । এর আগে কোনো যুবতীর সঙ্গে শোবার প্রস্তুতির পর্ব থেকেই আমার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে আনন্দনৃত্য শুরু হয়েছে । উদ্দেশ্যহীন শুয়ে থাকার অভিজ্ঞতা হয়নি আগে ।
চেন্নাই স্টাশানে পোঁছে, প্রথম ট্রেন পাওয়া গেল নেল্লোরের, তার দ্বিতীয় শ্রেণির টিকিট কেটে উঠলুম । হোটেল মালিকও বলেছিল, হনিমুনের জন্য নেল্লোর হয়ে কডপ্পা জেলার ম্যাগনামপেট অঞ্চলে ব্যারাইট ব্যবারিটাস খনি-অঞ্চল ছাড়িয়ে কিছুটা দক্ষিণপূর্বে গেলে খুবই ভাল সময় কাটবে ; সেখান থেকে আরও দক্ষিণে ভেতরদিকে গেলে , কর্ণটক সীমান্তের কাছাকাছি, একেবারে আধুনিকতা-বর্জিত গ্রামসমাজে যাওয়া যায় , উপজাতিরা থাকে, এমন জনসমাজ যেখানে অভাব আছে কিন্তু সেখানের লোকেরা তাকেই জীবন মনে করে , দারিদ্র্যই তাদের বেঁধে রেখেছে পরস্পরের সঙ্গে । তবে যেতে-আসতে অনেক হ্যাপা ।
আমার দশ কিলোমিটার মর্নিংওয়াকের অভ্যাস আছে । মায়াকে জিগ্যেস করেছিলুম, যাবেন কি ওই অঞ্চলে ?
মায়া বলেছিল, ওরকম অঞ্চলই তো চাইছি । দেখছেন তো ক্রমশ আমরা ইশারায় কথা বলতে বাধ্য হচ্ছি , কেননা সকলে আমার-আপনার ভাষা কাজ চালাবার মতন জানে । আমরাও এনাদের ভাষা একবর্ণ বুঝি না, তবুও বাংলা ভাষা দিয়ে কাজ তো চলে যাচ্ছে , কোনোই অসুবিধা হচ্ছে না ।
মায়া পালের কথা শুনছিলুম । যত শুনছিলুম, তত ওকে স্ট্রেঞ্জ মনে হচ্ছিল । ও তো, বুঝতে পারলুম, ব্যারাইট জিনিসটার নামই শোনেনি । বললুম, ব্যারাইট অনেকটা আপনার মতন, ঝিকমিক-ঝিকমিক ক্রিস্টাল দিয়ে গঠিত খনিজ, অনেক রকমের কাজে লাগে । শুনে, আমার মনে হল, ভালো লাগল মায়ার । ওর পাতলা ঠোঁটে হাসি খেলল । ওর বিভিন্ন মৃদু হাসিগুলোর মানে আমি বুঝতে আরম্ভ করেছি । নারীর স্টকে কত রকমের হাসি থাকে তার ইয়ত্তা নেই ।
নেল্লোরে নেমে ট্রেন পালটিয়ে কোদরু । নেল্লোরে যাবার পথে আমার মোবাইল, ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড নিয়ে নিজের পার্সে ঢুকিয়ে ট্রেন থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল মায়া । শখের কালো চশমাটা দিয়ে দিল আমাদের সামনে বসে-থাকা ছেলেটিকে, যে মায়ার পার্স ছুঁড়ে ফেলা দেখে তখনও পর্যন্ত সম্বিত ফিরে পায়নি । নিজের কার্ডগুলোও এক-এক করে জানলা দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছিল । আম কলা পাতিলেবু পেঁপের চাষের এলাকা আর ব্যারিটাইসের খনি অঞ্চল শুনে এই এলাকা চিহ্ণিত করেছিল মায়া । কোদরু থেকে ভাড়ার জিপগাড়িতে আধকাঁচা রাস্তার ধুলোর কুয়াশা ওড়াতে-ওড়াতে খনি অঞ্চল । প্যাংলা শ্রমিকদের আনাগোনা দেখে টের পাওয়া যাচ্ছিল যে খনি অঞ্চল এসে পড়ল । খনি ম্যানেজারকে আমাদের উদ্ভট হনিমুন পরিকল্পনা ব্যাখ্যা করতে, মিস্টার কৃষ্ণাইয়া ওনাদের রেস্ট হাউসে রাতটা কাটাতে দিলেন । এখানেও দুজনে পাশাপাশি শুলুম । তবে বিছানাটা বিশাল বলে আর ঘরে এসি থাকায় অসুবিধা হল না । রাজ্যের কেষ্টবিষ্টুরা এসে থাকেন বোধহয় , তাই বেশ সাজানো-গোছানো ।
আমি অতিপ্রয়োজনীয় ঘুমটা দিয়ে নিলুম । সকালে রেস্ট হাউসের দেয়া ব্রেকফাস্ট খেয়ে অজানা সাংসারিক জীবনের পথে রওনা দিলুম । ব্রেকফাস্টে যাতে ডিম আর দুধ দেয়া না হয় তা ওখানের খানসামাকে বলে দিয়েছিল মায়া । চা কেবল লিকার । ভাবলুম, বোধহয় শনি-মঙ্গলবার ধরণের কোনো স্ত্রী আচার । আমি তো নিজেই যা হোক ব্রেকফাস্ট খাই , ওটস, পরিজ, ব্রেড-স্যান্ড উইচ বা অফিসে পৌঁছে অর্ডার করি । এই অঞ্চলে রেস্টহাউসেই আমরা শাওয়ার বাথ করেছিলুম, একসঙ্গে নয়, প্রথমা মায়া তারপর আমি । যদিও আমার আশঙ্কা ছিল হয়তো মায়া সেরকম কোনো প্রস্তাব দিয়ে বসবে । রহস্যময়ী, অতএব কখন কোন রহস্যের ঘুর্ণিতে গিয়ে পড়ি , তার জন্যে নিজেকে সবকিছুর মুখোমুখি হবার জন্যে প্রস্তুত করে নিয়েছিলুম । মায়ার কার্যকলাপ দেখতে-দেখতে আমি ওর দায়িত্ব নিয়ে ফেলছিলুম ।
খনি ম্যানেজার একজন শ্রমিককে দিলেন গাইড হিসাবে । প্রথমে খনির ম্যাটাডর গাড়িতে, ড্রাইভারের পাশে গাইড, আমরা ক্যারিয়ারে হেলান দিয়ে । গাইড প্রস্তাব দিয়েছিল যে আমরা দুজনে ড্রাইভারের পেছনের সিটে বসি । মায়াই ক্যারিয়ারে বসার আইডিয়া দিয়েছিল, চারিদিকের দৃশ্য দেখতে-দেখতে যাবে বলে । সূর্যের অবস্হান দেখে বুঝতে পারছিলুম যে আমরা দক্ষিণের দিকে কোথাও যাচ্ছি ।
ম্যাটাডর আমাদের যে জায়গায় নামাল, গাঈদের পরামর্শে সেখানকার রাস্তার ধারের এক নোংরা ঢাবায় বিরাট-বিরাট জংলি পাতায় মোটা চালের ভাত আর ভিষণ ঝাল সাম্বর খেলুম । মায়াকে বলেছিলুম, যে কোনো জায়গায় জল খাবার অভ্যাস আছে তো , নয়তো পেট খারাপ হতে পারে । জবাবে মায়া বলেছিল, হলে হবে, ইমিউন হতে হবে তো, নয়তো থাকব কী করে সারাজীবন !
ঘাইড কোথা থেকে একটা গোরুর গাড়ি ডেকে এনেছিল, যতক্ষণ আমরা খাচ্ছিলুম সেই ফাঁকে । দক্ষিণ ভারতীয় বলদ । ওপর দিকে শিঙ উঠে ভেতরে বেঁকে এসেছে , গায়ে-গতরে পশ্চিমবঙ্গের বলদগুলোর চেয়ে স্বাস্হ্যবান । অদ্ভুত লাগল । লোকগুলো প্যাংলাটে আর বলদগুলো ভারিভরকম । মায়া দুহাত এগিয়ে দিয়ে বলল আমাকে গাড়িটায় তুলে দিন । দিলুম । অচেনা একধরণের ঠান্ডা ওর দেহকে ঘিরে রেখেছে মনে হল । এরকম ঠান্ডা দেহের নারী শরীরের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল না । পারফিউমের গন্ধ ছিল তখনও পর্যন্ত , নিশ্চই কোনো বিদেশি দামি পারফিউম লাগিয়েছিল বাড়ি থেকে বেরোবার সময়ে । গায়ে পারফিউম মেখে কেউ বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশে যায় ? গাড়িতে উঠে মায়া বলেছিল, যাক, বলদগুলোকে অত্যধিক খাটায় না , ওদের স্বাস্হ্য ভালো ।
গাড়ির ওপর শুকনো পেঁপেপাতার গদিতে বসলুম আমরা , আর হেলতে-দুলতে চললুম, মায়ার অদেখা স্বপ্নভূমিতে । এখানকার সূর্য কলকাতার সেপ্টেম্বরের সূর্য নয় । মায়ার মুখে ঘামের ফোঁটা ফুটে উঠছিল । মনে পড়ছিল না যে এত কাছ থেকে কোনো যুবতীকে এভাবে ঘামতে দেখেছি কিনা । আম কাঁঠাল লেবু পেঁপে আতা সজনেডাঁটা ইত্যাদি বাগানের পাশ দিয়ে সারারাত গোরুর গাড়ি করে অত্যন্ত ক্লান্ত দেহে ভোরবেলা পৌঁছোলুম এক গ্রামে , যেখানে শ্রমিকটি আমাদের আরেকজনের জিম্মায় দিয়ে চলে গেল । তাকে খি বুঝিয়েছিল জানি না, কেননা ভাষাটা ঠিকমতন ডেসিফার করতে পারছিলুম না । সে আমাদের ক্যারিব্যাগ দুটো মাথায় চাপিয়ে হাঁটতে আরম্ভ করল , আমরা পেছন-পেছন । ঘন্টাখানেক হেঁটে, একটা সরু ঝর্ণার পাশ দিয়ে , যে গ্রামে পোঁছোলুম, তার নাম লোকটি আকারে-ইঙ্গিতে জানিয়েছিল, অগ্রমগাগি, কর্ণাটকের সীমান্তের কাছাকাছি । মজুরি হিসাবে তাকে কিছু টাকা দিতে চাইলে সে নিতে অস্বীকার করল । মায়ার নির্দেশমত আমরা হাত-ঘড়ি দুটো দিয়ে দিলুম , যদিও কী কাজে যা লাগাবে লোকটা কে জানে । হয়তো বেচে কিছু রোজগারপাতি হবে ।
লোকজন দেখতে পাচ্ছিলুম না । চারিদিকে গাছপালা, বনাঞ্চল বলা যায় । গ্রাম বলে তো মনে হল না । জঙ্গলে এনে ছেড়ে দিল নাকি, যখন ভাবছি, একজন চাষিমতন লোক একটা বছর তেরো-চোদ্দর ছেলেকে গাছের ডাল দিয়ে পেটাতে-পেটাতে এদিকেই আসছিল । দৌড়ে গিয়ে ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরল মায়া , আর লোকটাকে বাংলাতেই যেভাবে বকুনি দেয়া শুরু করল তা বুঝতে কোনো ভাষাভাষিরই অসুবিধার কথা নয় । লোকটা তেলেগু ধরণের ভাষায় ছেলেটির অপরাধ, মনে হয়, ব্যাখ্যা করল, আর একেবারে অপরিচিত শহুরে দম্পতি দেখে অবাক প্রশ্ন তুলল ; অন্তত সেরকমটাই মনে হল । আমি ভাঙা-ভাঙা হিন্দিতে বোঝাবার চেষ্টা করলুম যে আমরা এখানে থাকতে এসেছি । নিজামদের প্রভাব কিনা কে জানে, লোকটা বিস্মিত কন্ঠে যা বলল, হায়দ্রাবাদি হিন্দি মেশানো তেলেগুতে, যা পরে জেনেছি আঞ্চলিক ভাষা তুরপু, তা হল যে এই অঞ্চল আপনাদের মতো মানুষের বসবাসের অযোগ্য , এটা ঠিক গ্রাম নয়, এটা আউটার এরিয়া, আমরা অনেক দূরে-দূরে থাকি , কেউই এক জায়গায় থাকি না । এই জঙ্গলটা গড়ে ওঠার আগে আমরা এই জঙ্গলের জমিতেই থাকতুম , আম লেবু পেঁপে কলার খেতে কাজ করতে যেতুম , এখনও প্রায় সকলেই ফলের বাগানে কাজ করতে যায় , তার জন্যে দুবেলা অনেকটা হাঁটতে হয় । এখানে আলো নেই , জল ভরতে অনেকটা হাঁটতে হয় , স্কুল নেই, পঞ্চায়েত দপতর এতো দূরে যে নেই বললেই চলে , কোনো সরকারি লোক আসে না এখানে , লোকে দুবেলা খেতে পায় না , পায়খানা নেই, মাঠে যেতে হয়…
লোকটি বলতে প্রচুর সময় নিয়েছিল , প্রায় আধ ঘন্টা, আমি তার কথার একটা নির্যাস লিখলুম । যাহোক, মায়া তাকে থামিয়ে সর্বভারতীয় খিচুড়ি ভাষায় বলল যে আমরা এখানেই থাকব , তোমাদের সঙ্গে, তোমাদের মতনকরে থাকব ।
মায়ার কথাগুলো আমি আরেকটু বোধগম্য হিন্দি করে বললুম লোকটাকে । সঙ্গের ছেলেটি একবার আমাদের আর একবার ওর বাবার মুখ দেখছিল । আঁচ করলুম যে ছেলেটি বোধহয় তার বাবার চেয়ে ভালো হিন্দি বলতে পারত, যেভাবে সে মৃদু হাসছিল আর কিছুটা অবাক হচ্ছিল আমাদের কথোপকথন শুনে । আমরা ওদের পাশাপাশি হাঁটতে লাগলুম ।
লোকটা বলতে-বলতে যাচ্ছিল, আমি আগে ব্যারাইট খনিতে কাজ করতুম, কিন্তু আমার স্ত্রীর ওই কাজ পছন্দ হচ্ছিল না বলে চলে এলুম, কেননা ওখানকার জল নষ্ট হয়ে গেছে খনির কারণে , শ্রমিকদের নানারকম রোগ হচ্ছে , আমার ছেলেটাও ওখানে কুসঙ্গে পড়ে খারাপ হয়ে যাচ্ছিল, শহরের ছেলেরা আজকাল যেমন হয় ; এখানে ফলমূল খেয়ে চলে যায় । পরে জেনেছি এখানকার তুরপুরা উপজাতি, তাই কারোর নজরে পড়ে না ; এরা ভোটাভুটি সম্পর্কেও আগ্রহী নয় । আরও পরে জেনেছিলুম যে এই অঞ্চলে মাটির তলায় আছে লোহা আর ম্যাঙ্গানিজ ।
আমরা লোকটির পেছন-পেছন তালপাতা পেঁপেপাতা আর গাছের ডালপালা ছাওয়া দরজাহীন একটা ঘরের কাছে পৌঁছোলে, আমাদের পথপ্রদর্শক তিন-চার বার হাঁক পেড়ে ডাকল কাউকে । কিছুক্ষণ পর যে লোকটি উদয় হল , তাকে দুর্বোধ্য বুলিতে বোঝাল আমাদের বক্তব্য । সেই লোকটা আরও রোগা, মাথায় ঝাঁকড়া চুল, কতকাল স্নান করেনি কে জানে । তার কথা আমাদের দোভাষী, বাধ্য হয়ে দোভাষী বলতে হচ্ছে আমাদের পথপ্রদর্শককে, অনুবাদ করে বলল যে একটা ঝুপড়ি আছে , যার ছিল সে বহুকাল আগে হায়দ্রাবাদ কিংবা ব্যাগালুরু চলে গেছে বোউ-বাচ্চা নিয়ে, আমরা চাইলে সেখানে গিয়ে থাকতে পারি ল
শুনে, মায়ার মুখ আলোকিত হল । আমার বিমূঢ় মুখ দেখে মায়া বলেছিল, আমি তো আছি, আশঙ্কা কিসের ।
উত্তরে বলেছিলুম, আমার এতক্ষণ ভুল ধারণা ছিল যে আমি আছি বলে আপনার কোনো আশঙ্কা নেই । প্রতিক্রিয়ায় মায়া মৃদু হাসি খেলিয়েছিল ঠোঁটে । চোখ বুজলেই আমি মায়ার এই বিশেষ হাসি-মাখানো মুখ দেখতে পাই । কতদিন কতবার যে দেখেছি ওর এই অনুমোদনমূলক হাসি , আমার স্মৃতিতে খোদাই হয়ে গেছে ছবিটা ।
আশ্চর্য ! জায়গাটায়, চালাঘরটায় থেকে গেলুম আমরা ! ক্রমশ রপ্ত হতে থাকল মূল ভারতবর্ষের জীবনযাত্রা । কাঁচকলা পোড়া, কাঁঠালবিচি সিদ্ধ-চটকানো , আর কখনো=সখনো আম বা পাকা পেঁপে খেয়ে, কেবল দিনের বেলায় , কেটে গেল বেশ কয়েকটা দিন । অবশ্য যে ছেলেটিকে মায়া মার খাওয়া থেকে বাঁচিয়েছিল , সে আমাদের ভারতীয় জীবনে সেটল হতে সাহায্য করেছিল । সে তালপাতার একটা চাটাই দিয়ে গেছে, যদিও তা অতিব্যবহারে চলনসই গোছের । সে আর তার বয়সী কয়েকটি ছেলে লেগেই থাকত আমাদের সঙ্গে । আমাদের সম্পর্কে তাদের কৌতূহল ; এত কাছ থেকে শহরের মানুষদের জীবনযাত্রা দেখেনি তারা । বহুবার প্রশ্ন করে তার নাম জেনেছে মায়া, সম্পূর্ণ নাম আমাদের পক্ষে উচ্চারখ করা কঠিন বলে মায়া ওকে বালু নাম দিয়েছে । সম্ভবত বালাজীর কোনো একটা নামের স্হানীয় রূপ । বালু কালো রঙের প্লাসটিকের ঘড়া আর প্লাসটিকেরই গেলাস দিয়ে গেছে জল ভরে রাখার আর খাবার জন্যে । ঘড়াটায় পুরো জল ভরা যায় না ; ওপর দিকটা সামান্য ফাটা । গেলাস চাপা দিয়েও কোনো লাভ নেই । প্রতিদিন জল না বদলালে মশা ব্রিড করবে , মায়াকে বলতে ও বলেছিল, এর সবাই তো খাচ্ছে, মশার ডিমসুদ্ধই খাচ্ছে হয়তো , আমরাও না হয় খাবো, ক্ষতি কী ।
কিছু দূরের বিশাল গভীর কুয়ো থেকে গ্রামের মহিলারা জল ভরে আনে দেখে মায়া নিজেই ঘড়া কাঁখে নিয়ে জল ভরে আনে । যতটুকু জল ও বইতে পারে ততটুকু, আমাদের তেষ্টা তাতেই মেটে । ব্লাউজহীন শাড়ি পরা আরম্ভ করেছে স্হানীয় মহিলাদের অনুকরণে । ব্লাউজহীন মায়াকে দেখে প্রথম-প্রথম আমার অস্বস্তি হতো ; তাকাতে লজ্জা করত । মায়াই একদিন সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল, সারা জীবন একসঙ্গে থাকতে হয়ে , ভুলে যাচ্ছেন কেন, তাকান তাকান তাকান তাকান, তাকিয়ে থাকুন ।
আমিও খালি গায়ে কেবল লুঙ্গি পরে থাকি । প্রথম দিন বিব্রত বোধ করেছিলুম , লুঙ্গি পরা আর খালি গায়ে থাকা, এই দুটিরই অভ্যাস ছিল না । মায়াকে দেখি আর নিজেকে কেমন দেখতে হয়েছে হয়ে যাচ্ছে অনুমান করি । গোঁফদাড়ি না কামিয়ে কেমন দেখাচ্ছে তা কালো ঘড়ার জলেতেও দেখার উপায় নেই । কোথাও প্রতিফলনের সুযোগ নেই । সত্যিই , নার্সিসিজম ঘটার কোনো সুযোগ নেই । তার মানে বহু মানুষ জীবনে মাত্র কয়েকবার আয়না দ্যাখে ; দ্যাখার প্রয়োজন বোধ করে না ।
মায়া কী করে চালাচ্ছে বিনা আয়নায় ? আজকালকার যুবতীরা নিজের প্রতিফলন দিনে বহুবার দেখেন । মায়া সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে সেই মায়ার সঙ্গে যে অফিসে আসার আগে নিজেকে সুশ্রী করে তুলে আনতো । অফিসেও টয়লেটে গিয়ে চুলের বিন্যাস গুছিয়ে ঠোঁটে লিপ্সটিকের নবীকরণ করে নিতো । বাড়ি যাবার সময়ে আবার একবার রূপটান দিয়ে নিত ! নারীর অন্তরজগতে পরিবর্তনের দ্রুতি কি পুরুষদের থেকে ভিন্ন ? বা, হয়তো, মায়া পাল নিজেকে নিয়ে চলেছেন এমনই এক জগতে যার সঙ্গে তাঁর নিজেরই পরিচয় হয়নি ? ভাবতুম ।
এখানে রাতের বেলায় না খেলেও চলে, এই প্রথম জানলুম । অন্ধকারেও থাকা যায়, এই প্রথম জানলুম । প্রতিদিন স্নান না করেও থাকা যায়, এই প্রথম জানলুম । ঘরের দরজা বন্ধ না করেও ঘুমোনো যায়, এই প্রথম জানলুম । লুঙ্গি পরে, গায়ে জামা না পরে থাকা যায়, এই প্রথম জানলুম । দাড়িগোঁফ না কামিয়ে থাকা যায়, এই প্রথম জানলুম । মাঠে বসে হাগা যায়, এই প্রথম জানলুম । অচেনা গাছের ডালে দাঁত ব্রাশ করা যায়, এই প্রথম জানলুম ।
মায়া কোথায় প্রাতঃকৃত্য সারতে যায় তা জানি না ; হয়তো অন্যান্য মহিলাদের কাছ থেকে জেনে নিয়েছে ।
একজন নাপিত আসে মাসে কখনও গ্রামে যারা চায় তাদের দাড়ি কামিয়ে গোঁফ ছেঁটে দিয়ে যায় । আমি আমার গোঁফদাড়িকে স্বাধীনতা দিয়েছি, যেভাবে ইচ্ছা বেড়ে উঠুক ।
তবে, মশারি টাঙানো থেকে মুক্ত হতে পারিনি । সন্ধা্যা হলেই মশারির ভেতরে ঢুকে বসে থাকি, মশা আর অজানা কীটের ভয়ে । মায়া বাধা দিয়েছিল । বোঝাতে চেয়েছিল ওকে যে ম্যালেরিয়া হলে যে উদ্দেশ্যে মায়া এসে্ছে তা পূরণ হবে না । অবশ্য কী যে ওর উদ্দেশ্য ছিল তা আজও জানি না ল মাটিতে চাটাই আর মোটা চাদর পেতে শুই । প্রায় সপ্তাহখানেক মেঝের উঁচুনিচু মাটির সঙ্গে খাপখাওয়াতে সময় লেগেছিল । ক্রমশ অমনভাবে শোয়ায় অভ্যাস করে ফেললুম । সহ্য হয়ে গেল ল
উটকো দুজন বাইরের মানুষ এসে তাদের সমাজে থেকে গেল, অঞ্চলের কারোর তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখলুম না । শহরে হলে, ক্লাবের ছেলেরা, পার্টির লোকেরা, পাড়া-প্রতিবেশি সবাই অযথা নাক গলাতো । এখানে কেউ নামও জানতে চাইল না । আমরা কোন ভাষায় কথা বলি বা কোথা থেকে এসেছি , তাতে কারোর কোনো আগ্রহ নেই । ভারতবর্ষে মানুষের চরিত্র ছোটো-ছোটো দ্বীপের মতন পৃথক বৈশিষ্ট্য নিয়ে গড়ে উঠেছে ।
একদিন মায়া বলল, গারু, এখানে পুরুষদের গারু বলে ডাকে, কলকাতায় যেমন স্যার কিংবা বাবু বা দাদা, মায়া বলেছিল, গারু, আজকে আমার মেন্সটুরেশান শুরু হল, হয়তো সেকারণে মেজাজটা নিয়ন্ত্রণে থাকবে না, কিছু মনে করবেন না ।
ভালই হল, বলেছিলুম আমি, এখানে ক্যালেন্ডার বা মাস-তারিখ জানার কোনো ব্যাপার নেই ; আপনার মেন্স যেদিন হবে আমাকে অবশ্যই বলবেন, আমি সামনের কাঁঠাল গাছটায় খুরপি দিয়ে দাগ দিয়ে রাখব , তাহলে মারা যাবার সময়ে আমি বা আপনি জানতে পারব, কতদিন একসঙ্গে ছিলুম । শারীরিক কষ্টের মধ্যেও জোরে হেসে উঠেছিল মায়া । হাসছিল ও, অথচ তার ঢেউ আছড়ে পড়ছিল আমার অস্তিত্বে , রিন রিন রিন রিন রিন । কারোর হাসি যে গা-ময় লেগে থাকে, তার কথা যে মগজের ভেতরে বাজতে থাকে, তার দেহের গন্ধ মনের মধ্যে ফিকে ঢেউ তোলে, তা মায়ার সংস্পর্শে না এলে জানতে পারতুম না ।
কলকাতায় নিজেকে কখনও পরগাছা মনে হয়নি । এখানে, তিন দিনেই মনে হতে লাগল যে পুরুতদের মতন বা পার্টিকর্মীদের মতন অন্যের দানে পেট ভরাতে হচ্ছে । বেশ গ্লানিময় । এত পড়াশোনা করেছি, গণিতে প্রথম শ্রেণি থেকে প্রথম হয়েছি চিরকাল, এই প্রায়-জনহীন গ্রামে সেসব জ্ঞানের কিয়দংশও কাজে লাগছে না । মায়াকে বলতে, ও বলল, ওর অবস্হা আরও খারাপ, ও চিরকাল ইংরেজি মাধ্যমে পড়েছে, ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর করেছে ।
ঘুরে-ঘুরে দেখেছি, আম লেবু পেঁপের গাছে তেলেগুতে সংখ্যা লেখা । গণিত আর ইংরেজি দুটোই সেক্ষেত্রে ফালতু বলেই মনে হল এই অঞ্চলে । তার চেয়ে, দুজনেই ঠিক করলুম, আমরাই শিখি । এই অঞ্চলের কীট পতঙ্গ আগাছা আচার ভাষা যা জানি না, তা-ই শেখার প্রয়াস করি ।
ওর বাবা ব্যারেটাইস খনিতে কাজ করার সময়ে বালো ওখানকার খনিশ্রমিকদের স্কুলে একবছর পড়েছে । বালুকে প্রস্তাব দেয়া হল যে সে আমাদের তেলেগু শেখাবে , যতটুকু ও জানে, অক্ষরজ্ঞান হলেই চলবে , প্রতিদানে আমি ওকে ইংরেজিতে এক দুই তিন চার শৈখাব , আর মায়া শেখাবে এ বি সি ডি । সমস্যা দেখা দিল শুরু করতে গিয়েই । ওর বা ওর পরিচিত কারোর বাড়িতে স্লেট-পেনসিল বা কাগজ কলম নেই । বালুই উপায় বাতলালো । আমাদের চালার বাইরে পেছনদিকে মাটির দেয়ালে কাঠ-কয়লা দিয়ে লেখা হবে আর ভিজে ন্যাকড়ায় তা পোঁছা হবে । ও উৎসাহিত, এইজন্যে যে ও দুটো জিনিস শিখবে আর আমরা দুজনে কেবল একটা । আমাদের ক্লাস নেয়া-দেয়া দেখাতে বালু নিজের মাকে এনেছিল । বালুর মা পরের দিন এসে কুমড়ো দিয়ে গিয়েছিল, যেটা দিয়ে কি করা হবে যাতে তা খাওয়া যায় ঠাহর করতে না পেরে মায়া শেষপর্যন্ত কুমড়ো-পোড়া বানিয়েছিল । গরম-গরম ভালই লেগেছিল খেতে , নুন-হীন । নুন খায় এ-অঞ্চলের লোকে, কিন্তু কুসংস্কারবশত নুন কেউ দিতে চায় না । আর চিনি তো খায়ই না এরা, পায়ই না তো খাবে কোথ্থেকে ! লঙ্কা হয় কারোর কারোর বাড়ির সামনের জমিটুকুতে– এনে দ্যায় বালু ; লঙ্কা দিয়েই স্বাদকে অভ্যস্ত করে নিয়েছিলুম আমরা ।
বালুর দেখাদেখি দশ-বারো দিনে আরও চারজন ছাত্র জুটে গেল আমাদের । ক্রমে গ্রামের, গ্রাম বলতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কিলোমিটার খানেক দূরত্বের সব আগ্রহী ছেলেমেয়ে চলে আসতে লাগল । যার যখন সময় । ওদের শেখার আর আমাদের শেখার তো কোনো নির্দিষ্ট স্কুলসময় বলে রুটিন ছিল না । তাদের মধ্যে থেকে আমরা একজন শিক্ষিকা পেলুম, সিরিদেবি, বোধহয় শ্রীদেবীর অপভ্রংশ, যে তেলেগুতে আমাদের এক দুই তিন চার শেখানো শুরু করল । তারা যে মায়াকেই বেশি পছন্দ করছে তার স্পষ্ট আভাস ফুটে উঠছিল ছাত্রছাট্রিদের মুখে আর ব্যবহারে । মায়া ওদের জড়িয়ে ধরে আদর করতে পারে , আমার কেমন যেন বাধো-বাধো ঠেকে । পড়াবার সময়ে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে আমাদের পা ব্যথা করতে পারে অনুমান করে সিরিদেবির বাবা গাছের ডাল দিয়ে তৈরি দুটো টুল বানিয়ে দিয়ে গেছে একটা একটু নিচু,মায়ার জন্যে, আরেকটা আমার কোমরের উচ্চতায় , আমার জন্যে ।
মাঝে-মথভে পড়াবার দেয়ালটা মাটি দিয়ে লেপে নতুন করে দিয়ে যায় কোনো ছাত্র বা ছাত্রীর মা । নয়তো মায়া নিজেই কোথাও থেকে গোবর এনে সারাদিন লেপার কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখে । মায়া আমাদের চালার ভেতরটাও গোবরে লেপে ফেলেছে । কোথায় যে গোবর পায় তা জানি না ; এখনও তো গোরু বা মোষ নজরে পড়েনি । হয়তো গ্রামের লোকেরা নিয়ে আসে কোথাও থেকে । যখন এক মনে দেয়ালে গোবর লেপে মায়া, আমি ওকে দেখেছি আর অবাক হয়েছি । নিজেকে একেবারে নতুন ছাঁচে ঢালাই করে ফেলেছে মায়া ; দেকতে থাকলে মনে হয় ঠিক যেন রঙ করার আগের মাটির প্রতিমা যার চোখদুটো কেবল আঁকা হয়েছে । আমি নেজেকে কীরকম দেখতে হয়েছে অনুমান করতে পারি ; ক্রমশ মহিষাসুর হয়ে উঠছি , সবুজদেহ অসুর নয়, কয়লাদেহ ।
মায়া চেঁচিয়ে-চেঁচিয়ে তেলেগু সংখ্যা আনকেলু এক দুই তিন চার অর্থাৎ ওকাতি , রেন্ডু, মুন্ডু, নালগু, আইডু, আরু, এডডু, এনিমিডি , তোম্মিদি, পাডি মুখস্হ করত । স্বরবর্ণ বা আচ্ছেলু , ব্যঞ্জনবর্ণ বা হাল্লুলু মুখস্হ করত । আমি ওর সঙ্গীতময় কন্ঠস্বর শুনতুম আর মনে রাখতুম । আজও আমার কানে ওরই তেলেগু অক্ষর বাজছে , যখন এই লেখাটার জন্যে কি-বোর্ড টিপছি । অক্ষরগুলো গোলগোল , বাংলার চেয়ে বেশ কঠিন, ইংরেজির থেকে তো বটেই । মায়া আমার চেয়ে তাড়াতাড়ি শিখে ফেলছে । আমার একটা অক্ষর রপ্ত করতে , এবং তার পরের অক্ষরে গিয়ে প্রথম অক্ষরে ফিরে আসতে তিন-চার দিন লাগছে ।
ও, মায়া, কুয়োতলায় গিয়ে মহিলাদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে, আকারে ইঙ্গিতে ইশারায় তারাও ওকে নানা কথা বলে , আমাদের সংসার গুছিয়ে ফেলেছি কিনা তারা জানতে চায় । মহিলারা জল তোলার সময়ে বাচ্চাকে মায়ার কোলে দিয়ে দেয় । ও ফিরে আসলে ওর গা থেকে শিশুদের গন্ধ বেরোয় । মায়া ফিরে এসে সেই দিনকার কোন বাচ্চা ওকে বেশি আদর করল তার গল্প শোনায় । মনে হয় জল ভরার অছিলায় বাচ্চাদের কোলে নিয়ে আদর করতেই যায় ও । কোনো-কোনো যুবতী শিশু দেখলেই কোলে নিতে চায়, তার সঙ্গে তোতলা কথা বলতে চায়, মায়া সেই ধরণেরই এক যুবতী । মায়া যেন মায়াময় ।
আমি গল্প করার বিশেষ কাউকে পাই না, ছাত্রছাত্রীরা ছাড়া । বৃদ্ধ-বৃদ্ধা আছেন দূরের এক-আধটা চালায় , কিন্তু কী গল্পই বা করব তাঁদের সঙ্গে । তাঁরা আমার কথা বুঝতে পারবেন না, আমি তাঁদের । অনেক সময়ে মনে হয় স্হানীয় পুরুষদের মতন আমিও কোনো ফলের বাগানে গিয়ে চাকরি নিই , অন্তত ভাঙা-ভাঙা কথা বলার লোক তো পাব । মায়াকে সেকথা জানালে ও রাজি হয় না । বলল, ওরা টাকা দেবে, তা নিয়ে কী করবেন ? নতুন সমস্যা দেখা দেবে । টাকা এলে তার সঙ্গে সংসার পাতার প্রক্রিয়াও এসে পড়বে , জীবনে চাই না, এরকম অপ্রয়োজনীয় বস্তু জড়ো হয়ে যেতে পারে , যদিও এখানকার কারোর সঙ্গে এখনও পরিচয় হয়নি যে অমনধারা জিনিস সম্পর্কে আগ্রহ দেখিয়েছে ।
শিক্ষকতার দরুণ গুরুদক্ষিণাও জুটতে লাগল , ইন কাইন্ড, এবং একদিন চালও পাওয়া গেল , লাল খোসাসহ, ব্রাউন রাইস, যা দেখে মায়া বলেছিল, কলকাতায় কত খুঁজেছিলাম প্রকৃত ব্রাউন রাইস , আর এখানে এটা গরিব গ্রামবাসীর খাদ্য ।
বললুম, দেখছেন তো ? অতীত কী ভাবে ঘাপটি মেরে থাকে ! শুনে, মায়া যেন কেমনতর উদাসীন হয়ে উঠল । বেফাঁস কথা বলায় আমিও বেশ অপ্রস্তুত হলুম ।
চাল-পোড়া তো খাওয়া যাবে না , তাই মায়া চাল দাতাকে অনুরোধ করেছিল যে আমাদের একমুঠো ভাত দিলেই চলবে , কাঁচকলা পোড়া বা কাঁঠালবিচি পোড়া দিয়ে খেয়ে নেয়া যাবে , লঙ্কার টাকনা দিয়ে । প্রায় প্রতিদিনই ভাত পেতে লাগলুম , যদিও কলকাতায় যা খেতুম তার চেয়ে অনেক কমই, কিন্তু কম খেয়ে আর রাতে না খেয়ে অভ্যাস হয়ে যাচ্ছিল কম খাবার । আমি চাইতুম মায়া বেশি খাক, মায়া চাইত আমি বেশি খাই । আমি একদিন বলেই ফেললুম, প্রকৃত ভালোবাসা কাকে বলে জানি না , কেবল যৌনতাই জেনে এসেছি এতকাল, আপনি ভালোবাসতে শেখালেন ।
জবাবে মায়া বলেছিল, অতীতকে আনবেন না প্লিজ, আপনি কী ছিলেন, কী করেছিলেন, সব ভুলে যান, সমস্তকিছু মুছে ফেলুন , আমি কি কোনো স্মৃতিচারণ করেছি ?
স্মৃতিচারণ মায়া করেছিল, করে ফেলেছিল, কয়েকজন বিদেশী সাহিত্যিকদের জীবনবোধকে একদিন তীব্র আক্রমণ করে ; আমি তাদের বইটই তখনও পর্যন্ত পড়িনি । তাই মুখ বন্ধ রেখে মায়ার জীবনদর্শনের সঙ্গে পরিচিত হবার সুযোগ উপভোগ করেছিলুম ।
ভাত পেয়ে, মায়া বলেছিল, ভাতও খাবো কিনা সে-চিন্তায় ছিলাম , কেননা ভাতের সঙ্গে তো অতীত জুড়ে রয়েছে । আপনি আমাকে ভালোবাসার চোখে দেখবেন তা আমি জানি , আমিও যে আপনাকে ভালোবাসছি, ভালবেসে ফেলেছি, তা অনুভব করছেন না ? আমার চোখের পানে সরাসরি তাকিয়ে মায়া যোগ করেছিল, বালুরা যে ঝর্ণার জলে স্নান করতে যায়, কালকে চলুন সেই ঝর্ণায় গিয়ে স্নান করি , আমাদের সত্যিই এবার পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন, নয়তো আচমকা কোনো রোগে দুজনের একজন আক্রান্ত হয়ে পড়তে পারি ।
আমি বলেছিলুম, কালকে নয়, যেদিন আপনার চতুর্থ মেন্সের দাগ কাঁঠালগাছে আঁকব, সেই স্নান ঝর্ণার জলে করবেন ।
—আপনি জানেন দেখছি , মধ্যবিত্ত সংস্কার অনুযায়ী স্নান করতে হয় ।
—হ্যাঁ, পর পর তিনবার আপনাকে স্নান করতে দেখলুম না, বলার সাহসও হয়নি ।
—আদিম মানবীরা কি স্নান করত ? বিদেশের প্রতিটি দেশের মহিলারা কি স্নান করেন ? এখানের মহিলারা করেন ? স্নান করাটা, দেখেছেন তো, এখানকার জনজীবনে উৎসবনির্ভর । দৈনন্দিন রুটিন নয় ।
—আরেকটা কথা বলি আপনাকে । একই মশারির ভেতর পাশাপাশি শুতে এখনও অস্বস্তি হয় আমার । কাঠ হয়ে শুয়ে থাকতে হয় । আমি বলেছিলুম মায়াকে ।
—আমি তো ওভাবে শুই না । আমি তো আপনাকে অ্যাডাম মনে করি আর নিজেকে ইভ , তাহলে স্পর্শ বাঁচাব কেন ? বলেছিল মায়া , অকপটে ।
—আমি কি আপনাকে জড়িয়ে ধরতে পারি ? বলেছিলুম আমি ।
—এই নিন আপনার অস্বস্তি কাটিয়ে দিচ্ছি ; বলছেন ভালোবাসেন, ভালোবাসা তো সর্বগ্রাসী । বলতে-বলতে মায়া জড়িয়ে ধরল আমায় । বলল, এই কারণেই ঝর্ণার জলে গিয়ে স্নান করে আসার প্রস্তাব দিয়েছিলাম । জানি, শহরের সুগন্ধ থেকে মুক্ত হয়ে গেছি, আদিম মানবীর গন্ধ হয়তো ছেয়ে গেছে দেহে । জানি না এখানকার স্বাভাবিক দেহ-গন্ধে আপনি নিজেকে খাপ খাওয়াতে পেরেছেন কিনা ।
—আপনার হাত যতক্ষণ না ক্লান্ত হচ্ছে ততক্ষণ জড়িয়ে থাকুন প্লিজ, বললুম আমি । আমিও জড়িয়ে ধরব কিনা নির্ণয় নিতে না পেরে ওভাবেই দাঁড়িয়ে রইলুম । এখানে এসে তো কেবল লুঙ্গি পরে থাকি , যা কাচা হয়নি এখনও । মায়াও একই কাপড় পরে আছে ।
বহুক্ষণ ওভাবে জড়িয়ে ধরে রেখেছিল মায়া । অথচ আমার যৌনতার উদ্রেক হল না । আমিই ক্লান্ত হয়ে পড়ছিলুম এক ঠায়ে দাঁড়িয়ে । বললুম, জানি, আপনার হাত ক্লান্ত হয়ে পড়েছে ; আমার অস্বস্তি কেটে গেছে । চলুন আমরা আমাদের আরামকেদারায় বসি । আরামকেদারা অর্থে কাঁঠালগাছের তলায় রাখা দুটো পাথর । গ্রামের লোকেরা ওদুটো আমাদের জন্যে এনে দেয়নি, ওগুলো আগেই ছিল ওখানে, হয়তো কাঁঠাল গাছে ওঠার জন্য কখনও এনেছিল কিশোর-যুবকেরা ।
পাথরের ওপর বসে মায়া শোনাত জীবনের সৌন্দর্যের গল্প । ও বলত, দেখছেন তো, জীবন মোটেই দরিদ্র, পঙ্কিল, কদর্য, অশ্লীল , জঘন্য, স্হূল, পাশবিক, অশিষ্ট , বর্বর নয় । শহরের সমস্তপ্রকার সুবিধা থেকে বঞ্চিত আমরা ; তবু কত শান্তিতে রয়েছি ।
কাঠাল গাছে দাগ দেবার চার দিন পর আমরা ঝর্ণার জলে স্নান করতে গেলুম , অনেকটা হেঁটে, প্রায় তিন কিলোমিটার । আমাদের সঙ্গে তিনজন ছাত্র যোগ দিল । আমি ভালোভাবেই স্নান করলুম, গা থেকে নোংরা ঘষে-ঘষে তুললুম । চুলের জট ছাড়ালুম , আঙুল দিয়ে আঁচড়িয়ে দাড়ির চুল ভালো করে ধুলুম । জলের আয়নায় নিজেকে প্রাগৈতিহাসিক মানব মনে হচ্ছিল । বহুদিন পর নিজের প্রতিবিম্ব দেখে নিজেকে অপরিচিত মনে হচ্ছিল ।
মায়ার প্রায় পুরোটা সময় গেল ছাত্রদের দিকে নজর রাখতে । একজন ছাত্র, কার্তিকা, বলল, আজকে আকাশ এরকম মানে রাতে বৃষ্টি পড়বে, তখন বৃষ্টিতে নাচব ।
ছাত্রদের জল থেকে তুলে, তাদের নিয়ে আমি রওনা দিলুম আস্তানার দিকে, ছাত্রদের দুজনের চালা আমাদের চালা থেকে বেশ দূরে, আধঘন্টার বেশি হাঁটতে হবে ওদের । মায়াকে বললুম, আপনিও ভালোভাবে স্নান করে আসুন , আপনার চুল তো সাধুদের মতো হয়ে চলেছে , আমি এদের নিয়ে এগোচ্ছি । কিছুটা হাঁটার পর বালু মায়াগারু মায়াগারু বলে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল, আঙুল তুলে দেখিয়ে বলল, আম্মা আম্মা । দেখলুম মায়া সম্পূর্ণ বিবস্ত্র হয়ে স্নান করছে । অপূর্ব লাগল । ভয়ও হল , প্রচণ্ড ভয়, যদি কেউ ওকে লুকিয়ে দেখতে থাকে ! তাকিয়েছিলুম ওর দিকে । তক্ষুনি মনে হল উচিত কাজ করছি না । এর আগে ওকে নগ্ন দেখিনি । দৃশ্যটা চোখ বুজলেই ভেসে ওঠে, আজও ।
মায়া ওদের আম্মা হয়ে উঠেছে কবে থেকে জানতুম না । বোধহয় কুয়োতলায় বাচ্চাদের আদর করার দৌলতে বা শিক্ষকতার কারণে ।
রাতে দুজনে দুজনকে নগ্ন পেলুম । একে আরেকজনের সামনে দাঁড়িয়ে, প্রায়ান্ধকারে, মশারির বাইরে । মায়া প্রশ্ন করল, ইতস্তত করছেন ? নিজেকে ফর্নিকেটর বা আমাকে ফ্ল্যাপার ভেবে গুটিয়ে রাখছেন না তো নিজেকে , মিস্টার মায়ালিঙ্গা ।
বললুম, আপনি এখানে সবায়ের আম্মা হয়ে গেছেন , কিশোর-কিশোরীদের, তাদের মা-বাবার সকলের আম্মা ; আমি নিরঞ্জন দত্ত থেকে ক্রমশ অবলুপ্তির পথে মিলিয়ে যাচ্ছি মায়ায়, নাম থেকে নামে , নামহীনতায় । কিন্তু আমার আর আপনার মাঝে আমি আর কাউকে চাই না, তাই ইতস্তত করছি । আমি চাই কেবল আপনি আর আমি , আমাদের নিজস্ব ব্রহ্মাণ্ডে ; আপনিই তো বলেছিলেন, আমরা কোনো সংসার পাতাপাতি করব না । আমরা যদি যৌনকর্মে মিলিত হই তাহলে আমরা হয়তো একধাপ এগিয়ে যাব সংসার পাতার পথে। আমি আপনার অখণ্ড ভালোবাসা চাই । কারোর সঙ্গে ভাগাভাগি করতে চাই না । আমি চাই না হঠাৎ কোনো শিশু এসে আমাকে আপনার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিক ।
মায়া বলেছিল, পিরিয়ডের প্রথম সাতদিন ও শেষ সাতদিন সেফ হয় । আপনি আমাকে জড়িয়ে ধরে আমার শরীরের তাপ অনুভব করুন আর তা স্মৃতিতে ধরে রাখুন । আপনি তো গণিত বিশেষজ্ঞ ; প্রকৃতি দেহের জন্যে গণিতের ছক তৈরি করে দিয়েছে । আমি আমার দেহের রসায়নের গণিত ও মিউকাস তৈরির কথা জানি , কী ভাবে তা ক্যালকুলেট করতে হয় জানি, কিন্তু নিজের দেহের তাপ তো নিজে অনুভব করতে পারব না । আপনি এই সময়ে প্রতিদিন আমাকে জড়িয়ে ধরবেন, যেদিন আমার শরীরের তাপ যৎসামান্য উনিশ-বিশ মনে হবে সেদিন জানাবেন । আমিও আপনার দেহের রসায়ন যাচাই করব । প্রকৃতি মনের তাপ আর দেহের তাপে পার্থক্য তৈরি করে রেখেছে । মনের তাপে আমরা কাছে আসব, আর দেহের তাপে যৌনক্রিয়া করব না । আমিও আপনার দেহের তাপ নজরে রাখব যাতে টের পাই যা আপনার দেহ অসুখের দিকে যাচ্ছে না । স্বাস্হ্য দেখে তো মনে হয় আপনার ইমিউন সিসটেম পর্যাপ্ত ।
জড়িয়ে ধরতে যাব, হাওয়ায় কেমন যেন বাঁশিতে তোলা উদারার আওয়াজ পেলুম , সম্ভবত ঝড়ের পূর্বাভাস , অদৃশ্য এক ধ্বনিকুহক ঝড়কে ডাকছে । সকালে কার্তিকা বলেছিল বৃষ্টি হবে, একজন বৃদ্ধও স্নান করতে যাবার পথে বলেছিল, আমরা যেন তাড়াতাড়ি ফিরে আসি, কেননা আজকে ঝড় উঠতে পারে । দুজনে বাইরে উঁকি দিলুম । দেখলুম আকাশ অমাবস্যার রাতের মতন অন্ধকার কিন্তু গোলাপি আভায় ছেয়ে গেছে । বালু ওর মায়ের হাত ধরে দৌড়ে-দৌড়ে এদিকে আসছে দেখে আমরা দ্রুত কাপড় পরে নিলুম । বালুর মা হাত নেড়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে তুরপু তেলেগুতে যা বলল তা আমরা বুঝতে না পারলেও, এটুকু বুঝলুম যে আমাদের মতো ওরাও ভয়ঙ্কর ঝড়ের আশঙ্কা করছে । বালুর কথায় স্পষ্ট হল যে এখানে থাকতে নিষেধ করছে ওর মা, ঝড় আমাদের উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে ।
মায়া বলল, নিয়ে যাক না উড়িয়ে, হারিয়ে যাবার জন্যেই তো এসেছি ।
—পাগলামি করবেন না , এখনও সম্পূর্ণ ভালোবাসা পাইনি আপনার । মায়ার হাত ধরে টানতে-টানতে দৌড়োলুম বালুর মায়ের পেছনে, ঝর্ণার দিকে । প্রশ্ন করার সময় ছিল না । কিছুদূর গিয়ে মায়াকে কাঁধের ওপর তুলে নিলুম, কারণ ও খালি পায়ে দ্রুত দৌড়োতে পারছিল না । দৌড়োবার সময়ে দেখতে পেলুম, অন্ধকারে বহু ছায়া দৌড়োচ্ছে আমাদের সঙ্গে, পেছনে, সামনে, বাঁদিকে, ডানদিকে । কোথাব ছিল এত মানুষ, আগে তো এতজনকে একত্রে দেখিনি । ঝড় সবাইকে আতঙ্ক দিয়ে বেঁধে ফেলেছে । ঝর্ণার স্রোতকে পাশ কাটিয়ে সবাই উঠলুম পাহাড়ের ওপর । ছায়াদলের নেতা ঢুকে গেল পাহাড়ের কন্দরে । তাকে একে-একে অনুসরণ করল সবাই, আমরাও । অন্ধকার গুহা । কে কোথায় কিচ্ছু টের পাওয়া যাচ্ছিল না । কেবল চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছিল । মহিলারা স্বামীকে, ছেলেদের ডেকে একত্রিত করছেন হয়তো । ভেতরে ঢুকে, মায়াকে নামিয়ে, টের পেলুম আগে থাকতে অনেকে এসে বসে আছে । আমি মায়ার হাত শক্ত করে ধরে রইলুম । বাইরে তখন প্রচণ্ড বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে , শোনা যাচ্ছে মেঘের আনন্দ-চিৎকার , আর থেকে-থেকে ভেতরে ছিটকে আসছে তার চিৎকারের আলো । এই প্রথম দেখলুম আলোও প্রতিধ্বনিত হয় ।
সবাই গুহার উবড়ো-খাবড়া দেয়ালে পিঠ দিয়ে বসে রইলুম সারা রাত । মায়া আমার কোলে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেও আমি ঘুমোইনি । জেগে বসেছিলুম সারারাত । ঘুমোলে যদি জেগে উঠে হঠাৎ নিজেকে দেখি দাদুর বাঙলোবাড়িতে আমার বিছানায় একা শুয়ে আছি ! অতীতকে মনে হচ্ছিল অবিশ্বাস্য । ভাবছিলুম সত্যিই কি পরিচিত প্রথিবীতে আছি না কি স্বপ্নের দুনিয়ায় ।
সকালে একে-একে বাইরে বেরিয়ে দেখলুম যে ঝড় বয়ে চলে গেছে অঞ্চলের ওপর দিয়ে । পাহাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে অন্যদিকটায় দেখতে পাচ্ছিলুম অজস্র কলা আর পেঁপেগাছ ফলসুদ্ধ ভেঙে পড়ে আছে । এত দূর থেকেও দেখতে পাচ্ছিলুম কাঁচা আর আধপাকা পেঁপে আর কলার কাঁদি কাৎ হয়ে ছড়িয়ে রয়েছে চারিধারে । ক্ষুধার্ত ঝড় কলা আর পেঁপে খেতে-খেতে এসেছে , আমাদের ভয় দেখিয়ে, আরও ভেতরে ঢুকে গেছে ঝড়টা, ব্যারাইটের খনির দিকে । বোধহয় এটা ছিল বঙ্গোপসাগরে ওঠা এক সামুদ্রিক ঘূর্ণির ল্যাজের ঝাপটা ।
পাহায থেকে নামবার সময়ে চোখে পড়ল ঝর্ণার স্বাস্হ্যবতী হয়ে ওঠা কলকল নৃত্য । মায়া বলল, আমার হাত ধরে, আপনি ওভাবে হঠাৎ কাঁধে তুলে নিলেন আমায় ? ইন্সটিংক্টিভলি ? কাঁধে তুলে দৌড়োচ্ছিলেন যখন, আমি আপনার গলা জড়িয়ে শুনতে পাচ্ছিলাম আপনার হৃৎপিণ্ড কত দ্রুত কাজ করে চলেছে. আমারই জন্যে , কী আশ্চর্য , তাই না ?
বলেছিলুম, কোনো চিন্তা মাথায় আসেনি তখন ; জাস্ট পৌঁছে যেতে চেয়েছিলুম পাহাড়ের ওপরে যত তাড়াতাড়ি পারা যায় ; আপনি যে আমার কাঁধে, আপনি যে আমার গলা জড়িয়ে ঝুলছেন, তা লক্ষ করার সম্বিত ছিল না তখন ।
যে যার চালার দিকে হাটতে লাগলুম । জঙ্গল পেরিয়ে আমাদের এলাকায় পৌঁছে স্পষ্ট হয়ে উঠল যে প্রায় সবায়ের চালা , সম্পূর্ণ পড়ে না গিয়ে থাকলেও , ভেঙেচুরে হেলে আছে । জঙ্গলের সুউচ্চ গাছগুলো চালাগুলোকে গুটিয়ে নিয়ে যেতে দেয়নি । আমাদের চালাটা কোনোমতে টিকে আছে । তবে ক্লাস নেবার দেয়ালকে খেয়ে ফেলেছে ঝড়ে , আর বেরিয়ে পড়েছে দেয়ালের পাঁজরা, শুকনো পেঁপে গাছের ও অন্যান্য গাছের ডালপালা, যার ওপর মাটি-গোবর লেপে গড়ে উঠেছিল দেয়ালের আস্তরণ বা ব্ল্যাকবোর্ড ।
গোরুছাগল কোথায় থাকে আমি খোঁজ নিইনি কখনও ; মায়া জানে । পরে ও বলেছিল, জন্তুগুলোর জন্যে পাথরে ঘেরা দেয়াল আছে , সেখানে ঢুকিয়ে গাঁছের গুঁড়ির গেট বন্ধ করে দেয়া হয় রাতের বেলায় । ফলে ঝড়ে জন্তুগুলো ডাকাডাকি করলেও বহাল তবিয়তে আছে ।
আমাদের ঘরের ভেতরেও জল ঢুকে গিয়েছিল । মশারি ভিজে চুপচুপে । ক্যারিব্যাগ দুটো চলে গিয়েছিল চালার বাইরে, বেশ দূরে । খুঁজে আনতে হল । মায়া বলেছিল , দেখেছেন তো ? প্রকৃতিও আমাদের দুজনার সঙ্গে রয়েছে । আধুনিকতার বিষ থেকে আমাদের ধুয়ে দিয়ে গেল । আমাদের ঘর এবার আমরা নিজেরাই মাটি লেপে নতুন করে তুলব । মেঝেটাও মসৃণ করে নেব যাতে আপনার পিঠে না ফোটে ।
আমি মনে-মনে ভেবেছিলুম, আধুনিকতার বিষ কি এড়ানো যায় ? যায় না, তার কারণ আমাদের নেশা ধরিয়ে দিয়েছে আধুনিকতা , মাদকের চেয়েও মহা আকর্ষক সেই নেশা । চলুন পালাই ডাকে সাড়া দিয়ে চলে তো এসেছি, তা কি মুক্ত করেছে আমাদের , আমাকে ? সদাসর্বদা আধুনিক বস্তুর অভাব বোধ করতে থাকি । মায়া না থাকলে এখানে এক ঘন্টাও টিকতে পারব না । মায়াই আমার জীবনদায়ী ওষুধ ।
পুরো প্রিন্টআউট পড়া শেষ হলে ইন্সপেক্টর রিমা খান সংশ্লিষ্ট সিডিটায় লিখে রাখল ‘পঠিত’ । এবার খুঁজে বের করতে হবে মায়া পালকে । মায়া পালই কি প্রেমিককে খুন করে উধাও হয়ে গেছে । ইনি কি সত্যিই কেউ , নাকি বানানো গল্প । কোথায় থাকেন ? বোঝা যাচ্ছে বেশ ধনী পরিবারের মেয়ে । উচ্চ-মধ্যবিত্ত বাঙালি এলাকায় নিবাস, নিঃসন্দেহে । বাবার নাম জানা গেলে সুবিধা হতো । কিন্তু পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতে লালিত একজন তরুণীর ওইভাবে জোতদার-জমিদার পরিবারের যুবককে প্রেমিক হিসাবে বেছে নেয়াটা কিরকম যেন বিসদৃশ ঠেকল ইন্সপেক্টর রিমা খানের । ইংরেজি ভাষার সঙ্গে গণিত কি মেলে ? মেট্রো রেলস্টেশান মানে এখানে দমদমই বুঝতে হবে, কেননা প্রেমিক মশায়ের সিদিগুলো পাওয়া গেছে ওনার বাড়িতে, যার সবচেয়ে কাছের মেট্রো রেলস্টেশান আপাতত দমদম । মায়া পালকে কিন্তু দমদমের মিলিউয়ের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো যাচ্ছে না । রাজারহাটের নিউটাউনও তখনও পর্যন্ত জমে ওঠেনি । মায়া পাল ওই স্টেশানে কি ওনার প্রেমিককে ধরার জন্যেই গিয়েছিলেন ? এই প্রেমের গল্পটাও তো অবিশ্বাস্য । কোনো ভালবাসাবাসি নেই, তার ব্যাকগ্রাউন্ড গড়ে ওঠেনি, ব্যাস, তরুণি বলল, চলুন পালাই, আর তরুণ তার সঙ্গে পালালো !
সিডিটায় , চিন্তা করছিল রিমা, ক্রিয়াপদের কালসঙ্গতি নেই ; কখনও লেখা হয়েছে অতীতকাল প্রয়োগ করে, আবার কখনও বর্তমানকাল । কংকালটা নিশ্চই বাংলায় ভালো মার্কস পেতো না । কিংবা হয়তো ক্যারিড অ্যাওয়ে হয়ে লিখে গেছে ।
প্রিন্টআউটের মার্জিনে এই প্রশ্নগুলো, যেগুলো ওর মগজে উদয় হচ্ছে, লিখে রাখছে ইন্সপেক্টর রিমা খান ।
বাঁ আঙুলে ধরা সিগারেটটা অ্যাশট্রেতে গুঁজে নেভাল রিমা খান । ঠোঁটের ওপর জিভ বুলিয়ে নিল । টেবিলের ওপর ঠ্যাং তুলে চোখ বুজল । কঠিন প্রেম, জটিল প্রেমিক, রহস্যময়ী প্রেমিকা —নিজেকে নিঃশব্দে শুনিয়ে বলল রিমা । মনের ভেতরে ‘আধুনিকতার বিষ’ কথাটা ভাসতে দিল কিছিক্ষণ । আধুনিকতা কী, সেটাই তো জানি না । কোলকাতার কোন লোকটা আধুনিক ? কোন পাড়াটা আধুনিক ? আধুনিকতা ছাড়াই তো বিষে-বিষে ছয়লাপ । এককালে ছিল ঠগিরা । আর এখন ? ঠগ বাছতে ভারত উজাড় ।
দিল্লিতে যে আন্তর্জাতিক ডিটেকটিভ সেমিনারে গিয়েছিল রিমা , তাতে যোগ দিতে লন্ডন থেকে শার্লক হোমসও এসেছিলেন । উনি বলেছিলেন, তোমাদের দেশ থেকে স্বাধীনতার পর চারশো বিলিয়ান ডলার চলে গেছে সুইস ব্যাঙ্কে , আমার কাছে প্রতিটি লোকের নাম, অ্যাকাউন্ট নম্বর আর ডলারের অ্যামাউন্ট আছে ; আমি তালিকাটা দিতে চেয়েছিলুম , কিন্তু তোমাদের দেশের সরকার নিতে রাজি হল না । আসলে কেই বা রাজি হবে ? যার হাতে দেবো , তারই তো লুকোনো টাকার পাহাড় রয়েছে সেখানে ।
মডার্ন ইন্ডিয়া ! নিজেকে নিজে বলেছিল ইন্সপেক্টার রিমা খান ।
অক্টোবর 2, 2012 – 6:44 পুর্বাহ্ন ক্যাটাগরিসমূহ: Detective story | Comments (2)Tagged ডিটেকটিভ উপন্যাস |
তারিখটা আজও মনে আছে : পয়লা সেপ্টেম্বর ।
মেট্রো রেল স্টেশানের চত্বরে দাঁড়িয়ে, মোবাইলটা পকেটে আছে কিনা চেক করছি, একজন তরুণী খপ করে বাঁ হাত ধরে বলে উঠল, ‘চলুন পালাই’ । খপ, এই শব্দটাই মাথায় এলো , অব্যর্থ শব্দ । ডেস্কটপের কি-বোর্ড পর্যন্ত শব্দটাকে নতুন মানে দিয়ে ফেলছে , স্পষ্ট অনুভব করছি । মুখে বললে অশ্লীল শোনাবে এই খপ শব্দটা ; কিন্তু হাত ধরার প্রক্রিয়ায় তো ওই আধ্যাত্মিক ইন্দ্রজাল লুকিয়ে ছিল । ইঁটের তলাকার ঘাসের মতন, রহস্যময় ।
‘চলুন পালাই’ কথাটার জন্যে নয় , বা, ডান হাতের কব্জিতে শক্ত মুঠোয় ধরার, ধরে থাকার কারণে , আমার মুখমন্ডলে যে ভাব ছড়িয়ে পড়েছিল, তা ভয়, ভীতি, অতিপরিচিত ভীতি, রক্তশূন্যতা, অথচ অজানা আশঙ্কা, বিপদের পূর্বাভাস না অন্য কিছু , তা স্মৃতিতে আর ফিরিয়ে আনতে পারছি না যদিও । ব্রহ্মাণ্ড নিশ্চই ভয় থেকে সৃষ্টি হয়েছিল । শব্দহীন, বর্ণহীন, গন্ধহীন, বাতাসের স্পর্শহীন, স্বাদবস্তুহীন পূঞ্জীভূত ভয় , সীমাহীন অন্ধকারে শূন্যবিন্দুতে ঘন হয়ে ওঠার ভয় । স্টেশানের বাইরে দাঁড়িয়ে আমি নিজেকে আবিষ্কার করলুম সেই শূন্যবিন্দুতে । হঠাৎ । আচমকা, এক নিঃশব্দ হিমশীতল বিস্ফোরণ । পয়লা সেপ্টেম্বর ।
তরুণী ফোটোক্রোমেটিক চশমায় , কাচের নিচের দিকটা ফিকে বলে গভীর চোখ দুটোয় প্রশ্নময়তার ঝিলিক । মাথাভরা কোঁকড়ানো চুল । আমার চেয়ে চার-পাঁচ ইঞ্চ ছোট ; দামি ব্র্যান্ডেড ফেডেড জিনসের ওপর সিল্কের ঢিলেঢালা টপ । আমার চেয়ে এক পোঁচ কম ফর্সা , কানে ছোট-ছোট হীরের তারা, ডান হাতে পুরুষালি ঘড়ি, বিদেশি দামি ঘড়ি — ওই হাতেই লুকিয়ে ছিল খপ শব্দটা । পাতলা ঠোঁটে হালকা গোলাপি লিপ্সটিক ছাপিয়ে শ্লেষের মৃদু হাসি, বলল, কী হল ? লেট আস রান অ্যাওয়ে, চলুন পালাই ।
বিন্যস্ত, মনস্হিতিকে শান্ত করতে , স্বাভাবিকভাবে, সময় লাগছিল । আমার প্রতিক্রিয়া উপভোগ করছিল স্মার্ট তরুণী । স্পষ্ট করে বলল, দেখুন, কত কাওয়ার্ড আপনি । নিজের কাওয়ার্ডাইসের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন না বুঝি ? প্রতিদিন তো তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেন আমায় । সারাদিনে বেশ কয়েকবার কাছাকাছি ঘোরাফেরা করেন , বুঝতে পারি কথা বলার সুযোগ খুঁজছেন ; এখন কী হল !
সম্বিত ফিরে পেতে যতক্ষণ । আমাদের ডিপার্টমেন্টের মায়া পাল । কয়েক মাস হল এই বিভাগে জয়েন করেছে । অফিসে তো ইংরেজিতে ছাড়া কথা বলে না , কনভেন্ট স্কুলের ইংরেজি । ওদের সেকশানে গেলে ফিরে-ফিরে চোখ চলে যেত তরুণীটির দিকে । চার্মিং । সুন্দরী না হয়েও আকর্ষণীয়া । হাঁটার, কথা কইবার ঢঙে গর্ব ছলকায় , সম্ভবত উচ্চশিক্ষায় ভালো ফলাফল করার, অঢেল মাইনে পাবার, গোমর , তখন ভাবতুম । মানুষের ভেতরের আলোর খবর সেসময়ে আমার জানা ছিল না । শুনেছিলুম, নানা চাকরি বদল করার অভ্যাস আছে তরুণীটির , একটি থেকে আরেকটিতে লাফিয়ে-লাফিয়ে বর্তমানে বছরখানেক আমাদের অফিসে । প্রতিষ্ঠান হিসাবে অফিস জিনিসটার আর গুরুত্ব নেই । চাকুরিজীবি নিজেই নিজের ব্র্যান্ড । তা সে যে সংস্হায় কাজ করছে সেটি যতই বিখ্যাত হোক ।
আমি জীবনে ওই একটি চাকরিই করেছি , এ ছাড়া কী করব জানি না বলে চাকরি করা শুরু করেছিলুম । বাপ-ঠাকুর্দা যা ছেড়ে গেছে তা যথেষ্ট । বিয়ে-করা, সংসার পাতা ইত্যাদি সম্পর্কে আমার কমিটমেন্ট ভীতি ছিল । আমি জানতুম যে আমি পলিগ্যামাস । একজন নারীর বাঁধনে নিজেকে আটকে ফেলার আশঙ্কায় প্রেমে পড়ার ব্যাপারটা চিরকাল এড়িয়ে গেছি । আকর্ষিত হয়েছি, কিন্তু গড়াতে দিইনি বেশিদিন । কলগার্লদের তাই আমার ভালো লাগত ; কল গার্ল বলতে আমি আমাদের দেশের বেশ্যালয়ের বেশ্যাদের কথা বলছি না । আমাদের দেশের কথাটা এইজন্যে মনে এলো যে পৃথিবীতে আমাদের দেশের বেশ্যালয়গুলোর মতন ্রকম নংরা পরিবেশ বোধহয় আর কোনো দেশে নেই । শহরের সবচেয়ে উপেক্ষিত পাড়াটি তাদের জন্য বরাদ্দ ; ভারতবর্ষে ।
আমি নিজেকে বলতে শুনলুম, আপনি ঠিক কী বলতে চাইছেন, মানে আপনার কথার আড়ালে কী লুকিয়ে রেখেছেন, ডেসিফার করতে পারছি না । এমনিতেই আমার গলা শুকিয়ে জল বা কোল্ড ড্রিংক্সের চাহিদায় তখন । তার ওপর যারা আসপাশ দিয়ে যাতায়াত করছে তারা যাতে কথপোকথন শুনতে না পায় তাই স্তিমিত কন্ঠস্বরে উচ্চারিত হয়েছিল আমার বোকামি ।
কোনোই হেঁয়ালি করিনি আমি ; জাস্ট লেট আস গেট লস্ট । এবার বুঝতে পেরেছেন ? আমি বলছি, চলুন পালাই, আমাদের এই চেনাজানা ম্যাডনেসের বাইরে পালাই, এমন পরিবেশে যেখানে আধুনিক জগত অনুপস্হিত, যেখানে ভিড় একদম নেই, মানুষ দেখতে পাওয়া যায় না সচরাচর, চেঁচামেচি নেই , আওয়াজ নেই, মানুষের গ্ল্যান্ডের দুর্গন্ধ নেই । অ্যাম আই ক্লিয়ার নাও ? আমার হাতের কব্জি ধরে রেখেই বলছিল মায়া । মনে হয়নি কখনও, ও এরকম চিন্তাকে প্রশ্রয় দিতে পারে, ওকে দেখে কখনও মনে হয়নি যে ও মহানগরীর বিতৃষ্ণায় আক্রান্ত ।
আজ বুঝতে পারি, মহানগরীয় বিতৃষ্ণা নয়, অন্য এক অজানার সন্ধান করেছিল মায়া পাল, যা জানতে পারা আমার ক্ষমতা ওজ্ঞানের বাইরে । আজও জানি না তা কী ।
একজন তরুণী তার সঙ্গে কোথাও উধাও হয়ে যেতে বলছে । কলকাতা শহরে, সকাল নটায়, অফিস যাত্রার দৈনিক ব্যস্ততার মাঝে এরকম একটা অ্যাবসার্ড প্রস্তাব দিয়ে বসল । ঠাট্টা-ইয়ার্কি নাকি হিউমিলিয়েট করার উদ্দেশ্যে, তা স্পষ্ট করার জন্যে বললুম, অকারণে অপমান করবেন না প্লিজ, তরুণীরাই আমার দিকে তাকান, তাকিয়ে থাকেন, কেউ-কেউ কথা বলতে চান, কিন্তু আমি কখনই কাউকে ডিমিন করি না, আমি প্রেমে পড়া ব্যাপারটাও ঠিক অনুমোদন করি না , তা ঘটে বলে তো মনে হয় না ।
হাত ধরে রেখেই মায়া বলেছিল, স্ট্রেঞ্জ, গলার টোন থেকে ধরতে পারছেন না যে আমি সিরিয়াস ? আমি বলছি, চলুন, সব কিছু পেছনে ফেলে চলে যাই কোথাও ; আমরা পরস্পরের সঙ্গে সেরকম পরিচিত নই, সেটা একটা প্লাস পয়েন্ট । কিছুটা তো চিনি একজন আরেকজনকে । বিকেল পর্যন্ত আমরা পরস্পরের পরিচিত হয়ে উঠব । পালাতে হলে এভাবেই পালাতে হয় , হঠাৎ । হঠাৎ একদিন কাউকে না জানিয়ে , এক পোশাকে, পরিচিত জগত থেকে ফ্রিক-আউট করে যাওয়া , বিকামিঙ আননোন, অ্যাননিমাস, ফরগটন । প্রেমে পড়ার কথা তো আসছে না । কী ? ভাবছেন, আমার মাথা খারাপ ? মেন্টাল কেস ? তাহলে এরকম চাকরি পেতাম নাকি ? কত স্মার্ট ক্যান্ডিডেট তো ছিল , তা থেকে মাত্র আমি সেলেক্ট হয়েছিলাম , আপনি তা জানেন নিশ্চই ? এই ধরণের চাকরি আমি চাইলেই পেতে পারি । ভাববার সময় নেবেন না । আমিও ঠিক এক্ষুনি ভাবলাম , পালানো যাক । কাউকে বলি, চলুন পালাই , আপনাকেই সামনে পেলুম । ভাবতে চেষ্টা করবেন না । অত্যধিন চিন্তা মানুষকে দুশ্চরিত্র করে । ও , আমার মুখ দেখতে পাচ্ছেন না ? চশমা খুলে মায়া বলল, নিন, চলুন পালাই, আই অ্যাম ডেড সিরিয়াস ।
আমার মুখ দিয়ে আমতা-আমতা কন্ঠস্বরে বেরিয়েছিল, আমি কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি বক্তা হিসাবে গণিত সম্পর্কে বক্তৃতা দিতে যাচ্ছি ।
ফরগেট ইট, বলেছিল মায়া, জানি আপনি গণিত বিশেষজ্ঞ । ওসব ভুলে যান । গণিত কাজে লাগে না , ইংরেজিরও প্রয়োজন নেই , এরকম জনহীন অঞ্চলে চলে যেতে চাই । তাড়াতাড়ি করুন । আমার কাছে এটিএম কার্ড, ক্রেডিট কার্ড আছে ; আপনার কাছেও আছে নিশ্চই । চলুন, যতটা পারা যায় তুলে নিই , তারপর নিরুদ্দেশের পথে ওগুলোর আর প্রয়োজন হবে না ।
মায়ার পরিবারে কে-কে আছে জানি না , কখনও জানিনি, জানতে চাইনি । আমার তো মা-বাবা মারা যাবার পর কেউ নেই , কেউই নেই । বিশাল বাঙলোবাড়িতে আমি একা । দাদুর বাবার ঘর, দাদুর ঘর, বাবার ঘর, বাবা-মা মারা যাবার পর আর খুলিনি । মায়ের চব্বিশ ঘন্টা কাজের বই সেলিমা বেওয়াকেও ছাড়িয়ে দিয়েছি , কেননা একা একজন যুবতীর সঙ্গে, সে কাজের মেয়ে হলেও, একই বাড়িতে থাকা যায় না । বস্তুত কেউ নেই বলেই চাকরি করি । নয়তো চাকরি করার দরকার ছিল না । মায়া পালকে বললুম, আমি অসৎ, জোচ্চোর, বিশ্বাসঘাতক, দুশ্চরিত্র, ফেরেববাজ, বেপাড়ার যাত্রী কিনা তা তো আপনি জানেন না ।
তরুণী হাসির মৃদু ঝিলিক খেলালেন, ঠোঁট সামান্য খুলে, বললেন, অ্যাডাম আর ইভের গল্প জানেন ? তাদের নাভি ছিল না । আমাদেরও অতীত ঠিক এই মুহূর্ত থেকে আর নেই । আমরা এক্ষুনি স্বর্গোদ্যানে নেমেছি । আপনি অ্যাডাম, আপনি নিষ্পাপ । আমরা তাদের মতনই শাকাহারী । এসব কথা বলার জন্যে তো সারাজীবন পড়ে রইলো । এখন চলুন, যেদিকে পথ নিয়ে যায়, সেইদিকে ।
জানি না কে কাকে সন্মোহিত করেছিল । আমরা নিজেদের অ্যাকাউন্ট থেকে যত বেশি সম্ভব টাকা তুলে, দমদম বিমান বন্দরে পৌঁছে, প্রথম ফ্লাইটের খোঁজ করে, চেন্নাইয়ের বিমানে দুটো সিট পেলুম । টিকিট মায়াই কেটেছিল, মিসেস মায়া পাল আর নিরঞ্জন পালের নামে । বিমানে বসে, মায়া চুপচাপ, হয়তো নিজের ফেলে আসা অতীতকে সম্পূর্ণ মুছে ফেলার চেষ্টায় একাগ্র । মেয়েদের অতীত পুরুষদের চেয়ে ভিন্ন হয় বলে আমার অনুমান । আমি অপেক্ষা করছিলুম ওর কথার, কথা বলার, কেননা নুরুদ্দেশে যাবার আকস্মিক পরিকল্পনাটা ওরই , আমি তো তাতে সঙ্গদান করছি মাত্র । আমার দিকে না তাকিয়েই মায়া বলেছিল, আমরা সারা জীবন নিজেদের সম্পর্ক আপনি-আজ্ঞের পবিত্র গভীরতায় রাখব । তুমি-তুমি ওগো-হ্যাঁগোর ছেঁদো নোংরা রুটিনে বাঁধা পড়ব না
বলেছিলুম, পবিত্র ? এই ধরণের অস্পষ্ট শব্দ ব্যবহার করবেন না প্লিজ ।
মায়া বলেছিল, ঠিক বলেছেন, এবার থেকে করব না ; এই রকম শব্দও তো অতীতকে ধরে রাখার ষড়যন্ত্র ।
মায়ার পাশে বসে একই ভাবনা ঘুরছিল আমার মগজে, যা বহুকাল থেকে বাসা বেঁধে আছে । তা এই যে, আমি একজন কুকুর । যে মালকিনির হাতে পড়েছি, সে যেরকম চেয়েছে, যেরকম গড়েছে, তা-ই হয়েছি : প্রেমের কুকুর, কাজের কুকুর, সেবার কুকুর, গুপ্তচর কুকুর, ধাঙড় কুকুর, কুরিয়ার কুকুর, প্রেডাটার কুকুর , পাহারাদার কুকুর, মানসিক থেরাপির কুকুর, অনধের কুকুর, শোনার কুকুর, শোঁকার কুকুর, চাটার কুকুর, রক্ষক কুকুর, গাড়িটানার কুকুর, আদরের কুকুর, এই কুকুর, ওই কুকুর ইত্যাদি । কিন্তু আমার লেজটা জন্মের সময়ে যেমন আকাশমুখো ছিল, আজও তেমনই আছে । থাকবে । এখন টাইপ করতে বসেও জানি, লেজটা অমনই রয়েছে ।
কুকুরের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আমার । টাকা ফুরোলে তো ফিরতেই হবে আরামের শহুরে জীবনে । না ফেরা পর্যন্ত নিরঞ্জন পাল হয়েই থাকা যাক । মায়া হয়তো সংসারের বেড়ি-শেকল থেকে কিছুদিনের জন্যে মুক্তি চাইছে । চেন্নাইতে নেমে, আমার প্রস্তাবমত, দুটো সস্তা ক্যারিব্যাগ, মোটা চাদর, ফোলাবার দুটো বালিশ, মশারি, দক্ষিণ ভারতীয় সস্তা শাড়ি, স্হানীয়দের মতৌ শাদা আর চাককাটা লুঙ্গি কিনে, স্টেশানের কাছে হোটেলে উঠলুম । মিসেস মায়া বণিক আর নিরঞ্জন বণিক নামে । মায়া কারণ বলেনি এই নতুন পদবির । আমি অনুমান করলুম, পেছনের যাবতীয় ছাপ মুছে ফেলতে চাইছে, প্রতিটি পদক্ষেপের, যাতে কেউ খুঁজে না পায় আমাদের । দক্ষিণ ভারতীয় সাপড়া, মানে ভাত সাম্বর রসম পাঁপড় পাতলা দই খেয়ে মায়া দিব্বি ঘুমোলো সারারাত । কোনো তরুণির পাশে শুয়ে ঘুমোনো , আমার মতন জার্মান শেপার্ড বা কুন হাউন্ডের পক্ষে অসম্ভব ছিল । জেগে রইলুম সারারাত । লক্ষ করলুম, মায়ার কানের হীরের টপ, আর হাতের মোটা চুড়িটা নেই । মায়ার পারফিউমের মায়াবিনী সুগন্ধের স্বপ্নিল পরিমণ্ডলে শুয়ে-শুয়ে সেদিন ভেবেছিলুম, এ কিরকম সম্পর্ক ! এ তো প্রেম নয়, কয়েক ঘন্টার জন্যে কেনা মেয়েমানুষের সঙ্গে শোয়া নয় ল সম্পূর্ণ অচেনা একজন মহিলার পাশে শুয়ে আছি , কেন তার কারণ নিজেই জানি না । মগজে ঘুরঘুর করছে ভাবনার ধোঁয়া ।
কে এই মহিলা ? কী চায় ? ধর্মের ঘেরাটোপে পাগল রমণী ?
পাল যখন তখন বৈষ্ণব নয় বলেই তো মনে হচ্ছে যে গোপন বৈরাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়ল ? ফেডেড জিন্স পরে !
একজন প্রায় অচেনা পুরুষের পাশে শুয়ে নিশ্চিন্তে কী করে ঘুমোতে পারে একজন যুবতী , যে দেখতেও ভাল, এমনকি আকর্ষক ?
জীবন থেকে কিছু চাই ? চাইলে আমার তো তাতে কোনো ভূমিকা থাকার কথা নয় ?
হয়তো আমার ভূমিকা ছকে রাখা আছে, ক্রমশ প্রকাশ্য । দেখাই যাক । একটা উদ্দেশ্য তো হল । বেঁচে থাকার উদ্দেশ্য !
আমি একজন যধবতীর পাশে শুয়ে আছি , অথচ আমার শরীরে কোনো যৌন প্রতিক্রিয়া ঘটছে না । এর আগে কোনো যুবতীর সঙ্গে শোবার প্রস্তুতির পর্ব থেকেই আমার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে আনন্দনৃত্য শুরু হয়েছে । উদ্দেশ্যহীন শুয়ে থাকার অভিজ্ঞতা হয়নি আগে ।
চেন্নাই স্টাশানে পোঁছে, প্রথম ট্রেন পাওয়া গেল নেল্লোরের, তার দ্বিতীয় শ্রেণির টিকিট কেটে উঠলুম । হোটেল মালিকও বলেছিল, হনিমুনের জন্য নেল্লোর হয়ে কডপ্পা জেলার ম্যাগনামপেট অঞ্চলে ব্যারাইট ব্যবারিটাস খনি-অঞ্চল ছাড়িয়ে কিছুটা দক্ষিণপূর্বে গেলে খুবই ভাল সময় কাটবে ; সেখান থেকে আরও দক্ষিণে ভেতরদিকে গেলে , কর্ণটক সীমান্তের কাছাকাছি, একেবারে আধুনিকতা-বর্জিত গ্রামসমাজে যাওয়া যায় , উপজাতিরা থাকে, এমন জনসমাজ যেখানে অভাব আছে কিন্তু সেখানের লোকেরা তাকেই জীবন মনে করে , দারিদ্র্যই তাদের বেঁধে রেখেছে পরস্পরের সঙ্গে । তবে যেতে-আসতে অনেক হ্যাপা ।
আমার দশ কিলোমিটার মর্নিংওয়াকের অভ্যাস আছে । মায়াকে জিগ্যেস করেছিলুম, যাবেন কি ওই অঞ্চলে ?
মায়া বলেছিল, ওরকম অঞ্চলই তো চাইছি । দেখছেন তো ক্রমশ আমরা ইশারায় কথা বলতে বাধ্য হচ্ছি , কেননা সকলে আমার-আপনার ভাষা কাজ চালাবার মতন জানে । আমরাও এনাদের ভাষা একবর্ণ বুঝি না, তবুও বাংলা ভাষা দিয়ে কাজ তো চলে যাচ্ছে , কোনোই অসুবিধা হচ্ছে না ।
মায়া পালের কথা শুনছিলুম । যত শুনছিলুম, তত ওকে স্ট্রেঞ্জ মনে হচ্ছিল । ও তো, বুঝতে পারলুম, ব্যারাইট জিনিসটার নামই শোনেনি । বললুম, ব্যারাইট অনেকটা আপনার মতন, ঝিকমিক-ঝিকমিক ক্রিস্টাল দিয়ে গঠিত খনিজ, অনেক রকমের কাজে লাগে । শুনে, আমার মনে হল, ভালো লাগল মায়ার । ওর পাতলা ঠোঁটে হাসি খেলল । ওর বিভিন্ন মৃদু হাসিগুলোর মানে আমি বুঝতে আরম্ভ করেছি । নারীর স্টকে কত রকমের হাসি থাকে তার ইয়ত্তা নেই ।
নেল্লোরে নেমে ট্রেন পালটিয়ে কোদরু । নেল্লোরে যাবার পথে আমার মোবাইল, ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড নিয়ে নিজের পার্সে ঢুকিয়ে ট্রেন থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল মায়া । শখের কালো চশমাটা দিয়ে দিল আমাদের সামনে বসে-থাকা ছেলেটিকে, যে মায়ার পার্স ছুঁড়ে ফেলা দেখে তখনও পর্যন্ত সম্বিত ফিরে পায়নি । নিজের কার্ডগুলোও এক-এক করে জানলা দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছিল । আম কলা পাতিলেবু পেঁপের চাষের এলাকা আর ব্যারিটাইসের খনি অঞ্চল শুনে এই এলাকা চিহ্ণিত করেছিল মায়া । কোদরু থেকে ভাড়ার জিপগাড়িতে আধকাঁচা রাস্তার ধুলোর কুয়াশা ওড়াতে-ওড়াতে খনি অঞ্চল । প্যাংলা শ্রমিকদের আনাগোনা দেখে টের পাওয়া যাচ্ছিল যে খনি অঞ্চল এসে পড়ল । খনি ম্যানেজারকে আমাদের উদ্ভট হনিমুন পরিকল্পনা ব্যাখ্যা করতে, মিস্টার কৃষ্ণাইয়া ওনাদের রেস্ট হাউসে রাতটা কাটাতে দিলেন । এখানেও দুজনে পাশাপাশি শুলুম । তবে বিছানাটা বিশাল বলে আর ঘরে এসি থাকায় অসুবিধা হল না । রাজ্যের কেষ্টবিষ্টুরা এসে থাকেন বোধহয় , তাই বেশ সাজানো-গোছানো ।
আমি অতিপ্রয়োজনীয় ঘুমটা দিয়ে নিলুম । সকালে রেস্ট হাউসের দেয়া ব্রেকফাস্ট খেয়ে অজানা সাংসারিক জীবনের পথে রওনা দিলুম । ব্রেকফাস্টে যাতে ডিম আর দুধ দেয়া না হয় তা ওখানের খানসামাকে বলে দিয়েছিল মায়া । চা কেবল লিকার । ভাবলুম, বোধহয় শনি-মঙ্গলবার ধরণের কোনো স্ত্রী আচার । আমি তো নিজেই যা হোক ব্রেকফাস্ট খাই , ওটস, পরিজ, ব্রেড-স্যান্ড উইচ বা অফিসে পৌঁছে অর্ডার করি । এই অঞ্চলে রেস্টহাউসেই আমরা শাওয়ার বাথ করেছিলুম, একসঙ্গে নয়, প্রথমা মায়া তারপর আমি । যদিও আমার আশঙ্কা ছিল হয়তো মায়া সেরকম কোনো প্রস্তাব দিয়ে বসবে । রহস্যময়ী, অতএব কখন কোন রহস্যের ঘুর্ণিতে গিয়ে পড়ি , তার জন্যে নিজেকে সবকিছুর মুখোমুখি হবার জন্যে প্রস্তুত করে নিয়েছিলুম । মায়ার কার্যকলাপ দেখতে-দেখতে আমি ওর দায়িত্ব নিয়ে ফেলছিলুম ।
খনি ম্যানেজার একজন শ্রমিককে দিলেন গাইড হিসাবে । প্রথমে খনির ম্যাটাডর গাড়িতে, ড্রাইভারের পাশে গাইড, আমরা ক্যারিয়ারে হেলান দিয়ে । গাইড প্রস্তাব দিয়েছিল যে আমরা দুজনে ড্রাইভারের পেছনের সিটে বসি । মায়াই ক্যারিয়ারে বসার আইডিয়া দিয়েছিল, চারিদিকের দৃশ্য দেখতে-দেখতে যাবে বলে । সূর্যের অবস্হান দেখে বুঝতে পারছিলুম যে আমরা দক্ষিণের দিকে কোথাও যাচ্ছি ।
ম্যাটাডর আমাদের যে জায়গায় নামাল, গাঈদের পরামর্শে সেখানকার রাস্তার ধারের এক নোংরা ঢাবায় বিরাট-বিরাট জংলি পাতায় মোটা চালের ভাত আর ভিষণ ঝাল সাম্বর খেলুম । মায়াকে বলেছিলুম, যে কোনো জায়গায় জল খাবার অভ্যাস আছে তো , নয়তো পেট খারাপ হতে পারে । জবাবে মায়া বলেছিল, হলে হবে, ইমিউন হতে হবে তো, নয়তো থাকব কী করে সারাজীবন !
ঘাইড কোথা থেকে একটা গোরুর গাড়ি ডেকে এনেছিল, যতক্ষণ আমরা খাচ্ছিলুম সেই ফাঁকে । দক্ষিণ ভারতীয় বলদ । ওপর দিকে শিঙ উঠে ভেতরে বেঁকে এসেছে , গায়ে-গতরে পশ্চিমবঙ্গের বলদগুলোর চেয়ে স্বাস্হ্যবান । অদ্ভুত লাগল । লোকগুলো প্যাংলাটে আর বলদগুলো ভারিভরকম । মায়া দুহাত এগিয়ে দিয়ে বলল আমাকে গাড়িটায় তুলে দিন । দিলুম । অচেনা একধরণের ঠান্ডা ওর দেহকে ঘিরে রেখেছে মনে হল । এরকম ঠান্ডা দেহের নারী শরীরের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল না । পারফিউমের গন্ধ ছিল তখনও পর্যন্ত , নিশ্চই কোনো বিদেশি দামি পারফিউম লাগিয়েছিল বাড়ি থেকে বেরোবার সময়ে । গায়ে পারফিউম মেখে কেউ বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশে যায় ? গাড়িতে উঠে মায়া বলেছিল, যাক, বলদগুলোকে অত্যধিক খাটায় না , ওদের স্বাস্হ্য ভালো ।
গাড়ির ওপর শুকনো পেঁপেপাতার গদিতে বসলুম আমরা , আর হেলতে-দুলতে চললুম, মায়ার অদেখা স্বপ্নভূমিতে । এখানকার সূর্য কলকাতার সেপ্টেম্বরের সূর্য নয় । মায়ার মুখে ঘামের ফোঁটা ফুটে উঠছিল । মনে পড়ছিল না যে এত কাছ থেকে কোনো যুবতীকে এভাবে ঘামতে দেখেছি কিনা । আম কাঁঠাল লেবু পেঁপে আতা সজনেডাঁটা ইত্যাদি বাগানের পাশ দিয়ে সারারাত গোরুর গাড়ি করে অত্যন্ত ক্লান্ত দেহে ভোরবেলা পৌঁছোলুম এক গ্রামে , যেখানে শ্রমিকটি আমাদের আরেকজনের জিম্মায় দিয়ে চলে গেল । তাকে খি বুঝিয়েছিল জানি না, কেননা ভাষাটা ঠিকমতন ডেসিফার করতে পারছিলুম না । সে আমাদের ক্যারিব্যাগ দুটো মাথায় চাপিয়ে হাঁটতে আরম্ভ করল , আমরা পেছন-পেছন । ঘন্টাখানেক হেঁটে, একটা সরু ঝর্ণার পাশ দিয়ে , যে গ্রামে পোঁছোলুম, তার নাম লোকটি আকারে-ইঙ্গিতে জানিয়েছিল, অগ্রমগাগি, কর্ণাটকের সীমান্তের কাছাকাছি । মজুরি হিসাবে তাকে কিছু টাকা দিতে চাইলে সে নিতে অস্বীকার করল । মায়ার নির্দেশমত আমরা হাত-ঘড়ি দুটো দিয়ে দিলুম , যদিও কী কাজে যা লাগাবে লোকটা কে জানে । হয়তো বেচে কিছু রোজগারপাতি হবে ।
লোকজন দেখতে পাচ্ছিলুম না । চারিদিকে গাছপালা, বনাঞ্চল বলা যায় । গ্রাম বলে তো মনে হল না । জঙ্গলে এনে ছেড়ে দিল নাকি, যখন ভাবছি, একজন চাষিমতন লোক একটা বছর তেরো-চোদ্দর ছেলেকে গাছের ডাল দিয়ে পেটাতে-পেটাতে এদিকেই আসছিল । দৌড়ে গিয়ে ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরল মায়া , আর লোকটাকে বাংলাতেই যেভাবে বকুনি দেয়া শুরু করল তা বুঝতে কোনো ভাষাভাষিরই অসুবিধার কথা নয় । লোকটা তেলেগু ধরণের ভাষায় ছেলেটির অপরাধ, মনে হয়, ব্যাখ্যা করল, আর একেবারে অপরিচিত শহুরে দম্পতি দেখে অবাক প্রশ্ন তুলল ; অন্তত সেরকমটাই মনে হল । আমি ভাঙা-ভাঙা হিন্দিতে বোঝাবার চেষ্টা করলুম যে আমরা এখানে থাকতে এসেছি । নিজামদের প্রভাব কিনা কে জানে, লোকটা বিস্মিত কন্ঠে যা বলল, হায়দ্রাবাদি হিন্দি মেশানো তেলেগুতে, যা পরে জেনেছি আঞ্চলিক ভাষা তুরপু, তা হল যে এই অঞ্চল আপনাদের মতো মানুষের বসবাসের অযোগ্য , এটা ঠিক গ্রাম নয়, এটা আউটার এরিয়া, আমরা অনেক দূরে-দূরে থাকি , কেউই এক জায়গায় থাকি না । এই জঙ্গলটা গড়ে ওঠার আগে আমরা এই জঙ্গলের জমিতেই থাকতুম , আম লেবু পেঁপে কলার খেতে কাজ করতে যেতুম , এখনও প্রায় সকলেই ফলের বাগানে কাজ করতে যায় , তার জন্যে দুবেলা অনেকটা হাঁটতে হয় । এখানে আলো নেই , জল ভরতে অনেকটা হাঁটতে হয় , স্কুল নেই, পঞ্চায়েত দপতর এতো দূরে যে নেই বললেই চলে , কোনো সরকারি লোক আসে না এখানে , লোকে দুবেলা খেতে পায় না , পায়খানা নেই, মাঠে যেতে হয়…
লোকটি বলতে প্রচুর সময় নিয়েছিল , প্রায় আধ ঘন্টা, আমি তার কথার একটা নির্যাস লিখলুম । যাহোক, মায়া তাকে থামিয়ে সর্বভারতীয় খিচুড়ি ভাষায় বলল যে আমরা এখানেই থাকব , তোমাদের সঙ্গে, তোমাদের মতনকরে থাকব ।
মায়ার কথাগুলো আমি আরেকটু বোধগম্য হিন্দি করে বললুম লোকটাকে । সঙ্গের ছেলেটি একবার আমাদের আর একবার ওর বাবার মুখ দেখছিল । আঁচ করলুম যে ছেলেটি বোধহয় তার বাবার চেয়ে ভালো হিন্দি বলতে পারত, যেভাবে সে মৃদু হাসছিল আর কিছুটা অবাক হচ্ছিল আমাদের কথোপকথন শুনে । আমরা ওদের পাশাপাশি হাঁটতে লাগলুম ।
লোকটা বলতে-বলতে যাচ্ছিল, আমি আগে ব্যারাইট খনিতে কাজ করতুম, কিন্তু আমার স্ত্রীর ওই কাজ পছন্দ হচ্ছিল না বলে চলে এলুম, কেননা ওখানকার জল নষ্ট হয়ে গেছে খনির কারণে , শ্রমিকদের নানারকম রোগ হচ্ছে , আমার ছেলেটাও ওখানে কুসঙ্গে পড়ে খারাপ হয়ে যাচ্ছিল, শহরের ছেলেরা আজকাল যেমন হয় ; এখানে ফলমূল খেয়ে চলে যায় । পরে জেনেছি এখানকার তুরপুরা উপজাতি, তাই কারোর নজরে পড়ে না ; এরা ভোটাভুটি সম্পর্কেও আগ্রহী নয় । আরও পরে জেনেছিলুম যে এই অঞ্চলে মাটির তলায় আছে লোহা আর ম্যাঙ্গানিজ ।
আমরা লোকটির পেছন-পেছন তালপাতা পেঁপেপাতা আর গাছের ডালপালা ছাওয়া দরজাহীন একটা ঘরের কাছে পৌঁছোলে, আমাদের পথপ্রদর্শক তিন-চার বার হাঁক পেড়ে ডাকল কাউকে । কিছুক্ষণ পর যে লোকটি উদয় হল , তাকে দুর্বোধ্য বুলিতে বোঝাল আমাদের বক্তব্য । সেই লোকটা আরও রোগা, মাথায় ঝাঁকড়া চুল, কতকাল স্নান করেনি কে জানে । তার কথা আমাদের দোভাষী, বাধ্য হয়ে দোভাষী বলতে হচ্ছে আমাদের পথপ্রদর্শককে, অনুবাদ করে বলল যে একটা ঝুপড়ি আছে , যার ছিল সে বহুকাল আগে হায়দ্রাবাদ কিংবা ব্যাগালুরু চলে গেছে বোউ-বাচ্চা নিয়ে, আমরা চাইলে সেখানে গিয়ে থাকতে পারি ল
শুনে, মায়ার মুখ আলোকিত হল । আমার বিমূঢ় মুখ দেখে মায়া বলেছিল, আমি তো আছি, আশঙ্কা কিসের ।
উত্তরে বলেছিলুম, আমার এতক্ষণ ভুল ধারণা ছিল যে আমি আছি বলে আপনার কোনো আশঙ্কা নেই । প্রতিক্রিয়ায় মায়া মৃদু হাসি খেলিয়েছিল ঠোঁটে । চোখ বুজলেই আমি মায়ার এই বিশেষ হাসি-মাখানো মুখ দেখতে পাই । কতদিন কতবার যে দেখেছি ওর এই অনুমোদনমূলক হাসি , আমার স্মৃতিতে খোদাই হয়ে গেছে ছবিটা ।
আশ্চর্য ! জায়গাটায়, চালাঘরটায় থেকে গেলুম আমরা ! ক্রমশ রপ্ত হতে থাকল মূল ভারতবর্ষের জীবনযাত্রা । কাঁচকলা পোড়া, কাঁঠালবিচি সিদ্ধ-চটকানো , আর কখনো=সখনো আম বা পাকা পেঁপে খেয়ে, কেবল দিনের বেলায় , কেটে গেল বেশ কয়েকটা দিন । অবশ্য যে ছেলেটিকে মায়া মার খাওয়া থেকে বাঁচিয়েছিল , সে আমাদের ভারতীয় জীবনে সেটল হতে সাহায্য করেছিল । সে তালপাতার একটা চাটাই দিয়ে গেছে, যদিও তা অতিব্যবহারে চলনসই গোছের । সে আর তার বয়সী কয়েকটি ছেলে লেগেই থাকত আমাদের সঙ্গে । আমাদের সম্পর্কে তাদের কৌতূহল ; এত কাছ থেকে শহরের মানুষদের জীবনযাত্রা দেখেনি তারা । বহুবার প্রশ্ন করে তার নাম জেনেছে মায়া, সম্পূর্ণ নাম আমাদের পক্ষে উচ্চারখ করা কঠিন বলে মায়া ওকে বালু নাম দিয়েছে । সম্ভবত বালাজীর কোনো একটা নামের স্হানীয় রূপ । বালু কালো রঙের প্লাসটিকের ঘড়া আর প্লাসটিকেরই গেলাস দিয়ে গেছে জল ভরে রাখার আর খাবার জন্যে । ঘড়াটায় পুরো জল ভরা যায় না ; ওপর দিকটা সামান্য ফাটা । গেলাস চাপা দিয়েও কোনো লাভ নেই । প্রতিদিন জল না বদলালে মশা ব্রিড করবে , মায়াকে বলতে ও বলেছিল, এর সবাই তো খাচ্ছে, মশার ডিমসুদ্ধই খাচ্ছে হয়তো , আমরাও না হয় খাবো, ক্ষতি কী ।
কিছু দূরের বিশাল গভীর কুয়ো থেকে গ্রামের মহিলারা জল ভরে আনে দেখে মায়া নিজেই ঘড়া কাঁখে নিয়ে জল ভরে আনে । যতটুকু জল ও বইতে পারে ততটুকু, আমাদের তেষ্টা তাতেই মেটে । ব্লাউজহীন শাড়ি পরা আরম্ভ করেছে স্হানীয় মহিলাদের অনুকরণে । ব্লাউজহীন মায়াকে দেখে প্রথম-প্রথম আমার অস্বস্তি হতো ; তাকাতে লজ্জা করত । মায়াই একদিন সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল, সারা জীবন একসঙ্গে থাকতে হয়ে , ভুলে যাচ্ছেন কেন, তাকান তাকান তাকান তাকান, তাকিয়ে থাকুন ।
আমিও খালি গায়ে কেবল লুঙ্গি পরে থাকি । প্রথম দিন বিব্রত বোধ করেছিলুম , লুঙ্গি পরা আর খালি গায়ে থাকা, এই দুটিরই অভ্যাস ছিল না । মায়াকে দেখি আর নিজেকে কেমন দেখতে হয়েছে হয়ে যাচ্ছে অনুমান করি । গোঁফদাড়ি না কামিয়ে কেমন দেখাচ্ছে তা কালো ঘড়ার জলেতেও দেখার উপায় নেই । কোথাও প্রতিফলনের সুযোগ নেই । সত্যিই , নার্সিসিজম ঘটার কোনো সুযোগ নেই । তার মানে বহু মানুষ জীবনে মাত্র কয়েকবার আয়না দ্যাখে ; দ্যাখার প্রয়োজন বোধ করে না ।
মায়া কী করে চালাচ্ছে বিনা আয়নায় ? আজকালকার যুবতীরা নিজের প্রতিফলন দিনে বহুবার দেখেন । মায়া সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে সেই মায়ার সঙ্গে যে অফিসে আসার আগে নিজেকে সুশ্রী করে তুলে আনতো । অফিসেও টয়লেটে গিয়ে চুলের বিন্যাস গুছিয়ে ঠোঁটে লিপ্সটিকের নবীকরণ করে নিতো । বাড়ি যাবার সময়ে আবার একবার রূপটান দিয়ে নিত ! নারীর অন্তরজগতে পরিবর্তনের দ্রুতি কি পুরুষদের থেকে ভিন্ন ? বা, হয়তো, মায়া পাল নিজেকে নিয়ে চলেছেন এমনই এক জগতে যার সঙ্গে তাঁর নিজেরই পরিচয় হয়নি ? ভাবতুম ।
এখানে রাতের বেলায় না খেলেও চলে, এই প্রথম জানলুম । অন্ধকারেও থাকা যায়, এই প্রথম জানলুম । প্রতিদিন স্নান না করেও থাকা যায়, এই প্রথম জানলুম । ঘরের দরজা বন্ধ না করেও ঘুমোনো যায়, এই প্রথম জানলুম । লুঙ্গি পরে, গায়ে জামা না পরে থাকা যায়, এই প্রথম জানলুম । দাড়িগোঁফ না কামিয়ে থাকা যায়, এই প্রথম জানলুম । মাঠে বসে হাগা যায়, এই প্রথম জানলুম । অচেনা গাছের ডালে দাঁত ব্রাশ করা যায়, এই প্রথম জানলুম ।
মায়া কোথায় প্রাতঃকৃত্য সারতে যায় তা জানি না ; হয়তো অন্যান্য মহিলাদের কাছ থেকে জেনে নিয়েছে ।
একজন নাপিত আসে মাসে কখনও গ্রামে যারা চায় তাদের দাড়ি কামিয়ে গোঁফ ছেঁটে দিয়ে যায় । আমি আমার গোঁফদাড়িকে স্বাধীনতা দিয়েছি, যেভাবে ইচ্ছা বেড়ে উঠুক ।
তবে, মশারি টাঙানো থেকে মুক্ত হতে পারিনি । সন্ধা্যা হলেই মশারির ভেতরে ঢুকে বসে থাকি, মশা আর অজানা কীটের ভয়ে । মায়া বাধা দিয়েছিল । বোঝাতে চেয়েছিল ওকে যে ম্যালেরিয়া হলে যে উদ্দেশ্যে মায়া এসে্ছে তা পূরণ হবে না । অবশ্য কী যে ওর উদ্দেশ্য ছিল তা আজও জানি না ল মাটিতে চাটাই আর মোটা চাদর পেতে শুই । প্রায় সপ্তাহখানেক মেঝের উঁচুনিচু মাটির সঙ্গে খাপখাওয়াতে সময় লেগেছিল । ক্রমশ অমনভাবে শোয়ায় অভ্যাস করে ফেললুম । সহ্য হয়ে গেল ল
উটকো দুজন বাইরের মানুষ এসে তাদের সমাজে থেকে গেল, অঞ্চলের কারোর তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখলুম না । শহরে হলে, ক্লাবের ছেলেরা, পার্টির লোকেরা, পাড়া-প্রতিবেশি সবাই অযথা নাক গলাতো । এখানে কেউ নামও জানতে চাইল না । আমরা কোন ভাষায় কথা বলি বা কোথা থেকে এসেছি , তাতে কারোর কোনো আগ্রহ নেই । ভারতবর্ষে মানুষের চরিত্র ছোটো-ছোটো দ্বীপের মতন পৃথক বৈশিষ্ট্য নিয়ে গড়ে উঠেছে ।
একদিন মায়া বলল, গারু, এখানে পুরুষদের গারু বলে ডাকে, কলকাতায় যেমন স্যার কিংবা বাবু বা দাদা, মায়া বলেছিল, গারু, আজকে আমার মেন্সটুরেশান শুরু হল, হয়তো সেকারণে মেজাজটা নিয়ন্ত্রণে থাকবে না, কিছু মনে করবেন না ।
ভালই হল, বলেছিলুম আমি, এখানে ক্যালেন্ডার বা মাস-তারিখ জানার কোনো ব্যাপার নেই ; আপনার মেন্স যেদিন হবে আমাকে অবশ্যই বলবেন, আমি সামনের কাঁঠাল গাছটায় খুরপি দিয়ে দাগ দিয়ে রাখব , তাহলে মারা যাবার সময়ে আমি বা আপনি জানতে পারব, কতদিন একসঙ্গে ছিলুম । শারীরিক কষ্টের মধ্যেও জোরে হেসে উঠেছিল মায়া । হাসছিল ও, অথচ তার ঢেউ আছড়ে পড়ছিল আমার অস্তিত্বে , রিন রিন রিন রিন রিন । কারোর হাসি যে গা-ময় লেগে থাকে, তার কথা যে মগজের ভেতরে বাজতে থাকে, তার দেহের গন্ধ মনের মধ্যে ফিকে ঢেউ তোলে, তা মায়ার সংস্পর্শে না এলে জানতে পারতুম না ।
কলকাতায় নিজেকে কখনও পরগাছা মনে হয়নি । এখানে, তিন দিনেই মনে হতে লাগল যে পুরুতদের মতন বা পার্টিকর্মীদের মতন অন্যের দানে পেট ভরাতে হচ্ছে । বেশ গ্লানিময় । এত পড়াশোনা করেছি, গণিতে প্রথম শ্রেণি থেকে প্রথম হয়েছি চিরকাল, এই প্রায়-জনহীন গ্রামে সেসব জ্ঞানের কিয়দংশও কাজে লাগছে না । মায়াকে বলতে, ও বলল, ওর অবস্হা আরও খারাপ, ও চিরকাল ইংরেজি মাধ্যমে পড়েছে, ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর করেছে ।
ঘুরে-ঘুরে দেখেছি, আম লেবু পেঁপের গাছে তেলেগুতে সংখ্যা লেখা । গণিত আর ইংরেজি দুটোই সেক্ষেত্রে ফালতু বলেই মনে হল এই অঞ্চলে । তার চেয়ে, দুজনেই ঠিক করলুম, আমরাই শিখি । এই অঞ্চলের কীট পতঙ্গ আগাছা আচার ভাষা যা জানি না, তা-ই শেখার প্রয়াস করি ।
ওর বাবা ব্যারেটাইস খনিতে কাজ করার সময়ে বালো ওখানকার খনিশ্রমিকদের স্কুলে একবছর পড়েছে । বালুকে প্রস্তাব দেয়া হল যে সে আমাদের তেলেগু শেখাবে , যতটুকু ও জানে, অক্ষরজ্ঞান হলেই চলবে , প্রতিদানে আমি ওকে ইংরেজিতে এক দুই তিন চার শৈখাব , আর মায়া শেখাবে এ বি সি ডি । সমস্যা দেখা দিল শুরু করতে গিয়েই । ওর বা ওর পরিচিত কারোর বাড়িতে স্লেট-পেনসিল বা কাগজ কলম নেই । বালুই উপায় বাতলালো । আমাদের চালার বাইরে পেছনদিকে মাটির দেয়ালে কাঠ-কয়লা দিয়ে লেখা হবে আর ভিজে ন্যাকড়ায় তা পোঁছা হবে । ও উৎসাহিত, এইজন্যে যে ও দুটো জিনিস শিখবে আর আমরা দুজনে কেবল একটা । আমাদের ক্লাস নেয়া-দেয়া দেখাতে বালু নিজের মাকে এনেছিল । বালুর মা পরের দিন এসে কুমড়ো দিয়ে গিয়েছিল, যেটা দিয়ে কি করা হবে যাতে তা খাওয়া যায় ঠাহর করতে না পেরে মায়া শেষপর্যন্ত কুমড়ো-পোড়া বানিয়েছিল । গরম-গরম ভালই লেগেছিল খেতে , নুন-হীন । নুন খায় এ-অঞ্চলের লোকে, কিন্তু কুসংস্কারবশত নুন কেউ দিতে চায় না । আর চিনি তো খায়ই না এরা, পায়ই না তো খাবে কোথ্থেকে ! লঙ্কা হয় কারোর কারোর বাড়ির সামনের জমিটুকুতে– এনে দ্যায় বালু ; লঙ্কা দিয়েই স্বাদকে অভ্যস্ত করে নিয়েছিলুম আমরা ।
বালুর দেখাদেখি দশ-বারো দিনে আরও চারজন ছাত্র জুটে গেল আমাদের । ক্রমে গ্রামের, গ্রাম বলতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কিলোমিটার খানেক দূরত্বের সব আগ্রহী ছেলেমেয়ে চলে আসতে লাগল । যার যখন সময় । ওদের শেখার আর আমাদের শেখার তো কোনো নির্দিষ্ট স্কুলসময় বলে রুটিন ছিল না । তাদের মধ্যে থেকে আমরা একজন শিক্ষিকা পেলুম, সিরিদেবি, বোধহয় শ্রীদেবীর অপভ্রংশ, যে তেলেগুতে আমাদের এক দুই তিন চার শেখানো শুরু করল । তারা যে মায়াকেই বেশি পছন্দ করছে তার স্পষ্ট আভাস ফুটে উঠছিল ছাত্রছাট্রিদের মুখে আর ব্যবহারে । মায়া ওদের জড়িয়ে ধরে আদর করতে পারে , আমার কেমন যেন বাধো-বাধো ঠেকে । পড়াবার সময়ে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে আমাদের পা ব্যথা করতে পারে অনুমান করে সিরিদেবির বাবা গাছের ডাল দিয়ে তৈরি দুটো টুল বানিয়ে দিয়ে গেছে একটা একটু নিচু,মায়ার জন্যে, আরেকটা আমার কোমরের উচ্চতায় , আমার জন্যে ।
মাঝে-মথভে পড়াবার দেয়ালটা মাটি দিয়ে লেপে নতুন করে দিয়ে যায় কোনো ছাত্র বা ছাত্রীর মা । নয়তো মায়া নিজেই কোথাও থেকে গোবর এনে সারাদিন লেপার কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখে । মায়া আমাদের চালার ভেতরটাও গোবরে লেপে ফেলেছে । কোথায় যে গোবর পায় তা জানি না ; এখনও তো গোরু বা মোষ নজরে পড়েনি । হয়তো গ্রামের লোকেরা নিয়ে আসে কোথাও থেকে । যখন এক মনে দেয়ালে গোবর লেপে মায়া, আমি ওকে দেখেছি আর অবাক হয়েছি । নিজেকে একেবারে নতুন ছাঁচে ঢালাই করে ফেলেছে মায়া ; দেকতে থাকলে মনে হয় ঠিক যেন রঙ করার আগের মাটির প্রতিমা যার চোখদুটো কেবল আঁকা হয়েছে । আমি নেজেকে কীরকম দেখতে হয়েছে অনুমান করতে পারি ; ক্রমশ মহিষাসুর হয়ে উঠছি , সবুজদেহ অসুর নয়, কয়লাদেহ ।
মায়া চেঁচিয়ে-চেঁচিয়ে তেলেগু সংখ্যা আনকেলু এক দুই তিন চার অর্থাৎ ওকাতি , রেন্ডু, মুন্ডু, নালগু, আইডু, আরু, এডডু, এনিমিডি , তোম্মিদি, পাডি মুখস্হ করত । স্বরবর্ণ বা আচ্ছেলু , ব্যঞ্জনবর্ণ বা হাল্লুলু মুখস্হ করত । আমি ওর সঙ্গীতময় কন্ঠস্বর শুনতুম আর মনে রাখতুম । আজও আমার কানে ওরই তেলেগু অক্ষর বাজছে , যখন এই লেখাটার জন্যে কি-বোর্ড টিপছি । অক্ষরগুলো গোলগোল , বাংলার চেয়ে বেশ কঠিন, ইংরেজির থেকে তো বটেই । মায়া আমার চেয়ে তাড়াতাড়ি শিখে ফেলছে । আমার একটা অক্ষর রপ্ত করতে , এবং তার পরের অক্ষরে গিয়ে প্রথম অক্ষরে ফিরে আসতে তিন-চার দিন লাগছে ।
ও, মায়া, কুয়োতলায় গিয়ে মহিলাদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে, আকারে ইঙ্গিতে ইশারায় তারাও ওকে নানা কথা বলে , আমাদের সংসার গুছিয়ে ফেলেছি কিনা তারা জানতে চায় । মহিলারা জল তোলার সময়ে বাচ্চাকে মায়ার কোলে দিয়ে দেয় । ও ফিরে আসলে ওর গা থেকে শিশুদের গন্ধ বেরোয় । মায়া ফিরে এসে সেই দিনকার কোন বাচ্চা ওকে বেশি আদর করল তার গল্প শোনায় । মনে হয় জল ভরার অছিলায় বাচ্চাদের কোলে নিয়ে আদর করতেই যায় ও । কোনো-কোনো যুবতী শিশু দেখলেই কোলে নিতে চায়, তার সঙ্গে তোতলা কথা বলতে চায়, মায়া সেই ধরণেরই এক যুবতী । মায়া যেন মায়াময় ।
আমি গল্প করার বিশেষ কাউকে পাই না, ছাত্রছাত্রীরা ছাড়া । বৃদ্ধ-বৃদ্ধা আছেন দূরের এক-আধটা চালায় , কিন্তু কী গল্পই বা করব তাঁদের সঙ্গে । তাঁরা আমার কথা বুঝতে পারবেন না, আমি তাঁদের । অনেক সময়ে মনে হয় স্হানীয় পুরুষদের মতন আমিও কোনো ফলের বাগানে গিয়ে চাকরি নিই , অন্তত ভাঙা-ভাঙা কথা বলার লোক তো পাব । মায়াকে সেকথা জানালে ও রাজি হয় না । বলল, ওরা টাকা দেবে, তা নিয়ে কী করবেন ? নতুন সমস্যা দেখা দেবে । টাকা এলে তার সঙ্গে সংসার পাতার প্রক্রিয়াও এসে পড়বে , জীবনে চাই না, এরকম অপ্রয়োজনীয় বস্তু জড়ো হয়ে যেতে পারে , যদিও এখানকার কারোর সঙ্গে এখনও পরিচয় হয়নি যে অমনধারা জিনিস সম্পর্কে আগ্রহ দেখিয়েছে ।
শিক্ষকতার দরুণ গুরুদক্ষিণাও জুটতে লাগল , ইন কাইন্ড, এবং একদিন চালও পাওয়া গেল , লাল খোসাসহ, ব্রাউন রাইস, যা দেখে মায়া বলেছিল, কলকাতায় কত খুঁজেছিলাম প্রকৃত ব্রাউন রাইস , আর এখানে এটা গরিব গ্রামবাসীর খাদ্য ।
বললুম, দেখছেন তো ? অতীত কী ভাবে ঘাপটি মেরে থাকে ! শুনে, মায়া যেন কেমনতর উদাসীন হয়ে উঠল । বেফাঁস কথা বলায় আমিও বেশ অপ্রস্তুত হলুম ।
চাল-পোড়া তো খাওয়া যাবে না , তাই মায়া চাল দাতাকে অনুরোধ করেছিল যে আমাদের একমুঠো ভাত দিলেই চলবে , কাঁচকলা পোড়া বা কাঁঠালবিচি পোড়া দিয়ে খেয়ে নেয়া যাবে , লঙ্কার টাকনা দিয়ে । প্রায় প্রতিদিনই ভাত পেতে লাগলুম , যদিও কলকাতায় যা খেতুম তার চেয়ে অনেক কমই, কিন্তু কম খেয়ে আর রাতে না খেয়ে অভ্যাস হয়ে যাচ্ছিল কম খাবার । আমি চাইতুম মায়া বেশি খাক, মায়া চাইত আমি বেশি খাই । আমি একদিন বলেই ফেললুম, প্রকৃত ভালোবাসা কাকে বলে জানি না , কেবল যৌনতাই জেনে এসেছি এতকাল, আপনি ভালোবাসতে শেখালেন ।
জবাবে মায়া বলেছিল, অতীতকে আনবেন না প্লিজ, আপনি কী ছিলেন, কী করেছিলেন, সব ভুলে যান, সমস্তকিছু মুছে ফেলুন , আমি কি কোনো স্মৃতিচারণ করেছি ?
স্মৃতিচারণ মায়া করেছিল, করে ফেলেছিল, কয়েকজন বিদেশী সাহিত্যিকদের জীবনবোধকে একদিন তীব্র আক্রমণ করে ; আমি তাদের বইটই তখনও পর্যন্ত পড়িনি । তাই মুখ বন্ধ রেখে মায়ার জীবনদর্শনের সঙ্গে পরিচিত হবার সুযোগ উপভোগ করেছিলুম ।
ভাত পেয়ে, মায়া বলেছিল, ভাতও খাবো কিনা সে-চিন্তায় ছিলাম , কেননা ভাতের সঙ্গে তো অতীত জুড়ে রয়েছে । আপনি আমাকে ভালোবাসার চোখে দেখবেন তা আমি জানি , আমিও যে আপনাকে ভালোবাসছি, ভালবেসে ফেলেছি, তা অনুভব করছেন না ? আমার চোখের পানে সরাসরি তাকিয়ে মায়া যোগ করেছিল, বালুরা যে ঝর্ণার জলে স্নান করতে যায়, কালকে চলুন সেই ঝর্ণায় গিয়ে স্নান করি , আমাদের সত্যিই এবার পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন, নয়তো আচমকা কোনো রোগে দুজনের একজন আক্রান্ত হয়ে পড়তে পারি ।
আমি বলেছিলুম, কালকে নয়, যেদিন আপনার চতুর্থ মেন্সের দাগ কাঁঠালগাছে আঁকব, সেই স্নান ঝর্ণার জলে করবেন ।
—আপনি জানেন দেখছি , মধ্যবিত্ত সংস্কার অনুযায়ী স্নান করতে হয় ।
—হ্যাঁ, পর পর তিনবার আপনাকে স্নান করতে দেখলুম না, বলার সাহসও হয়নি ।
—আদিম মানবীরা কি স্নান করত ? বিদেশের প্রতিটি দেশের মহিলারা কি স্নান করেন ? এখানের মহিলারা করেন ? স্নান করাটা, দেখেছেন তো, এখানকার জনজীবনে উৎসবনির্ভর । দৈনন্দিন রুটিন নয় ।
—আরেকটা কথা বলি আপনাকে । একই মশারির ভেতর পাশাপাশি শুতে এখনও অস্বস্তি হয় আমার । কাঠ হয়ে শুয়ে থাকতে হয় । আমি বলেছিলুম মায়াকে ।
—আমি তো ওভাবে শুই না । আমি তো আপনাকে অ্যাডাম মনে করি আর নিজেকে ইভ , তাহলে স্পর্শ বাঁচাব কেন ? বলেছিল মায়া , অকপটে ।
—আমি কি আপনাকে জড়িয়ে ধরতে পারি ? বলেছিলুম আমি ।
—এই নিন আপনার অস্বস্তি কাটিয়ে দিচ্ছি ; বলছেন ভালোবাসেন, ভালোবাসা তো সর্বগ্রাসী । বলতে-বলতে মায়া জড়িয়ে ধরল আমায় । বলল, এই কারণেই ঝর্ণার জলে গিয়ে স্নান করে আসার প্রস্তাব দিয়েছিলাম । জানি, শহরের সুগন্ধ থেকে মুক্ত হয়ে গেছি, আদিম মানবীর গন্ধ হয়তো ছেয়ে গেছে দেহে । জানি না এখানকার স্বাভাবিক দেহ-গন্ধে আপনি নিজেকে খাপ খাওয়াতে পেরেছেন কিনা ।
—আপনার হাত যতক্ষণ না ক্লান্ত হচ্ছে ততক্ষণ জড়িয়ে থাকুন প্লিজ, বললুম আমি । আমিও জড়িয়ে ধরব কিনা নির্ণয় নিতে না পেরে ওভাবেই দাঁড়িয়ে রইলুম । এখানে এসে তো কেবল লুঙ্গি পরে থাকি , যা কাচা হয়নি এখনও । মায়াও একই কাপড় পরে আছে ।
বহুক্ষণ ওভাবে জড়িয়ে ধরে রেখেছিল মায়া । অথচ আমার যৌনতার উদ্রেক হল না । আমিই ক্লান্ত হয়ে পড়ছিলুম এক ঠায়ে দাঁড়িয়ে । বললুম, জানি, আপনার হাত ক্লান্ত হয়ে পড়েছে ; আমার অস্বস্তি কেটে গেছে । চলুন আমরা আমাদের আরামকেদারায় বসি । আরামকেদারা অর্থে কাঁঠালগাছের তলায় রাখা দুটো পাথর । গ্রামের লোকেরা ওদুটো আমাদের জন্যে এনে দেয়নি, ওগুলো আগেই ছিল ওখানে, হয়তো কাঁঠাল গাছে ওঠার জন্য কখনও এনেছিল কিশোর-যুবকেরা ।
পাথরের ওপর বসে মায়া শোনাত জীবনের সৌন্দর্যের গল্প । ও বলত, দেখছেন তো, জীবন মোটেই দরিদ্র, পঙ্কিল, কদর্য, অশ্লীল , জঘন্য, স্হূল, পাশবিক, অশিষ্ট , বর্বর নয় । শহরের সমস্তপ্রকার সুবিধা থেকে বঞ্চিত আমরা ; তবু কত শান্তিতে রয়েছি ।
কাঠাল গাছে দাগ দেবার চার দিন পর আমরা ঝর্ণার জলে স্নান করতে গেলুম , অনেকটা হেঁটে, প্রায় তিন কিলোমিটার । আমাদের সঙ্গে তিনজন ছাত্র যোগ দিল । আমি ভালোভাবেই স্নান করলুম, গা থেকে নোংরা ঘষে-ঘষে তুললুম । চুলের জট ছাড়ালুম , আঙুল দিয়ে আঁচড়িয়ে দাড়ির চুল ভালো করে ধুলুম । জলের আয়নায় নিজেকে প্রাগৈতিহাসিক মানব মনে হচ্ছিল । বহুদিন পর নিজের প্রতিবিম্ব দেখে নিজেকে অপরিচিত মনে হচ্ছিল ।
মায়ার প্রায় পুরোটা সময় গেল ছাত্রদের দিকে নজর রাখতে । একজন ছাত্র, কার্তিকা, বলল, আজকে আকাশ এরকম মানে রাতে বৃষ্টি পড়বে, তখন বৃষ্টিতে নাচব ।
ছাত্রদের জল থেকে তুলে, তাদের নিয়ে আমি রওনা দিলুম আস্তানার দিকে, ছাত্রদের দুজনের চালা আমাদের চালা থেকে বেশ দূরে, আধঘন্টার বেশি হাঁটতে হবে ওদের । মায়াকে বললুম, আপনিও ভালোভাবে স্নান করে আসুন , আপনার চুল তো সাধুদের মতো হয়ে চলেছে , আমি এদের নিয়ে এগোচ্ছি । কিছুটা হাঁটার পর বালু মায়াগারু মায়াগারু বলে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল, আঙুল তুলে দেখিয়ে বলল, আম্মা আম্মা । দেখলুম মায়া সম্পূর্ণ বিবস্ত্র হয়ে স্নান করছে । অপূর্ব লাগল । ভয়ও হল , প্রচণ্ড ভয়, যদি কেউ ওকে লুকিয়ে দেখতে থাকে ! তাকিয়েছিলুম ওর দিকে । তক্ষুনি মনে হল উচিত কাজ করছি না । এর আগে ওকে নগ্ন দেখিনি । দৃশ্যটা চোখ বুজলেই ভেসে ওঠে, আজও ।
মায়া ওদের আম্মা হয়ে উঠেছে কবে থেকে জানতুম না । বোধহয় কুয়োতলায় বাচ্চাদের আদর করার দৌলতে বা শিক্ষকতার কারণে ।
রাতে দুজনে দুজনকে নগ্ন পেলুম । একে আরেকজনের সামনে দাঁড়িয়ে, প্রায়ান্ধকারে, মশারির বাইরে । মায়া প্রশ্ন করল, ইতস্তত করছেন ? নিজেকে ফর্নিকেটর বা আমাকে ফ্ল্যাপার ভেবে গুটিয়ে রাখছেন না তো নিজেকে , মিস্টার মায়ালিঙ্গা ।
বললুম, আপনি এখানে সবায়ের আম্মা হয়ে গেছেন , কিশোর-কিশোরীদের, তাদের মা-বাবার সকলের আম্মা ; আমি নিরঞ্জন দত্ত থেকে ক্রমশ অবলুপ্তির পথে মিলিয়ে যাচ্ছি মায়ায়, নাম থেকে নামে , নামহীনতায় । কিন্তু আমার আর আপনার মাঝে আমি আর কাউকে চাই না, তাই ইতস্তত করছি । আমি চাই কেবল আপনি আর আমি , আমাদের নিজস্ব ব্রহ্মাণ্ডে ; আপনিই তো বলেছিলেন, আমরা কোনো সংসার পাতাপাতি করব না । আমরা যদি যৌনকর্মে মিলিত হই তাহলে আমরা হয়তো একধাপ এগিয়ে যাব সংসার পাতার পথে। আমি আপনার অখণ্ড ভালোবাসা চাই । কারোর সঙ্গে ভাগাভাগি করতে চাই না । আমি চাই না হঠাৎ কোনো শিশু এসে আমাকে আপনার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিক ।
মায়া বলেছিল, পিরিয়ডের প্রথম সাতদিন ও শেষ সাতদিন সেফ হয় । আপনি আমাকে জড়িয়ে ধরে আমার শরীরের তাপ অনুভব করুন আর তা স্মৃতিতে ধরে রাখুন । আপনি তো গণিত বিশেষজ্ঞ ; প্রকৃতি দেহের জন্যে গণিতের ছক তৈরি করে দিয়েছে । আমি আমার দেহের রসায়নের গণিত ও মিউকাস তৈরির কথা জানি , কী ভাবে তা ক্যালকুলেট করতে হয় জানি, কিন্তু নিজের দেহের তাপ তো নিজে অনুভব করতে পারব না । আপনি এই সময়ে প্রতিদিন আমাকে জড়িয়ে ধরবেন, যেদিন আমার শরীরের তাপ যৎসামান্য উনিশ-বিশ মনে হবে সেদিন জানাবেন । আমিও আপনার দেহের রসায়ন যাচাই করব । প্রকৃতি মনের তাপ আর দেহের তাপে পার্থক্য তৈরি করে রেখেছে । মনের তাপে আমরা কাছে আসব, আর দেহের তাপে যৌনক্রিয়া করব না । আমিও আপনার দেহের তাপ নজরে রাখব যাতে টের পাই যা আপনার দেহ অসুখের দিকে যাচ্ছে না । স্বাস্হ্য দেখে তো মনে হয় আপনার ইমিউন সিসটেম পর্যাপ্ত ।
জড়িয়ে ধরতে যাব, হাওয়ায় কেমন যেন বাঁশিতে তোলা উদারার আওয়াজ পেলুম , সম্ভবত ঝড়ের পূর্বাভাস , অদৃশ্য এক ধ্বনিকুহক ঝড়কে ডাকছে । সকালে কার্তিকা বলেছিল বৃষ্টি হবে, একজন বৃদ্ধও স্নান করতে যাবার পথে বলেছিল, আমরা যেন তাড়াতাড়ি ফিরে আসি, কেননা আজকে ঝড় উঠতে পারে । দুজনে বাইরে উঁকি দিলুম । দেখলুম আকাশ অমাবস্যার রাতের মতন অন্ধকার কিন্তু গোলাপি আভায় ছেয়ে গেছে । বালু ওর মায়ের হাত ধরে দৌড়ে-দৌড়ে এদিকে আসছে দেখে আমরা দ্রুত কাপড় পরে নিলুম । বালুর মা হাত নেড়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে তুরপু তেলেগুতে যা বলল তা আমরা বুঝতে না পারলেও, এটুকু বুঝলুম যে আমাদের মতো ওরাও ভয়ঙ্কর ঝড়ের আশঙ্কা করছে । বালুর কথায় স্পষ্ট হল যে এখানে থাকতে নিষেধ করছে ওর মা, ঝড় আমাদের উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে ।
মায়া বলল, নিয়ে যাক না উড়িয়ে, হারিয়ে যাবার জন্যেই তো এসেছি ।
—পাগলামি করবেন না , এখনও সম্পূর্ণ ভালোবাসা পাইনি আপনার । মায়ার হাত ধরে টানতে-টানতে দৌড়োলুম বালুর মায়ের পেছনে, ঝর্ণার দিকে । প্রশ্ন করার সময় ছিল না । কিছুদূর গিয়ে মায়াকে কাঁধের ওপর তুলে নিলুম, কারণ ও খালি পায়ে দ্রুত দৌড়োতে পারছিল না । দৌড়োবার সময়ে দেখতে পেলুম, অন্ধকারে বহু ছায়া দৌড়োচ্ছে আমাদের সঙ্গে, পেছনে, সামনে, বাঁদিকে, ডানদিকে । কোথাব ছিল এত মানুষ, আগে তো এতজনকে একত্রে দেখিনি । ঝড় সবাইকে আতঙ্ক দিয়ে বেঁধে ফেলেছে । ঝর্ণার স্রোতকে পাশ কাটিয়ে সবাই উঠলুম পাহাড়ের ওপর । ছায়াদলের নেতা ঢুকে গেল পাহাড়ের কন্দরে । তাকে একে-একে অনুসরণ করল সবাই, আমরাও । অন্ধকার গুহা । কে কোথায় কিচ্ছু টের পাওয়া যাচ্ছিল না । কেবল চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছিল । মহিলারা স্বামীকে, ছেলেদের ডেকে একত্রিত করছেন হয়তো । ভেতরে ঢুকে, মায়াকে নামিয়ে, টের পেলুম আগে থাকতে অনেকে এসে বসে আছে । আমি মায়ার হাত শক্ত করে ধরে রইলুম । বাইরে তখন প্রচণ্ড বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে , শোনা যাচ্ছে মেঘের আনন্দ-চিৎকার , আর থেকে-থেকে ভেতরে ছিটকে আসছে তার চিৎকারের আলো । এই প্রথম দেখলুম আলোও প্রতিধ্বনিত হয় ।
সবাই গুহার উবড়ো-খাবড়া দেয়ালে পিঠ দিয়ে বসে রইলুম সারা রাত । মায়া আমার কোলে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেও আমি ঘুমোইনি । জেগে বসেছিলুম সারারাত । ঘুমোলে যদি জেগে উঠে হঠাৎ নিজেকে দেখি দাদুর বাঙলোবাড়িতে আমার বিছানায় একা শুয়ে আছি ! অতীতকে মনে হচ্ছিল অবিশ্বাস্য । ভাবছিলুম সত্যিই কি পরিচিত প্রথিবীতে আছি না কি স্বপ্নের দুনিয়ায় ।
সকালে একে-একে বাইরে বেরিয়ে দেখলুম যে ঝড় বয়ে চলে গেছে অঞ্চলের ওপর দিয়ে । পাহাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে অন্যদিকটায় দেখতে পাচ্ছিলুম অজস্র কলা আর পেঁপেগাছ ফলসুদ্ধ ভেঙে পড়ে আছে । এত দূর থেকেও দেখতে পাচ্ছিলুম কাঁচা আর আধপাকা পেঁপে আর কলার কাঁদি কাৎ হয়ে ছড়িয়ে রয়েছে চারিধারে । ক্ষুধার্ত ঝড় কলা আর পেঁপে খেতে-খেতে এসেছে , আমাদের ভয় দেখিয়ে, আরও ভেতরে ঢুকে গেছে ঝড়টা, ব্যারাইটের খনির দিকে । বোধহয় এটা ছিল বঙ্গোপসাগরে ওঠা এক সামুদ্রিক ঘূর্ণির ল্যাজের ঝাপটা ।
পাহায থেকে নামবার সময়ে চোখে পড়ল ঝর্ণার স্বাস্হ্যবতী হয়ে ওঠা কলকল নৃত্য । মায়া বলল, আমার হাত ধরে, আপনি ওভাবে হঠাৎ কাঁধে তুলে নিলেন আমায় ? ইন্সটিংক্টিভলি ? কাঁধে তুলে দৌড়োচ্ছিলেন যখন, আমি আপনার গলা জড়িয়ে শুনতে পাচ্ছিলাম আপনার হৃৎপিণ্ড কত দ্রুত কাজ করে চলেছে. আমারই জন্যে , কী আশ্চর্য , তাই না ?
বলেছিলুম, কোনো চিন্তা মাথায় আসেনি তখন ; জাস্ট পৌঁছে যেতে চেয়েছিলুম পাহাড়ের ওপরে যত তাড়াতাড়ি পারা যায় ; আপনি যে আমার কাঁধে, আপনি যে আমার গলা জড়িয়ে ঝুলছেন, তা লক্ষ করার সম্বিত ছিল না তখন ।
যে যার চালার দিকে হাটতে লাগলুম । জঙ্গল পেরিয়ে আমাদের এলাকায় পৌঁছে স্পষ্ট হয়ে উঠল যে প্রায় সবায়ের চালা , সম্পূর্ণ পড়ে না গিয়ে থাকলেও , ভেঙেচুরে হেলে আছে । জঙ্গলের সুউচ্চ গাছগুলো চালাগুলোকে গুটিয়ে নিয়ে যেতে দেয়নি । আমাদের চালাটা কোনোমতে টিকে আছে । তবে ক্লাস নেবার দেয়ালকে খেয়ে ফেলেছে ঝড়ে , আর বেরিয়ে পড়েছে দেয়ালের পাঁজরা, শুকনো পেঁপে গাছের ও অন্যান্য গাছের ডালপালা, যার ওপর মাটি-গোবর লেপে গড়ে উঠেছিল দেয়ালের আস্তরণ বা ব্ল্যাকবোর্ড ।
গোরুছাগল কোথায় থাকে আমি খোঁজ নিইনি কখনও ; মায়া জানে । পরে ও বলেছিল, জন্তুগুলোর জন্যে পাথরে ঘেরা দেয়াল আছে , সেখানে ঢুকিয়ে গাঁছের গুঁড়ির গেট বন্ধ করে দেয়া হয় রাতের বেলায় । ফলে ঝড়ে জন্তুগুলো ডাকাডাকি করলেও বহাল তবিয়তে আছে ।
আমাদের ঘরের ভেতরেও জল ঢুকে গিয়েছিল । মশারি ভিজে চুপচুপে । ক্যারিব্যাগ দুটো চলে গিয়েছিল চালার বাইরে, বেশ দূরে । খুঁজে আনতে হল । মায়া বলেছিল , দেখেছেন তো ? প্রকৃতিও আমাদের দুজনার সঙ্গে রয়েছে । আধুনিকতার বিষ থেকে আমাদের ধুয়ে দিয়ে গেল । আমাদের ঘর এবার আমরা নিজেরাই মাটি লেপে নতুন করে তুলব । মেঝেটাও মসৃণ করে নেব যাতে আপনার পিঠে না ফোটে ।
আমি মনে-মনে ভেবেছিলুম, আধুনিকতার বিষ কি এড়ানো যায় ? যায় না, তার কারণ আমাদের নেশা ধরিয়ে দিয়েছে আধুনিকতা , মাদকের চেয়েও মহা আকর্ষক সেই নেশা । চলুন পালাই ডাকে সাড়া দিয়ে চলে তো এসেছি, তা কি মুক্ত করেছে আমাদের , আমাকে ? সদাসর্বদা আধুনিক বস্তুর অভাব বোধ করতে থাকি । মায়া না থাকলে এখানে এক ঘন্টাও টিকতে পারব না । মায়াই আমার জীবনদায়ী ওষুধ ।
পুরো প্রিন্টআউট পড়া শেষ হলে ইন্সপেক্টর রিমা খান সংশ্লিষ্ট সিডিটায় লিখে রাখল ‘পঠিত’ । এবার খুঁজে বের করতে হবে মায়া পালকে । মায়া পালই কি প্রেমিককে খুন করে উধাও হয়ে গেছে । ইনি কি সত্যিই কেউ , নাকি বানানো গল্প । কোথায় থাকেন ? বোঝা যাচ্ছে বেশ ধনী পরিবারের মেয়ে । উচ্চ-মধ্যবিত্ত বাঙালি এলাকায় নিবাস, নিঃসন্দেহে । বাবার নাম জানা গেলে সুবিধা হতো । কিন্তু পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতে লালিত একজন তরুণীর ওইভাবে জোতদার-জমিদার পরিবারের যুবককে প্রেমিক হিসাবে বেছে নেয়াটা কিরকম যেন বিসদৃশ ঠেকল ইন্সপেক্টর রিমা খানের । ইংরেজি ভাষার সঙ্গে গণিত কি মেলে ? মেট্রো রেলস্টেশান মানে এখানে দমদমই বুঝতে হবে, কেননা প্রেমিক মশায়ের সিদিগুলো পাওয়া গেছে ওনার বাড়িতে, যার সবচেয়ে কাছের মেট্রো রেলস্টেশান আপাতত দমদম । মায়া পালকে কিন্তু দমদমের মিলিউয়ের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো যাচ্ছে না । রাজারহাটের নিউটাউনও তখনও পর্যন্ত জমে ওঠেনি । মায়া পাল ওই স্টেশানে কি ওনার প্রেমিককে ধরার জন্যেই গিয়েছিলেন ? এই প্রেমের গল্পটাও তো অবিশ্বাস্য । কোনো ভালবাসাবাসি নেই, তার ব্যাকগ্রাউন্ড গড়ে ওঠেনি, ব্যাস, তরুণি বলল, চলুন পালাই, আর তরুণ তার সঙ্গে পালালো !
সিডিটায় , চিন্তা করছিল রিমা, ক্রিয়াপদের কালসঙ্গতি নেই ; কখনও লেখা হয়েছে অতীতকাল প্রয়োগ করে, আবার কখনও বর্তমানকাল । কংকালটা নিশ্চই বাংলায় ভালো মার্কস পেতো না । কিংবা হয়তো ক্যারিড অ্যাওয়ে হয়ে লিখে গেছে ।
প্রিন্টআউটের মার্জিনে এই প্রশ্নগুলো, যেগুলো ওর মগজে উদয় হচ্ছে, লিখে রাখছে ইন্সপেক্টর রিমা খান ।
বাঁ আঙুলে ধরা সিগারেটটা অ্যাশট্রেতে গুঁজে নেভাল রিমা খান । ঠোঁটের ওপর জিভ বুলিয়ে নিল । টেবিলের ওপর ঠ্যাং তুলে চোখ বুজল । কঠিন প্রেম, জটিল প্রেমিক, রহস্যময়ী প্রেমিকা —নিজেকে নিঃশব্দে শুনিয়ে বলল রিমা । মনের ভেতরে ‘আধুনিকতার বিষ’ কথাটা ভাসতে দিল কিছিক্ষণ । আধুনিকতা কী, সেটাই তো জানি না । কোলকাতার কোন লোকটা আধুনিক ? কোন পাড়াটা আধুনিক ? আধুনিকতা ছাড়াই তো বিষে-বিষে ছয়লাপ । এককালে ছিল ঠগিরা । আর এখন ? ঠগ বাছতে ভারত উজাড় ।
দিল্লিতে যে আন্তর্জাতিক ডিটেকটিভ সেমিনারে গিয়েছিল রিমা , তাতে যোগ দিতে লন্ডন থেকে শার্লক হোমসও এসেছিলেন । উনি বলেছিলেন, তোমাদের দেশ থেকে স্বাধীনতার পর চারশো বিলিয়ান ডলার চলে গেছে সুইস ব্যাঙ্কে , আমার কাছে প্রতিটি লোকের নাম, অ্যাকাউন্ট নম্বর আর ডলারের অ্যামাউন্ট আছে ; আমি তালিকাটা দিতে চেয়েছিলুম , কিন্তু তোমাদের দেশের সরকার নিতে রাজি হল না । আসলে কেই বা রাজি হবে ? যার হাতে দেবো , তারই তো লুকোনো টাকার পাহাড় রয়েছে সেখানে ।
মডার্ন ইন্ডিয়া ! নিজেকে নিজে বলেছিল ইন্সপেক্টার রিমা খান ।
Tagged ডিটেকটিভ উপন্যাস |
২. প্রেমিক কংকালের আত্মক্ষত
পরের সিডিটার প্রিন্টআউট পড়ায় একাগ্র হল রিমা, যদি কোনো সূত্র পাওয়া যায় :
নাম নিরঞ্জন পাল, বণিক, ব্যানার্জি, দত্তমজুমদার, মিত্র, লিঙ্গা, গারু, ওয়েডিং গিফ্ট , সাকার, লম্বুলোচ্চা ইত্যাদি । একাধিক ওরফেও পাওয়া গেছে । বয়স আনুমানিক এত বছর এত মাস এত দিন । উচ্চতা পাঁচ ফিট নয় ইঞ্চি । ওজন এত কিলো । মুখাকৃতি সম্ভবত ওভাল , চওড়া কপাল । চুল কাঁচা-পাকা । গায়ের রঙ ফর্সা । এই ডিস্কে টেক্সট ঢোকাবার সময়ে প্রথম দিন লাল টিশার্ট , ব্লু ফেডেড জিনস পরে আছি ।
কেন এসব লিখছি ? শেষতম মহিলা জানতে চেয়েছেন । মেয়েটির নাম বিদকুটে । আমি তাই ওকে ‘শেষনি’ বলে ডাকি । ও নিজেও চায় না যে আমি ওর নামটা এখানে রেকর্ড করি । কিন্তু আমি শেষনিকে বলিনি যে আমি সিডিতে তুলে রাখছি । ও শুধু জানে যে হার্ড ডিস্কে থাকছে । ও আমার কমপ্লিট লাইফ-স্টোরি চায় । আমি বাংলায় লিখছি বটে, কিন্তু অক্ষরগুলো থাকছে তেলেগু । ও বলেছে কাউকে দিয়ে বাংলা অক্ষরে কনভার্ট করে নেবে । নিক । কী কাজে লাগবে জানি না । নিরঞ্জনের শিক্ষা গণিতে স্নাতকোত্তর । আয়ের স্রোত বহুবিধ । দাদুর বাবার সোনাদান , দাদুর জমিজিরেত, বাবার সম্পত্তি, যা ভাগ্যিস বেদখল হয়নি ; কোমপানি ডিভিডেন্ড ; ফিক্স ডিপজিটস ; গভমেন্ট সিকিউরিটিজ । বাবা নামকরা ফৌজদারি উকিল ছিলেন । কত খুনি, জোচ্চোর, ডাকাত, ব্যাংক জালিয়াত, বাটপাড়, রাজনৈতিক গুণ্ডা , টাকা ছয়লাপকারীদের জেল থেকে বাঁচিয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই । মা ছিলেন স্কুল শিক্ষিকা ; ব্রাহ্মণ পরিবারের ।
আমি প্রথম চাকরি পাবার দিন বাবা মারা গেলেন। আঘাত সহ্য করতে না পেরে মা মারা গেলেন তিন মাস পর , একই তারিখে, স্ট্রঞ্জলি ; অথচ দুজনের যে খুব ভাব-ভালবাসা ছিল তা নায় । নারী-পুরুষের এরকম ব্যাখ্যার অতীত সমস্যাসংকুল সম্পর্ক যে সম্ভব, তা আমি নিজের জীবন থেকেই জানি ।
জীবনের বাঁকবদলগুলো, যতবার ঘটেছে বাঁকবদল, সব সব সব সব নারীকেন্দ্রিক ; নারীর ইচ্ছার, নির্দেশের, দেহের, আকর্ষণের, রহস্যের মোহে । স্কুলের শেষ পরীক্ষায় ভাল, সান্মানিক স্নাতকে খুব-ভাল , স্নাতকোত্তরে অত্যন্ত ভাল, তাদেরই কারণে , প্রভাবে, চাপে, আদরে । চাকরিতে যোগ নারীর জন্যে উন্নতি নারীর জন্যে, চাকরি ছাড়া নারীর জন্যে , ভাসমান জীবিকা নারীর জন্যে , অবসরে পৈতৃক বৈভবে পরগাছাবৃত্তি নারীর কারণে । কে জানে, হয়তো মৃত্যুও নারীর হাতেই হবে ।
জীবনে নারীদের আসা-যাওয়া, সেনসেক্স ওঠা-পড়ার মতন, না ঘটলে, আমার ব্যর্থতা, ব্যথা, পরাজয়, গ্লানি, অপরাধবোধ, এ-সবের জন্যে কাকেই বা দায়ি করতুম ! কাকেই বা দোষ দিতুম আমার অধঃপতনের জন্যে ? লোভি লম্পট মাগিবাজ প্রেমিক ফেরারি হয়ে ওঠার জন্যে ? হবার, নাকি হয়ে ওঠার ?
আসলে আমি একটা কুকুর । আগের সিডিতে লিখেছি, তবু রিপিট করছি শেষনির খাতিরে । যে-মালকিনির হাতে পড়েছি , সে য-রকম চেয়েছে, যে-রকম গড়েছে , তা-ই হয়েছি । সেবার কুকুর, কাজের কুকুর, প্রজননের কুকুর, গুপ্তচর কুকুর, ধাঙড় কুকুর, কুরিয়ার কুকুর, প্রেডাটার কুকুর, পাহারাদার কুকুর, মানসিক থেরাপি কুকুর, শোনার কুকুর, শোঁকার কুকুর, চাটার কুকুর, রক্ষক কুকুর, গাড়িটানার কুকুর, কোলের কুকুর, আদরের কুকুর, এই কুকুর, ওই কুকুর, সেই কুকুর ইত্যাদি । কিন্তু একমাত্র কুকুর যেটাকে আমি ভালবেসেছি, তা হল মালকিনিকে উন্মাদের মতন ভালবাসার কুকুর । কিন্তু আমার লেজটা জন্মের সময়ে যেমন আকাশমুখো ছিল , চিরকাল তেমনই থেকে গেছে । আজও, যখন আমার গা থেকে চুল ঝরে যাচ্ছে, চোখে ভাল দেখতে পাই না , ইন্দ্রিয়গুলো খর্ব হয়ে ক্ষয়ে চলেছে ।
ভাবি । যে-বয়সে আমার আসেপাশের লোকেরা ড্রইংরুমে নকল পিকাসো , নকল যামিনী রায় টাঙাতো, আমি টাঙাতুম আসল সিনেমা-সিন্দরীদের । এখনও সেরকমই কেউ একজন টাঙানো রয়েছে । যেমন-যেমন ফিল্মের নায়িকারা পালটেছে আমার দেয়ালের নায়িকাদের বদল ঘটেছে । আমার বয়সী লোকেরা ঘরের আলমারিতে রেখেছে রবীন্দ্ররচনাবলী । আমি রাখতুম হ্যাভলক এলিস , হেনরি মিলারদের । তবে, আমি সোনাগাছিতে যারা যায় তাদের ক্ষমা করি না । আমার কাছে নারীর অর্থ সম্পূর্ণ ভিন্ন । এমনকি আমি কল গার্ল বরদাস্ত করি , কিন্তু সোনাগাছি বরদাস্ত করতে পারি না । জানি না লোকে কি করে সেখানে যায় ! গলিটা দিয়ে গিয়েছিলুম একবার ; বমি পেয়ে গিয়েছিল ।
দাদুর বাবা বাইজি নাচাতেন, এই বাড়িতেই । বারোটা ঘর আছে বাড়িটায় । ওনার কিউরিও ঘর দেখে সবাই স্তম্ভিত হয় । ওনার সময়ে অবশ্য ওটা কিউরিও ঘর ছিল না । বাবা ওনার ক্লায়েন্টদের দেখাবার উদ্দেশে ওটাকে কিউরিও ঘর বানিয়েছেন । বাইজিদের সঙ্গে যে-খাটে দাদুর বাবা শুতেন, সেই বিশাল পালঙ্ক আজও একইভাবে আছে । কল গার্লদের ওই ঘরে নিয়ে গেলে তাদের মুডই বদলে যেত । অনেকে আবার ডাক দেবার জন্যে অনুরোধ করত , এমনকি এও বলত যে কম টাকা দিলেও চলবে, রাতটা ওই ঘরে ঘুমিয়ে কাটাতে চায় । আমার কলেজের বন্ধুবান্ধবরা স্তম্ভিত হয়ে যেত দাদুর বাবার ঘরের সংগ্রহ দেখে ; নিজের প্রেমিকাকে নিয়ে এসে ওই ঘরে রাত কাটিয়ে গেছে কলেজের বন্ধুরা । কত রকমের সংলাপের স্মৃতি ঘুরে বেড়ায় ঘরটায় , নারী-পুরুষের দৈহিক সম্পর্কের তাপ থেকে চাগিয়ে ওঠা সংলাপ । ওই ঘরটা ইস্ট ইনডিয়া কোমপানির স্মৃতি । দাদুর ঘরটা রেনেসঁসের স্মৃতি ;মনীষীদের ছবি টাঙানো দেয়ালে-দেয়ালে । বাবার ঘর ? আধুনিক-অনাধুনিকের খিচুড়ি ; আলমারি জুড়ে আইনের মোটা-মোটা বই , গন্ধও আদালতের মতন । মায়ের ঘর দেখলে মনে হবে ভারতের সব দেবী-দেবতাদের সভা ; কোথা থেকে যে মা ওই সব ছবি এবং মূর্তি সংগ্রহ করতেন জানি না । রবি ভার্মা না থাকলে দেবী-দেবতার মুখ কি এত সুন্দর হতো !
আমার ঘর ? সিম্পল । আমি বেশি আসবাব পছন্দ করি না । অতিপ্রয়োজনীয় জিনিস ছাড়া কিছুই নেই আমার ঘরে ।
একদা নারীর নৈকট্য ছাড়া আমার জীবন ছিল ঘটনাহীন । কে এই নিরঞ্জন ? নারী ছাড়া ! বেঁচে থাকার মানে , কারণ, মূল্য আর কী-ই বা হতে ওপারে ? আমার তো জানা নেই । পৃথিবী নামের ছোট্টো দ্বীপটায়, নারী ছাড়া আমি একা, নিঃসঙ্গ, অন্তরীণ । জীবনে নারী নেই ভাবলেই মনে হয় মরে যাবো, মরে যাচ্ছি, মরে গেছি ; ফাঁকা, ফোঁপরা, খালি । জানতেই পারতুম না আহ্লাদ কি, আঘাত কি, বেদনা কি, হাহাকার কি ।
এতজন নারীর সান্নিধ্য সত্ত্বেও , কি স্বদেশে বা কি বিদেশে, আমি জীবনসূত্র পেয়েছিলুম একজনের কাছ থেকেই । সে লরেটোতে পড়া, ইংরেজিতে সান্মানিক স্নাতক । স্নাতকোত্তরে টি এস এলিয়ট বিশেষজ্ঞ । আমি তো গণিতে এম এস সি । সাহিটভ বা দর্শন সম্পর্কে আগ্রহ ছিল না ; আজও অবশ্য নেই । সে আমাকে টমাস হবস, জোসেফ কনরাড, অ্যান্টনি বারজেস, উইলিয়াম গোলডিং আরো কারা কারা যেন, প্রতিটি নাম মনেও নেই এতদিন পর , এনাদের লেখালিখির কথা শোনাতো । তার জীবনের অতীতসূত্র কেবল এই সাহিত্যদর্শনকে ঘৃণা । তার অতীত সম্পর্কে আর বিশেষ কিছু জানি না, সে বলতে চায়নি । বলত ওনারা জীবনের ভুল ব্যাখ্যা করে গেছেন । ওনারা নাকি বলে গেছেন একজন মানুষের জীবন সংক্ষিপ্ত, সে একাকী, কেউ নেই তার, যত বৈভব থাক নাকেন সে প্রকৃতপক্ষে দরিদ্র , পঙ্কিল, কদর্য, অশ্লীল, জঘন্য, স্হূল, পাশবিক, অশিষ্ট ও বর্বর । সে বলত, জীবনের এই আশাহীন দৃষ্টিকোণ অসত্য । জানি না সে প্রমাণ করতে পেরেছিল কিনা যে ওই লোকগুলোর বক্তব্য ভুল না সঠিক । আমাকে সে নতুন মানুষ করে তুলছিল ; তার মাঝেই একদিন সে হঠাৎ বলে উঠল, ‘আচ্ছা চলি’ । আমি বাকি জীবনটা নানা নারীদের মাধ্যমে তাকে মুছে ফেলতে চেয়েছি । পারিনি ।
তদন্তকারী পুলিস অফিসার রিমা খানের সামনে টেবিলের ওপর এক গোছা সিডির পাশে যে প্রিন্টআঊটটা পড়ে আছে, তেলেগু অক্ষরে লেখা বাংলা ন্যারেটিভ । অনুবাদ-করা নয় , তেলেগু অক্ষরকে বাংলায় রুপান্তরণ ।
একটি সিডিতে ব্যাস ওইটুকুই লিখে গেছে লোকটা , যার অদ্ভুত মৃত্যু সম্পর্কে তদন্ত করছে রিমা , পুলিসের ইনভেসটিগেটিং অফিসার , বর্তমানে চাকরি থেকে নিলম্বিত । এই কেস যিনি সর্বপ্রথম দদন্ত করেছিলেন, তিনি স্হানীয় থানার ওসি সুমন মিশ্র । এফ আই আর অনুযায়ী, বাঙলোবাড়ির পাশের মাঠে একটি পিকনিক দল শীতের আমেজে, সেবার শীত পুজোর পর-পরই এসে পড়েছিল , যখন হইচই করছে, কয়েকটা তিনচার বছরের ছেলেমেয়ে খেলতে-খেলতে বাঙলোবাড়ির দেয়াল পর্যন্ত চলে যায় বলের খোঁজে । তাদের পিঁপড়ের ঝাঁক আক্রমণ করে । পিঁপড়ে কামড়ের অ্যালার্জি কম-বেশি কয়েকটা বাচ্চার হলেও, সবচেয়ে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হয় একটি মেয়ে ; বস্তুত সে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায় । তাৎক্ষণিক জ্বরে আক্রান্ত হয় মেয়েটি এবং সে অজ্ঞান হয়ে যায় । পিকনিকদলের সদস্যদের সাক্ষ্য অনুযায়ী , পিঁপড়ের ঝাঁক আসছিল বাঙলোবাড়ির ভেতর থেকে । দলের নেতা রবিরঞ্জন কর্মকার গিয়ে খবর দেন স্হানীয় থানায় এবং থানা ইনচার্জের জিপে চেপে ডাকতার ডেকে আনেন ।
থানাত ওসি সুমন মিশ্র ঘটনাস্হলে পোঁছে বাঙলোবাড়িটা তালা-বন্ধ পান , এক নজরে টের পাওয়া যায় কেউ থাকেনা বাড়িটায় , বহুদিন যাবত অব্যবহৃত পড়ে আছে । তিনি জিপে চেপে কাছাকাছি যে ডাকতার পেয়েছিলেন তাঁকে ডেকে আনেন । ডাকতার সযত্নে বাচ্চাটির শুশ্রুষা করেন । কোনো ফিস নেননি , বরং নিজেই ওষুধ দিয়ে বাচ্চা মেয়েটিকে সুস্হ করেন ও জ্ঞান ফেরে তার । সাদা কাগজে কয়েকটা ওষুধ লিখে দেন কয়েকদিন খাবার জন্য ; তাড়াহুড়োয় নিজের প্রিন্টেড প্যাড আনতে পারেননি । সামান্য ঘটনা বলে ওসি বিশেষ আগ্রহ দেখাননি । থানায় নতুন এসেছিলেন, তাই এলাকা সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান ছিল না তাঁর । পিকনিকদলের আক্রান্ত শিশুদের অভিভাবকদের ঠিকানা ডিটেইলসে লিখে রাখা প্রয়োজন মনে করেননি । যে শিশুটি সর্বাধিক আক্রান্ত হয়েছিল তার বাবার নাম ও স্হানটুকু লেখা : দীপ্যমান গোস্বামী, সাকিন লেক টাউন । ভালোয়-ভালোয় ঘটনা মিটমাট হয়ে যাওয়ায় তখনকার মতন নিশ্চিন্ত ছিলেন ওসি ।
মাস ছয়েক পর, হঠাৎই, হাতে তেমন কাজ ছিল না, ওসি বাঙলোবাড়িটার হাল-হকিকাত জানার জন্য, সেখানে ক্রিমিনাল আড্ডা থাকতে পারে অনুমান করে, কেননা কিছুদিন যাবত তাঁর এলাকায় অপরাধের সংখ্যা বেড়েই চলছিল, একাই ঢুঁ মারেন । গেটের তালা একজন তালা-খুলিয়ে বিশেষজ্ঞ কন্সটেবলকে দিয়ে খুলিয়ে, ভেতরে প্রবেশ করে দেখতে পান যে বাড়িটায় বহুকাল বসবাস করা হয়নি ; ঝোপ-ঝাড় উঁচু ঘাসে সামনের বাগান ছয়লাপ , এক-আধটা ফুলের গাছ দেখে টের পাওয়া যায় যে কখনও সাজানো বাগান ছিল । আগাছার জঙ্গলে পিঁপড়ে আর ছিল না । ওসির ধারণা হয় যে পিঁপড়েরা কলোনি সরিয়ে নিয়ে গিয়ে থাকবে । বাঙলোবাড়িটার ফাটলেও গাছ গজিয়েছে । সিঁড়ি দিয়ে উঠে, পুলিস অফিসার হলেও, তাঁর গা ছমছম করে । সেদিনকার মতন অনুসন্ধান স্হগিত রেখে আবার কিছুদিন পর তিনি হেড কন্সটেবল পীতাম্বর পোড়েল আর সইফুদ্দি তালাঅলাকে এনে প্রবেশের সদরের তালা খোলান, গোদরেজের ডুলিকেট ল্যাচকি নিজের কাছে রেখে, চাবিঅলাকে চলে যেতে বলে, ভেতরে ঢুকে সাজানো বাড়ির বৈভব দেখে অবাক হয়ে যান । বাড়িতে কেমন যেন অশরিরী গন্ধ রয়েছে মনে হয় তাঁর , পোড়োবাড়ির গন্ধ সচরাচর যেমন হয় তেমন সোঁদাটে নয়, কিছুটা ইংরেজ-রাজত্বের ফেলে যাওয়া গোরস্হানের মতন , স্বদেশে ফিরতে পারেনি বলে গোরা সায়েবের প্রেতাত্মা হাহাকার করে বেড়াচ্ছে । নিজের দৈনিক ডায়েরিতে এভাবেই বর্ণনা করে গেছেন তিনি তাঁর অভিজ্ঞতা ।
বাড়িটার সবকটা ঘর খোলা থাকলেও একটা ঘর বাইরে থেকে তালা-বন্ধ ছিল , তার জানালাও ভেতর থেকে বন্ধ । হেড কন্সটেবল পীতাম্বর পোড়েলের কাঁধের ধাক্কায় খুলে যায় মরচেধরা তালাটা । বিশেষ আসবাবপত্র নেই ঘরটায় । ঘরের ভেতরের দৃশ্যে অবাক হয়ে যান ওসি সুমন মিশ্র । ঘরের দামি মেহগনি খাটে পুরু বিছানার ওপর অর্থেক ঝুলে আছে একজন মানুষের কংকাল , বিছানা থেকে কয়েক পা দূরে একটা প্রাণীর কংকাল । প্রাণীটাকে খুঁটিয়ে দেখার জন্যে উবু হয়ে বসলেন ওসি । প্রাণীটার চামড়া রয়ে গেছে দেহের কয়েকটা অংশে , কালো-সাদা, পোকা আর সময় সম্পূর্ণ খেয়ে নিশ্চিহ্ণ করতে পারেনি । মুখের আকৃতি , কাটা লেজের আর দেহের চামড়া থেকে ওসি অনুমান করলেন যে কংকালটি একটি কুকুরের । বাঙলোবাড়িটায় তালা দিয়ে ফিরলেন তিনি, এবং স্বতঃপণোদিত হয়ে পিঁপড়ের কামড়ের যে নথি ছিল, তা নিয়ে একটি ফাইল খুললেন, জনৈক ব্যক্তির অস্বাভাবিক মৃত্যুর ।
পরের দিন বাঙলোবাড়িটায় দুজন কন্সটেবলকে সঙ্গে নিয়ে গেলেন ওসি সুমন মিশ্র । মানুষের আর কুকুরের কংকালের রহস্য , যদিও তাঁর জানা জরুরি ছিল না, তবে তাঁর মনে হয়েছিল যে এর পেছনে একটা অঘটনের কাহিনি নিশ্চই আছে , যার রহস্য ভেদ করা পুলিসের কাজ । কয়েকটা জিনিস তিনি সংগ্রহ করেছিলেন রহস্যময় বাঙলোবাড়ি থেকে : ( ১ ) বাথরুমে রাখা চটি ; ( ২ ) দ্রেসিংটেবিলের ওপর রাখা কয়েকগাছা চুলসহ একটা হেয়ারব্রাশ ; ( ৩ ) কমপিউটারবিহীন ও মনিটরবিহীন কিবোর্ড ; কমপিউটারটা না থাকায় সন্দেহের খচখচানি হল ওসির ; ( ৪ ) এক হাজারটি সিডি , ইংরেজিতে নম্বর দেয়া ; ( ৫ ) ব্রাউনরঙের খামে কোনো মহিলার দীর্ঘ চুলের আঁটি, সম্ভবত তাঁকে নেড়া করার সময়ে একটুখানি নেয়া । সিজ করার মতন আর তেমন কিছু পেলেন না ওসি ।
মিউনিসিপালিটির রেকর্ড থেকে বাঙলোবাড়ির মালিকের নাম পেয়েছিলেন ওসি, গুরুচরণ দত্তমজুমদার ; তিনি তো দেশ স্বাধীন হবার আগেই মারা গিয়েছিলেন, বোধহয় ইংরেজদের আমলেই, তখন মিউনিসিপালিটি ছিল না । তাঁর ছেলেও মারা গিয়েছিল । মিউনিসিপাল কর্পোরেশানের কাছে তাঁদের মৃত্যুর দিনক্ষণ দর্জ করা নেই । তাঁদের সময়ে অবশ্য ওটা নোটিফায়েড এরিয়া ছিল, মিউনিসিপালিটির অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি । তাঁর উত্তরাধীকারী এরকম দায়িত্বজ্ঞানহীন কী করে, লোকটা যখন ফৌজদারি উকিল ছিল । সাবইন্সপেক্টারকে পাঠিয়ে বার কাউনসিলের পুরানো রেকর্ড থেকে দত্তমজুমদার পদবির অ্যাডভোকেট পেয়েছিলেন ওসি, সুবীর দত্তমজুমদার । পরের প্রজন্মের উকিলরা জানে যে তিনি ব্রিফ নেবার অনেক ফিস নিতেন , বিচারপতিরা তাঁকে আইনী-জ্ঞানের কারণে সমীহ করতেন । রাশভারি দশাসই চেহারার লোক ছিলেন , বাজখাঁই গলা, রাগি মেজাজের, অথচ তাঁর পরিবারের বিষয়ে কেউ কিছুই বলতে পারল না ।
সাইবার কাফেতে গিয়ে কয়েকটা সিডি দেখার চেষ্টা করেছিলেন, কেননা পুলিস কমপিউটার সেন্টার তখনও স্হাপিত হয়নি এই রাজ্যে ; বিলেতি আর হিন্দি গানের আধিক্য দেখে কোনো ক্লু পাননি । চুলের দুটি গোছা, হেয়ার ব্রাশ আর ব্রাউন প্যাকেটে, তাঁর মতে, বাড়ির কোনো সদস্যের ; হয়তো ওই কংকাল মহিলার , যিনি হঅর্ট অ্যাটাক বা সেরিব্রাল অ্যাটাকে মারা যান ; কুকুরটা মণিবের দুঃখে মারা গেছে । নিজে থেকে পিঁপড়ের কেসকে কংকালের কেসে নিয়ে গিয়ে নিজেই বিপদে পড়েন তিনি । ক্লোজ করার জন্যে ঊর্ধতন অফিসারদের পাঠিয়েছিলেন, তাঁরা মত না দিয়ে ঝুলিয়ে রেখেছিলেন ।
পরের ইনভেসটিগেটিং অফিসার রমেন বসু ফাইলটা নাড়াচাড়া করতেন আর চিন্তা করতেন কী করা যায় । বাঙলোবাড়ি সিল করে দেয়া হয়েছিল । মানুষের কংকাল যে অবস্হায় ছিল তেমনই পড়ে ছিল । তিনি বাড়তি সিজ করেছিলেন কুকুরের কংকাল আর তার ছাল । কুকুরের ছালসহ কংকালটি থানার মালখানায় এনে রেখেছিলেন । সিডিগুলোর মধ্যে থেকে কয়েকটা বাছাই করে দেখার চেষ্টা করে তিনি দেখেন সেগুলো খুলছে না , যেগুলো খুলছে সেগুলো বাংলা ইংরেজি হিন্দি গানের । তাঁর সন্দেহ হয় । তিনি পুলিস কমপিউটার সেন্টারে সাইবার বিশেষজ্ঞকে পাঠালে , বিশেষজ্ঞ জানান, যেগুলো খুলছিল না ওগুলো তেলেগু ভাষায় লেখা । সেসময়ে তেলেগু-জানা কাউকে পুলিসে না পেয়ে তিনি সিডিগুলো সম্পর্কে আগ্রহ হারিয়ে ফ্যালেন । তবে কুকুরের কংকালটা তিনি সরকারি পশু ডাকতার কাকলি সোমকে দেখিয়ে একটা রিপোর্ট নিয়েছিলেন । কুকুরটা সম্ভবত পিট বুল প্রজাতির , ভয়ানক হিংস্র , কেবল মালিকের হুকুম শোনে , মাংস ছাড়া খায় না । বোধহয় না খেতে পেয়ে মরে গেছে । তার মালিকের মৃত্যুর পর তাকে খেতে দেবার কেউ ছিল না বাঙলোবাড়িটায় । চামড়াটা পোকায় খেয়ে ফেলেছে , আর বহুকাল পড়ে থাকার দরুণ চুল ঝরে গেছে । তিনি নেক্রপসি করেছিলেন কিন্তু ডিএনএ স্যামপেলের কেমিকাল অ্যানালিসিস করেননি । সেসময়ে ফরেনসিক ল্যাব ঠিকমতন গড়ে ওঠেনি ।
কোনো নির্ণয়ে পোঁছোতে না পেরে, মৃত্যুর কারণ অনিশ্চিত লিখে, রমেন বসুও ঝুলিয়ে রাখেন ফাইলটা । সেই থেকে কেসটা হাফ-খোলা হাফ-বন্ধ হয়ে পড়েছিল । এখন রিমার দায়িত্ব , নির্ণয়ে পৌঁছোবার ; ওকে কেসটা দেয়া হয়েছে দুর্নাম থেকে সুনামে ফেরত যাবার একমাত্র উপায় হিসাবে । দুর্নাম থেকে সুনামে ফেরত যাবার জন্যে রিমা খান অনেককে ধরাধরি করেছিকল ; কোনো কাজ হয়নি । অনেক ওপর পর্যন্ত গিয়েছিল ; মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন যে অত সহজে বদনাম থেকে মুক্ত করা যাবে না ; রিমাকে কিছু-একটা করে দেখাতে হবে যাতে মিডিয়ার চোখে ও নায়িকার পাবলিসিটি পায় । কেননা মিডিয়াই ওকে বদনাম করেছে । চ্যালেঞ্জ নিয়েছে রিমা ; এর শেষ দেখে তবে ছাড়বে ।
রিমার ধারণা কেসটার সমাধান করার জন্য বিল্ডার লবির চাপ আছে ; তারা অতখানি জমির লোভ সামলাতে পারছে না । কেস-ফাইল হঠাৎ ক্লোজ করে দিলে মিডিয়ার লোকেরা নতুন রসদ পেয়ে হইচই করবে । কেন্দ্রীয় নেতাদের টাকা গেঁড়িয়ে সুইসব্যাঙ্কে রাখার খবর শুনে আর পড়ে লোকে ক্লান্ত হয়ে গেছে ; দেশের মানুষ মেনে নিয়েছে যে এই সমস্ত জোচ্চর রাজনীতিকদের নিয়েই ভোটাভুটির গণতন্ত্র চলতে থাকবে এদেশে । পাবলিকের এখন নতুন মালখাদ্য চাই ।
রিমা একটা ফিলটার টিপ সিগারেট ধরালো । অন্য মেয়েরা রাস্তা-ঘাটে লুকিয়ে ফোঁকে ; রিমার লুকোছাপা নেই, উচ্চমাধ্যমিকের সময় থেকে । মুখেরও আগল নেই, স্কুল থেকেই । পুলিসে ঢুকে অবশ্য সেই গুণগুলো কাজে দিয়েছে । পুরুষতান্ত্রিক পুলিসে সহকর্মীরা ভেবেছিল অশ্লীল শব্দ আর গালমন্দ প্রয়োগ করে ঘাবড়ে দেবে রিমাকে । অপরাধীরাও রিমার মুখনিঃসৃত এমসেবিসি বাণী থেকে নিস্তার পায় না ।
দীপ্যমান গোস্বামী । চাকরিতে থাকলে থাকার কর্মীদের পাওয়া যেত । রিমার জন্য ডিজি পবিত্র মুখোপাধ্যায় বরাদ্দ করেছেন সাব-ইন্সপেক্টার রজত মণ্ডলকে । তার জন্যেও কত ধরাধরি করতে হয়েছিল । ডিজি নিজের ডিসক্রিশানারি পাওয়ার প্রয়োগ করে রজতকে দিয়েছেন । রিমা অবশ্য ব্যক্তিগতভাবে কোনো-কোনো কর্মীর সাহায্য নেয় । কন্সটেবলরা, যারা ওর আন্ডারে কাজ করেছে, তারা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কাজ করে দ্যায় । রিমা চিরকাল ওর অধস্তনদের বাঁচিয়েছে , ঊর্ধতনদের প্রকোপ থেকে ।
বাঙালিদের পিকনিকে যাবার অভ্যাসটাও মন্দ নয় । কবে থেকে পিকনিকের চল হয়েছে তা অনুমান করতে পারে রিমা । ইংরেজরা যাবার সময়ে তাদের বাতিল গোরস্তানের সঙ্গে দিয়ে গেছে এটা । বলিউডি গান সহযোগে বিয়ার বা পাউচমালের সঙ্গে মুর্গির টাকনা । সপরিবারে হলে অন্তাক্ষরী। অনেক রকমের এঁটো ফেলে গেছে ওরা । যারা পিকনিকে যায় তারাও নানা এঁটো ফেলে জায়গাটা নোংরা করে চলে যায়।
বিএসএনএল-এর ডিরেক্টরি তন্ন তন্ন খুঁজে কোনো দীপ্যমান গোস্বামীকে লেক টাউন অঞ্চলে পাওয়া গেল না । ইনটারনেটে বিএসএনএল-এর তালিকাতেও পেল না । মোবাইল হয়ে লোকে ল্যান্ডলাইন কাটিয়ে দিলেও, পুরানোতে হয়তো আছে ; কিন্তু ওয়েবসাইটে অবিরাম পরিবর্তন ঘটতে থাকায় পুরানো রেকর্ড নেই । কী করা যায় ?
রাজ্য নির্বাচন দপতরে একদিন গেল রিমা, উর্দি পরে । লেক টাউনের হালের লিস্টটায় পেয়ে গেল দুজন দীপ্যমান গোস্বামী । একজন কালিন্দীতে , অন্যজন বাইরে । রবিবার দেখে কালিন্দীতেও পুলিসের উর্দিতে গেল । বাড়িতে দীপ্যমান ছিলেন না । তাঁর স্ত্রী চৈতালি, গায়ের রঙ ময়লাটে, দুবেলা ভাত-খাওয়া ভরাট কাঠামো, প্রতিদিনের গৃহদেবতার পুজোর সন্দেশ আর জল দিয়ে ভয়ে-ভয়ে জানতে চাইলেন, কেন আসা । পুলিস দেখে কয়েকজন দরজায় উঁকিঝুঁকি মারছিল । দীপ্যমানের স্ত্রী দরজা বন্ধ করে দিতে যাচ্ছিলেন, রিমা বলল, আসতে দিন আসতে দিন, আমি আপনাদের পিকনিকে গিয়ে পিঁপড়ে কামড়ের ঘটনাটা জানতে চাই । দীপ্যমানের স্ত্রী বললেন, হ্যাঁ, আমার মেয়েকেই জংলি পিঁপড়ে কামড়ে ছিল, ওঃ, সে কি অঘটন, ভাগ্যিস সুমনবাবু একজন ডাকতার এনে তক্ষুনি ওষুধপথ্য করলেন , নয়তো কী যে হতো ভগবানই জানেন ।
সমবেত প্রতিবেশীরা ঘটনাটাকে নানাভাবে উপস্হাপন করছিলেন । কিছুক্ষণ পর দীপ্যমান গোস্বামী বাজার থেকে দুহাতে দুটি থলে ঝুলিয়ে ফিরলেন , এবং যথারীতি পুলিস দেখে ঘাবড়ে গেলেন । প্রতিবেশিরা তাঁকে রিমার আগমনের উদ্দেশ্য জানালে তিনি ফ্ল্যাটের অন্য ঘর থেকে একটা ফাইল নিয়ে এলেন । বললেন, সেই পিঁপড়ের কামড়ে আমার মেয়ে আজও মানসিকভাবে ভুগছে , কীটফোবিয়া হয়ে গেছে ওর , আমরা প্রতি মাসে পেস্ট কন্ট্রোলকে দিয়ে পুরি ফ্ল্যাট ডিসইনসেক্টিফাই করাই । দীপ্যামন গোস্বামী লোকটা ওর স্ত্রীর চেয়ে বেশ ফর্সা , বোধহয় প্রেম, নয়তো মোটা যৌতুক । গালদুটো মোদো-চকচকে , চুল কোঁকড়ানো, পায়জামা কুর্তায় , আজকালকার রঙিন চকরাবকরা পাঞ্জাবি ।
রিমা জানাল , আমি সেই ঘটনার সূত্রে আরেকটি ঘটনার তদন্ত করছি । ডাকতারের ক্লিনিকটা কোথায় আর তাঁর নাম-ঠিকানা জানেন কি ?
—না, তা তো আমরা জিগ্যেস করিনি তখন, এত বিপর্যস্ত ছিলাম আমরা । আমার মেয়েকে সবচে বেশি কামড়ে ছিল, কিন্তু কমবেশি অনেকের বাচ্চাকে কামড়েছিল ওই বিদকুটে বিষাক্ত পিঁপড়ে ।
—হ্যাঁ, আমার মেয়েকেও পিমড়ে কামড়েছিল , তবে অত জঘন্য ভাবে নয় ; বাড়ি ফিরে ডাকতার দেখিয়ে ওষুধ দিয়ে কয়েক দিনেই সেরে গিয়েছিল ।
—আমার দুই ছেলেকে কামড়েছিল বটে, তবে গোস্বামীদার মেয়ের মতন নয় ।
দীপ্যমান গোস্বামীকে রিমা অনুরোধ করা প্রেসক্রিপশানের জেরক্স নিল, মোবাইল নম্বর নিল দীপ্যমানসহ কয়েক জনের । ডাকতারদের হাতের লেখা এত নোংরা কেন যে হয় , নামের জায়গায় ইজকুড়ি-বিজকুড়ি । নয়তো ডাকতার সাহায্য করতে পারতেন ।
ডাকতারকে কী রকম দেখতে ? জানতে চাইল রিমা ।
দীপ্যমান : মহিলা ডাকতার যুবতী-যুবতী টাইপ । ঢ্যাঙা । কাঁধ পর্যন্ত চুল ; চুলে তেমন পাক ধরেনি যদিও । গায়ের রঙ এই ধরুন আমার চেয়ে এক পোঁচ ময়লা । ফিস দিতে চাইলেও নেননি ।
চৈতালি : কম বয়সী কী ? চাহারা তো একহারা । বোধহয় বিয়ে করেননি বলে কম বয়সী মনে হচ্ছিল , মানে সিঁদুর-টিঁদুর তো দেখিনি ; আজকাল অবশ্য ডাকতার-টাকতাররা শাঁখা-সিঁদুর পরেন না । তবে বেশি বয়স নয় ; আলগাচটুকে ।
দীপ্যমান : ডাকতার হলেও কিন্তু দামি জামদানি পরেছিলেন । চোখে রিমলেস চশমা । হাতে একগাছা সোনার বালা । অন্য হাতে চারচৌকো ঘড়ি । ফিস নিশ্চই অনেক, কিন্তু আমার কাছ থেকে নিলেন না । বোথহয় বাচ্চার কষ্ট দেখে ।
—স্যার, খবরটা কি টিভিতে আসবে ? মানে টিভির লোক কি দীপ্যমানবাবুর বাড়ি আসবেন এই কেস তুলে ধরতে ? জিগ্যেস করল একজন যুবক ।
—না না, এখনই এটা নিউজ হবার মতন নয় । হলে দীপ্যমানবাবুকে ওরা অবশ্যই কভার করবে , বলে, রিমা উঠে দাঁড়াল, যোগ করল, পরে দরকার পড়লে যোগাযোগ করব । আর, ডাকতারের সঙ্গে যোগাযোগ হলে ঠিকানা-ফোন নম্বর নিয়ে নেবেন প্লিজ ।
বাইরে বারিয়ে রিমা দেখল ওর লাল-কালো সুজুকি হায়াবুসা মোটর সাইকেল ঘিরে ভিড় । স্টার্ট করে আধা-থ্রটল হুমকি দিতেই ভিড় সরে গেল । রিমা শুনতে পেল কেউ বলছে, আরে এ তো সেই বিখ্যাত নোংরা পরি, উরিব্বাস, কত চুপটি করে কথা বললে আমাদের সঙ্গে । টিভিতে দেখেছিলিস তো ওনাকে নিয়ে প্রোগ্রাম করেছিল ? জাঁদরেল অফিসার , চোর-ডাকাতরা ওনার ভয়ে হেগে ফ্যালে । মোটর সাইকেলটার ফোটো বেরিয়েছিল কাগজে । নোংরা পরি ওপর বসলে সাইকেলটার ডানা গজায় ।
আর পুরুষদের ওপর বসলে তাদের গায়ে কাঁটা গজায় , রিমা নিজেকে শোনালো, রে-ব্যান গগলস পরতে-পরতে ।
অক্টোবর 2, 2012 – 6:42 পুর্বাহ্ন ক্যাটাগরিসমূহ: Detective story | Post a commentTagged ডিটেকটিভ উপন্যাস |
পরের সিডিটার প্রিন্টআউট পড়ায় একাগ্র হল রিমা, যদি কোনো সূত্র পাওয়া যায় :
নাম নিরঞ্জন পাল, বণিক, ব্যানার্জি, দত্তমজুমদার, মিত্র, লিঙ্গা, গারু, ওয়েডিং গিফ্ট , সাকার, লম্বুলোচ্চা ইত্যাদি । একাধিক ওরফেও পাওয়া গেছে । বয়স আনুমানিক এত বছর এত মাস এত দিন । উচ্চতা পাঁচ ফিট নয় ইঞ্চি । ওজন এত কিলো । মুখাকৃতি সম্ভবত ওভাল , চওড়া কপাল । চুল কাঁচা-পাকা । গায়ের রঙ ফর্সা । এই ডিস্কে টেক্সট ঢোকাবার সময়ে প্রথম দিন লাল টিশার্ট , ব্লু ফেডেড জিনস পরে আছি ।
কেন এসব লিখছি ? শেষতম মহিলা জানতে চেয়েছেন । মেয়েটির নাম বিদকুটে । আমি তাই ওকে ‘শেষনি’ বলে ডাকি । ও নিজেও চায় না যে আমি ওর নামটা এখানে রেকর্ড করি । কিন্তু আমি শেষনিকে বলিনি যে আমি সিডিতে তুলে রাখছি । ও শুধু জানে যে হার্ড ডিস্কে থাকছে । ও আমার কমপ্লিট লাইফ-স্টোরি চায় । আমি বাংলায় লিখছি বটে, কিন্তু অক্ষরগুলো থাকছে তেলেগু । ও বলেছে কাউকে দিয়ে বাংলা অক্ষরে কনভার্ট করে নেবে । নিক । কী কাজে লাগবে জানি না । নিরঞ্জনের শিক্ষা গণিতে স্নাতকোত্তর । আয়ের স্রোত বহুবিধ । দাদুর বাবার সোনাদান , দাদুর জমিজিরেত, বাবার সম্পত্তি, যা ভাগ্যিস বেদখল হয়নি ; কোমপানি ডিভিডেন্ড ; ফিক্স ডিপজিটস ; গভমেন্ট সিকিউরিটিজ । বাবা নামকরা ফৌজদারি উকিল ছিলেন । কত খুনি, জোচ্চোর, ডাকাত, ব্যাংক জালিয়াত, বাটপাড়, রাজনৈতিক গুণ্ডা , টাকা ছয়লাপকারীদের জেল থেকে বাঁচিয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই । মা ছিলেন স্কুল শিক্ষিকা ; ব্রাহ্মণ পরিবারের ।
আমি প্রথম চাকরি পাবার দিন বাবা মারা গেলেন। আঘাত সহ্য করতে না পেরে মা মারা গেলেন তিন মাস পর , একই তারিখে, স্ট্রঞ্জলি ; অথচ দুজনের যে খুব ভাব-ভালবাসা ছিল তা নায় । নারী-পুরুষের এরকম ব্যাখ্যার অতীত সমস্যাসংকুল সম্পর্ক যে সম্ভব, তা আমি নিজের জীবন থেকেই জানি ।
জীবনের বাঁকবদলগুলো, যতবার ঘটেছে বাঁকবদল, সব সব সব সব নারীকেন্দ্রিক ; নারীর ইচ্ছার, নির্দেশের, দেহের, আকর্ষণের, রহস্যের মোহে । স্কুলের শেষ পরীক্ষায় ভাল, সান্মানিক স্নাতকে খুব-ভাল , স্নাতকোত্তরে অত্যন্ত ভাল, তাদেরই কারণে , প্রভাবে, চাপে, আদরে । চাকরিতে যোগ নারীর জন্যে উন্নতি নারীর জন্যে, চাকরি ছাড়া নারীর জন্যে , ভাসমান জীবিকা নারীর জন্যে , অবসরে পৈতৃক বৈভবে পরগাছাবৃত্তি নারীর কারণে । কে জানে, হয়তো মৃত্যুও নারীর হাতেই হবে ।
জীবনে নারীদের আসা-যাওয়া, সেনসেক্স ওঠা-পড়ার মতন, না ঘটলে, আমার ব্যর্থতা, ব্যথা, পরাজয়, গ্লানি, অপরাধবোধ, এ-সবের জন্যে কাকেই বা দায়ি করতুম ! কাকেই বা দোষ দিতুম আমার অধঃপতনের জন্যে ? লোভি লম্পট মাগিবাজ প্রেমিক ফেরারি হয়ে ওঠার জন্যে ? হবার, নাকি হয়ে ওঠার ?
আসলে আমি একটা কুকুর । আগের সিডিতে লিখেছি, তবু রিপিট করছি শেষনির খাতিরে । যে-মালকিনির হাতে পড়েছি , সে য-রকম চেয়েছে, যে-রকম গড়েছে , তা-ই হয়েছি । সেবার কুকুর, কাজের কুকুর, প্রজননের কুকুর, গুপ্তচর কুকুর, ধাঙড় কুকুর, কুরিয়ার কুকুর, প্রেডাটার কুকুর, পাহারাদার কুকুর, মানসিক থেরাপি কুকুর, শোনার কুকুর, শোঁকার কুকুর, চাটার কুকুর, রক্ষক কুকুর, গাড়িটানার কুকুর, কোলের কুকুর, আদরের কুকুর, এই কুকুর, ওই কুকুর, সেই কুকুর ইত্যাদি । কিন্তু একমাত্র কুকুর যেটাকে আমি ভালবেসেছি, তা হল মালকিনিকে উন্মাদের মতন ভালবাসার কুকুর । কিন্তু আমার লেজটা জন্মের সময়ে যেমন আকাশমুখো ছিল , চিরকাল তেমনই থেকে গেছে । আজও, যখন আমার গা থেকে চুল ঝরে যাচ্ছে, চোখে ভাল দেখতে পাই না , ইন্দ্রিয়গুলো খর্ব হয়ে ক্ষয়ে চলেছে ।
ভাবি । যে-বয়সে আমার আসেপাশের লোকেরা ড্রইংরুমে নকল পিকাসো , নকল যামিনী রায় টাঙাতো, আমি টাঙাতুম আসল সিনেমা-সিন্দরীদের । এখনও সেরকমই কেউ একজন টাঙানো রয়েছে । যেমন-যেমন ফিল্মের নায়িকারা পালটেছে আমার দেয়ালের নায়িকাদের বদল ঘটেছে । আমার বয়সী লোকেরা ঘরের আলমারিতে রেখেছে রবীন্দ্ররচনাবলী । আমি রাখতুম হ্যাভলক এলিস , হেনরি মিলারদের । তবে, আমি সোনাগাছিতে যারা যায় তাদের ক্ষমা করি না । আমার কাছে নারীর অর্থ সম্পূর্ণ ভিন্ন । এমনকি আমি কল গার্ল বরদাস্ত করি , কিন্তু সোনাগাছি বরদাস্ত করতে পারি না । জানি না লোকে কি করে সেখানে যায় ! গলিটা দিয়ে গিয়েছিলুম একবার ; বমি পেয়ে গিয়েছিল ।
দাদুর বাবা বাইজি নাচাতেন, এই বাড়িতেই । বারোটা ঘর আছে বাড়িটায় । ওনার কিউরিও ঘর দেখে সবাই স্তম্ভিত হয় । ওনার সময়ে অবশ্য ওটা কিউরিও ঘর ছিল না । বাবা ওনার ক্লায়েন্টদের দেখাবার উদ্দেশে ওটাকে কিউরিও ঘর বানিয়েছেন । বাইজিদের সঙ্গে যে-খাটে দাদুর বাবা শুতেন, সেই বিশাল পালঙ্ক আজও একইভাবে আছে । কল গার্লদের ওই ঘরে নিয়ে গেলে তাদের মুডই বদলে যেত । অনেকে আবার ডাক দেবার জন্যে অনুরোধ করত , এমনকি এও বলত যে কম টাকা দিলেও চলবে, রাতটা ওই ঘরে ঘুমিয়ে কাটাতে চায় । আমার কলেজের বন্ধুবান্ধবরা স্তম্ভিত হয়ে যেত দাদুর বাবার ঘরের সংগ্রহ দেখে ; নিজের প্রেমিকাকে নিয়ে এসে ওই ঘরে রাত কাটিয়ে গেছে কলেজের বন্ধুরা । কত রকমের সংলাপের স্মৃতি ঘুরে বেড়ায় ঘরটায় , নারী-পুরুষের দৈহিক সম্পর্কের তাপ থেকে চাগিয়ে ওঠা সংলাপ । ওই ঘরটা ইস্ট ইনডিয়া কোমপানির স্মৃতি । দাদুর ঘরটা রেনেসঁসের স্মৃতি ;মনীষীদের ছবি টাঙানো দেয়ালে-দেয়ালে । বাবার ঘর ? আধুনিক-অনাধুনিকের খিচুড়ি ; আলমারি জুড়ে আইনের মোটা-মোটা বই , গন্ধও আদালতের মতন । মায়ের ঘর দেখলে মনে হবে ভারতের সব দেবী-দেবতাদের সভা ; কোথা থেকে যে মা ওই সব ছবি এবং মূর্তি সংগ্রহ করতেন জানি না । রবি ভার্মা না থাকলে দেবী-দেবতার মুখ কি এত সুন্দর হতো !
আমার ঘর ? সিম্পল । আমি বেশি আসবাব পছন্দ করি না । অতিপ্রয়োজনীয় জিনিস ছাড়া কিছুই নেই আমার ঘরে ।
একদা নারীর নৈকট্য ছাড়া আমার জীবন ছিল ঘটনাহীন । কে এই নিরঞ্জন ? নারী ছাড়া ! বেঁচে থাকার মানে , কারণ, মূল্য আর কী-ই বা হতে ওপারে ? আমার তো জানা নেই । পৃথিবী নামের ছোট্টো দ্বীপটায়, নারী ছাড়া আমি একা, নিঃসঙ্গ, অন্তরীণ । জীবনে নারী নেই ভাবলেই মনে হয় মরে যাবো, মরে যাচ্ছি, মরে গেছি ; ফাঁকা, ফোঁপরা, খালি । জানতেই পারতুম না আহ্লাদ কি, আঘাত কি, বেদনা কি, হাহাকার কি ।
এতজন নারীর সান্নিধ্য সত্ত্বেও , কি স্বদেশে বা কি বিদেশে, আমি জীবনসূত্র পেয়েছিলুম একজনের কাছ থেকেই । সে লরেটোতে পড়া, ইংরেজিতে সান্মানিক স্নাতক । স্নাতকোত্তরে টি এস এলিয়ট বিশেষজ্ঞ । আমি তো গণিতে এম এস সি । সাহিটভ বা দর্শন সম্পর্কে আগ্রহ ছিল না ; আজও অবশ্য নেই । সে আমাকে টমাস হবস, জোসেফ কনরাড, অ্যান্টনি বারজেস, উইলিয়াম গোলডিং আরো কারা কারা যেন, প্রতিটি নাম মনেও নেই এতদিন পর , এনাদের লেখালিখির কথা শোনাতো । তার জীবনের অতীতসূত্র কেবল এই সাহিত্যদর্শনকে ঘৃণা । তার অতীত সম্পর্কে আর বিশেষ কিছু জানি না, সে বলতে চায়নি । বলত ওনারা জীবনের ভুল ব্যাখ্যা করে গেছেন । ওনারা নাকি বলে গেছেন একজন মানুষের জীবন সংক্ষিপ্ত, সে একাকী, কেউ নেই তার, যত বৈভব থাক নাকেন সে প্রকৃতপক্ষে দরিদ্র , পঙ্কিল, কদর্য, অশ্লীল, জঘন্য, স্হূল, পাশবিক, অশিষ্ট ও বর্বর । সে বলত, জীবনের এই আশাহীন দৃষ্টিকোণ অসত্য । জানি না সে প্রমাণ করতে পেরেছিল কিনা যে ওই লোকগুলোর বক্তব্য ভুল না সঠিক । আমাকে সে নতুন মানুষ করে তুলছিল ; তার মাঝেই একদিন সে হঠাৎ বলে উঠল, ‘আচ্ছা চলি’ । আমি বাকি জীবনটা নানা নারীদের মাধ্যমে তাকে মুছে ফেলতে চেয়েছি । পারিনি ।
তদন্তকারী পুলিস অফিসার রিমা খানের সামনে টেবিলের ওপর এক গোছা সিডির পাশে যে প্রিন্টআঊটটা পড়ে আছে, তেলেগু অক্ষরে লেখা বাংলা ন্যারেটিভ । অনুবাদ-করা নয় , তেলেগু অক্ষরকে বাংলায় রুপান্তরণ ।
একটি সিডিতে ব্যাস ওইটুকুই লিখে গেছে লোকটা , যার অদ্ভুত মৃত্যু সম্পর্কে তদন্ত করছে রিমা , পুলিসের ইনভেসটিগেটিং অফিসার , বর্তমানে চাকরি থেকে নিলম্বিত । এই কেস যিনি সর্বপ্রথম দদন্ত করেছিলেন, তিনি স্হানীয় থানার ওসি সুমন মিশ্র । এফ আই আর অনুযায়ী, বাঙলোবাড়ির পাশের মাঠে একটি পিকনিক দল শীতের আমেজে, সেবার শীত পুজোর পর-পরই এসে পড়েছিল , যখন হইচই করছে, কয়েকটা তিনচার বছরের ছেলেমেয়ে খেলতে-খেলতে বাঙলোবাড়ির দেয়াল পর্যন্ত চলে যায় বলের খোঁজে । তাদের পিঁপড়ের ঝাঁক আক্রমণ করে । পিঁপড়ে কামড়ের অ্যালার্জি কম-বেশি কয়েকটা বাচ্চার হলেও, সবচেয়ে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হয় একটি মেয়ে ; বস্তুত সে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায় । তাৎক্ষণিক জ্বরে আক্রান্ত হয় মেয়েটি এবং সে অজ্ঞান হয়ে যায় । পিকনিকদলের সদস্যদের সাক্ষ্য অনুযায়ী , পিঁপড়ের ঝাঁক আসছিল বাঙলোবাড়ির ভেতর থেকে । দলের নেতা রবিরঞ্জন কর্মকার গিয়ে খবর দেন স্হানীয় থানায় এবং থানা ইনচার্জের জিপে চেপে ডাকতার ডেকে আনেন ।
থানাত ওসি সুমন মিশ্র ঘটনাস্হলে পোঁছে বাঙলোবাড়িটা তালা-বন্ধ পান , এক নজরে টের পাওয়া যায় কেউ থাকেনা বাড়িটায় , বহুদিন যাবত অব্যবহৃত পড়ে আছে । তিনি জিপে চেপে কাছাকাছি যে ডাকতার পেয়েছিলেন তাঁকে ডেকে আনেন । ডাকতার সযত্নে বাচ্চাটির শুশ্রুষা করেন । কোনো ফিস নেননি , বরং নিজেই ওষুধ দিয়ে বাচ্চা মেয়েটিকে সুস্হ করেন ও জ্ঞান ফেরে তার । সাদা কাগজে কয়েকটা ওষুধ লিখে দেন কয়েকদিন খাবার জন্য ; তাড়াহুড়োয় নিজের প্রিন্টেড প্যাড আনতে পারেননি । সামান্য ঘটনা বলে ওসি বিশেষ আগ্রহ দেখাননি । থানায় নতুন এসেছিলেন, তাই এলাকা সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান ছিল না তাঁর । পিকনিকদলের আক্রান্ত শিশুদের অভিভাবকদের ঠিকানা ডিটেইলসে লিখে রাখা প্রয়োজন মনে করেননি । যে শিশুটি সর্বাধিক আক্রান্ত হয়েছিল তার বাবার নাম ও স্হানটুকু লেখা : দীপ্যমান গোস্বামী, সাকিন লেক টাউন । ভালোয়-ভালোয় ঘটনা মিটমাট হয়ে যাওয়ায় তখনকার মতন নিশ্চিন্ত ছিলেন ওসি ।
মাস ছয়েক পর, হঠাৎই, হাতে তেমন কাজ ছিল না, ওসি বাঙলোবাড়িটার হাল-হকিকাত জানার জন্য, সেখানে ক্রিমিনাল আড্ডা থাকতে পারে অনুমান করে, কেননা কিছুদিন যাবত তাঁর এলাকায় অপরাধের সংখ্যা বেড়েই চলছিল, একাই ঢুঁ মারেন । গেটের তালা একজন তালা-খুলিয়ে বিশেষজ্ঞ কন্সটেবলকে দিয়ে খুলিয়ে, ভেতরে প্রবেশ করে দেখতে পান যে বাড়িটায় বহুকাল বসবাস করা হয়নি ; ঝোপ-ঝাড় উঁচু ঘাসে সামনের বাগান ছয়লাপ , এক-আধটা ফুলের গাছ দেখে টের পাওয়া যায় যে কখনও সাজানো বাগান ছিল । আগাছার জঙ্গলে পিঁপড়ে আর ছিল না । ওসির ধারণা হয় যে পিঁপড়েরা কলোনি সরিয়ে নিয়ে গিয়ে থাকবে । বাঙলোবাড়িটার ফাটলেও গাছ গজিয়েছে । সিঁড়ি দিয়ে উঠে, পুলিস অফিসার হলেও, তাঁর গা ছমছম করে । সেদিনকার মতন অনুসন্ধান স্হগিত রেখে আবার কিছুদিন পর তিনি হেড কন্সটেবল পীতাম্বর পোড়েল আর সইফুদ্দি তালাঅলাকে এনে প্রবেশের সদরের তালা খোলান, গোদরেজের ডুলিকেট ল্যাচকি নিজের কাছে রেখে, চাবিঅলাকে চলে যেতে বলে, ভেতরে ঢুকে সাজানো বাড়ির বৈভব দেখে অবাক হয়ে যান । বাড়িতে কেমন যেন অশরিরী গন্ধ রয়েছে মনে হয় তাঁর , পোড়োবাড়ির গন্ধ সচরাচর যেমন হয় তেমন সোঁদাটে নয়, কিছুটা ইংরেজ-রাজত্বের ফেলে যাওয়া গোরস্হানের মতন , স্বদেশে ফিরতে পারেনি বলে গোরা সায়েবের প্রেতাত্মা হাহাকার করে বেড়াচ্ছে । নিজের দৈনিক ডায়েরিতে এভাবেই বর্ণনা করে গেছেন তিনি তাঁর অভিজ্ঞতা ।
বাড়িটার সবকটা ঘর খোলা থাকলেও একটা ঘর বাইরে থেকে তালা-বন্ধ ছিল , তার জানালাও ভেতর থেকে বন্ধ । হেড কন্সটেবল পীতাম্বর পোড়েলের কাঁধের ধাক্কায় খুলে যায় মরচেধরা তালাটা । বিশেষ আসবাবপত্র নেই ঘরটায় । ঘরের ভেতরের দৃশ্যে অবাক হয়ে যান ওসি সুমন মিশ্র । ঘরের দামি মেহগনি খাটে পুরু বিছানার ওপর অর্থেক ঝুলে আছে একজন মানুষের কংকাল , বিছানা থেকে কয়েক পা দূরে একটা প্রাণীর কংকাল । প্রাণীটাকে খুঁটিয়ে দেখার জন্যে উবু হয়ে বসলেন ওসি । প্রাণীটার চামড়া রয়ে গেছে দেহের কয়েকটা অংশে , কালো-সাদা, পোকা আর সময় সম্পূর্ণ খেয়ে নিশ্চিহ্ণ করতে পারেনি । মুখের আকৃতি , কাটা লেজের আর দেহের চামড়া থেকে ওসি অনুমান করলেন যে কংকালটি একটি কুকুরের । বাঙলোবাড়িটায় তালা দিয়ে ফিরলেন তিনি, এবং স্বতঃপণোদিত হয়ে পিঁপড়ের কামড়ের যে নথি ছিল, তা নিয়ে একটি ফাইল খুললেন, জনৈক ব্যক্তির অস্বাভাবিক মৃত্যুর ।
পরের দিন বাঙলোবাড়িটায় দুজন কন্সটেবলকে সঙ্গে নিয়ে গেলেন ওসি সুমন মিশ্র । মানুষের আর কুকুরের কংকালের রহস্য , যদিও তাঁর জানা জরুরি ছিল না, তবে তাঁর মনে হয়েছিল যে এর পেছনে একটা অঘটনের কাহিনি নিশ্চই আছে , যার রহস্য ভেদ করা পুলিসের কাজ । কয়েকটা জিনিস তিনি সংগ্রহ করেছিলেন রহস্যময় বাঙলোবাড়ি থেকে : ( ১ ) বাথরুমে রাখা চটি ; ( ২ ) দ্রেসিংটেবিলের ওপর রাখা কয়েকগাছা চুলসহ একটা হেয়ারব্রাশ ; ( ৩ ) কমপিউটারবিহীন ও মনিটরবিহীন কিবোর্ড ; কমপিউটারটা না থাকায় সন্দেহের খচখচানি হল ওসির ; ( ৪ ) এক হাজারটি সিডি , ইংরেজিতে নম্বর দেয়া ; ( ৫ ) ব্রাউনরঙের খামে কোনো মহিলার দীর্ঘ চুলের আঁটি, সম্ভবত তাঁকে নেড়া করার সময়ে একটুখানি নেয়া । সিজ করার মতন আর তেমন কিছু পেলেন না ওসি ।
মিউনিসিপালিটির রেকর্ড থেকে বাঙলোবাড়ির মালিকের নাম পেয়েছিলেন ওসি, গুরুচরণ দত্তমজুমদার ; তিনি তো দেশ স্বাধীন হবার আগেই মারা গিয়েছিলেন, বোধহয় ইংরেজদের আমলেই, তখন মিউনিসিপালিটি ছিল না । তাঁর ছেলেও মারা গিয়েছিল । মিউনিসিপাল কর্পোরেশানের কাছে তাঁদের মৃত্যুর দিনক্ষণ দর্জ করা নেই । তাঁদের সময়ে অবশ্য ওটা নোটিফায়েড এরিয়া ছিল, মিউনিসিপালিটির অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি । তাঁর উত্তরাধীকারী এরকম দায়িত্বজ্ঞানহীন কী করে, লোকটা যখন ফৌজদারি উকিল ছিল । সাবইন্সপেক্টারকে পাঠিয়ে বার কাউনসিলের পুরানো রেকর্ড থেকে দত্তমজুমদার পদবির অ্যাডভোকেট পেয়েছিলেন ওসি, সুবীর দত্তমজুমদার । পরের প্রজন্মের উকিলরা জানে যে তিনি ব্রিফ নেবার অনেক ফিস নিতেন , বিচারপতিরা তাঁকে আইনী-জ্ঞানের কারণে সমীহ করতেন । রাশভারি দশাসই চেহারার লোক ছিলেন , বাজখাঁই গলা, রাগি মেজাজের, অথচ তাঁর পরিবারের বিষয়ে কেউ কিছুই বলতে পারল না ।
সাইবার কাফেতে গিয়ে কয়েকটা সিডি দেখার চেষ্টা করেছিলেন, কেননা পুলিস কমপিউটার সেন্টার তখনও স্হাপিত হয়নি এই রাজ্যে ; বিলেতি আর হিন্দি গানের আধিক্য দেখে কোনো ক্লু পাননি । চুলের দুটি গোছা, হেয়ার ব্রাশ আর ব্রাউন প্যাকেটে, তাঁর মতে, বাড়ির কোনো সদস্যের ; হয়তো ওই কংকাল মহিলার , যিনি হঅর্ট অ্যাটাক বা সেরিব্রাল অ্যাটাকে মারা যান ; কুকুরটা মণিবের দুঃখে মারা গেছে । নিজে থেকে পিঁপড়ের কেসকে কংকালের কেসে নিয়ে গিয়ে নিজেই বিপদে পড়েন তিনি । ক্লোজ করার জন্যে ঊর্ধতন অফিসারদের পাঠিয়েছিলেন, তাঁরা মত না দিয়ে ঝুলিয়ে রেখেছিলেন ।
পরের ইনভেসটিগেটিং অফিসার রমেন বসু ফাইলটা নাড়াচাড়া করতেন আর চিন্তা করতেন কী করা যায় । বাঙলোবাড়ি সিল করে দেয়া হয়েছিল । মানুষের কংকাল যে অবস্হায় ছিল তেমনই পড়ে ছিল । তিনি বাড়তি সিজ করেছিলেন কুকুরের কংকাল আর তার ছাল । কুকুরের ছালসহ কংকালটি থানার মালখানায় এনে রেখেছিলেন । সিডিগুলোর মধ্যে থেকে কয়েকটা বাছাই করে দেখার চেষ্টা করে তিনি দেখেন সেগুলো খুলছে না , যেগুলো খুলছে সেগুলো বাংলা ইংরেজি হিন্দি গানের । তাঁর সন্দেহ হয় । তিনি পুলিস কমপিউটার সেন্টারে সাইবার বিশেষজ্ঞকে পাঠালে , বিশেষজ্ঞ জানান, যেগুলো খুলছিল না ওগুলো তেলেগু ভাষায় লেখা । সেসময়ে তেলেগু-জানা কাউকে পুলিসে না পেয়ে তিনি সিডিগুলো সম্পর্কে আগ্রহ হারিয়ে ফ্যালেন । তবে কুকুরের কংকালটা তিনি সরকারি পশু ডাকতার কাকলি সোমকে দেখিয়ে একটা রিপোর্ট নিয়েছিলেন । কুকুরটা সম্ভবত পিট বুল প্রজাতির , ভয়ানক হিংস্র , কেবল মালিকের হুকুম শোনে , মাংস ছাড়া খায় না । বোধহয় না খেতে পেয়ে মরে গেছে । তার মালিকের মৃত্যুর পর তাকে খেতে দেবার কেউ ছিল না বাঙলোবাড়িটায় । চামড়াটা পোকায় খেয়ে ফেলেছে , আর বহুকাল পড়ে থাকার দরুণ চুল ঝরে গেছে । তিনি নেক্রপসি করেছিলেন কিন্তু ডিএনএ স্যামপেলের কেমিকাল অ্যানালিসিস করেননি । সেসময়ে ফরেনসিক ল্যাব ঠিকমতন গড়ে ওঠেনি ।
কোনো নির্ণয়ে পোঁছোতে না পেরে, মৃত্যুর কারণ অনিশ্চিত লিখে, রমেন বসুও ঝুলিয়ে রাখেন ফাইলটা । সেই থেকে কেসটা হাফ-খোলা হাফ-বন্ধ হয়ে পড়েছিল । এখন রিমার দায়িত্ব , নির্ণয়ে পৌঁছোবার ; ওকে কেসটা দেয়া হয়েছে দুর্নাম থেকে সুনামে ফেরত যাবার একমাত্র উপায় হিসাবে । দুর্নাম থেকে সুনামে ফেরত যাবার জন্যে রিমা খান অনেককে ধরাধরি করেছিকল ; কোনো কাজ হয়নি । অনেক ওপর পর্যন্ত গিয়েছিল ; মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন যে অত সহজে বদনাম থেকে মুক্ত করা যাবে না ; রিমাকে কিছু-একটা করে দেখাতে হবে যাতে মিডিয়ার চোখে ও নায়িকার পাবলিসিটি পায় । কেননা মিডিয়াই ওকে বদনাম করেছে । চ্যালেঞ্জ নিয়েছে রিমা ; এর শেষ দেখে তবে ছাড়বে ।
রিমার ধারণা কেসটার সমাধান করার জন্য বিল্ডার লবির চাপ আছে ; তারা অতখানি জমির লোভ সামলাতে পারছে না । কেস-ফাইল হঠাৎ ক্লোজ করে দিলে মিডিয়ার লোকেরা নতুন রসদ পেয়ে হইচই করবে । কেন্দ্রীয় নেতাদের টাকা গেঁড়িয়ে সুইসব্যাঙ্কে রাখার খবর শুনে আর পড়ে লোকে ক্লান্ত হয়ে গেছে ; দেশের মানুষ মেনে নিয়েছে যে এই সমস্ত জোচ্চর রাজনীতিকদের নিয়েই ভোটাভুটির গণতন্ত্র চলতে থাকবে এদেশে । পাবলিকের এখন নতুন মালখাদ্য চাই ।
রিমা একটা ফিলটার টিপ সিগারেট ধরালো । অন্য মেয়েরা রাস্তা-ঘাটে লুকিয়ে ফোঁকে ; রিমার লুকোছাপা নেই, উচ্চমাধ্যমিকের সময় থেকে । মুখেরও আগল নেই, স্কুল থেকেই । পুলিসে ঢুকে অবশ্য সেই গুণগুলো কাজে দিয়েছে । পুরুষতান্ত্রিক পুলিসে সহকর্মীরা ভেবেছিল অশ্লীল শব্দ আর গালমন্দ প্রয়োগ করে ঘাবড়ে দেবে রিমাকে । অপরাধীরাও রিমার মুখনিঃসৃত এমসেবিসি বাণী থেকে নিস্তার পায় না ।
দীপ্যমান গোস্বামী । চাকরিতে থাকলে থাকার কর্মীদের পাওয়া যেত । রিমার জন্য ডিজি পবিত্র মুখোপাধ্যায় বরাদ্দ করেছেন সাব-ইন্সপেক্টার রজত মণ্ডলকে । তার জন্যেও কত ধরাধরি করতে হয়েছিল । ডিজি নিজের ডিসক্রিশানারি পাওয়ার প্রয়োগ করে রজতকে দিয়েছেন । রিমা অবশ্য ব্যক্তিগতভাবে কোনো-কোনো কর্মীর সাহায্য নেয় । কন্সটেবলরা, যারা ওর আন্ডারে কাজ করেছে, তারা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কাজ করে দ্যায় । রিমা চিরকাল ওর অধস্তনদের বাঁচিয়েছে , ঊর্ধতনদের প্রকোপ থেকে ।
বাঙালিদের পিকনিকে যাবার অভ্যাসটাও মন্দ নয় । কবে থেকে পিকনিকের চল হয়েছে তা অনুমান করতে পারে রিমা । ইংরেজরা যাবার সময়ে তাদের বাতিল গোরস্তানের সঙ্গে দিয়ে গেছে এটা । বলিউডি গান সহযোগে বিয়ার বা পাউচমালের সঙ্গে মুর্গির টাকনা । সপরিবারে হলে অন্তাক্ষরী। অনেক রকমের এঁটো ফেলে গেছে ওরা । যারা পিকনিকে যায় তারাও নানা এঁটো ফেলে জায়গাটা নোংরা করে চলে যায়।
বিএসএনএল-এর ডিরেক্টরি তন্ন তন্ন খুঁজে কোনো দীপ্যমান গোস্বামীকে লেক টাউন অঞ্চলে পাওয়া গেল না । ইনটারনেটে বিএসএনএল-এর তালিকাতেও পেল না । মোবাইল হয়ে লোকে ল্যান্ডলাইন কাটিয়ে দিলেও, পুরানোতে হয়তো আছে ; কিন্তু ওয়েবসাইটে অবিরাম পরিবর্তন ঘটতে থাকায় পুরানো রেকর্ড নেই । কী করা যায় ?
রাজ্য নির্বাচন দপতরে একদিন গেল রিমা, উর্দি পরে । লেক টাউনের হালের লিস্টটায় পেয়ে গেল দুজন দীপ্যমান গোস্বামী । একজন কালিন্দীতে , অন্যজন বাইরে । রবিবার দেখে কালিন্দীতেও পুলিসের উর্দিতে গেল । বাড়িতে দীপ্যমান ছিলেন না । তাঁর স্ত্রী চৈতালি, গায়ের রঙ ময়লাটে, দুবেলা ভাত-খাওয়া ভরাট কাঠামো, প্রতিদিনের গৃহদেবতার পুজোর সন্দেশ আর জল দিয়ে ভয়ে-ভয়ে জানতে চাইলেন, কেন আসা । পুলিস দেখে কয়েকজন দরজায় উঁকিঝুঁকি মারছিল । দীপ্যমানের স্ত্রী দরজা বন্ধ করে দিতে যাচ্ছিলেন, রিমা বলল, আসতে দিন আসতে দিন, আমি আপনাদের পিকনিকে গিয়ে পিঁপড়ে কামড়ের ঘটনাটা জানতে চাই । দীপ্যমানের স্ত্রী বললেন, হ্যাঁ, আমার মেয়েকেই জংলি পিঁপড়ে কামড়ে ছিল, ওঃ, সে কি অঘটন, ভাগ্যিস সুমনবাবু একজন ডাকতার এনে তক্ষুনি ওষুধপথ্য করলেন , নয়তো কী যে হতো ভগবানই জানেন ।
সমবেত প্রতিবেশীরা ঘটনাটাকে নানাভাবে উপস্হাপন করছিলেন । কিছুক্ষণ পর দীপ্যমান গোস্বামী বাজার থেকে দুহাতে দুটি থলে ঝুলিয়ে ফিরলেন , এবং যথারীতি পুলিস দেখে ঘাবড়ে গেলেন । প্রতিবেশিরা তাঁকে রিমার আগমনের উদ্দেশ্য জানালে তিনি ফ্ল্যাটের অন্য ঘর থেকে একটা ফাইল নিয়ে এলেন । বললেন, সেই পিঁপড়ের কামড়ে আমার মেয়ে আজও মানসিকভাবে ভুগছে , কীটফোবিয়া হয়ে গেছে ওর , আমরা প্রতি মাসে পেস্ট কন্ট্রোলকে দিয়ে পুরি ফ্ল্যাট ডিসইনসেক্টিফাই করাই । দীপ্যামন গোস্বামী লোকটা ওর স্ত্রীর চেয়ে বেশ ফর্সা , বোধহয় প্রেম, নয়তো মোটা যৌতুক । গালদুটো মোদো-চকচকে , চুল কোঁকড়ানো, পায়জামা কুর্তায় , আজকালকার রঙিন চকরাবকরা পাঞ্জাবি ।
রিমা জানাল , আমি সেই ঘটনার সূত্রে আরেকটি ঘটনার তদন্ত করছি । ডাকতারের ক্লিনিকটা কোথায় আর তাঁর নাম-ঠিকানা জানেন কি ?
—না, তা তো আমরা জিগ্যেস করিনি তখন, এত বিপর্যস্ত ছিলাম আমরা । আমার মেয়েকে সবচে বেশি কামড়ে ছিল, কিন্তু কমবেশি অনেকের বাচ্চাকে কামড়েছিল ওই বিদকুটে বিষাক্ত পিঁপড়ে ।
—হ্যাঁ, আমার মেয়েকেও পিমড়ে কামড়েছিল , তবে অত জঘন্য ভাবে নয় ; বাড়ি ফিরে ডাকতার দেখিয়ে ওষুধ দিয়ে কয়েক দিনেই সেরে গিয়েছিল ।
—আমার দুই ছেলেকে কামড়েছিল বটে, তবে গোস্বামীদার মেয়ের মতন নয় ।
দীপ্যমান গোস্বামীকে রিমা অনুরোধ করা প্রেসক্রিপশানের জেরক্স নিল, মোবাইল নম্বর নিল দীপ্যমানসহ কয়েক জনের । ডাকতারদের হাতের লেখা এত নোংরা কেন যে হয় , নামের জায়গায় ইজকুড়ি-বিজকুড়ি । নয়তো ডাকতার সাহায্য করতে পারতেন ।
ডাকতারকে কী রকম দেখতে ? জানতে চাইল রিমা ।
দীপ্যমান : মহিলা ডাকতার যুবতী-যুবতী টাইপ । ঢ্যাঙা । কাঁধ পর্যন্ত চুল ; চুলে তেমন পাক ধরেনি যদিও । গায়ের রঙ এই ধরুন আমার চেয়ে এক পোঁচ ময়লা । ফিস দিতে চাইলেও নেননি ।
চৈতালি : কম বয়সী কী ? চাহারা তো একহারা । বোধহয় বিয়ে করেননি বলে কম বয়সী মনে হচ্ছিল , মানে সিঁদুর-টিঁদুর তো দেখিনি ; আজকাল অবশ্য ডাকতার-টাকতাররা শাঁখা-সিঁদুর পরেন না । তবে বেশি বয়স নয় ; আলগাচটুকে ।
দীপ্যমান : ডাকতার হলেও কিন্তু দামি জামদানি পরেছিলেন । চোখে রিমলেস চশমা । হাতে একগাছা সোনার বালা । অন্য হাতে চারচৌকো ঘড়ি । ফিস নিশ্চই অনেক, কিন্তু আমার কাছ থেকে নিলেন না । বোথহয় বাচ্চার কষ্ট দেখে ।
—স্যার, খবরটা কি টিভিতে আসবে ? মানে টিভির লোক কি দীপ্যমানবাবুর বাড়ি আসবেন এই কেস তুলে ধরতে ? জিগ্যেস করল একজন যুবক ।
—না না, এখনই এটা নিউজ হবার মতন নয় । হলে দীপ্যমানবাবুকে ওরা অবশ্যই কভার করবে , বলে, রিমা উঠে দাঁড়াল, যোগ করল, পরে দরকার পড়লে যোগাযোগ করব । আর, ডাকতারের সঙ্গে যোগাযোগ হলে ঠিকানা-ফোন নম্বর নিয়ে নেবেন প্লিজ ।
বাইরে বারিয়ে রিমা দেখল ওর লাল-কালো সুজুকি হায়াবুসা মোটর সাইকেল ঘিরে ভিড় । স্টার্ট করে আধা-থ্রটল হুমকি দিতেই ভিড় সরে গেল । রিমা শুনতে পেল কেউ বলছে, আরে এ তো সেই বিখ্যাত নোংরা পরি, উরিব্বাস, কত চুপটি করে কথা বললে আমাদের সঙ্গে । টিভিতে দেখেছিলিস তো ওনাকে নিয়ে প্রোগ্রাম করেছিল ? জাঁদরেল অফিসার , চোর-ডাকাতরা ওনার ভয়ে হেগে ফ্যালে । মোটর সাইকেলটার ফোটো বেরিয়েছিল কাগজে । নোংরা পরি ওপর বসলে সাইকেলটার ডানা গজায় ।
আর পুরুষদের ওপর বসলে তাদের গায়ে কাঁটা গজায় , রিমা নিজেকে শোনালো, রে-ব্যান গগলস পরতে-পরতে ।
Tagged ডিটেকটিভ উপন্যাস |
৩. ওয়েডিং গিফ্ট
ক্লাস টেনে পড়ার সময়ে, তখন ভবানীপুরে থাকতুম, মিলিদের পাশের বাড়িতেই , কেননা বাবা এই বাঙলোবাড়িটায় থাকতে চাইতেন না । বলতেন, ওটা বাড়ি নাকি ? দাদুর বেলেল্লাপনার মিউজিয়াম । মিলির সঙ্গে ছোটোবেলা থেকে চেনাজানা ছিল । এই চল, একদিন দুজনে মিলে লুকিয়ে চুমু খাই, বলতেও ও রাজি হয়ে গেল । বলেছিল, তুই এর আগে চুমু খাসনি তো কাউকে ? উচ্ছিষ্ট হয়ে যাসনি তো ? আজকালকার ছোঁড়ারা তো নিজে চুল আঁচড়াতে শিখলেই উচ্ছিষ্ট হয়ে যায় । কত স্যামপেল যে দেখলুম আজ পজ্জন্ত ।
সত্যিই আগে কাউকে চুমু খাইনি । তুই খেয়েছিস কি খাসনি তাতে আমার কিচ্ছু এসে যায় না । মিলির মোটা-মোটা গোল টুপটুপে ঠোঁট কাছ থেকে দেখলেই চুমু খাবার ইচ্ছে হতো । আসলে যেকোনো মেয়েকেই চুমু খাবার ইচ্ছে হতো । ক্লাসের সহপাঠীরা প্রতিদিনই গল্প করত কেমন চুমু খেল, ফ্রকে হাত ঢুকিয়ে আনন্দ করল , বান্ধবীর হাত নিয়ে নিজের ট্রাউজারে রাখতে দিল ইত্যাদি ।
মিলির দেহ-কাঠামো দারুণ, যদিও মুখশ্রী তত ভালো ছিল না । ছোটো-ছোটো চোখের আর চ্যাপ্টা নাকের কারণে । স্কুলের সবাই জানত, ও নিজেও জানত যে ও সেক্সি । আমার আগে অনেক সহপাঠী লাইন মেরেছিল ওকে । আমি বলেছিলুম , না খাইনি, তাইতো খেতে চাইছি , কিরকম লাগে জানতে চাই । ও বলেছিল, আমিও খাইনি, প্রমিস, গড প্রমিস, কাউকে দেখে পছন্দ না হলে কেন চুমু খাব ! কেন বলতো ? চুমু খাওয়াটা তো আর খাওয়া নয়, প্রেম করা ।
আমিও জানি না কিরকম লাগে, কিন্তু কাউকে চুমু খেতে খুব ইচ্ছে করে , ইচ্ছে করে কসসে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ চুমু খাই কোনো ছেলেকে । তবে সব ছেলে আমার পছন্দ নয় , তুই যেরকম খোলাখুলি বললি সেভাবে কেউ বলেনি । শুধু গন্দা-গন্দা মন্তব্য করে । মুখ দেখেই বলে দিতে পারি যে কোন ছেলের মুখ দিয়ে কিরকম গন্ধ বেরোয় । তোর তো প্রেমিক হবার সব গুণ আছে । কেন বলতো ? তুই বেশ খাবসুরাত । সত্যি । আমার বন্ধু দিপলি, তুই তো চিনিস ওকে, ও রোজ ওর প্রেমিকের গল্প করে , কত কি করে দুজনে ওরা ; আমারও খুব ইচ্ছে হয় । চল না , তুই আর আমি প্রেমিক-প্রেমিকা হই । বলেছিল মিলি ।
আমি জিগ্যেস করেছিলুম, দিপলির বয়ফ্রেন্ড কে রে ? তারপর বলেছিলুম , কোথায় গিয়ে চুমু খাব ?
ও বলেছিল, আপাতত চল না কোনো সিনেমায় যাই , অন্ধকার হলেই দুজনে চুমু খাবো , দিপলির মতন নানা ব্যাপার করব । দিপলির প্রেমিক নীতিদিদির বর ; নীতিদিদিটা নাকি একদম রেফরিজারেটার । কেন বলতো ? পাশ ফেরালে পাশ ফেরে , কাৎ করালে কাৎ হয়, চিৎ হতে বললে চিৎ হয়, উপুড় হতে বললে উপুড় হয়, নিজে থেকে কিছুই করে না । অমন ঠান্ডা প্রেমিকাকে কে-ই বা নেবে ? বল ! তুই তো লম্বা চওড়া জোয়ান ছেলে, সবে গোঁফের রেখা দেখা দিয়েছে । তুই নির্ঘাৎ নীতিদিদির বরের চেয়ে ভালো প্রেমিক হবি । আরো কেন বলতো ? তোর বাবা কায়েত আর তোর মা বামুন , তার মানে তোর রক্তে প্রেমিক-প্রেমিকার ইচ্ছে বইছে । আজকে কোনো ফিলিম দেখতে চল । যেদিন আমার বাবা-মা দক্ষিণেশ্বরে যাবে , সেদিনকে তোকে বাড়িতে নিয়ে যাব । প্রেমিক হতে হলে কিন্তু সাহসী হতে হয় । কেন বলতো ? নানা বাধা বিপত্তি আসে, তাই ।
সিনেমা দেখতে গিয়েছিলুম মীনার হলে । কী ফিল্ম দেখাচ্ছিল কে জানে ; যতবার দুজনে কাছাকাছি হবার চেষ্টা করি অন্ধকারটা হঠাৎ সরে গিয়ে আলো হয়ে যায় । আলো হলে ওকে কাছ থেকে কত লোভনীয় মনে হচ্ছিল, অথচ কিছু করার উপায় নেই । আসলে সঠিক সিনেমা হল আর অন্ধকারাচ্ছন্ন ফিল্ম বাছাই না করেই চলে গিয়েছিলুম।
মিলি বলল, এখানে চুমু খাওয়া কঠিন , বার-বার আলো হয়ে যাচ্ছে , তোর মুখের ওপর ফোকাস মারছে , শেষে কেউ দেখে ফেলবে, তার চেয়ে আমরা ধরাধরি খেলি । বলে, মিলি হঠাৎ আমার প্যান্টের ওপর হাত রাখল , বলল, বোতাম খোলো, বোতাম খোল, এবার থেকে বোতাম খুলে রাখবি । দিপলি বলেছে, প্রেমিকের বোতাম সদাসর্বদা খোলা থাকা দরকার । একেবারে উজবুক তুই, তোকেও আগ্রহ দেখাতে হবে তো । প্রেমিককে প্রেমিকার চেয়ে বেশি-বেশি আগ্রহ দেখাতে হয় ।
আমি বোতাম খুলতেই হাত চালিয়ে দিল মিলি । বলল, যাক বাবা, ভেতরে কিছু পরে আসিসনি ; তারপর প্রকৃত বিস্ময়ে ফিসফিস করল, ও, এরকম হয় বুঝি , এই ফুলে যাচ্ছে রে, গরমও হয়ে যাচ্ছে , ঠিকি যেমন দিপলি বলেছে । আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে রে, বুক ঢিপ-ঢিপ করছে ; তোর কিছু হচ্ছে না ? মানে এখানে নয়, যেটা ধরে আছি, মনের মধ্যে কিছু ? কিংবা বুকে ? বাবা-মা কোনদিন যে দক্ষিণেশ্বর যাবে কে জানে !
আমি ওর হাত সরিয়ে বললুম, বার-বআর দিপলিদিপলি করিসনি , ওর নাম শুনলে তোর মুখের বদলে ওর মুখটাই ভাসবে চোখের সামনে ; এবার তোরটায় হাত দিতে দে । হাত চালিয়ে দিতে ন্যাকড়া-বাঁধা পেলুম । চাপা উত্তেজনায় বললুম, ও, নিজেরটা বেঁথে এনেছিস । কেন ? চাস না যে হাত দিই !
মিলি বলেছিল, ধ্যাৎ বোকা , এখুন ধ্যাড়ানি চলছে ; কালকে খুলব , তখন যত ইচ্ছে হাত দিস । দিপলি বলেছে ওর প্রেমিক মুখও দ্যায়, কিন্তু এখানে তো আর তুই মুখ দিতে পারবি না । বাবাকে বলব, যাও দক্ষিণেশ্বরে পুজো দিয়ে্ এসো , যাতে এবার ক্লাসে প্রোমোশান পাই । বাবা আমার কথা ফেলে না ।
আমি বলেছিলুম, হোকগে থ্যাড়ানি, আমি এখনই হাত দেবো , টের পাচ্ছিস তো আমি ষাঁড়ের মতন হয়ে যাচ্ছি । মিলি ন্যাকড়া ঢিলে করতে হাত ঢোকালুম , কিরকম চটচটে । আমার হাতটা নিয়ে নিজের ফ্রকে পুঁছে মিলি বলেছিল, দেখলি তো ? কালকের দিনটা অপেক্ষা করতে পারলি না । তুই কিন্তু সত্যিই ষাঁড় । বড়বাজারে গিসলুম একবার, তখন দেখেছিলুম একটা ষাঁড় ওই করছে। একদম গোলাপি । তুইও নিশ্চই গোলাপি । কেন বলতো ? তুই তোফর্সা । নীতিদিদির বরটাতো কালোকুচ্ছিত , তবে দিপলি বলেছে প্রেমে কালো-ফর্সা বলে কিছু হয় না । মিলন হলেই সব একাকার , বুকের ভেতর আলোয় আলো । এই তুই কবিতা জানিস ? কেন বলতো ? দিপলি বলছিল যে যখন শরীর গরম হতে থাকে তখন নীতিদিদির বর ওর কানে-কানে কবিতা শোনায়, গানও শোনায় । আমি তো কবিতাও জানি না আর গানের গলাও নেই কী করব বল !
—কবিতা ? কী যে বলিস ! আমি সাইন্সের ছাত্র , অঙ্কতে সবচে বেশি নম্বর পাই ক্লাসে । তবে নার্সারি রাইম জানি , ছোটোবেলায় শিখেছিলুম । বলেছিলুম ওকে ।
মিলি তাইতেই সন্তুষ্ট । ঘাড় নেড়ে সায় দিয়ে বলেছিল, তবে তা-ই শোনাস । ক্লাস এইটা আর ক্লাস নাইনে একবার করে ফেল করেছে মিলি । তাতে কি । কত মোটা-মোটা গোলাপি ওর ঠোঁট দুটো । বুকও ঢেউ খেলতে শুরু করেছে , আর আমার চেয়ে অনেক ফর্সা । জামা খুললে ঘরে বোধহয় আলো জ্বালতে হয় না । কথাটা ওকে বলতে মিলির খুব ভালো লাগল । বলল, তুই যা বললি তা নীতিদিদির বরের কবিতারচে অনেক-অনেক মিষ্টি । এই রকম কথা মাঝে-মাঝে বলিস । কেন বলতো ? যে কথার মানে হয় না অথচ শুনতে ভালো লাগে তা শোনার জন্যেই তো মানুষ বেঁচে থাকে ; মানুষ তো শুধু খাবার আর হাগবার জন্যে বেঁচে থাকে না ।
পরের দিন গেলুম ভবানী সিনেমায় । মিলি নিজে সিনেমার টিকিট কেটে রেখেছিল। দেয়ালে ঠেসান-দেয়া সিট পেয়েছিলুম । ভালই হল । আমি ফিসফিস করে বললুম, আজকে কিছু বাঁথিসনি তো ? মিলি আমার বাঁ-হাতর মধ্যমা আঙুলটা নিয়ে বলেছিল, এইতে রাখ, শুধু রাখবি, নাড়াবিনা কিন্তু, নাড়ালে কাল থেকে আসবো না ।
আমি আঙুলটা নাড়াতে-নাড়াতে বললুম, নাড়ালে কী হয় ?
মিলি আমার বোতাম-খোলা প্যান্টে হাত ঢুকিয়ে টিপে-টিপে ফোলাতে লাগল আর বলতে লাগল, এই হয়, এই হয়, এই হয়, এই হয়, হেই হয়, এই হয়, এটা আমার আমার আমার । আমি এত উত্তেজিত হয়েগিয়েছিলুম যে সামলাতে পারলুম না । রুমাল বের করে পুঁছতে হল । রুমালটা নিজের কাছে রেখে নিয়ে মিলি বলেছিল, এটা আমার ওয়েডিং গিফ্ট । রুমালটা বুকের মধ্যে গুঁজে মিলি বলল, চল এবার, ফিলিম দেখে কী হবে ? আমরা দুজনে বাইরে বেরিয়ে গেলুম , ইনটারভালের আগেই । বাইরে বেরিয়ে মিলি রুমালটা শুঁকতে-শুঁকতে খুব জোরে হাসতে লাগল । হাসতে-হাসতে বলল, অদ্ভূত ব্যাপার এই প্রেম ; তুই এটা প্রেম ভাবছিস তো ? আমি কিন্তু ঠিক করে নিয়েছি তু-ই আমার প্রেমিক । কিন্তু আমার কিছু হবার আগেই তোর হয়ে গেল কেন ? তোর সঙ্গে ঘর বাঁথা যাবে না , এক্কেবারে প্রেমিক হবার অযোগ্য তুই । দিপলি বলেছে, দুজনের একসঙ্গে হওয়া মানে প্রেমিক-প্রেমিকার রাজযোটক । ঠিকুজি-কুষ্টি মেলাবার সময়ে আঁক কষে এটাই তো দ্যাখে , সেই বিয়ে সফল হয় ।
—তোর জন্যেই তো হল, বলেছিলুম ওকে ।
দিপলি বলেছিল, প্রথম দিনেই দেখে নিতে । তাই টেস্ট করলুম। তুই পাস । লেটার পাবি প্রেমে । বাব্বাঃ, কত স্টক তোর , প্রেমে টইটুম্বুর । আনন্দিত আননে বলেছিল মিলি ।
আমরা দুজনে অনেকক্ষণ চুপচাপ হাঁটলুম , চিনেবাদাম খেলুম । চিনেবাদাম খেতে-খেতে মিলি বলেছিল, ফুচকা খেয়ে চুমু খাস , তার মতন আর মজা নেই । দিপলি আর নীতিদিদির বর প্রায়ই ফুচকা খেয়ে চুমু খায়, টকঝাল চুমু । নানা স্বাদের চুমু হয় । বড়-বড় কবি-মনীষিরা লেখে গেছেন । তুই সেসব পড়তে পারবি না , সংস্কৃততে লেখা ।
যাবার আগে আমি বললুম, কালকে আমার পালা, তুই কিছু করবি না । ও বলেছিল, ঠিক আছে , তুই যা করার করে নিবি , তারপর আমি আমার ওয়েডিং গিফ্ট নেবো । আমার তো আর অত তাড়াতাড়ি তোর মতন রসগোল্লার রস বেরোবে না । আমি নিজে-নিজেও নিজের মজা নিই , ক্লাসে অনেকেই নিজে-নিজে আনন্দ নেয় । ছেলেরাও তো নিজে-নিজে আনন্দ নেয় । তুই নিস ? রোজ দুটো করে হাফ-বয়েল ডিম খাবি । কেন বলতো ? তাহলে রস অক্ষুন্ন থাকবে , দিপলি বলেছে । দেখিসনি, ফুচকায় রস থাকে বলে খেতে ভালো লাগে , মুখে ঢোকালি কি ফুচ ।
পরের দিন আমরা লাইটহাউসে গেলুম । মিলি বাড়ি থেকে চাইলেই পয়সা পেতো । আমি বাড়িতে হাতখরচ চাইলে খেতুম চড় । লাইটহাউসে আমরা চুমু খাবার সুযোগ পেয়ে গেলুম । উনটারভালে বাইরে বেরিয়ে ফুচকা খেয়ে আবার চুমু খেলুম । চুমু খেতে যে এত ভালো লাগে জানতুম না , ফুচকা অর নো ফুচকা । চুমুটা খাবার পর থেকে আমরা দুজনেই চুমু খাবার সুযোগ খুঁজতুম । মিলির মোটা-মোটা ঠোঁটের গরম গন্ধ আমার ভালো লাগত । ওর ভাল লাগত ওয়েডিং গিফ্ট ; এই ওয়েডিং গিফ্ট খেলা খেলতে ওর ভালো লাগত । কত যে ওয়েডিং গিফ্ট ওকে দিয়েছি তার হিসেব নেই । তবে রুমালের বদলে কাপড়ের টুকরো ওই আনত ।
একদিন ওকে বললুম তোর বুকে হাত বোলাবো কী করে ? তোর বুক দেখতে খুব ইচ্ছে করে । ও বলল, শীতকাল তো আসছে , একটু অপেক্ষা কর , সামনে দিকে বোতামখোলা একটা সোয়েটার আছে আমার , সেইটে পরে বেরোব , ভেতরে পরব না কিছু । বড়দিনের দিন সেই দিনটা এলো । অমরা ছবিঘর সিনেমা হলে গিয়েছিলুম । মিলি ওর সোয়েটারে বোতাম খুলতেই ফিল্মের আলোয় ওর বুকের ঢেউ আরও গোলাপি হয়ে উঠেছিল , আর ওর বুকের ওপর দেখতে পাচ্ছিলুম নায়ক আর খলনায়কের মারামারির আলোছায়া । আমি ওর কাছ ঘেঁষে হাত বোলালুম , বললুম, মুখ দিতে ইচ্ছে করছে রে । মিলি বলল, পরশু বাড়িতে কেউ থাকবে না ; মা-বাবা যাবে দক্ষিণেশ্বরে , আমি বলে দিয়েছি পরীক্ষার পড়া আছে । তুই দুপুর বেলা চলে আসিস , সঙ্গে বইখাতা নিয়ে আসিস । কেন বলতো ? যদি অন্য কেউ হঠাৎ এসে পড়ে । ড্রইংরুমে বইখাতা খুলে রাখব । কেন বলতো ? কেউ এলে ভাববে তুই আমাকে পড়াচ্ছিস । সবাই জানে তুই ভাল ছাত্র , আর আমি ফেলটুস । পড়ে কি করব ? কেন বলতো ? সংসার তো তুই চালাবি , আমার শুধু তো সংসারের খাটনি থাকবে । কত প্রেম করব দুজনে , ওফ, ভাবলেই তোকে আলুপোস্ত করে ফেলতে ইচ্ছে করে ।
আমি স্কুলব্যাগ বইখাতা জিওমেট্রর বাক্স নিয়ে মিলিদের বাড়ি গিয়ে দেখি ও ড্রইংরুমের কার্পেটের ওপর বই-খাতা খুলে রেখেছে । আমার কাঁধ থেকে তাড়াতাড়ি স্কুলব্যাগ নিয়ে বই-খাতা পেনসিল বের করে রাখল , এমনভাবে যাতে মনে হয় ওকে বুঝিয়ে দিচ্ছি । বলল, দাঁড়া, আমার টাওয়েলটা নিয়ে আসি ; কেন বলতো ? তোর রসগোল্লার রসে যদি কার্পেট নোংরা হয়ে যায়, বড়রা ঠিক টের পেয়ে যাবে । তারপর জিগ্যেস করল, রবার এনেছিস ?
আমি বললুম, হ্যাঁ, জিওমেট্রি বক্সে আছে ।
—ওঃ মাগো, একে নিয়ে কী করব ! দুহাত ওপরে তুলে বিরক্তি প্রকাশ করল মিলি : ওই রবার নয় রে গাধা, প্রেম করার রবার , ওফ, যদি জানতুম তাহলে দিপলির কাছ থেকে নিয়ে নিতুম । নীতিদিদির বর নিজের পকেটে নিয়ে ঘোরে , জানিস ? কখন দরকার পড়ে, বলা তো যায় না । কোনো সুযোগ ছাড়ে না ওরা । আমার অবাক চেহারাখানা দেখে আরও বিরক্ত হল মিলি । বলল, প্রেম করার সময়ে ছেলেরা পরে, জানিস না ? কেন বলতো ? না পরলে রসগোল্লার রস ভেতরে পড়ে বাচ্চা ফুটিয়ে ফেলবে । আজকের পুরো সুযোগটা ডোবালি তুই । নাঃ, তোকে নিয়ে পারা যায় না , মোটেই প্রেমিক হবার যোগ্য নোস । হয় ভগবান, কাকে যে প্রেমিক বাছলুম ।
ও বারবার এত হাত নাড়িয়ে কথা বলছিল যে ওর ফ্রক ওপরে উঠে যাচ্ছিল ঞাঝে-মাঝে , আর তাইতে বুঝে গেলুম যে ফ্রকের তলায় কিছু পরে নেই । আমি সজোরে জড়িয়ে ধরে ওর মোটা-মোটা ঠোটে আমার ঠোঁট চেপে ধরে মিলির কথাবলা থামালুম। ও আমাকে টেনে বই-খাতার মধ্যে ফেলল, বলল, তুই আমার পায়ের দিকে মাথা কর , দিপলি বলেছে, রবার সঙ্গে না থাকলে এই উপায় করতে হয় । আমার আগে মিলি নিজেই আমার মাথার দিকে পা করে ফেলল আর আমায় বলল, ওখানে জিভ ঘসতে থাক , মুখ ঘসতে থাক । যখন বলব তখন থামবি ; আমার হয়ে গেলে আমি তোর শুরু করব ।
উল্টো দিকে মুখ করে শুয়ে মিলি বলল, তোর বুকের মধ্যে কী বাজছে বলতো ?
আমি জিগ্যাস করলুম, কী ?
ও আমাকে বলার আগেই গাল ঘসতে লেগে গিয়েছিলুম ; নেশা ধরা গন্ধ, চোখ বুজে গন্ধ নিতে-নিতে আমার উঠতি দাড়ি দিয়ে ঘসছিলুম । মিলি বলল, কবিতা বল না , যা জানিস, তা-ই বল, আর যা করছিস তা-ই কর, ভেতরে গিয়ে বল ; ওটাও কবিতা বোঝে ।
আমি টুইংকল টুইংকল লিটল স্টার হাউ আই ওয়ান্ডার হোয়াট ইউ আর বলতে-বলতে কী যে করছিলুম, নিজেই জানি না, যতক্ষণ না মিলি থামতে বলল, ততক্ষণ । মিলি কেঁপে-কেঁপে জোরে জড়িয়ে ধরল । তারপর যা করল তা আজও মনে হয় আত্ম-আবিষ্কার । মুখে পুরে নিয়ে জিভ ব্যবহার করে রসগোল্লার রস বের করে ফেলল , আর গিলে নিল, স্পষ্ট টের পেলুম ।
—কী করছিস কি, পাগল না কি তুই, বললুম উঠে বসে ।
মিলি বলল, দিপলিও খায় , বেশ ভালো স্বাদ , মন ভরে গেল, সত্যি, আলোয় আলো হয়ে গেল মনটা । তুই এবার বই-খাতা গুটিয়ে, যা, কেটে পড় ; ভাগ্যিস কেউ আসেনি । এবার আমিই রবার যোগাড় করে রাখব , তোর দ্বারা কিসসু হবে না ।
আমি বললুম, এখনও তোর বুকটাই ভালো করে দেখা হল না আর তুই তাড়িয়ে দিচ্ছিস । মিলি ফ্রক ওপরে তুলে বলল, নে, যত পারিস দেখে নে শিগগির ; আশ মিটিয়ে নে । ফ্রক তোলার ফলে ওর মুখ ঠাকা পড়ে গিয়েছিল । আমি সেই সুযোগে ওকে জড়িয়ে ধরে ওর বুকে মুখ গুঁজে দিলুম । ঢেউয়ের ওপর জিভের নৌকো বাইতে লাগলুম , ও বাধা দিল না ; বলল, ঠিক আছে, কর কর , বেশ ভাল্লাগছে । বলল, তোর ভেতর কোন বাজনা বাজছে বলতো ? পুজোর বাজনা : না না চাই, হ্যাঁ হ্যাঁ চাই না, না না চাই , হ্যাঁ হ্যাঁ চাই না, না না চাই, হ্যাঁ হ্যাঁ চাই না , না না চাই, ঠিক কি না ?
আমি দাঁত বসিয়ে দিতে, উঃ, জানোয়ার কোথাকার, সুযোগ পেয়েছিস কি নিজের রূপে এসে গেলি ।
তখনকার মতো আমার প্রথম প্রেমের সেখানেই ইতি ।
আমাদের দুজনকে বাবা কোথায় একসঙ্গে দেখে ফেলেছিলেন । আমরা নাকি খুব হাসাহাসি করছিলুম । ব্যাস, চড়, চড়ের পর চড়, আরও চড় । বাবার ধারণা যে বাইজি নাচাবার রক্ত আমার শরীরে ডাক দিতে লেগেছে । আমাকে ওই রক্তদোষ থেকে বাঁচাবার জন্যে বাবা এই বাগানবাড়িতে থাকাটা শ্রেয় মনে করলেন । আমার নারী-সঙ্গর সাহস, কেন কে জানে, ছিল না তখন । তা ঢুকল কলেজে ঢুকে , হস্টেলে থাকার সময়ে , বাবার চোখের আড়ালে ।
বাবা প্রেম ব্যাপারটা একেবারে সহ্য করতে পারতেন না , সম্ভবত নিজে প্রেম করে বিয়ে করাটা সফল হয়নি বলে । স্কুলের দিনে মিলির সঙ্গে তারপর দেখা হলে ওয়েডিং গিফ্ট বলে ডাকত না । বলত, কী রে জারজ, বাপকে ভয় পাস, প্রেম করার মুরোদ নেই চললেন উনি বুকে হাত বোলাতে । তবে তোকে আমি ছাড়ব না, দেখে নিস । যদি আমার বিয়েও হয়ে যায়, আমি তোর বাচ্চাকে পেটে নেবোই নেবো । তুই পৃথিবীর যেখানেই থাকিস খুঁজে বের করব তোকে । তোর মতন কেউ আমার সঙ্গে প্রেম করতে পারবে না , জানি আমি । তারপর রাস্তায় দাঁড়িয়েই কাঁদতে আরম্ভ করে দিয়েছিল ।
আমি বলেছিলুম, তুই কি উন্মাদ ?
ও বলেছিল, হ্যাঁ, আমি উন্মাদ ; তা না হলে কি করে এক কথায় রাজি হয়ে যেতুম ? তুই এত ভিতু ? এরকম ঢ্যাঙা ছেলে, চওড়া ছাতি, হিরি-হিরো চেহারা, আর সেই ছেলেটা কিনা নিজের বাবাকে ভয় পায় ! প্রেমকে ভয় পায় ! প্রেমের জন্যে মানুষ মরতে পর্যন্ত রাজি হয় আর তুই প্রেমিক হয়েও পালালি বাপের ঠ্যাঙানির ভয়ে ! তবে ছাড়ব না তোকে, এই বলে রাখলুম , দক্ষিণেশ্বরের দিব্বি ।
বাবাকে কেউ নিশ্চই খবর দিয়ে থাকবে । আমার এখন মনে হয় দিপলির সঙ্গে সব কথা বলাবলি করার ফলে নীতিদিদির বরের কানে গিয়ে থাকবে আমাদের প্রেম-কাহিনি । বাবা পাড়াটাই ছেড়ে দিলেন ।
আমরা তারপর দাদুর বাগানবাড়িতে চলে এলুম । একদিক থেকে ভালো হল । শহর থেকে দূরে বলে বাবার গাড়ি করে স্কুলে যাতায়াতের সুবিধে হয়ে গেল । তারপর কলেজে গিয়ে হস্টেলে ভর্তি হলুম । মিলির সঙ্গে প্রেমের নবীকরণের সুযোগ ছিল । কিন্তু আমার কেমন যেন গিল্ট ফিলিং হতে লাগল । কত আর ধোকা দেব বোকা মেয়েটাকে ! বোকা বলেই ওকে ভালো লাগত । ভয় ছিল যে শেষে পেটে বাচ্চা-ফাচ্চা এসে গেলে কেলেঙ্কারি , এমন ডাকাবুকো মেয়ে মিলি যে নিজে থেকেই হয়তো চেষ্টা করত যাতে পেটে বাচ্চা এসে যায় । বাবা জানতে পারলে চড় মেরে-মেরে আধমরা করে দিতেন ।
কলেজে ঢুকে সহপাঠীদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার সহায়তায় কল গার্লদের জগতটার সঙ্গে পরিচয় হল ।
এক কথায় রাজি হয়ে যাওয়া, এই অভিব্যক্তিটা এই বুড়ো বয়সে আমায় হন্ট করে । উন্মাদ ? হ্যাঁ, আজ জানি, আমি উন্মাদ ।
বাগানবাড়িটা নিয়ে দাদু আর দাদুর বাবার বনিবনা ছিল না । দাদুর বাবা নাকি বাইজিদের নিয়ে কেলো করতেন বাড়িটায় । দাদুর নামে করে দিয়ে যাননি । নোটিফায়েড এরিয়ে বলে দাদুও বিশেষ গা করেননি দাদুর বাবা মারা যাবার পর । দাদু মারা যেতে বাবাও মিউটেশানের জন্যে করেননি কিছু । আমিই বা কী করব সম্পত্তির মালিকানার ঝঞ্ঝাটে ঢুকে !
ইউরোপ যাবার আগে, উত্তর ইউরোপের কয়েকটা দেশের ভিসা পেয়েছিলুম , বাবা এত টাকা আমার জন্যে রেখে গিয়েছিলেন যে মন ভালো করার উদ্দেশ্যে ঘুরে বেড়ানো ছাড়া অন্য পথ ছিল না । অন্ধ্র থেকে ফিরে এসে আমার মন ভেঙে পড়েছিল । দেশে থাকলে বাগানবাড়িতে, নতুবা বিদেশে, এভাবেই জীবন কাটাব ঠিক করেছিলুম ।
ওবেরয় গ্র্যান্ড থেকে বেরিয়ে , এয়ার কান্ডিশানের শীতটা দেহ থেকে ঝরিয়ে ফেলার উদ্দেশ্যে, ফুটপাতের রোদে গিয়ে দাঁড়াতেই , একজন মহিলা, কাঁধে চামড়ার সুদৃশ্য ব্যাগ, আমাকে আঁকড়ে ধরলেন । ছাড়ুন, ছাড়ুন, কী করছেন কি , এভাবে, কে আপনি ? বলে, ছাড়াতে, দেখি মিলি । দেখেই ভয় করে উঠল , বাবার ভয় নব< বাবা তো স্বর্গে , অন্য এক অচেনা ভয় , বিশ্বাসঘাতকরা হয়তো এরকম ভয়ে আচমকা আক্রান্ত হয় । বুকের ভেতরে বাবা তখন হৃৎপুণ্ডকে চড় মেরে চলেছেন ।
—জানি, তুই চিনতে পারবি না , মিলি কে চিনতিস কি , যখন স্কুলে পড়তিস ? আমি সেই মিলি । আজকেই, আজকেই বলি কেন, এই কিছুক্ষণ আগে আমার ডিভোর্স হয়ে গেল । কেন বলতো ? আমার বর ভালো চাকরি করে না , আমার রোজগার উড়িয়ে বেঁচে থাকতে চাইছিল বাঞ্চোতটা । মিলি বলল, সরাসরি আমার চোখে চোখ রেখে ।
—আমি তো পরশু ইউরোপ চলে যাচ্ছি । ভয়ে আমার মুখ দিয়ে পলায়নের অ্যালিবাই বেরোলো । টের পাচ্ছিলুম ঘেমে উঠছি ।
—তোর বাবা তো কবেই অক্কা পেয়েছেন , এখনও কিসের ভয়ে মরিস ? প্রথম প্রেমকে ভয় পাস ? নিজেকেই ভয় পাস তুই । কেন বলতো ? নিজেই নিজেকে জানিস না ।
—প্রেমকে ভয় ? মায়ার স্মৃতি উসকে উঠল । মিলি বুঝতে পারছিল আমি কোনো সংবেদন চেপে রাখতে চাইছি । বললুম, না রে, প্রেমকে ভয় পাই না আর , প্রেম বিপর্যস্ত করে দিয়ে চলে যায় । আমি তোকে বিপর্যস্ত করে দিয়ে উধাও হয়ে গিয়েছিলুম । তোর দুঃখ আর অসহায়তা আজ অনুভব করি ।
—চল না, তোর বাড়ি যাই , দুজনে দুঃখ ভাগাভাগি করব । চিনেবাদামের দুপুর আর ফুচকার রাতগুলোর গল্প করব । তুই তো সেই উত্তর চব্বিশ পরগণার কোথায় যেন থাকিস , বিশাল প্রাসাদ আছে তোদের, তা তো দেখাই হয়নি । নিয়ে চল না । ভয় নেই তোর চলে আসব , আমার নিজের ছোট্ট ফ্ল্যাট আছে গল্ফগ্রীনের চার তলায় ; সেখানে তোকে নিয়ে যেতে পারতাম । আজকে নয় । কেন বলতো ? লোকেরা আজকে আমার মুখ দেখার জন্যে তৈরি হয়েই থাকবে , বিয়ে ভাঙনের আনন্দ নেবে । আমার হাত দুটো নিয়ে বলল মিলি ।
নিয়ে গেলুম ওকে । পথে দুবার ট্যাক্সি পাল্টালুম । নির্বাক দীর্ঘ পথে গায়ে গা লাগিয়ে মিলি আড়চোখে মাপজোক করছিল আমরা পরস্পরের কত আলোকবর্ষ দূরে চলে গেছি ।
বাড়িতে ঢুকে দরজা বনধ করার সঙ্গে-সঙ্গেই মিলি জড়িয়ে ধরল আমাকে । ফোঁপাতে লাগল । কারণ ঠাহর করতে পারলুম না । কাঁদবার রসায়ন আমার শরীরে ঘোর অনর্থ গড়া শুরু করেছিল ; তা চাপা দিতে আমিও জড়িয়ে ধরলুম মিলিকে যাতে ও আমার মুখের দিকে তাকাতে না পারে । ও আমার শঅর্ট টেনে ছেঁড়ার চেষ্টা করতে লাগল, ছিঁড়েও গেল বোতামগুলো । বলতে লাগল, তোর বাচ্চা চাই, তোর বাচ্চা চাই, তোর বাচ্চা চাই…
আমার ভয় নাকি যৌনতা তা জানি না । একজন যুবতী জড়িয়ে ধরেছে আমায় , তার নরম বুক চেপে বসিয়ে দিয়েছে আমার বুকে, নিজের পোশাক নিজেই দ্রুত খুলে ফেলার প্রয়াস করছে । আমি চোখ বুজতেই মায়া ভেসে উঠল, মায়ার উলঙ্গ দেহ দেখতে পেলুম চোখের সামনে ।
মিলি বলল, আমি আজ তোকে খুন করে তবে যাব , খোল, খোল, খোল, খোল….জানি, তোর বুকের ভেতরে সেই পুরানো বাজনাটা বাজছে, না না চাই, হ্যাঁ হ্যাঁ চাই না, না না চাই, হ্যাঁ হ্যাঁ চাই না, না না চাই, হ্যাঁ হ্যাঁ চাই না, না না চাই, হ্যাঁ হ্যাঁ চাই না, না না চাই, হ্যাঁ হ্যাঁ চাই না, না না চাই, হ্যাঁ হ্যাঁ চাই না , না না চাই, হ্যাঁ হ্যাঁ চাই না । আর আমার ভেতরেও সেই পুরানো বাজনাটা বাজছে চাই চাই চাই চাই চাই চাই চাই চাই চাই চাই চাই…..
—কি করছিস কি , পরশু আমি চলে যাব রে , কি করবি তুই তারপর , এখনও তুই উন্মাদ থেকে গেছিস, ছাড়, ছাড়, ছাড় ।
—ওসব আমি বুঝব ; বললুম না তোকে । আজ তোকে খুন করে তবেই যাব , তোর খাবারে বিষ মেশাব , দে, তোর বাচ্চা দে…
নারী জড়িয়ে ধরলে আমার পক্ষে আত্মনিয়ন্ত্রণ যে আসম্ভব তা আমি জানি । বোধহয় মিলিও জানত । আমি ওকে দুহাতে পাঁজাকোলা করে তুলে দাদুর বাবার ঘরে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করালুম , এই আশায় যে ঘরের আসবাব ওকে পাগলামি থেকে মুক্ত করবে । দাদুর বাবার ঘরে ওনার সময়ে শিকার করা স্টাফড বাঘ, হরিণ, মোষ, জংলি বিড়াল ইত্যাদি দিয়ে সাজানো ; দেয়ালে ওনার সঙ্গে ওনার স্ত্রী আর দাদুর তেলরঙে বিরাট ছবি , ওনার প্রিয় বাইজির তেলরঙে পোরট্রেট , দেয়ালে মোষের, হরিণের করোটি । মিলির কোনো পরিবর্তন হল না । পরিবর্তে , আমার গলা জড়িয়ে বলে উঠল, ওঃ, এই ঘরটায় তো কত অবৈধ ভালবাসাবসি হয়েছিল , না হয় আরেকটা হল । রসে রস মিশলে প্রেম আর অবৈধ থাকে না , বলে রাখলুম তোকে ।
সারা রাত পোশাকহীন আর অভূক্ত থেকে সকালে শাড়ি-ব্লাউজ পরতে-পরতে ও বলেছিল, রক্ত দেখে তোর সন্দেহ হয়নি ? তোকে মিথ্যা কথা বলেছিলুম , আমার বিয়েই হয়নি তো ডিভোর্স হবে কোথ্থেকে !
আমি স্তম্ভিত ।
রাতে ওর বুকে একটা দাগ দেখিয়ে বলেছিল মিলি, এই দ্যাখ, সেই তুই কামড়ে দিয়েছিলি, তোর দাঁতের বিষে ঘা হয়ে গিয়েছিল । আমি ওষুধ লাগাতে দিইনি, লাগাইনি, তোর স্মৃতিচিহ্ণ ধরে রেখেছি ।
আমার জীবনে আমি কোনো নারীকে বুঝে উঠতে পারিনি । হয়তো সেকারণেই আমি আকৃষ্ট হই, আজও । এই বার্ধক্যে ।
ও বলেছিল, তোর বাড়ি দেখে রাখলুম , যদি আমার আজকের উদ্দেশ্য সফল না হয়, তাহলে একদিন চুপচাপ এসে তোকে খুন করে যাব । এমনভাবে খুন করব যে কেউ বুঝতে পারবে না তুই কি করে মরলি ।
আমি ওকে ট্যাক্সিতে চাপিয়ে, ভাড়া দিয়ে দিতে চাইছিলুম । মিলি বলল, ট্যাক্সিঅলার সামনেই, তুই কি সেবার দাম দিচ্ছিস নাকি ? আমাকে পি পথবৌমা পেয়েছিস নাকি ? দেখি কি হয়, নয়তো সত্যইই তোকে জীবন দিয়ে দাম চোকাতে হবে । মনে রাখিস । ঠাট্টা করছি না, সিরিয়াসলি বলছি । ডায়েরিতে লিখে রাখ , পুলিস তোর লাশ পেয়ে আমার খোঁজে আসবে তাহলে ।
শেষনির কথামতন লিখতে-লিখতে বেশ লাগছে । সব-কিছুই মনে করতে পারছি , এত দিন পরও । মিলির মোটা-মোটা ঠোঁট, গোলাপি ভরাট বুক, বুকে কামড়ে দেবার দাগ, সোঁদা-সোঁদা গন্ধ । আর ওর প্রতিজ্ঞা যে, আমার বাচ্চাকে ও পেটে নেবেই নেবে , নয়তো খুন করবে আমাকে । আমি ওর স্মৃতিতে আমার শুক্রকীট ডক্টে অনিল পালেসকরের লিকুইড নাইট্রোজেনে ফ্রিজ করিয়ে রেখেছি ; চল্লিশ বছর রেখে দেবার কনট্র্যাক্ট । এখন তো কাগজে পড়ি ষাট-বাষট্টি বছরেও ফ্রোজ করা স্পার্ম থেকে বাচ্চা হয় । ডক্টর পালেসকর বলেছেন কোনো সমস্যা হবে না । আপনার নির্দেশ অনুযায়ী দাবিদার মহিলা যোগাযোগ করলে আমরা প্রয়োজনীয় আইভিএফ করে দিতে পারব , আপনার স্পার্ম কাউন্ট অনেক বেশি ।
মিলি তুই কোথায় ? তুই কি সফল হয়েছিলি ? তুই কি কেওড়াতলার স্বর্গদ্বার দিয়ে উধাও হয়ে গেছিস ? কেই বা তোকে জানাবে তোকে নিবেদিত আমার স্পার্মের কথা , শীতঘুমে নিদ্রিত তোর সন্তান-সন্ততির অপেক্ষার কথা !
ওর, মানে মিলির, চামড়ার ব্যাগটা পড়ে রয়েছে ; মিলি বাড়িতে ঢুকেই যেখানে ওটা রেখেছিল । ব্যাগটায় একটা ছোরা দেখে আমার আরও ভয় হল যে সত্যিই মিলি ইনসেন নয়তো । বা, হয়তো, ওর প্রেম ইনসেন , ও নয় ।
আমারও বেশ লাগল হে কংকাল প্রেমিক, তোমার প্রথম প্রেমের গল্প পড়ে । ইন্সপেক্টার রিমা খান নিজেকে শুনিয়ে বলল , সিগারেটের ধোঁয়া হাওয়ায় উড়িয়ে । তবে তুমি নিজের ঠিকানাটা লিখলে না কেন ? কোথায় থাকতে ভবানীপুরে ? মিলিদের বাড়ির নম্বরটাই বা কি ? মিলির বাপের নাম কি ? দিপলি কে ? নীতিদিদির বর লোকটা কে ? শ্রাদ্ধ করতে বসে লোকে দাদু-দাদুর বাপের নাম বলতে পারে না । আর এখানে একজন, যে কিনা নিজের নাম বলছে না, অথচ গ্রেটগ্র্যান্ড ফাদারের কাহিনি শোনাচ্ছে ! প্রথম প্রেমের রহস্যময়ী প্রেমিকার কাহিনি শোনাচ্ছে , নিজেকে শোনাচ্ছে । হাউ অ্যাবসার্ড । মায়া পাল নামে সেই মহিলার কী হল তাহলে ? এটা কি ডাইভারসানারি ট্যাকটিকস ? কংকালটা বেশ ঘোড়েল ।
মিলি কি এসে খুন করে যাবে ? মনে তো হয় না । প্রেমে উন্মাদ প্রেমিকা বলে কথা, অপেক্ষা করেছে বছরের পর বছর পালিয়ে যাওয়া প্রেমিকের জন্য । কিন্তু মিলির চামড়ার ব্যাগটা তো সিজার লিস্টে নেই । ওটা কি হল ? কংকাল প্রেমিকের দাদুর বাবার কিউরিও ঘরটাও অব্যবহৃত । ওই ঘরটার তালা জংধরা ছিল ; অর্থাৎ কংকাল প্রেমিক নিজেও, সম্ভবত মিলি এপিসোডের পর খোলেনি । বেডরুমটা কংকাল প্রেমিক ব্যবহার করত না , স্টাডিতেই শুত , আর সেখানেই মরেছে । লোকটার স্টাডিতেও জমকালো পালঙ্ক । মহিলার চুলের গোছা পাওয়া গেছে , সেটা তাহলে মিলির নয় বলেই মনে হচ্ছে । তাহলে কার ?
যাহোক, দুটো সূত্র তো পাওয়া গেল । বেডরুমে হাতের ছাপ যা পাওয়া গেছে, তার দ্বিতীয় আর তৃতীয় স্যামপেলের একটা হয়তো মিলির ; অন্যটা কার সন্ধান করতে হবে । প্রথম আর দ্বিতীয় ইনভেসটিগেটিং অফিসাররা আঙুলের ছাপ স্টেট ক্রাইম ব্র্যাঞ্চ রেকর্ডস ব্যুরোয় সংরক্ষিত ছাপগুলোর সঙ্গে মিলিয়েছিলেন ; মেলেনি , কেননা রেকর্ডে কেবল ক্রিমিনালদের ছাপই রক্ষিত । কংকাল প্রেমিকের হত্যায় কোনো পেশাদার খুনির হাত আছে বলে আপাতত মনে হচ্ছে না ।
শুক্রকীত সংরক্ষণ করার এই ডাকতারের নাম দেখেছি সংবাদপত্রে । অনেকের আইভিএফ করে বাচ্চার জন্ম দিয়েছেন । ইনি নিশ্চয় মুম্বাইয়ের সেই বিখ্যাত ডাকতার । নিজেই যাব । ডিজিকে অনুরোধ করব যাতায়াতের খরচ অনুমোদন আর মুম্বাইয়ের কমিশনারকে একটা চিঠি দিয়ে দিতে যাতে সরকারি অতিথি হয়ে থাকতে পারি ।
রিমা পড়তে-পড়তে ভাবছিল, কংকালটা বেশ লিখেছে , উপন্যাস টাইপের । ডিজিকে জিগ্যেস করতে হবে এই পুরো লেখাটা কোনো ডিটেকটিভ রাইটারকে দিয়ে নিরঞ্জন দত্ত নামে বই ছাপানো যায় কি না । কিন্তু মাঝখানে হঠাৎ এই গল্পটা ঢোকাতে গেল কেন ? কংকালটা বোধ হয় ঠাহর করতে পারেনি যে তার প্রকৃত প্রেমিকা কে ! সত্যিই, দুজন তরুণি যদি একজন পুরুষকে ভালোবাসে , তাহলে কোন নিক্তি প্রবোগ করেই বা বুঝবে যে কাকে ও চায় । ধরা যাক আরও কয়েকজন তরুণী পুরুষটাকে প্রেম নিবেদন করে বসল , তখন লোকটা কি করবে ? মায়া আর মিলি এই দুজন একেবারে বিপরীত মেরুর মহিলা । এদের দুজনকেই যদি খুঁজে পাওয়া যায় , তাহলে বাঙলোবাড়িতে এনে কংকালটাকে দেখিয়ে জানতে চাইবে, চেনে কিনা ।
অক্টোবর 2, 2012 – 6:40 পুর্বাহ্ন ক্যাটাগরিসমূহ: Detective story | Post a commentTagged ডিটেকটিভ উপন্যাস |
ক্লাস টেনে পড়ার সময়ে, তখন ভবানীপুরে থাকতুম, মিলিদের পাশের বাড়িতেই , কেননা বাবা এই বাঙলোবাড়িটায় থাকতে চাইতেন না । বলতেন, ওটা বাড়ি নাকি ? দাদুর বেলেল্লাপনার মিউজিয়াম । মিলির সঙ্গে ছোটোবেলা থেকে চেনাজানা ছিল । এই চল, একদিন দুজনে মিলে লুকিয়ে চুমু খাই, বলতেও ও রাজি হয়ে গেল । বলেছিল, তুই এর আগে চুমু খাসনি তো কাউকে ? উচ্ছিষ্ট হয়ে যাসনি তো ? আজকালকার ছোঁড়ারা তো নিজে চুল আঁচড়াতে শিখলেই উচ্ছিষ্ট হয়ে যায় । কত স্যামপেল যে দেখলুম আজ পজ্জন্ত ।
সত্যিই আগে কাউকে চুমু খাইনি । তুই খেয়েছিস কি খাসনি তাতে আমার কিচ্ছু এসে যায় না । মিলির মোটা-মোটা গোল টুপটুপে ঠোঁট কাছ থেকে দেখলেই চুমু খাবার ইচ্ছে হতো । আসলে যেকোনো মেয়েকেই চুমু খাবার ইচ্ছে হতো । ক্লাসের সহপাঠীরা প্রতিদিনই গল্প করত কেমন চুমু খেল, ফ্রকে হাত ঢুকিয়ে আনন্দ করল , বান্ধবীর হাত নিয়ে নিজের ট্রাউজারে রাখতে দিল ইত্যাদি ।
মিলির দেহ-কাঠামো দারুণ, যদিও মুখশ্রী তত ভালো ছিল না । ছোটো-ছোটো চোখের আর চ্যাপ্টা নাকের কারণে । স্কুলের সবাই জানত, ও নিজেও জানত যে ও সেক্সি । আমার আগে অনেক সহপাঠী লাইন মেরেছিল ওকে । আমি বলেছিলুম , না খাইনি, তাইতো খেতে চাইছি , কিরকম লাগে জানতে চাই । ও বলেছিল, আমিও খাইনি, প্রমিস, গড প্রমিস, কাউকে দেখে পছন্দ না হলে কেন চুমু খাব ! কেন বলতো ? চুমু খাওয়াটা তো আর খাওয়া নয়, প্রেম করা ।
আমিও জানি না কিরকম লাগে, কিন্তু কাউকে চুমু খেতে খুব ইচ্ছে করে , ইচ্ছে করে কসসে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ চুমু খাই কোনো ছেলেকে । তবে সব ছেলে আমার পছন্দ নয় , তুই যেরকম খোলাখুলি বললি সেভাবে কেউ বলেনি । শুধু গন্দা-গন্দা মন্তব্য করে । মুখ দেখেই বলে দিতে পারি যে কোন ছেলের মুখ দিয়ে কিরকম গন্ধ বেরোয় । তোর তো প্রেমিক হবার সব গুণ আছে । কেন বলতো ? তুই বেশ খাবসুরাত । সত্যি । আমার বন্ধু দিপলি, তুই তো চিনিস ওকে, ও রোজ ওর প্রেমিকের গল্প করে , কত কি করে দুজনে ওরা ; আমারও খুব ইচ্ছে হয় । চল না , তুই আর আমি প্রেমিক-প্রেমিকা হই । বলেছিল মিলি ।
আমি জিগ্যেস করেছিলুম, দিপলির বয়ফ্রেন্ড কে রে ? তারপর বলেছিলুম , কোথায় গিয়ে চুমু খাব ?
ও বলেছিল, আপাতত চল না কোনো সিনেমায় যাই , অন্ধকার হলেই দুজনে চুমু খাবো , দিপলির মতন নানা ব্যাপার করব । দিপলির প্রেমিক নীতিদিদির বর ; নীতিদিদিটা নাকি একদম রেফরিজারেটার । কেন বলতো ? পাশ ফেরালে পাশ ফেরে , কাৎ করালে কাৎ হয়, চিৎ হতে বললে চিৎ হয়, উপুড় হতে বললে উপুড় হয়, নিজে থেকে কিছুই করে না । অমন ঠান্ডা প্রেমিকাকে কে-ই বা নেবে ? বল ! তুই তো লম্বা চওড়া জোয়ান ছেলে, সবে গোঁফের রেখা দেখা দিয়েছে । তুই নির্ঘাৎ নীতিদিদির বরের চেয়ে ভালো প্রেমিক হবি । আরো কেন বলতো ? তোর বাবা কায়েত আর তোর মা বামুন , তার মানে তোর রক্তে প্রেমিক-প্রেমিকার ইচ্ছে বইছে । আজকে কোনো ফিলিম দেখতে চল । যেদিন আমার বাবা-মা দক্ষিণেশ্বরে যাবে , সেদিনকে তোকে বাড়িতে নিয়ে যাব । প্রেমিক হতে হলে কিন্তু সাহসী হতে হয় । কেন বলতো ? নানা বাধা বিপত্তি আসে, তাই ।
সিনেমা দেখতে গিয়েছিলুম মীনার হলে । কী ফিল্ম দেখাচ্ছিল কে জানে ; যতবার দুজনে কাছাকাছি হবার চেষ্টা করি অন্ধকারটা হঠাৎ সরে গিয়ে আলো হয়ে যায় । আলো হলে ওকে কাছ থেকে কত লোভনীয় মনে হচ্ছিল, অথচ কিছু করার উপায় নেই । আসলে সঠিক সিনেমা হল আর অন্ধকারাচ্ছন্ন ফিল্ম বাছাই না করেই চলে গিয়েছিলুম।
মিলি বলল, এখানে চুমু খাওয়া কঠিন , বার-বার আলো হয়ে যাচ্ছে , তোর মুখের ওপর ফোকাস মারছে , শেষে কেউ দেখে ফেলবে, তার চেয়ে আমরা ধরাধরি খেলি । বলে, মিলি হঠাৎ আমার প্যান্টের ওপর হাত রাখল , বলল, বোতাম খোলো, বোতাম খোল, এবার থেকে বোতাম খুলে রাখবি । দিপলি বলেছে, প্রেমিকের বোতাম সদাসর্বদা খোলা থাকা দরকার । একেবারে উজবুক তুই, তোকেও আগ্রহ দেখাতে হবে তো । প্রেমিককে প্রেমিকার চেয়ে বেশি-বেশি আগ্রহ দেখাতে হয় ।
আমি বোতাম খুলতেই হাত চালিয়ে দিল মিলি । বলল, যাক বাবা, ভেতরে কিছু পরে আসিসনি ; তারপর প্রকৃত বিস্ময়ে ফিসফিস করল, ও, এরকম হয় বুঝি , এই ফুলে যাচ্ছে রে, গরমও হয়ে যাচ্ছে , ঠিকি যেমন দিপলি বলেছে । আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে রে, বুক ঢিপ-ঢিপ করছে ; তোর কিছু হচ্ছে না ? মানে এখানে নয়, যেটা ধরে আছি, মনের মধ্যে কিছু ? কিংবা বুকে ? বাবা-মা কোনদিন যে দক্ষিণেশ্বর যাবে কে জানে !
আমি ওর হাত সরিয়ে বললুম, বার-বআর দিপলিদিপলি করিসনি , ওর নাম শুনলে তোর মুখের বদলে ওর মুখটাই ভাসবে চোখের সামনে ; এবার তোরটায় হাত দিতে দে । হাত চালিয়ে দিতে ন্যাকড়া-বাঁধা পেলুম । চাপা উত্তেজনায় বললুম, ও, নিজেরটা বেঁথে এনেছিস । কেন ? চাস না যে হাত দিই !
মিলি বলেছিল, ধ্যাৎ বোকা , এখুন ধ্যাড়ানি চলছে ; কালকে খুলব , তখন যত ইচ্ছে হাত দিস । দিপলি বলেছে ওর প্রেমিক মুখও দ্যায়, কিন্তু এখানে তো আর তুই মুখ দিতে পারবি না । বাবাকে বলব, যাও দক্ষিণেশ্বরে পুজো দিয়ে্ এসো , যাতে এবার ক্লাসে প্রোমোশান পাই । বাবা আমার কথা ফেলে না ।
আমি বলেছিলুম, হোকগে থ্যাড়ানি, আমি এখনই হাত দেবো , টের পাচ্ছিস তো আমি ষাঁড়ের মতন হয়ে যাচ্ছি । মিলি ন্যাকড়া ঢিলে করতে হাত ঢোকালুম , কিরকম চটচটে । আমার হাতটা নিয়ে নিজের ফ্রকে পুঁছে মিলি বলেছিল, দেখলি তো ? কালকের দিনটা অপেক্ষা করতে পারলি না । তুই কিন্তু সত্যিই ষাঁড় । বড়বাজারে গিসলুম একবার, তখন দেখেছিলুম একটা ষাঁড় ওই করছে। একদম গোলাপি । তুইও নিশ্চই গোলাপি । কেন বলতো ? তুই তোফর্সা । নীতিদিদির বরটাতো কালোকুচ্ছিত , তবে দিপলি বলেছে প্রেমে কালো-ফর্সা বলে কিছু হয় না । মিলন হলেই সব একাকার , বুকের ভেতর আলোয় আলো । এই তুই কবিতা জানিস ? কেন বলতো ? দিপলি বলছিল যে যখন শরীর গরম হতে থাকে তখন নীতিদিদির বর ওর কানে-কানে কবিতা শোনায়, গানও শোনায় । আমি তো কবিতাও জানি না আর গানের গলাও নেই কী করব বল !
—কবিতা ? কী যে বলিস ! আমি সাইন্সের ছাত্র , অঙ্কতে সবচে বেশি নম্বর পাই ক্লাসে । তবে নার্সারি রাইম জানি , ছোটোবেলায় শিখেছিলুম । বলেছিলুম ওকে ।
মিলি তাইতেই সন্তুষ্ট । ঘাড় নেড়ে সায় দিয়ে বলেছিল, তবে তা-ই শোনাস । ক্লাস এইটা আর ক্লাস নাইনে একবার করে ফেল করেছে মিলি । তাতে কি । কত মোটা-মোটা গোলাপি ওর ঠোঁট দুটো । বুকও ঢেউ খেলতে শুরু করেছে , আর আমার চেয়ে অনেক ফর্সা । জামা খুললে ঘরে বোধহয় আলো জ্বালতে হয় না । কথাটা ওকে বলতে মিলির খুব ভালো লাগল । বলল, তুই যা বললি তা নীতিদিদির বরের কবিতারচে অনেক-অনেক মিষ্টি । এই রকম কথা মাঝে-মাঝে বলিস । কেন বলতো ? যে কথার মানে হয় না অথচ শুনতে ভালো লাগে তা শোনার জন্যেই তো মানুষ বেঁচে থাকে ; মানুষ তো শুধু খাবার আর হাগবার জন্যে বেঁচে থাকে না ।
পরের দিন গেলুম ভবানী সিনেমায় । মিলি নিজে সিনেমার টিকিট কেটে রেখেছিল। দেয়ালে ঠেসান-দেয়া সিট পেয়েছিলুম । ভালই হল । আমি ফিসফিস করে বললুম, আজকে কিছু বাঁথিসনি তো ? মিলি আমার বাঁ-হাতর মধ্যমা আঙুলটা নিয়ে বলেছিল, এইতে রাখ, শুধু রাখবি, নাড়াবিনা কিন্তু, নাড়ালে কাল থেকে আসবো না ।
আমি আঙুলটা নাড়াতে-নাড়াতে বললুম, নাড়ালে কী হয় ?
মিলি আমার বোতাম-খোলা প্যান্টে হাত ঢুকিয়ে টিপে-টিপে ফোলাতে লাগল আর বলতে লাগল, এই হয়, এই হয়, এই হয়, এই হয়, হেই হয়, এই হয়, এটা আমার আমার আমার । আমি এত উত্তেজিত হয়েগিয়েছিলুম যে সামলাতে পারলুম না । রুমাল বের করে পুঁছতে হল । রুমালটা নিজের কাছে রেখে নিয়ে মিলি বলেছিল, এটা আমার ওয়েডিং গিফ্ট । রুমালটা বুকের মধ্যে গুঁজে মিলি বলল, চল এবার, ফিলিম দেখে কী হবে ? আমরা দুজনে বাইরে বেরিয়ে গেলুম , ইনটারভালের আগেই । বাইরে বেরিয়ে মিলি রুমালটা শুঁকতে-শুঁকতে খুব জোরে হাসতে লাগল । হাসতে-হাসতে বলল, অদ্ভূত ব্যাপার এই প্রেম ; তুই এটা প্রেম ভাবছিস তো ? আমি কিন্তু ঠিক করে নিয়েছি তু-ই আমার প্রেমিক । কিন্তু আমার কিছু হবার আগেই তোর হয়ে গেল কেন ? তোর সঙ্গে ঘর বাঁথা যাবে না , এক্কেবারে প্রেমিক হবার অযোগ্য তুই । দিপলি বলেছে, দুজনের একসঙ্গে হওয়া মানে প্রেমিক-প্রেমিকার রাজযোটক । ঠিকুজি-কুষ্টি মেলাবার সময়ে আঁক কষে এটাই তো দ্যাখে , সেই বিয়ে সফল হয় ।
—তোর জন্যেই তো হল, বলেছিলুম ওকে ।
দিপলি বলেছিল, প্রথম দিনেই দেখে নিতে । তাই টেস্ট করলুম। তুই পাস । লেটার পাবি প্রেমে । বাব্বাঃ, কত স্টক তোর , প্রেমে টইটুম্বুর । আনন্দিত আননে বলেছিল মিলি ।
আমরা দুজনে অনেকক্ষণ চুপচাপ হাঁটলুম , চিনেবাদাম খেলুম । চিনেবাদাম খেতে-খেতে মিলি বলেছিল, ফুচকা খেয়ে চুমু খাস , তার মতন আর মজা নেই । দিপলি আর নীতিদিদির বর প্রায়ই ফুচকা খেয়ে চুমু খায়, টকঝাল চুমু । নানা স্বাদের চুমু হয় । বড়-বড় কবি-মনীষিরা লেখে গেছেন । তুই সেসব পড়তে পারবি না , সংস্কৃততে লেখা ।
যাবার আগে আমি বললুম, কালকে আমার পালা, তুই কিছু করবি না । ও বলেছিল, ঠিক আছে , তুই যা করার করে নিবি , তারপর আমি আমার ওয়েডিং গিফ্ট নেবো । আমার তো আর অত তাড়াতাড়ি তোর মতন রসগোল্লার রস বেরোবে না । আমি নিজে-নিজেও নিজের মজা নিই , ক্লাসে অনেকেই নিজে-নিজে আনন্দ নেয় । ছেলেরাও তো নিজে-নিজে আনন্দ নেয় । তুই নিস ? রোজ দুটো করে হাফ-বয়েল ডিম খাবি । কেন বলতো ? তাহলে রস অক্ষুন্ন থাকবে , দিপলি বলেছে । দেখিসনি, ফুচকায় রস থাকে বলে খেতে ভালো লাগে , মুখে ঢোকালি কি ফুচ ।
পরের দিন আমরা লাইটহাউসে গেলুম । মিলি বাড়ি থেকে চাইলেই পয়সা পেতো । আমি বাড়িতে হাতখরচ চাইলে খেতুম চড় । লাইটহাউসে আমরা চুমু খাবার সুযোগ পেয়ে গেলুম । উনটারভালে বাইরে বেরিয়ে ফুচকা খেয়ে আবার চুমু খেলুম । চুমু খেতে যে এত ভালো লাগে জানতুম না , ফুচকা অর নো ফুচকা । চুমুটা খাবার পর থেকে আমরা দুজনেই চুমু খাবার সুযোগ খুঁজতুম । মিলির মোটা-মোটা ঠোঁটের গরম গন্ধ আমার ভালো লাগত । ওর ভাল লাগত ওয়েডিং গিফ্ট ; এই ওয়েডিং গিফ্ট খেলা খেলতে ওর ভালো লাগত । কত যে ওয়েডিং গিফ্ট ওকে দিয়েছি তার হিসেব নেই । তবে রুমালের বদলে কাপড়ের টুকরো ওই আনত ।
একদিন ওকে বললুম তোর বুকে হাত বোলাবো কী করে ? তোর বুক দেখতে খুব ইচ্ছে করে । ও বলল, শীতকাল তো আসছে , একটু অপেক্ষা কর , সামনে দিকে বোতামখোলা একটা সোয়েটার আছে আমার , সেইটে পরে বেরোব , ভেতরে পরব না কিছু । বড়দিনের দিন সেই দিনটা এলো । অমরা ছবিঘর সিনেমা হলে গিয়েছিলুম । মিলি ওর সোয়েটারে বোতাম খুলতেই ফিল্মের আলোয় ওর বুকের ঢেউ আরও গোলাপি হয়ে উঠেছিল , আর ওর বুকের ওপর দেখতে পাচ্ছিলুম নায়ক আর খলনায়কের মারামারির আলোছায়া । আমি ওর কাছ ঘেঁষে হাত বোলালুম , বললুম, মুখ দিতে ইচ্ছে করছে রে । মিলি বলল, পরশু বাড়িতে কেউ থাকবে না ; মা-বাবা যাবে দক্ষিণেশ্বরে , আমি বলে দিয়েছি পরীক্ষার পড়া আছে । তুই দুপুর বেলা চলে আসিস , সঙ্গে বইখাতা নিয়ে আসিস । কেন বলতো ? যদি অন্য কেউ হঠাৎ এসে পড়ে । ড্রইংরুমে বইখাতা খুলে রাখব । কেন বলতো ? কেউ এলে ভাববে তুই আমাকে পড়াচ্ছিস । সবাই জানে তুই ভাল ছাত্র , আর আমি ফেলটুস । পড়ে কি করব ? কেন বলতো ? সংসার তো তুই চালাবি , আমার শুধু তো সংসারের খাটনি থাকবে । কত প্রেম করব দুজনে , ওফ, ভাবলেই তোকে আলুপোস্ত করে ফেলতে ইচ্ছে করে ।
আমি স্কুলব্যাগ বইখাতা জিওমেট্রর বাক্স নিয়ে মিলিদের বাড়ি গিয়ে দেখি ও ড্রইংরুমের কার্পেটের ওপর বই-খাতা খুলে রেখেছে । আমার কাঁধ থেকে তাড়াতাড়ি স্কুলব্যাগ নিয়ে বই-খাতা পেনসিল বের করে রাখল , এমনভাবে যাতে মনে হয় ওকে বুঝিয়ে দিচ্ছি । বলল, দাঁড়া, আমার টাওয়েলটা নিয়ে আসি ; কেন বলতো ? তোর রসগোল্লার রসে যদি কার্পেট নোংরা হয়ে যায়, বড়রা ঠিক টের পেয়ে যাবে । তারপর জিগ্যেস করল, রবার এনেছিস ?
আমি বললুম, হ্যাঁ, জিওমেট্রি বক্সে আছে ।
—ওঃ মাগো, একে নিয়ে কী করব ! দুহাত ওপরে তুলে বিরক্তি প্রকাশ করল মিলি : ওই রবার নয় রে গাধা, প্রেম করার রবার , ওফ, যদি জানতুম তাহলে দিপলির কাছ থেকে নিয়ে নিতুম । নীতিদিদির বর নিজের পকেটে নিয়ে ঘোরে , জানিস ? কখন দরকার পড়ে, বলা তো যায় না । কোনো সুযোগ ছাড়ে না ওরা । আমার অবাক চেহারাখানা দেখে আরও বিরক্ত হল মিলি । বলল, প্রেম করার সময়ে ছেলেরা পরে, জানিস না ? কেন বলতো ? না পরলে রসগোল্লার রস ভেতরে পড়ে বাচ্চা ফুটিয়ে ফেলবে । আজকের পুরো সুযোগটা ডোবালি তুই । নাঃ, তোকে নিয়ে পারা যায় না , মোটেই প্রেমিক হবার যোগ্য নোস । হয় ভগবান, কাকে যে প্রেমিক বাছলুম ।
ও বারবার এত হাত নাড়িয়ে কথা বলছিল যে ওর ফ্রক ওপরে উঠে যাচ্ছিল ঞাঝে-মাঝে , আর তাইতে বুঝে গেলুম যে ফ্রকের তলায় কিছু পরে নেই । আমি সজোরে জড়িয়ে ধরে ওর মোটা-মোটা ঠোটে আমার ঠোঁট চেপে ধরে মিলির কথাবলা থামালুম। ও আমাকে টেনে বই-খাতার মধ্যে ফেলল, বলল, তুই আমার পায়ের দিকে মাথা কর , দিপলি বলেছে, রবার সঙ্গে না থাকলে এই উপায় করতে হয় । আমার আগে মিলি নিজেই আমার মাথার দিকে পা করে ফেলল আর আমায় বলল, ওখানে জিভ ঘসতে থাক , মুখ ঘসতে থাক । যখন বলব তখন থামবি ; আমার হয়ে গেলে আমি তোর শুরু করব ।
উল্টো দিকে মুখ করে শুয়ে মিলি বলল, তোর বুকের মধ্যে কী বাজছে বলতো ?
আমি জিগ্যাস করলুম, কী ?
ও আমাকে বলার আগেই গাল ঘসতে লেগে গিয়েছিলুম ; নেশা ধরা গন্ধ, চোখ বুজে গন্ধ নিতে-নিতে আমার উঠতি দাড়ি দিয়ে ঘসছিলুম । মিলি বলল, কবিতা বল না , যা জানিস, তা-ই বল, আর যা করছিস তা-ই কর, ভেতরে গিয়ে বল ; ওটাও কবিতা বোঝে ।
আমি টুইংকল টুইংকল লিটল স্টার হাউ আই ওয়ান্ডার হোয়াট ইউ আর বলতে-বলতে কী যে করছিলুম, নিজেই জানি না, যতক্ষণ না মিলি থামতে বলল, ততক্ষণ । মিলি কেঁপে-কেঁপে জোরে জড়িয়ে ধরল । তারপর যা করল তা আজও মনে হয় আত্ম-আবিষ্কার । মুখে পুরে নিয়ে জিভ ব্যবহার করে রসগোল্লার রস বের করে ফেলল , আর গিলে নিল, স্পষ্ট টের পেলুম ।
—কী করছিস কি, পাগল না কি তুই, বললুম উঠে বসে ।
মিলি বলল, দিপলিও খায় , বেশ ভালো স্বাদ , মন ভরে গেল, সত্যি, আলোয় আলো হয়ে গেল মনটা । তুই এবার বই-খাতা গুটিয়ে, যা, কেটে পড় ; ভাগ্যিস কেউ আসেনি । এবার আমিই রবার যোগাড় করে রাখব , তোর দ্বারা কিসসু হবে না ।
আমি বললুম, এখনও তোর বুকটাই ভালো করে দেখা হল না আর তুই তাড়িয়ে দিচ্ছিস । মিলি ফ্রক ওপরে তুলে বলল, নে, যত পারিস দেখে নে শিগগির ; আশ মিটিয়ে নে । ফ্রক তোলার ফলে ওর মুখ ঠাকা পড়ে গিয়েছিল । আমি সেই সুযোগে ওকে জড়িয়ে ধরে ওর বুকে মুখ গুঁজে দিলুম । ঢেউয়ের ওপর জিভের নৌকো বাইতে লাগলুম , ও বাধা দিল না ; বলল, ঠিক আছে, কর কর , বেশ ভাল্লাগছে । বলল, তোর ভেতর কোন বাজনা বাজছে বলতো ? পুজোর বাজনা : না না চাই, হ্যাঁ হ্যাঁ চাই না, না না চাই , হ্যাঁ হ্যাঁ চাই না, না না চাই, হ্যাঁ হ্যাঁ চাই না , না না চাই, ঠিক কি না ?
আমি দাঁত বসিয়ে দিতে, উঃ, জানোয়ার কোথাকার, সুযোগ পেয়েছিস কি নিজের রূপে এসে গেলি ।
তখনকার মতো আমার প্রথম প্রেমের সেখানেই ইতি ।
আমাদের দুজনকে বাবা কোথায় একসঙ্গে দেখে ফেলেছিলেন । আমরা নাকি খুব হাসাহাসি করছিলুম । ব্যাস, চড়, চড়ের পর চড়, আরও চড় । বাবার ধারণা যে বাইজি নাচাবার রক্ত আমার শরীরে ডাক দিতে লেগেছে । আমাকে ওই রক্তদোষ থেকে বাঁচাবার জন্যে বাবা এই বাগানবাড়িতে থাকাটা শ্রেয় মনে করলেন । আমার নারী-সঙ্গর সাহস, কেন কে জানে, ছিল না তখন । তা ঢুকল কলেজে ঢুকে , হস্টেলে থাকার সময়ে , বাবার চোখের আড়ালে ।
বাবা প্রেম ব্যাপারটা একেবারে সহ্য করতে পারতেন না , সম্ভবত নিজে প্রেম করে বিয়ে করাটা সফল হয়নি বলে । স্কুলের দিনে মিলির সঙ্গে তারপর দেখা হলে ওয়েডিং গিফ্ট বলে ডাকত না । বলত, কী রে জারজ, বাপকে ভয় পাস, প্রেম করার মুরোদ নেই চললেন উনি বুকে হাত বোলাতে । তবে তোকে আমি ছাড়ব না, দেখে নিস । যদি আমার বিয়েও হয়ে যায়, আমি তোর বাচ্চাকে পেটে নেবোই নেবো । তুই পৃথিবীর যেখানেই থাকিস খুঁজে বের করব তোকে । তোর মতন কেউ আমার সঙ্গে প্রেম করতে পারবে না , জানি আমি । তারপর রাস্তায় দাঁড়িয়েই কাঁদতে আরম্ভ করে দিয়েছিল ।
আমি বলেছিলুম, তুই কি উন্মাদ ?
ও বলেছিল, হ্যাঁ, আমি উন্মাদ ; তা না হলে কি করে এক কথায় রাজি হয়ে যেতুম ? তুই এত ভিতু ? এরকম ঢ্যাঙা ছেলে, চওড়া ছাতি, হিরি-হিরো চেহারা, আর সেই ছেলেটা কিনা নিজের বাবাকে ভয় পায় ! প্রেমকে ভয় পায় ! প্রেমের জন্যে মানুষ মরতে পর্যন্ত রাজি হয় আর তুই প্রেমিক হয়েও পালালি বাপের ঠ্যাঙানির ভয়ে ! তবে ছাড়ব না তোকে, এই বলে রাখলুম , দক্ষিণেশ্বরের দিব্বি ।
বাবাকে কেউ নিশ্চই খবর দিয়ে থাকবে । আমার এখন মনে হয় দিপলির সঙ্গে সব কথা বলাবলি করার ফলে নীতিদিদির বরের কানে গিয়ে থাকবে আমাদের প্রেম-কাহিনি । বাবা পাড়াটাই ছেড়ে দিলেন ।
আমরা তারপর দাদুর বাগানবাড়িতে চলে এলুম । একদিক থেকে ভালো হল । শহর থেকে দূরে বলে বাবার গাড়ি করে স্কুলে যাতায়াতের সুবিধে হয়ে গেল । তারপর কলেজে গিয়ে হস্টেলে ভর্তি হলুম । মিলির সঙ্গে প্রেমের নবীকরণের সুযোগ ছিল । কিন্তু আমার কেমন যেন গিল্ট ফিলিং হতে লাগল । কত আর ধোকা দেব বোকা মেয়েটাকে ! বোকা বলেই ওকে ভালো লাগত । ভয় ছিল যে শেষে পেটে বাচ্চা-ফাচ্চা এসে গেলে কেলেঙ্কারি , এমন ডাকাবুকো মেয়ে মিলি যে নিজে থেকেই হয়তো চেষ্টা করত যাতে পেটে বাচ্চা এসে যায় । বাবা জানতে পারলে চড় মেরে-মেরে আধমরা করে দিতেন ।
কলেজে ঢুকে সহপাঠীদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার সহায়তায় কল গার্লদের জগতটার সঙ্গে পরিচয় হল ।
এক কথায় রাজি হয়ে যাওয়া, এই অভিব্যক্তিটা এই বুড়ো বয়সে আমায় হন্ট করে । উন্মাদ ? হ্যাঁ, আজ জানি, আমি উন্মাদ ।
বাগানবাড়িটা নিয়ে দাদু আর দাদুর বাবার বনিবনা ছিল না । দাদুর বাবা নাকি বাইজিদের নিয়ে কেলো করতেন বাড়িটায় । দাদুর নামে করে দিয়ে যাননি । নোটিফায়েড এরিয়ে বলে দাদুও বিশেষ গা করেননি দাদুর বাবা মারা যাবার পর । দাদু মারা যেতে বাবাও মিউটেশানের জন্যে করেননি কিছু । আমিই বা কী করব সম্পত্তির মালিকানার ঝঞ্ঝাটে ঢুকে !
ইউরোপ যাবার আগে, উত্তর ইউরোপের কয়েকটা দেশের ভিসা পেয়েছিলুম , বাবা এত টাকা আমার জন্যে রেখে গিয়েছিলেন যে মন ভালো করার উদ্দেশ্যে ঘুরে বেড়ানো ছাড়া অন্য পথ ছিল না । অন্ধ্র থেকে ফিরে এসে আমার মন ভেঙে পড়েছিল । দেশে থাকলে বাগানবাড়িতে, নতুবা বিদেশে, এভাবেই জীবন কাটাব ঠিক করেছিলুম ।
ওবেরয় গ্র্যান্ড থেকে বেরিয়ে , এয়ার কান্ডিশানের শীতটা দেহ থেকে ঝরিয়ে ফেলার উদ্দেশ্যে, ফুটপাতের রোদে গিয়ে দাঁড়াতেই , একজন মহিলা, কাঁধে চামড়ার সুদৃশ্য ব্যাগ, আমাকে আঁকড়ে ধরলেন । ছাড়ুন, ছাড়ুন, কী করছেন কি , এভাবে, কে আপনি ? বলে, ছাড়াতে, দেখি মিলি । দেখেই ভয় করে উঠল , বাবার ভয় নব< বাবা তো স্বর্গে , অন্য এক অচেনা ভয় , বিশ্বাসঘাতকরা হয়তো এরকম ভয়ে আচমকা আক্রান্ত হয় । বুকের ভেতরে বাবা তখন হৃৎপুণ্ডকে চড় মেরে চলেছেন ।
—জানি, তুই চিনতে পারবি না , মিলি কে চিনতিস কি , যখন স্কুলে পড়তিস ? আমি সেই মিলি । আজকেই, আজকেই বলি কেন, এই কিছুক্ষণ আগে আমার ডিভোর্স হয়ে গেল । কেন বলতো ? আমার বর ভালো চাকরি করে না , আমার রোজগার উড়িয়ে বেঁচে থাকতে চাইছিল বাঞ্চোতটা । মিলি বলল, সরাসরি আমার চোখে চোখ রেখে ।
—আমি তো পরশু ইউরোপ চলে যাচ্ছি । ভয়ে আমার মুখ দিয়ে পলায়নের অ্যালিবাই বেরোলো । টের পাচ্ছিলুম ঘেমে উঠছি ।
—তোর বাবা তো কবেই অক্কা পেয়েছেন , এখনও কিসের ভয়ে মরিস ? প্রথম প্রেমকে ভয় পাস ? নিজেকেই ভয় পাস তুই । কেন বলতো ? নিজেই নিজেকে জানিস না ।
—প্রেমকে ভয় ? মায়ার স্মৃতি উসকে উঠল । মিলি বুঝতে পারছিল আমি কোনো সংবেদন চেপে রাখতে চাইছি । বললুম, না রে, প্রেমকে ভয় পাই না আর , প্রেম বিপর্যস্ত করে দিয়ে চলে যায় । আমি তোকে বিপর্যস্ত করে দিয়ে উধাও হয়ে গিয়েছিলুম । তোর দুঃখ আর অসহায়তা আজ অনুভব করি ।
—চল না, তোর বাড়ি যাই , দুজনে দুঃখ ভাগাভাগি করব । চিনেবাদামের দুপুর আর ফুচকার রাতগুলোর গল্প করব । তুই তো সেই উত্তর চব্বিশ পরগণার কোথায় যেন থাকিস , বিশাল প্রাসাদ আছে তোদের, তা তো দেখাই হয়নি । নিয়ে চল না । ভয় নেই তোর চলে আসব , আমার নিজের ছোট্ট ফ্ল্যাট আছে গল্ফগ্রীনের চার তলায় ; সেখানে তোকে নিয়ে যেতে পারতাম । আজকে নয় । কেন বলতো ? লোকেরা আজকে আমার মুখ দেখার জন্যে তৈরি হয়েই থাকবে , বিয়ে ভাঙনের আনন্দ নেবে । আমার হাত দুটো নিয়ে বলল মিলি ।
নিয়ে গেলুম ওকে । পথে দুবার ট্যাক্সি পাল্টালুম । নির্বাক দীর্ঘ পথে গায়ে গা লাগিয়ে মিলি আড়চোখে মাপজোক করছিল আমরা পরস্পরের কত আলোকবর্ষ দূরে চলে গেছি ।
বাড়িতে ঢুকে দরজা বনধ করার সঙ্গে-সঙ্গেই মিলি জড়িয়ে ধরল আমাকে । ফোঁপাতে লাগল । কারণ ঠাহর করতে পারলুম না । কাঁদবার রসায়ন আমার শরীরে ঘোর অনর্থ গড়া শুরু করেছিল ; তা চাপা দিতে আমিও জড়িয়ে ধরলুম মিলিকে যাতে ও আমার মুখের দিকে তাকাতে না পারে । ও আমার শঅর্ট টেনে ছেঁড়ার চেষ্টা করতে লাগল, ছিঁড়েও গেল বোতামগুলো । বলতে লাগল, তোর বাচ্চা চাই, তোর বাচ্চা চাই, তোর বাচ্চা চাই…
আমার ভয় নাকি যৌনতা তা জানি না । একজন যুবতী জড়িয়ে ধরেছে আমায় , তার নরম বুক চেপে বসিয়ে দিয়েছে আমার বুকে, নিজের পোশাক নিজেই দ্রুত খুলে ফেলার প্রয়াস করছে । আমি চোখ বুজতেই মায়া ভেসে উঠল, মায়ার উলঙ্গ দেহ দেখতে পেলুম চোখের সামনে ।
মিলি বলল, আমি আজ তোকে খুন করে তবে যাব , খোল, খোল, খোল, খোল….জানি, তোর বুকের ভেতরে সেই পুরানো বাজনাটা বাজছে, না না চাই, হ্যাঁ হ্যাঁ চাই না, না না চাই, হ্যাঁ হ্যাঁ চাই না, না না চাই, হ্যাঁ হ্যাঁ চাই না, না না চাই, হ্যাঁ হ্যাঁ চাই না, না না চাই, হ্যাঁ হ্যাঁ চাই না, না না চাই, হ্যাঁ হ্যাঁ চাই না , না না চাই, হ্যাঁ হ্যাঁ চাই না । আর আমার ভেতরেও সেই পুরানো বাজনাটা বাজছে চাই চাই চাই চাই চাই চাই চাই চাই চাই চাই চাই…..
—কি করছিস কি , পরশু আমি চলে যাব রে , কি করবি তুই তারপর , এখনও তুই উন্মাদ থেকে গেছিস, ছাড়, ছাড়, ছাড় ।
—ওসব আমি বুঝব ; বললুম না তোকে । আজ তোকে খুন করে তবেই যাব , তোর খাবারে বিষ মেশাব , দে, তোর বাচ্চা দে…
নারী জড়িয়ে ধরলে আমার পক্ষে আত্মনিয়ন্ত্রণ যে আসম্ভব তা আমি জানি । বোধহয় মিলিও জানত । আমি ওকে দুহাতে পাঁজাকোলা করে তুলে দাদুর বাবার ঘরে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করালুম , এই আশায় যে ঘরের আসবাব ওকে পাগলামি থেকে মুক্ত করবে । দাদুর বাবার ঘরে ওনার সময়ে শিকার করা স্টাফড বাঘ, হরিণ, মোষ, জংলি বিড়াল ইত্যাদি দিয়ে সাজানো ; দেয়ালে ওনার সঙ্গে ওনার স্ত্রী আর দাদুর তেলরঙে বিরাট ছবি , ওনার প্রিয় বাইজির তেলরঙে পোরট্রেট , দেয়ালে মোষের, হরিণের করোটি । মিলির কোনো পরিবর্তন হল না । পরিবর্তে , আমার গলা জড়িয়ে বলে উঠল, ওঃ, এই ঘরটায় তো কত অবৈধ ভালবাসাবসি হয়েছিল , না হয় আরেকটা হল । রসে রস মিশলে প্রেম আর অবৈধ থাকে না , বলে রাখলুম তোকে ।
সারা রাত পোশাকহীন আর অভূক্ত থেকে সকালে শাড়ি-ব্লাউজ পরতে-পরতে ও বলেছিল, রক্ত দেখে তোর সন্দেহ হয়নি ? তোকে মিথ্যা কথা বলেছিলুম , আমার বিয়েই হয়নি তো ডিভোর্স হবে কোথ্থেকে !
আমি স্তম্ভিত ।
রাতে ওর বুকে একটা দাগ দেখিয়ে বলেছিল মিলি, এই দ্যাখ, সেই তুই কামড়ে দিয়েছিলি, তোর দাঁতের বিষে ঘা হয়ে গিয়েছিল । আমি ওষুধ লাগাতে দিইনি, লাগাইনি, তোর স্মৃতিচিহ্ণ ধরে রেখেছি ।
আমার জীবনে আমি কোনো নারীকে বুঝে উঠতে পারিনি । হয়তো সেকারণেই আমি আকৃষ্ট হই, আজও । এই বার্ধক্যে ।
ও বলেছিল, তোর বাড়ি দেখে রাখলুম , যদি আমার আজকের উদ্দেশ্য সফল না হয়, তাহলে একদিন চুপচাপ এসে তোকে খুন করে যাব । এমনভাবে খুন করব যে কেউ বুঝতে পারবে না তুই কি করে মরলি ।
আমি ওকে ট্যাক্সিতে চাপিয়ে, ভাড়া দিয়ে দিতে চাইছিলুম । মিলি বলল, ট্যাক্সিঅলার সামনেই, তুই কি সেবার দাম দিচ্ছিস নাকি ? আমাকে পি পথবৌমা পেয়েছিস নাকি ? দেখি কি হয়, নয়তো সত্যইই তোকে জীবন দিয়ে দাম চোকাতে হবে । মনে রাখিস । ঠাট্টা করছি না, সিরিয়াসলি বলছি । ডায়েরিতে লিখে রাখ , পুলিস তোর লাশ পেয়ে আমার খোঁজে আসবে তাহলে ।
শেষনির কথামতন লিখতে-লিখতে বেশ লাগছে । সব-কিছুই মনে করতে পারছি , এত দিন পরও । মিলির মোটা-মোটা ঠোঁট, গোলাপি ভরাট বুক, বুকে কামড়ে দেবার দাগ, সোঁদা-সোঁদা গন্ধ । আর ওর প্রতিজ্ঞা যে, আমার বাচ্চাকে ও পেটে নেবেই নেবে , নয়তো খুন করবে আমাকে । আমি ওর স্মৃতিতে আমার শুক্রকীট ডক্টে অনিল পালেসকরের লিকুইড নাইট্রোজেনে ফ্রিজ করিয়ে রেখেছি ; চল্লিশ বছর রেখে দেবার কনট্র্যাক্ট । এখন তো কাগজে পড়ি ষাট-বাষট্টি বছরেও ফ্রোজ করা স্পার্ম থেকে বাচ্চা হয় । ডক্টর পালেসকর বলেছেন কোনো সমস্যা হবে না । আপনার নির্দেশ অনুযায়ী দাবিদার মহিলা যোগাযোগ করলে আমরা প্রয়োজনীয় আইভিএফ করে দিতে পারব , আপনার স্পার্ম কাউন্ট অনেক বেশি ।
মিলি তুই কোথায় ? তুই কি সফল হয়েছিলি ? তুই কি কেওড়াতলার স্বর্গদ্বার দিয়ে উধাও হয়ে গেছিস ? কেই বা তোকে জানাবে তোকে নিবেদিত আমার স্পার্মের কথা , শীতঘুমে নিদ্রিত তোর সন্তান-সন্ততির অপেক্ষার কথা !
ওর, মানে মিলির, চামড়ার ব্যাগটা পড়ে রয়েছে ; মিলি বাড়িতে ঢুকেই যেখানে ওটা রেখেছিল । ব্যাগটায় একটা ছোরা দেখে আমার আরও ভয় হল যে সত্যিই মিলি ইনসেন নয়তো । বা, হয়তো, ওর প্রেম ইনসেন , ও নয় ।
আমারও বেশ লাগল হে কংকাল প্রেমিক, তোমার প্রথম প্রেমের গল্প পড়ে । ইন্সপেক্টার রিমা খান নিজেকে শুনিয়ে বলল , সিগারেটের ধোঁয়া হাওয়ায় উড়িয়ে । তবে তুমি নিজের ঠিকানাটা লিখলে না কেন ? কোথায় থাকতে ভবানীপুরে ? মিলিদের বাড়ির নম্বরটাই বা কি ? মিলির বাপের নাম কি ? দিপলি কে ? নীতিদিদির বর লোকটা কে ? শ্রাদ্ধ করতে বসে লোকে দাদু-দাদুর বাপের নাম বলতে পারে না । আর এখানে একজন, যে কিনা নিজের নাম বলছে না, অথচ গ্রেটগ্র্যান্ড ফাদারের কাহিনি শোনাচ্ছে ! প্রথম প্রেমের রহস্যময়ী প্রেমিকার কাহিনি শোনাচ্ছে , নিজেকে শোনাচ্ছে । হাউ অ্যাবসার্ড । মায়া পাল নামে সেই মহিলার কী হল তাহলে ? এটা কি ডাইভারসানারি ট্যাকটিকস ? কংকালটা বেশ ঘোড়েল ।
মিলি কি এসে খুন করে যাবে ? মনে তো হয় না । প্রেমে উন্মাদ প্রেমিকা বলে কথা, অপেক্ষা করেছে বছরের পর বছর পালিয়ে যাওয়া প্রেমিকের জন্য । কিন্তু মিলির চামড়ার ব্যাগটা তো সিজার লিস্টে নেই । ওটা কি হল ? কংকাল প্রেমিকের দাদুর বাবার কিউরিও ঘরটাও অব্যবহৃত । ওই ঘরটার তালা জংধরা ছিল ; অর্থাৎ কংকাল প্রেমিক নিজেও, সম্ভবত মিলি এপিসোডের পর খোলেনি । বেডরুমটা কংকাল প্রেমিক ব্যবহার করত না , স্টাডিতেই শুত , আর সেখানেই মরেছে । লোকটার স্টাডিতেও জমকালো পালঙ্ক । মহিলার চুলের গোছা পাওয়া গেছে , সেটা তাহলে মিলির নয় বলেই মনে হচ্ছে । তাহলে কার ?
যাহোক, দুটো সূত্র তো পাওয়া গেল । বেডরুমে হাতের ছাপ যা পাওয়া গেছে, তার দ্বিতীয় আর তৃতীয় স্যামপেলের একটা হয়তো মিলির ; অন্যটা কার সন্ধান করতে হবে । প্রথম আর দ্বিতীয় ইনভেসটিগেটিং অফিসাররা আঙুলের ছাপ স্টেট ক্রাইম ব্র্যাঞ্চ রেকর্ডস ব্যুরোয় সংরক্ষিত ছাপগুলোর সঙ্গে মিলিয়েছিলেন ; মেলেনি , কেননা রেকর্ডে কেবল ক্রিমিনালদের ছাপই রক্ষিত । কংকাল প্রেমিকের হত্যায় কোনো পেশাদার খুনির হাত আছে বলে আপাতত মনে হচ্ছে না ।
শুক্রকীত সংরক্ষণ করার এই ডাকতারের নাম দেখেছি সংবাদপত্রে । অনেকের আইভিএফ করে বাচ্চার জন্ম দিয়েছেন । ইনি নিশ্চয় মুম্বাইয়ের সেই বিখ্যাত ডাকতার । নিজেই যাব । ডিজিকে অনুরোধ করব যাতায়াতের খরচ অনুমোদন আর মুম্বাইয়ের কমিশনারকে একটা চিঠি দিয়ে দিতে যাতে সরকারি অতিথি হয়ে থাকতে পারি ।
রিমা পড়তে-পড়তে ভাবছিল, কংকালটা বেশ লিখেছে , উপন্যাস টাইপের । ডিজিকে জিগ্যেস করতে হবে এই পুরো লেখাটা কোনো ডিটেকটিভ রাইটারকে দিয়ে নিরঞ্জন দত্ত নামে বই ছাপানো যায় কি না । কিন্তু মাঝখানে হঠাৎ এই গল্পটা ঢোকাতে গেল কেন ? কংকালটা বোধ হয় ঠাহর করতে পারেনি যে তার প্রকৃত প্রেমিকা কে ! সত্যিই, দুজন তরুণি যদি একজন পুরুষকে ভালোবাসে , তাহলে কোন নিক্তি প্রবোগ করেই বা বুঝবে যে কাকে ও চায় । ধরা যাক আরও কয়েকজন তরুণী পুরুষটাকে প্রেম নিবেদন করে বসল , তখন লোকটা কি করবে ? মায়া আর মিলি এই দুজন একেবারে বিপরীত মেরুর মহিলা । এদের দুজনকেই যদি খুঁজে পাওয়া যায় , তাহলে বাঙলোবাড়িতে এনে কংকালটাকে দেখিয়ে জানতে চাইবে, চেনে কিনা ।
Tagged ডিটেকটিভ উপন্যাস |
৪. নোংরা পরি
তেলেগু অক্ষরে লেখা বাংলা ন্যারেটিভ পড়া বজায় রাখল ইন্সপেক্টার রিমা খান । তেলেগু অক্ষরকে বাংলা করিয়ে প্রিন্টআউট নিয়েছে ।
সময়টা সেনসেক্স অমুক থেকে তমুক হাজারে যাবার মাঝামাঝি বেশ পেছলা এরকম কাদায় কিউতে দাঁড়িয়ে টাইমপাস করতে চোখ ব্যবহার করে, চারিপাশে তাকিয়ে তার সঙ্গে কাণ উৎকর্ণ রেখে ফালতু গল্পে নিজেকে সেসব টানাপোড়েনে জড়িয়ে রেখেছিলুম । ক্লান্তির আবছায়ায় মনে হচ্ছিল, অতীতে, ধূসর নয়, রঙ গন্ধ ছোঁয়ার স্মৃতিতে ভাসছিল ও, নিরঞ্জন, বয়স হওয়া সত্ত্বেও । ডাকতার ওকে বলেছে ভাবতে-ভাবতে অতীতের স্মৃতিকে খুঁচিয়ে তুলতে , যতটা স্পষ্টতা ওসকানো সম্ভব, পেছনে চলে যেতে, পেছনে পেছনে পেছনে পেছনে গিয়ে আবার এগিয়ে আসতে , এগিয়ে এগিয়ে এগিয়ে এগিয়ে, বিশেষ করে প্রতিযোগীতায় হেরে যাবার, মা-বাবার কাছে মার খাবার, চোট-জখমের, অপমানিত হবার, শয্যাশায়ী থাকার, অসুখের, প্রতারিত হবার, প্রতারণা করার, প্রেমে বিশ্বাসঘাতকতার, যৌনতার, যৌন হুল্লোড়ের, যে-স্মৃতিগুলো ঘাঁটলে মগজ টাটকা থাকবে, বুড়িয়ে যাবার অবধারিত ভুলোপনাকে আটকে রাখবে, অ্যালঝিমারের ভয় থাকবে না । ডাকতার শেষনি ম্যাডাম বলেছেন যে গোপন স্বীকৃতি কমপিউটারে লুকিয়ে রাখুন , মাঝে-মাঝে পড়ুন, মেমারি এনজয় করুন , ফ্রেশ ফিল করবেন ।
মেয়েমানুষ, নারী, স্ত্রীলোক ছাড়া কোনও একরোখা উদ্দেশ্য ছিল না । হ্যাঁ, খাওয়া আর টাকা থাকাটাও জরুরি মনে হয়েছে । কত রকমের খাবার যে আছে জগতে । মানুষে-মানুষে প্রভেদ যে কত প্রয়োজন তা রকমারি খাবার দেখে, খেয়ে বুঝতে পেরেছি । মেয়েমানুষ, টাকা আর খাওয়া । কিন্তু একদিন একজন হঠাৎ বলে উঠল, ‘চলুন পালাই’ , আর ব্যাস, সব কিছু ওলোট-পালোট হয়ে গিয়েছিল ।
সেনসেক্সের অমুক হাজার থেকে স্মৃতিকে আঙুল করছে নিরঞ্জন, নিরু, মায়ালিঙ্গা, মায়াগারু, নিরঞ্জন পাল, নিরঞ্জন বণিক, নিরঞ্জন ব্যানার্জি, নির্জনাইয়া । এসব ওরফে আমার নিজের নেয়া নয় ; আমার ওপর চাপানো । আমার কিন্তু তা ভালো লেগেছে । ওরফেগুলোর জন্যে নিজেকে আবিষ্কার করতে পারলুম । নয়তো কি-ই বা ছিলুম । কখনও ষাঁড়ের মতন দৌড়োতুম, কখনও ভাল্লুকের মতন গোটাতুম নিরঞ্জনকে । বাবার দেয়া নাম । বাবা । যিনি কথায়-কথায় চড় মারতেন । আমার কানে প্রতিটি চড়ের আওয়াজ দর্জ করা আছে । সব চড়ের ধ্বনি একই রকম নয় । চড়ের কারণ অনুযায়ী বাবা চড়কে শব্দদান করতেন । এবং অর্থ ।
অনেকে বলে ঠাস করে চড় । তারা জানেইনা চড় কাকে বলে । চড়ের আওয়াজ ঠাস হতে পারে না । পপটিটি চড়ের পৃথক অর্থ হয় । এখন চড়ের আশঙ্কা নেই । ভয় সুধু ভাইরাসের । হার্ড ডিস্কের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভর না করার কারণ এই ভাইরাসই । কোথা থেকে কোন ভাইরাস চলে আসবে তার ঠিক নেই । সিডি থেকেই চলে আসবে হয়তো বা গান বা বাজনা থেকে । বাবার চড়ের চেয়েও অপ্রত্যাশিত ।
পড়তে শুরু করে পুলিসের ইনভেসটিগেটিং অফিসার ইন্সপেক্টার রিমা খানকে এই চিন্তাটা উত্তেজিত করেছে যে কেন কংকালটা লিখেছে বাংলা কিন্তু ব্যবহার করেছে তেলেগু অক্ষর । এটুকু পড়ে নোট নিল যে শেষনি ছদ্মনামের একজন ডাকতারের নির্দেশে, কংকালটা নিজের বার্ধক্যের নিরাময়ের উপায় হিসাবে এই প্রক্রিয়া প্রয়োগ করেছে । শেষনি সত্যিই ডাকতার না নার্স না সেবিকা না সহায়িকা না প্রেমিকা তা কংকালের হেঁয়ালির কারণে বেশ কনফিউজিং । সতর্কভাবে কনফিউজ করার ব্যবস্হা করে রেখেছে কংকাল লোকটা । যাতে কেউ না সহজে পড়ে ফ্যালে, সেদিকেও কংকালটা খেয়াল রেখেছিল ।
কংকালটার বাপ ওকে ঠেঙিয়ে-ঠেঙিয়ে মেনটাল কেস করে দিয়েছিল কিনা তাও জানা দরকার । তার মানে কংকালটার যোগাযোগ ছিল কিছু লোকের সঙ্গে যাদের সবাইকে ও নিজের সম্পর্কে গোপন তথ্য জানতে দিতে চায়নি । কী সেই গোপনীয়তা ? শেষনি ছদ্মনামের কোনো ডাকতার খুঁজে পাওয়া যাবে না রেজিস্টার্ড ডাকতারদের তালিকা থেকে । কংকালটার বাড়িতে মেডিকাল ফাইল পাওয়া যায়নি । প্রেসক্রিপশান বা প্যাথলজিকাল রিপোর্ট থাকলেও ক্লু পাওয়া যেত । শেষনি হয়তো ডাকতার নয় ; কংকালের বুড়ো বয়সের প্রেমিকা হতে পারে । অনেক পুরুষ আছে যারা প্রেমিকা ছাড়া বাঁচতে পারে না । কংকালটাও বোধহয় সেই টাইপের লোক ছিল । শেষনি বলে জুটিয়েছিল কাউকে ।
ওই মহিলা, যার কয়েকগাছা চুল পাওয়া গেছে, তার হদিস এই সিডিগুলোর মথ্যে নিশ্চয় কোনোটায় থাকবে । বাথরুমের চটিটা এত বড় মাপের যে মনে হয় তা কোনো পুরুষের । কংকালের নিজেরও হতে পারে । কিন্তু কংকাল কি অমন রঙচঙে মেয়েলি চটি পরত ? কংকালটা গে নয় তো ? হয়তো কোনো গে পুরুষ ভুলে ফেলে গেছে ! সেই কি খুনি ? গে পুরুষদের প্রেমিক নিয়ে টানাটানি হয় বটে, তা থেকে খুনোখুনির সূত্রপাতও ঘটে ; বিদেশে তো অমন গে সংক্রান্ত খুনোখুনি প্রায়ই ঘটতে দেখা যায় । সুমন মিশ্র আর রমেন বসু চটিটার কেমিকাল অ্যানালিসিস করিয়ে নিতে পারেননি, তখন ফরেনসিক দপতরের সুযোগ-সুবিধা ছিল না তেমন । চুলের যে গোছা পাওয়া গেছে তার ডিএনএ টেস্ট করিয়ে নেয়া যেতে পারে , যদি আরও কোনো জিনিসের ডিএনএর সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে হয় ভবিষ্যতে ।
প্রথম যিনি এই কেসটা নিয়েছিলেন সেই তদন্তকারী অফিসার সুমন মিশ্র নির্ণয় নিতে পারেননি যে এটা আত্মহত্যা না খুন না স্বাভাবিক মৃত্যু । উনি বিরক্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত ফাইলটা ক্লোজ করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন ; সে প্রায় দশ বছর আগের কথা । ফাইলটা তখন ক্লোজ করতে চাননি তখনকার ডাইরেক্টার জেনারাল হরিশঙ্কর মুখার্জি । ওনার গভীর অভিজ্ঞতা ওনাকে সন্দেহ করতে বাধ্য করেছিল যে এই মৃত্যু স্বাভাবিক নয় ।
দ্বিতীয় তদন্তকারী অফিসার রমেনবাবু বছর দুয়েক পরে কেসটা নিয়ে বহু তথ্য একত্রিত করেছিলেন, উনিও পথ গুলিয়ে হাল ছেড়ে দেন । সেই থেকে ফাইলটা বলা যায় হাফ-খোলা-হাফ-বন্ধ হয়ে পড়ে আছে । বর্তমান ডায়রেক্টার জেনারাল পবিত্র মুখোপাধ্যায় বলেছেন যে চাকরি থেকে সাসপেন্ডেড রিমার চাকরিতে বহাল হওয়া , আটকে থাকা পোস্টিং আর প্রোমোশান এই কেসটা সুরাহা করার পরই হবে । দ্বিতীয় তদন্তকারী ওসির সময়ে ফরেনসিক সায়েন্স ল্যাবরেটারিতে ডিএনএ স্যামপেল টেস্ট করার কেমিকাল নাকি ফুরিয়ে গিয়েছিল ; দুটো জেনেটিক অ্যানালাইজারের মধ্যে একটা খারাপ হয়ে পড়েছিল ; অ্যানালিস্টদের পদগুলোতে পোস্টিং হয়নি কারোর ।
ট্র্যান্সক্রিপ্ট-অনুবাদের গোছা পড়া বজায় রাখল রিমা । পুলিস কমপিউটার সেন্টারের সহায়তায় সবকটা সিডি ও তেলেগু থেকে বাংলা করেছে । কংকালের সংগ্রহের প্রতিটি সিডিই তার আত্মক্ষতর খতিয়ান নয় । প্রায় হাজার খানেক সিডির মাত্র কয়েকটায় আত্মক্ষত আছে । বাদবাকি সবকটাই পাশ্চাত্য গান, বাংলা গান, বলিউডি গান, হলিউডের ফিল্ম, নাচের ডিভিডি, আর কোনো কিছু রেকর্ড না-করা সিডি । প্রতিটি দেখে দেখে তেলেগু লেখা সিডিগুলো পৃথক করেছে রিমা । ২০০টা সিডি দেখার পর রিমার মনে হয়েছিল প্রেমিক কংকাল ১০১, ২০১, ৩০১, ৪০১, ৫০১, ৬০১ আর ৭০১ নম্বরের সিডিতে নিজের গল্প লিখে রেখেছে , যা কিনা একটা সিডিতেই এঁটেভ যেত । এক থেকে একহাজার পর্যন্ত সবুজ মার্কার দিয়ে মার্ক করেছিল কংকালটা , যাতে খুঁজতে অসুবিধা না হয় । সিডি তো রয়েছে , কিন্তু কমপিউটার আর মনিটর লোপাট বা ল্যাওপটপ থাকলে সেটি লোপাট । ল্যাপটপ ছিল না , ডেস্কটপই ছিল , কেননা কি-বোর্ড পড়ে আছে । বাড়িতে কোথাও মার্কার বা পেন-পেনসিল কিচ্ছু নেই । কেউ ওই ধরণের জিনিসপত্র সরিয়ে ফেলে থাকবে । কে সে ? মায়া পাল ? মিলি ? না অন্য কেউ ? কংকালটা ওর ফিকল্স ডিপজিট , গভমেন্ট সিকিউরিটি, শেয়ার সার্টিফিকেত ইত্যাদির কথা লিখেছে আরেকটা সিডিতে । তা সেগুলো গেল কোথায় ? ওগুলো যে-কেউ ভাঙাতে পারবে না, যদি না কংকালটা মরার আগে তার নামে ট্রান্সফার করে দিয়ে থাকে । খুনি জোর করে সই করিয়ে মেরে ফ্যালেনি তো ?
রিমার ক্লু খোঁজার চেষ্টা চলছে । প্রথম এবং দ্বিতীয় তদন্তকারী অফিসাররা ভেবেছিলেন সব কয়টা সিডিই হয় ফিল্ম নয় গান । সব কয়টা দেখার প্রয়োজন মনে করেননি । তাংছাড়া একটায় তেলেগু লেখা দেখে আশাহত হন দ্বিতীয় ওসি রমেনদা ।
রিমার চাকরিতে বহাল আর প্রোমোশান নির্ভর করছে এই রহস্য অনুসন্ধানের ওপর । লক আপে একজন আসামিকে মেরে ফেলার অভিযোগে ও সাসপেন্ডেড ; যদিও এনকোয়ারি কমিশন ওকে বেনিফিট অব ডাউট দিয়েছে । চাকরিতে বহাল আর প্রোমোশান আটকে আছে । ওর নামই সংবাদপত্র আর টিভির সাংবাদিকরা দিয়েছে ডার্টি ফেয়ারি বা নোংরা পরি, আমেরিকার কোনো মারকুটে পুলিস অফিসারের নামের আদলে । সে নাকি বলত ‘মেক মাই ডে’ । সাংবাদিকরা সেরকম গল্পই ছড়িয়েছে রিমা খান সম্পর্কে ; রিমা খানের উক্তি হল ‘একে ববিটাইজ কর ‘। সাংবাদিকদের মতে , রিমা নাকি পুরুষ আসামিদের ভয় দেখায়, লিঙ্গের চারপাশের চুল নাপিত ডেকে কামিয়ে একজন কন্সটেবল ক্ষুর নিয়ে অপেক্ষা করে । অপরাধীকে চেয়ারে বেঁধে তার দুহাত আর দুপা দুদিকে টান-টান করে বেঁধে রাখা হয় । রিমা খানের চোখের সামনে । তাতেই কাজ হয়। ডাকসাইটে গুন্ডার কাছেও তার যৌনাঙ্গের চেয়ে পার্থিব-অপার্থিব দামি কোনো বস্তু নেই । মিডিয়াতে রসিয়ে-রসিয়ে রঙিন ছবি এঁকে তুলে ধরা হয়েছে ।
মা-বাবা বলেন, তোকে কেই বা বিয়ে করবে এবার ! সাংবাদিকরা জিগ্যেস করে, মেয়ে হয়ে নোংরা গালাগাল ইউজ করেন ? অপরাধীদের থানায় এনেই আপনি নাকি হুমকি দ্যান যে নপুংসক করে দেব তোকে । রিমার সোজাসাপটা উত্তর, কেন, মেয়েমানুষের জন্যে ভাষা আলাদা, শব্দভাঁড়ার পৃথক ? মেয়েরা পাদবে না, ঢেঁকুর তুলবে না, যৌনকর্মে প্যাসিভ থাকবে । যত্তো সব ব্লাডি রাসকেল বাঙালি মধ্যবিত্ত পুরুষ ।
নোংরা পরি ! আর নাম পেলি না তোরা ? আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন তোলে রিমা । তবে প্রেমিক কংকালটার গল্প বেশ ইনটারেস্টিং মনে হচ্ছে । এককালে মেয়েদের নিয়ে জব্বর লীলে করেছে দেখছি ।
পড়া বজায় রাখল রিমা ।
নারীরা আমার ভাসমান জাহাজের অ্যাংকর । হ্যাঁ, অ্যাংকর কথাটা সঠিক । মেয়েমানুষ হল অ্যাংকর, নোঙর, যে স্হিরতা দেয় । চেতনার তরল কোলাহলের হইচই ঘিরে এক নারী-দেয়াল । কোনোপ্রকার আদর্শ ছাড়াই নোঙরের অধিযন্ত্র গড়ে তোলে এমন একটা মূল্যমান যাতে অজান্তেই সঙ্গতিপূর্ণভাবে একাগ্র হওয়া যায় । অমন একাগ্রতার দরুণ মগজটা আর মনের ওপর চড়াও হতে পারে না । অবিরাম দাসত্বকে লাগাতার উদ্ভাবনা দিয়ে মনোযোগের ঘেরাটোকে সতত উদ্দীপিত রাখার আর কি-ই বা উপায় আছে ? অন্তত আমি তো তা জানি না । বেঁচে থাকার তেজ খরচ করার জন্যে এর চেয়ে আরামপ্রদ আকর্ষণ আর নেই । দুঃখ কষ্ট যাতনা একাকীত্ব গ্লানি ইত্যাদির চেয়ে উন্নত কোনো আরাম আছে কি ? নেই ।
ওই আকর্ষণের ফলে যাবতীয় এনার্জি নেতিবাচক নির্গমপথের বদলে ইতিবাচক রাস্তায় চালিত করা গেছে । জীবনের ঝড় জঞ্জাল নোংরামির ঘূর্ণিপাকে উচ্চতর মহত্তর পরমোল্লাস । বোথহয় একেই বলে আধ্যাত্মিক প্রাপ্তি । মায়া এনে দিয়েছিল ।
এই সিডিটা এখানেই শেষ দেখছি , নিজেকে শুনিয়ে বলল রিমা । এরকম টুকরো-টুকরো লিখেছে কেন ? টাইমপাস না অন্য কিছু ? পড়ার মজা নষ্ট হয়ে যায় ।
অক্টোবর 2, 2012 – 6:38 পুর্বাহ্ন ক্যাটাগরিসমূহ: Detective story | Post a commentTagged ডিটেকটিভ উপন্যাস |
তেলেগু অক্ষরে লেখা বাংলা ন্যারেটিভ পড়া বজায় রাখল ইন্সপেক্টার রিমা খান । তেলেগু অক্ষরকে বাংলা করিয়ে প্রিন্টআউট নিয়েছে ।
সময়টা সেনসেক্স অমুক থেকে তমুক হাজারে যাবার মাঝামাঝি বেশ পেছলা এরকম কাদায় কিউতে দাঁড়িয়ে টাইমপাস করতে চোখ ব্যবহার করে, চারিপাশে তাকিয়ে তার সঙ্গে কাণ উৎকর্ণ রেখে ফালতু গল্পে নিজেকে সেসব টানাপোড়েনে জড়িয়ে রেখেছিলুম । ক্লান্তির আবছায়ায় মনে হচ্ছিল, অতীতে, ধূসর নয়, রঙ গন্ধ ছোঁয়ার স্মৃতিতে ভাসছিল ও, নিরঞ্জন, বয়স হওয়া সত্ত্বেও । ডাকতার ওকে বলেছে ভাবতে-ভাবতে অতীতের স্মৃতিকে খুঁচিয়ে তুলতে , যতটা স্পষ্টতা ওসকানো সম্ভব, পেছনে চলে যেতে, পেছনে পেছনে পেছনে পেছনে গিয়ে আবার এগিয়ে আসতে , এগিয়ে এগিয়ে এগিয়ে এগিয়ে, বিশেষ করে প্রতিযোগীতায় হেরে যাবার, মা-বাবার কাছে মার খাবার, চোট-জখমের, অপমানিত হবার, শয্যাশায়ী থাকার, অসুখের, প্রতারিত হবার, প্রতারণা করার, প্রেমে বিশ্বাসঘাতকতার, যৌনতার, যৌন হুল্লোড়ের, যে-স্মৃতিগুলো ঘাঁটলে মগজ টাটকা থাকবে, বুড়িয়ে যাবার অবধারিত ভুলোপনাকে আটকে রাখবে, অ্যালঝিমারের ভয় থাকবে না । ডাকতার শেষনি ম্যাডাম বলেছেন যে গোপন স্বীকৃতি কমপিউটারে লুকিয়ে রাখুন , মাঝে-মাঝে পড়ুন, মেমারি এনজয় করুন , ফ্রেশ ফিল করবেন ।
মেয়েমানুষ, নারী, স্ত্রীলোক ছাড়া কোনও একরোখা উদ্দেশ্য ছিল না । হ্যাঁ, খাওয়া আর টাকা থাকাটাও জরুরি মনে হয়েছে । কত রকমের খাবার যে আছে জগতে । মানুষে-মানুষে প্রভেদ যে কত প্রয়োজন তা রকমারি খাবার দেখে, খেয়ে বুঝতে পেরেছি । মেয়েমানুষ, টাকা আর খাওয়া । কিন্তু একদিন একজন হঠাৎ বলে উঠল, ‘চলুন পালাই’ , আর ব্যাস, সব কিছু ওলোট-পালোট হয়ে গিয়েছিল ।
সেনসেক্সের অমুক হাজার থেকে স্মৃতিকে আঙুল করছে নিরঞ্জন, নিরু, মায়ালিঙ্গা, মায়াগারু, নিরঞ্জন পাল, নিরঞ্জন বণিক, নিরঞ্জন ব্যানার্জি, নির্জনাইয়া । এসব ওরফে আমার নিজের নেয়া নয় ; আমার ওপর চাপানো । আমার কিন্তু তা ভালো লেগেছে । ওরফেগুলোর জন্যে নিজেকে আবিষ্কার করতে পারলুম । নয়তো কি-ই বা ছিলুম । কখনও ষাঁড়ের মতন দৌড়োতুম, কখনও ভাল্লুকের মতন গোটাতুম নিরঞ্জনকে । বাবার দেয়া নাম । বাবা । যিনি কথায়-কথায় চড় মারতেন । আমার কানে প্রতিটি চড়ের আওয়াজ দর্জ করা আছে । সব চড়ের ধ্বনি একই রকম নয় । চড়ের কারণ অনুযায়ী বাবা চড়কে শব্দদান করতেন । এবং অর্থ ।
অনেকে বলে ঠাস করে চড় । তারা জানেইনা চড় কাকে বলে । চড়ের আওয়াজ ঠাস হতে পারে না । পপটিটি চড়ের পৃথক অর্থ হয় । এখন চড়ের আশঙ্কা নেই । ভয় সুধু ভাইরাসের । হার্ড ডিস্কের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভর না করার কারণ এই ভাইরাসই । কোথা থেকে কোন ভাইরাস চলে আসবে তার ঠিক নেই । সিডি থেকেই চলে আসবে হয়তো বা গান বা বাজনা থেকে । বাবার চড়ের চেয়েও অপ্রত্যাশিত ।
পড়তে শুরু করে পুলিসের ইনভেসটিগেটিং অফিসার ইন্সপেক্টার রিমা খানকে এই চিন্তাটা উত্তেজিত করেছে যে কেন কংকালটা লিখেছে বাংলা কিন্তু ব্যবহার করেছে তেলেগু অক্ষর । এটুকু পড়ে নোট নিল যে শেষনি ছদ্মনামের একজন ডাকতারের নির্দেশে, কংকালটা নিজের বার্ধক্যের নিরাময়ের উপায় হিসাবে এই প্রক্রিয়া প্রয়োগ করেছে । শেষনি সত্যিই ডাকতার না নার্স না সেবিকা না সহায়িকা না প্রেমিকা তা কংকালের হেঁয়ালির কারণে বেশ কনফিউজিং । সতর্কভাবে কনফিউজ করার ব্যবস্হা করে রেখেছে কংকাল লোকটা । যাতে কেউ না সহজে পড়ে ফ্যালে, সেদিকেও কংকালটা খেয়াল রেখেছিল ।
কংকালটার বাপ ওকে ঠেঙিয়ে-ঠেঙিয়ে মেনটাল কেস করে দিয়েছিল কিনা তাও জানা দরকার । তার মানে কংকালটার যোগাযোগ ছিল কিছু লোকের সঙ্গে যাদের সবাইকে ও নিজের সম্পর্কে গোপন তথ্য জানতে দিতে চায়নি । কী সেই গোপনীয়তা ? শেষনি ছদ্মনামের কোনো ডাকতার খুঁজে পাওয়া যাবে না রেজিস্টার্ড ডাকতারদের তালিকা থেকে । কংকালটার বাড়িতে মেডিকাল ফাইল পাওয়া যায়নি । প্রেসক্রিপশান বা প্যাথলজিকাল রিপোর্ট থাকলেও ক্লু পাওয়া যেত । শেষনি হয়তো ডাকতার নয় ; কংকালের বুড়ো বয়সের প্রেমিকা হতে পারে । অনেক পুরুষ আছে যারা প্রেমিকা ছাড়া বাঁচতে পারে না । কংকালটাও বোধহয় সেই টাইপের লোক ছিল । শেষনি বলে জুটিয়েছিল কাউকে ।
ওই মহিলা, যার কয়েকগাছা চুল পাওয়া গেছে, তার হদিস এই সিডিগুলোর মথ্যে নিশ্চয় কোনোটায় থাকবে । বাথরুমের চটিটা এত বড় মাপের যে মনে হয় তা কোনো পুরুষের । কংকালের নিজেরও হতে পারে । কিন্তু কংকাল কি অমন রঙচঙে মেয়েলি চটি পরত ? কংকালটা গে নয় তো ? হয়তো কোনো গে পুরুষ ভুলে ফেলে গেছে ! সেই কি খুনি ? গে পুরুষদের প্রেমিক নিয়ে টানাটানি হয় বটে, তা থেকে খুনোখুনির সূত্রপাতও ঘটে ; বিদেশে তো অমন গে সংক্রান্ত খুনোখুনি প্রায়ই ঘটতে দেখা যায় । সুমন মিশ্র আর রমেন বসু চটিটার কেমিকাল অ্যানালিসিস করিয়ে নিতে পারেননি, তখন ফরেনসিক দপতরের সুযোগ-সুবিধা ছিল না তেমন । চুলের যে গোছা পাওয়া গেছে তার ডিএনএ টেস্ট করিয়ে নেয়া যেতে পারে , যদি আরও কোনো জিনিসের ডিএনএর সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে হয় ভবিষ্যতে ।
প্রথম যিনি এই কেসটা নিয়েছিলেন সেই তদন্তকারী অফিসার সুমন মিশ্র নির্ণয় নিতে পারেননি যে এটা আত্মহত্যা না খুন না স্বাভাবিক মৃত্যু । উনি বিরক্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত ফাইলটা ক্লোজ করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন ; সে প্রায় দশ বছর আগের কথা । ফাইলটা তখন ক্লোজ করতে চাননি তখনকার ডাইরেক্টার জেনারাল হরিশঙ্কর মুখার্জি । ওনার গভীর অভিজ্ঞতা ওনাকে সন্দেহ করতে বাধ্য করেছিল যে এই মৃত্যু স্বাভাবিক নয় ।
দ্বিতীয় তদন্তকারী অফিসার রমেনবাবু বছর দুয়েক পরে কেসটা নিয়ে বহু তথ্য একত্রিত করেছিলেন, উনিও পথ গুলিয়ে হাল ছেড়ে দেন । সেই থেকে ফাইলটা বলা যায় হাফ-খোলা-হাফ-বন্ধ হয়ে পড়ে আছে । বর্তমান ডায়রেক্টার জেনারাল পবিত্র মুখোপাধ্যায় বলেছেন যে চাকরি থেকে সাসপেন্ডেড রিমার চাকরিতে বহাল হওয়া , আটকে থাকা পোস্টিং আর প্রোমোশান এই কেসটা সুরাহা করার পরই হবে । দ্বিতীয় তদন্তকারী ওসির সময়ে ফরেনসিক সায়েন্স ল্যাবরেটারিতে ডিএনএ স্যামপেল টেস্ট করার কেমিকাল নাকি ফুরিয়ে গিয়েছিল ; দুটো জেনেটিক অ্যানালাইজারের মধ্যে একটা খারাপ হয়ে পড়েছিল ; অ্যানালিস্টদের পদগুলোতে পোস্টিং হয়নি কারোর ।
ট্র্যান্সক্রিপ্ট-অনুবাদের গোছা পড়া বজায় রাখল রিমা । পুলিস কমপিউটার সেন্টারের সহায়তায় সবকটা সিডি ও তেলেগু থেকে বাংলা করেছে । কংকালের সংগ্রহের প্রতিটি সিডিই তার আত্মক্ষতর খতিয়ান নয় । প্রায় হাজার খানেক সিডির মাত্র কয়েকটায় আত্মক্ষত আছে । বাদবাকি সবকটাই পাশ্চাত্য গান, বাংলা গান, বলিউডি গান, হলিউডের ফিল্ম, নাচের ডিভিডি, আর কোনো কিছু রেকর্ড না-করা সিডি । প্রতিটি দেখে দেখে তেলেগু লেখা সিডিগুলো পৃথক করেছে রিমা । ২০০টা সিডি দেখার পর রিমার মনে হয়েছিল প্রেমিক কংকাল ১০১, ২০১, ৩০১, ৪০১, ৫০১, ৬০১ আর ৭০১ নম্বরের সিডিতে নিজের গল্প লিখে রেখেছে , যা কিনা একটা সিডিতেই এঁটেভ যেত । এক থেকে একহাজার পর্যন্ত সবুজ মার্কার দিয়ে মার্ক করেছিল কংকালটা , যাতে খুঁজতে অসুবিধা না হয় । সিডি তো রয়েছে , কিন্তু কমপিউটার আর মনিটর লোপাট বা ল্যাওপটপ থাকলে সেটি লোপাট । ল্যাপটপ ছিল না , ডেস্কটপই ছিল , কেননা কি-বোর্ড পড়ে আছে । বাড়িতে কোথাও মার্কার বা পেন-পেনসিল কিচ্ছু নেই । কেউ ওই ধরণের জিনিসপত্র সরিয়ে ফেলে থাকবে । কে সে ? মায়া পাল ? মিলি ? না অন্য কেউ ? কংকালটা ওর ফিকল্স ডিপজিট , গভমেন্ট সিকিউরিটি, শেয়ার সার্টিফিকেত ইত্যাদির কথা লিখেছে আরেকটা সিডিতে । তা সেগুলো গেল কোথায় ? ওগুলো যে-কেউ ভাঙাতে পারবে না, যদি না কংকালটা মরার আগে তার নামে ট্রান্সফার করে দিয়ে থাকে । খুনি জোর করে সই করিয়ে মেরে ফ্যালেনি তো ?
রিমার ক্লু খোঁজার চেষ্টা চলছে । প্রথম এবং দ্বিতীয় তদন্তকারী অফিসাররা ভেবেছিলেন সব কয়টা সিডিই হয় ফিল্ম নয় গান । সব কয়টা দেখার প্রয়োজন মনে করেননি । তাংছাড়া একটায় তেলেগু লেখা দেখে আশাহত হন দ্বিতীয় ওসি রমেনদা ।
রিমার চাকরিতে বহাল আর প্রোমোশান নির্ভর করছে এই রহস্য অনুসন্ধানের ওপর । লক আপে একজন আসামিকে মেরে ফেলার অভিযোগে ও সাসপেন্ডেড ; যদিও এনকোয়ারি কমিশন ওকে বেনিফিট অব ডাউট দিয়েছে । চাকরিতে বহাল আর প্রোমোশান আটকে আছে । ওর নামই সংবাদপত্র আর টিভির সাংবাদিকরা দিয়েছে ডার্টি ফেয়ারি বা নোংরা পরি, আমেরিকার কোনো মারকুটে পুলিস অফিসারের নামের আদলে । সে নাকি বলত ‘মেক মাই ডে’ । সাংবাদিকরা সেরকম গল্পই ছড়িয়েছে রিমা খান সম্পর্কে ; রিমা খানের উক্তি হল ‘একে ববিটাইজ কর ‘। সাংবাদিকদের মতে , রিমা নাকি পুরুষ আসামিদের ভয় দেখায়, লিঙ্গের চারপাশের চুল নাপিত ডেকে কামিয়ে একজন কন্সটেবল ক্ষুর নিয়ে অপেক্ষা করে । অপরাধীকে চেয়ারে বেঁধে তার দুহাত আর দুপা দুদিকে টান-টান করে বেঁধে রাখা হয় । রিমা খানের চোখের সামনে । তাতেই কাজ হয়। ডাকসাইটে গুন্ডার কাছেও তার যৌনাঙ্গের চেয়ে পার্থিব-অপার্থিব দামি কোনো বস্তু নেই । মিডিয়াতে রসিয়ে-রসিয়ে রঙিন ছবি এঁকে তুলে ধরা হয়েছে ।
মা-বাবা বলেন, তোকে কেই বা বিয়ে করবে এবার ! সাংবাদিকরা জিগ্যেস করে, মেয়ে হয়ে নোংরা গালাগাল ইউজ করেন ? অপরাধীদের থানায় এনেই আপনি নাকি হুমকি দ্যান যে নপুংসক করে দেব তোকে । রিমার সোজাসাপটা উত্তর, কেন, মেয়েমানুষের জন্যে ভাষা আলাদা, শব্দভাঁড়ার পৃথক ? মেয়েরা পাদবে না, ঢেঁকুর তুলবে না, যৌনকর্মে প্যাসিভ থাকবে । যত্তো সব ব্লাডি রাসকেল বাঙালি মধ্যবিত্ত পুরুষ ।
নোংরা পরি ! আর নাম পেলি না তোরা ? আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন তোলে রিমা । তবে প্রেমিক কংকালটার গল্প বেশ ইনটারেস্টিং মনে হচ্ছে । এককালে মেয়েদের নিয়ে জব্বর লীলে করেছে দেখছি ।
পড়া বজায় রাখল রিমা ।
নারীরা আমার ভাসমান জাহাজের অ্যাংকর । হ্যাঁ, অ্যাংকর কথাটা সঠিক । মেয়েমানুষ হল অ্যাংকর, নোঙর, যে স্হিরতা দেয় । চেতনার তরল কোলাহলের হইচই ঘিরে এক নারী-দেয়াল । কোনোপ্রকার আদর্শ ছাড়াই নোঙরের অধিযন্ত্র গড়ে তোলে এমন একটা মূল্যমান যাতে অজান্তেই সঙ্গতিপূর্ণভাবে একাগ্র হওয়া যায় । অমন একাগ্রতার দরুণ মগজটা আর মনের ওপর চড়াও হতে পারে না । অবিরাম দাসত্বকে লাগাতার উদ্ভাবনা দিয়ে মনোযোগের ঘেরাটোকে সতত উদ্দীপিত রাখার আর কি-ই বা উপায় আছে ? অন্তত আমি তো তা জানি না । বেঁচে থাকার তেজ খরচ করার জন্যে এর চেয়ে আরামপ্রদ আকর্ষণ আর নেই । দুঃখ কষ্ট যাতনা একাকীত্ব গ্লানি ইত্যাদির চেয়ে উন্নত কোনো আরাম আছে কি ? নেই ।
ওই আকর্ষণের ফলে যাবতীয় এনার্জি নেতিবাচক নির্গমপথের বদলে ইতিবাচক রাস্তায় চালিত করা গেছে । জীবনের ঝড় জঞ্জাল নোংরামির ঘূর্ণিপাকে উচ্চতর মহত্তর পরমোল্লাস । বোথহয় একেই বলে আধ্যাত্মিক প্রাপ্তি । মায়া এনে দিয়েছিল ।
এই সিডিটা এখানেই শেষ দেখছি , নিজেকে শুনিয়ে বলল রিমা । এরকম টুকরো-টুকরো লিখেছে কেন ? টাইমপাস না অন্য কিছু ? পড়ার মজা নষ্ট হয়ে যায় ।
Tagged ডিটেকটিভ উপন্যাস |
৫. খুনি কে ?
সন্ধ্যা ।
অন্ধকার ঘরে দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগে মগ্ন ইন্সপেকটর রিমা খান । চারটে সিগারেটই ছিল প্যাকেটে । শেষ হয়ে গেছে দেখে প্যাকেটটা দুমড়ে টেবিলের তলায় রাখা পেপার-বিনে ফেলে দিল ।
ঘরে ঢুকেই রিমার মা সিগারেটের ধোঁয়া খেয়ে কাশতে শুরু করলেন। কাশতে-কাশতেই বললেন, কতবার বলেছি তোকে এত সিগারেট খাসনি । টেনশানের চাকরি, ছেড়েদে না । কাশি থামলে বললেন, পুলিসের চাকরি শুনে কেই বা বিয়ে করবে তোকে ? পুলিসের লোকেই করতে পারে ; তাও জোটাতে পারলি না । বিয়ের বয়সও পার করতে চললি । আবার কোনো তেএঁটে কেস এনেছিস বোধহয় । তোর সাসপেনশানের হিল্লে হল না, আবার কেস । কতবার বললুম, যা, দিল্লিতে সেজো মামার সঙ্গে দেখা কর ; ওনার অনেক জানাশোনা আছে দিল্লিতে , কাউকে ধরে এখানে মুখ্যমন্ত্রীকে একটা যদি ফোন করাতে পারতিস তাহলে তোর বিপদের সুরাহা হতো ।
রিমা বলল, মা, ধরাধরি করে দেখে নিয়েছি । ডিজি একটা কেস দিয়েছেন, বলেছেন, স্বরাষ্ট্র সচিবের নির্দেশ হল যে আমি যদি এই প্যাঁচালো কেসটার সুরাহা করতে পারি, তাহলে তার পর দিনই আমার পোস্টিং আর প্রোমোশানের অর্ডার বেরিয়ে যাবে । আর সিগারেট ? কলেজগুলোয় গিয়ে দ্যাখো, বেশির ভাগ মেয়েই আজকাল গ্যাঁজা, যাকে ওরা বলে পাতা, দিব্বি ফোঁকে । দিনে গ্যাঁজা, রাতে ডিলডো ।
প্রকৃতই আঁৎকে উঠলেন রিমার মা সুনয়না খান ; আশঙ্কা-থমথমে কন্ঠে বললেন, আবার প্যাঁচালো কেস ? ওই প্যাঁচালো কেসের সমাধান করতে গিয়েই তুই লক আপে একজনকে ঠেঙিয়ে বিপদ ডেকে এনেছিস । আবার ? ডিলডো কী রে ? কেমন খেতে ? ডিলডো কোনো নতুন সিগারেট ?
মাকে পাশের স্টুলে বসিয়ে রিমা বলল, না, মা, সেরকম প্যাঁচালো নয় । এটা একজন লোকের রহস্য , যে পাঁচ বছরেরও বেশি আগে মরে ভুত হয়ে গেছে , এখন কংকাল হয়ে পড়ে আছে সে, তারই বিশাল বাড়িতে । কেউ তাকে খুন করেছিল, নাকি সে আত্মহত্যা করেছিল, নাকি তার মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল, তা আমায় খুঁজে বের করতে হবে । ডিলডো কী তা জেনে তোমার কাজ নেই ; ওটা কলেজ-পড়ুয়া মেয়েদের খেলনা, অবশ্য স্কুল-পড়ুয়া মেয়েরাও খেলে হয়তো কেউ কেউ । তোমাদের সময়ে অমন খেলনা ছিল না । আর আশ্চর্য কী জানো ? সব খেলনাই আজকাল চিন থেকে আসে ; কিন্তু এই খেলনাটা আসে ইউরোপ-আমেরিকা থেকে । চিনে তৈরি হলে কুড়ি-পঁচিশ টাকায় পাওয়া যেত , ইউরোপ থেকে আসে বলে দু-তিন হাজার টাকা দাম ।আমিও একটা কিনব , কখনও-কখনও ইচ্ছে করে খেলতে ।
—হ্যাঁ, কিনে নিস, মনটা হালকা হবে । যখন কিছুই ভালো লাগবে না তখন একটু খেলে নিলে কাজে মন লাগবে । বললেন রিমার মা ।
রিমা, সমান্তরাল চিন্তায় অভ্যস্ত, ভাবল, এই ডিলডো জিনিসটা মন্দ নয়, নানা রঙের, নানা কায়দার, সঙ্গীতময় ডিলডো, জেলি-দেয়া ডিলডো, ব্যাটারিতে কাঁপুনি-তোলা ডিলডো । বিয়ে না করে যৌবনটা কাটিয়ে দেয়া যায় ডিলডোদের সঙ্গে প্রেম করে । কোনো নটবরের দায়-দায়িত্ব নেই , হাগিজ পালটাবার হ্যাঙ্গাম নেই, প্লে স্কুলে গিয়ে লাইন দেবার ঝামেলা নেই , ডোনেশানের দুশ্চিন্তা নেই । ভাইব্রেটারের আনন্দ নাও , আর গাঢ় ঘুমে রাত কাবার ।
—ও আবার কেমন পুলিসি কেস ? অমন তো শুনিনি আগে , বললেন সুনয়না । উপদেশের ঢঙে যোগ করলেন, তোর সঙ্গে তো সেই বিদেশি একজন বিখ্যাত ডিটেকটিভের আলাপ হয়েছিল দিল্লির কোন সেমিনারে, তা তাকে তোর এই প্যাঁচালো কেসের বিষয়ে কথা বলে পরামর্শ নিতে পারতিস । একদিন স্কাইপে কথা বলে দেখ ।
—সেটাই তো ধাঁধা , বলল রিমা । তারপর যোগ করল, এর আগে দুজন ডিটেকটিভ, মানে পুলিসেরই অফিসার, তুমি চেনো, সুমনদা আর রমেনদা, তদন্ত করে হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন । আমি সুযোগ পেয়েছি কিছু একটা করে দেখাবার, ছাড়ব কেন ! তুমি দেখে নিও, কয়েক সপ্তাহেই রহস্য ভেদ করব । দেখা তো বহু এদেশি-বিদেশি ডিটেকটিভের সঙ্গে হয়েছিল সেখানে, সে একখানা অভিজ্ঞতা বটে । ওই বিদেশি ডিটেকটিভের নাম এরকুল পয়েরো ; উনি বলছিলেন, ব্রিটিশ আমলে তোমাদের শহরেও স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড ছিল ; এখন তোমাদের দেশে ডিটেকটিভের আর দরকার কোথায় ? প্রতিদিন তোমাদের রাজ্যে দু-দশটা খুন হয় , আর সেগুলো তোমাদের মন্ত্রীরা রাজনৈতিক খুন নাম দিয়ে চাপা দিয়ে দেন । উনি বলছিলেন, তোমাদের বাংলাভাষায় ডিটেকটিভরা উধাও হয়ে গেল কারণ রাজনীতিকরা গুন্ডা পোষে , খুন করায়, ডাকাতি করায়, ট্রেন লুট করায়, নারী পাচার করায় , আর তারাই আবার আইন বানায় ; তোমাদের দেশে আমলা-রাজনীতিক-অপরাধীদের এমন চক্র তৈরি হয়ে গেছে যে অপরাধীরা হিরোর সন্মান পাচ্ছে , নির্বাচন জিতে আইনসভায় যাচ্ছে ।
—আরেকজন বিদেশি ডিটেকটিভের সঙ্গে তো এই শহরেই দেখা হয়েছিল । তিনি আমেরিকার রেড ইনডিয়ান মহিলা, নাম এলা ক্লাহ । উনি আরও মারাত্মক কথা বলেছিলেন । উনি বলেছিলেন যে তোমাদের শহরটা পৃথিবীর পঙ্কিল শহরগুলোর অন্যতম, তোমাদের সরকারি হাসপাতালগুলো সমাজবিরোধীদের আখড়া । এখানে তো বিনা চিকিৎসায় রোজ কতজন মারা যায় তার ইয়ত্তা নেই , না খেতে পেয়ে মানুষ মরছে ; ডিটেকটিভ থাকাটা তোমাদের সমাজে বিলাসিতা , একটা-দুটো খুনে কী-ই বা এসে যায় এরকম সমাজে !
মায়ের শাঁখা-নোয়া পরা বাঁ হাত নিজের দু হাতে নিয়ে রিমা বলল, আমি শুনে-শুনে শুধু ইয়েস স্যার ইয়েস স্যার ইয়েস ম্যাম ইয়েস ম্যাম করে গেলুম ।
—অসত্য বলেনি তো মা । তা তুই তোর কেসের কোনো সুলুক সন্ধান পেয়েছিস ? কেসটাই বা কেমনতরো, রিমার মা শুধোলেন ।
—দুপুর থেকে তা-ই তো চিন্তা করছি , বলল রিমা । যে লোকটা মরে গেছে তার কংকালই কেবল রয়েছে ; মেয়ে না পুরুষমানুষ তা জানি না , আর তার কুকুরের কংকাল রয়েছে আমাদের মালখানায় । আমার আগের অফিসাররা হাতের টিপছাপ সংগ্রহ করেছিলেন ঘরগুলো থেকে, তা পুলিসের ফাইলে রাখা কোনো অপরাধীর সঙ্গে মেলেনি । একগাদা কমপিউটার ডিস্ক পাওয়া গেছে, গানের, বাজনার, নাচের ; কয়েকটা তেলেগু ভাষায় ইজকুড়ি-বিজকুড়ি লেখা বলে আগের অফিসাররা আগ্রহ দেখাননি । ল্যাপটপ বা টেবিলটপ কমপিউটার পাওয়া যায়নি ।
রিমার মা বললেন, তুই কোনো ডাকতার দেখা ।
—ডাকতার আবার কী দেখাব , আমার কিছু হয়েছে নাকি ? শুধু ক্লান্ত, ব্যাস, রাগতস্বরে বলল রিমা ।
সুনয়না বললেন, পুলিস ইন্সপেক্টারবাবু, তোর অসুখের কথা বলিনি । বলছি যে কংকালটা কোনো ডাকতারকে দেখা , তারা তো জানবে যে ওটা মেয়ের না ছেলের, কেমন করে মরল, কবে মরল ।
চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল রিমা । বলে উঠল, আরে ঠিক বলেছ তো । কোন দিক দিয়ে এগোবো বুঝতেই পারছিলাম না । লোকটার লেখা পড়তে-পড়তে তাইতেই মশগুল হয়ে পড়েছিলাম ।
সুনয়না বললেন, যে-লোকটা মরেছে, মানে যার কংকাল, তারও তো কোনো ডাকতার ছিল , তারও অসুখ-বিসুখ করত নিশ্চয়ই । খোঁজখবর নে, দ্যাক গিয়ে আসেপাশে কোনো ডাকতার-টাকতার বা হাসপাতাল আছে কিনা । লোকটার আত্মীয়-স্বজন কেউ তো হবে ? অমন মানুষ হয় নাকি যার ভূভারতে কেউ নেই ?
রিমা বলল, চলি মা, তোমার কথামতন এগিয়ে দেখি । নিচে নেমে মোটর সাইকেলে স্টার্ট দিয়ে রিমা সোজা ঘটনাস্হলে পোঁছাল। দশ বছর আগে বাঙলোটার ধারে-কাছে কোনো ঘরবাড়ি ছিল না । কেবল বাঙলোবাড়িটা ছিল , একটা ফাঁকা মাঠের মধ্যে । যেমন-যেমন ফ্ল্যাটবাড়ি উঠেছে, এলাকাটার নাম হয়ে গেছে কংকাল-বাঙলো পাড়া । পাড়ার লোকেদের কাহিনী অনুযায়ী , বাঙলোবাড়িটায় রাতে অনেকগুলো কংকালভুত ঘুরে বেড়ায় , তারা ঘুঙুর পরে নাচে, গান গায়, বাজনা বাজায় , মেয়ে কংকালগুলো হাসাহাসি করে ; তাই বাঙলোটার মাঠের কাছাকাছি ফ্ল্যাটবাড়ি তৈরি হয়েছে, কিন্তু বিক্রি হয়নি , ভয়ে কেউ আসতে চায়নি । নতুন তৈরি বিল্ডিঙগুলোতে শ্যাওলা জমে কালচে হয়ে যাচ্ছে । এই বিল্ডাররাই চাইছে কেসটার তাড়াতাড়ি হিল্লে হোক , খুনি ধরা পড়ুক , বা রহস্যটার বিশ্বাসযোগ্য সমাধান হোক ।
রিমা এক নজরে বাঙলোবাড়িটা দেখে নিয়ে মোটরসাইকেলে থ্রটল ঘুরিয়ে প্রথম গেল গোবিন্দর সেলুনে , বিশ্বকর্মা হেয়ার কাটিং স্টুডিও, গোবিন্দ যে ফোটোগ্রাফার হতে চেয়েছিল , তার নিদর্শন । একটা চেয়ার খালি আছে , উঁকি মেরে দেখে ঢুকলো রিমা ; অন্য দুটো চেয়ারে দুজন ঘুমন্ত বৃদ্ধ চুল কাটাচ্ছেন । বুড়োরা বোধহয় সন্ধ্যাবেলা চুল কাটায় , নিজেকে বলল রিমা । ওর সমান্তরাল চিন্তা ওকে বলল, খগেনের কাছ থেকে খবর নেয়া যাক । খগেন গোবিন্দর ছেলে , দুটো নাপিত রেখে সেলুনটা চালাচ্ছে , বাস চাপা পড়ে গোবিন্দ মারা যাবার পর । ফাঁকা চেয়ারটায় গিয়ে বসতে বৃদ্ধ দুজন এক পলক দেখে নিয়ে নিজেদের নাপিততন্দ্রায় ফিরে গেলেন । ওপরের উঁচু তাকে রাখা মিউজিক সিসটেমে হিন্দি গান বাজছে ।
খগেনকে রিমা বলল, চেঁচিয়েই বলল, নে, বয়কাট করে দে , কানের ওপর চুল এসে গেছে, সুড়সুড়ি লাগে । আর তোর এই হিন্দি গান বন্ধ কর , কত ভালোভালো বাংলা গান আছে, সেসব বাজাতে পারিস না ?
মিউজিক সিসটেমের সুইচ অফ করে খগেন বলল, ওই দ্যাখো, তোমার ফোটো, মোবাইলে তুলেছিলুম, এনলার্জ করিয়ে টাঙিয়ে রেখেছি । ছোটকুর কমপিউটার দোকানে গিয়ে মোবাইল থেকে তোমার রঙিন ফোটো বানিয়ে নিলুম । কেন জানো ? তুমিই আমার একমাত্তর মেয়ে খদ্দের । আর তোমার নাম তো পৃথিবীতে সক্কোলে জানে । গর্বভরে বলল খগেন প্রামাণিক । তারপর ফিসফিস করে জিগ্যেস করল, চাকরিতে বহাল হলে ? যাও দুচারটাকা তোমার কাছ থেকে পেতুম, তাও তো বন্ধ ।
খগেন রিমার ইনফরমার বাহিনীর একজন । অনেকে চুল কাটতে আসে ওর সেলুনে , আর ও গল্প শুরু করে খবর আদায় করার মতলবে । কোনো একটা সূত্র পেলেই হল , রিমা তা অনুসরণ করে বেশ কয়েকটা আসামি ধরেছে ।
রিমা বলল, হ্যাঁ, একটা কেস বিশেষ করে আমাকেই দিয়েছেন ডিজি । জানিস তো, আমার থানায় কোনো কেস ঝুলে থাকত না । সমাধান করে তবে শ্বাস নিয়েছি । তুই ওই কংকাল-পাড়ার বাঙলোবাড়ির বিষয়ে জানিস কিছু ? এই যে রে , নতুন পাড়ার মাঠের ওপারে, কংকালবাঙলো পাড়ায় ?
—ও তো ভুতুড়ে বাড়ি গো । ওর ধারে-কাছে যায় না কেউ । চুল ছাঁটার বদলে কাঁচির বাজনা আর আঙুলের নাচ বেশি তুলছিল খগেন । ওই বাড়িটার গল্প নিয়ে নাকি হিন্দিতে ভুতবাংলা নামে একটা ফিলিম হয়েছিল , হিরো মামুদ মিউজিক আর ডি বর্মণ ; বাবার মুখে শুনেছিলুম । আমি তো জম্মে ও-মুখো হইনি ।
—ওই বাঙলোবাড়ি ভিষণ অপয়া , বলল জনৈক চুলকাটিয়ে বৃদ্ধ , ঝিমন্ত অবস্হাতেই । তারপর যোগ করল, আমিও মেশোমশায়ের কাছে শুনেছি ; রাতের বেলায় বাঙলোবাড়িটায় নীল আলো জ্বলত আর হিন্দি ফিলিমের গান বাজত , কখনও-কখীনও বিলিতি গান বাজতো । মেশোমশায় বলেছিলেন, ওই গান শোনার পরেই উনি কালা হয়ে যান ।
—ওটা হরিচরণ দত্ত নামে একজন জমিদারের বাগানবাড়ি ছিল, দিনাজপুর না মালদা কোথাকার জমিদার-জোতদার , অনেক জমিজমার মালিক ; সে বাইজি নাচাত বাড়িটায়, হিন্দুস্তানি বাইজিরা সারা রাত নাচত ওই বাড়িতে ; ওই বাড়ির ভেতরে গেলে মেয়েদের কিমারীত্ব সঙ্গে-সঙ্গে নষ্ট হয়ে যায় বলে শুনেছি । অন্য বৃদ্ধ, যাঁর চুল কাটানো হয়ে গিয়েছিল, জামা থেকে চুল ঝাড়তে-ঝাড়তে বলল।
—ওনার কি কেউ ছিল সন্তান ? জানতে চাইল রিমা । যে বহুবার ঢুকেছে বাড়িটায় আর এখনও যার কুমারীত্ব, পুরুষের বা লেসবিয়ানের দ্বারা ভাঙেনি; ওর নিজের মতে ইনট্যাক্ট — ম্যাস্টারবেশানে যদি কুমারীত্ব নষ্ট হয়ে থাকে তাহলে কোনো তরুণীই কুমারী আর কোনো যুবকই কুমার থাকে বলে মনে হয় না । তেনশান কমাতে ও মাঝে-মধ্যে ম্যাস্টারবেট করে ।
আয়নার দিকে তাকিয়ে, নিজেকে চোখ দিয়ে আদর করতে-করতে আর চুল আঁচড়াতে-আঁচড়াতে বৃদ্ধ বলল, তা জানি না, আমি তখন শহরের দক্ষিণে থাকতুম । মেসো ওনার বাড়িটা আমাকে লিখে দেবার পর গেল বছর এ-পাড়ায় এসেছি । তা তোমাকে তো চেনা-চেনা মনে হচ্ছে গো, কোথায় দেখেছি যেন ?
খগেন বলল, ইনি রিমা খান , বিখ্যাত পুলিস অফিসার , সাদা পোশাকে বলে চিনতে পারছেন না ; রিমাদি একবার উর্দি পরলে ওনার রোয়াব দেখে কে ? কোথায় দেখেছেন জানেন ? টিভিতে আর খবরের কাগজে , ওনার বিষয়ে রসালো সব গপ্পো বেরিয়েছিল গত বছর । টিভিতে চ্যাংড়ারা ওনার নাম দিয়েছিল….
—নোংরা পরি । খগেনের কথা মাঝপথে থামিয়ে বলল রিমা ।
—ও, তুমিই সেই পুলিসনি ; তুমি তো বিখ্যাত মহিলা গো ; তা লোকটা কি সত্যই লক আপে মরেছিল , না আগেই মরে গিসলো ? যে বৃদ্ধর দাড়ি কামিয়ে দিচ্ছিল খগেনের কর্মী রেজাউল, জানতে চাইল সেই বৃদ্ধ ।
—না, পিটিয়ে মেরে দিয়েছিলুম ; আর খভাতি জিনিসটা অন্যলোকে দেয় না স্যার , পাবলিকও দেয় না, ওটা আত্মআবিষ্কারের ব্যাপার , নিজেকে খুঁজে পাবার রহস্য , বুঝলেন দাদু । খ্যাতি জন্মায় উদ্বেগ-উৎকন্ঠা থেকে । নিজের ভেতরকার উদ্বেগ-উৎকন্ঠা , সাংসারিক দুশ্চিন্তা নয় , ঘাড় ঘুরিয়ে বলল রিমা ।
—আরে কি আবোল-তাবোল বকছ রিমাদি , পাবলিক ভাববে তুমিও থার্ড ডিগ্রি ঠ্যাঙাও । বলে উঠল রেজাউল । যার চুল কাটছিল, আয়নার দিকে তাকিয়ে তাকে বলল, গুণ্ডাটা অন্য একটা লোককে খুন করে তাকে নিজেরই নাম দিয়ে শ্মশানে নিয়ে গিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিল , আর তারপর মরা লোকটার আত্মপরিচয় নিয়ে দিব্বি কুকম্মো করে বেড়াচ্ছিল । রিমাদিই তো ধরেছিলেন ব্যাটাকে ; এখন তার মুখ থেকে তার অপরাধ না জানতে পারলে ঘুণ্ডাটা তো সারাজীবন ওই মরা লোকটার নামে নিজেকে চালাত, খুন করেও পার পেয়ে যেত । টিভিঅলারা পাবলিককে বুঝিয়েছিল যে শ্মশানে যে গুণ্ডাটা পুড়েছে সেটাকে রিমাদিই মেরে ফেলেছিলেন ।
রিমা গম্ভীর কন্ঠে চিবিয়ে-চিবিয়ে বলল, যে ক্রিমিনালরা জেরা করার সময়ে আমার পায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে তাদের দু-ডিগ্রি ঠ্যাঙাই, যারা মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে তাদের থার্ড ডিগ্রি ঠ্যাঙাই । যারা আমার বুকের দিকে তাকিয়ে থাকে তাদের ঠেঙিয়ে কথা আদায় করি না , আমার সাবইন্সপেক্টারের ওপর ছেড়ে দিই মিষ্টি-মিষ্টি কথা বলার জন্যে । এক ডিগ্রি বলে কোনো ঠ্যাঙানি হয় না ।
—কি বলছ রিমাদি , দেখছ বয়স্ক লোক এখানে , বলল খগেন ।
রিমা মুচকি হাসি ঠোঁটে মাখিয়ে বলল, এতে লুকোবার কি আছে ! তুইওতো চুল কাটতে-কাটতে আমার বুকের খাঁজ দেখছিলি, আয়নায় তোর কিত্তি দেখা যাচ্ছিল রে । পুরুষরা যুবতীদের দেখার সময়ে সবচেয়ে প্রথমে বুকের দিকে তাকায় , সেটাই স্বাভাবিক, মাদার-সান ইন্সটিংকট, মানে মা-ছেলে সম্পর্কের চেতনা । যে-ক্রিমিনালরা বুকের দিকে তাকায় , বুঝতে হবে ব্যাটা ততো বজ্জাত নয় ; আর আমার বুক নকল নয়, সিলিকন-পোরা নয়; কোনো প্রেমিকও ছিল না কস্মিনকালে যে তার ছোঁয়ায় ফুলে উঠেছে আজকালকার খুকিগুলোর মতন ।
—একেই বলে মডার্ন মেয়ে , এক বৃদ্ধ আরেক বৃদ্ধকে বলল, পার্স থেকে টাকা বের করে । দুজন বৃদ্ধই সারা মুখে খাঁটি ওথলানো-বুক দেখার আনন্দ ফুটিয়ে বেরিয়ে গেল সেলুন থেকে । বাইরে বেরিয়ে একজন আরেকজনকে বলল, এবার থেকে কালো চশমা পরতে হবে বুঝলে । আমিও মেয়েদের দিকে তাকালেই সবচে আগে বুকের দিকে তাকাই । ছুঁচলো-ছুঁচলো বডিস পরে ঘোরে, দেখেছেন, কচি-কচি মেয়েরাও । চোখের এমন অভ্যাস হয়ে গেছে ইসকুলে পড়ার সময় থেকে যে মন না চাইলেও চোখ চেয়ে ফ্যালে ।
অন্য বৃদ্ধ বলল, আজগাল বাংলা ফিলিমেও তো নায়িকারা বুকের খাঁজ দেখিয়ে নাচে । যাদের ভগবানের দেয়া খাঁজ নেই তারা বিদেশে গিয়ে শল্যচিকিৎসা করিয়ে নকল খাঁজ বানিয়ে আনে । কীই বা করবে বলুন , প্রতিযোগীতার বাজার ; নজর কাড়তে হলে করতেই হবে । তবে এখনকার মেয়েদের খাঁজগুলো বেশ মিষ্টি । উদারীকরণের মিষ্টতা ।
রেজাউলের দিকে তাকিয়ে খগেন বলল, রিমাদিও ক্যারাটে জানেন , একাই যে-কোনো লোককে পেড়ে ফেলতে পারেন ।
—উঁহু উঁহু, বাধা দিয়ে বলল রিমা , ক্যারাটে নয়, আমি যেটা শিখেছি তার নাম এসক্রিমা , ফিলিপাইনসের আত্মরক্ষার টাকনিক । চিরুনি , কলম, খবরের কাগজ, চটি, হাতের কাছে যা আছে তা দিয়েই আত্মরক্ষা করা যায় , আবার ধরেও ফেলা যায় আসামিকে, কোনো শারীরিক আঘাত না করে । সাবইন্সপেক্টার থাকার সময়ে আমাকে পাঠানো হয়েছিল রাধিকা শেখের ন্যাশানাল স্কুল অব কমব্যাট আর্টে , মুম্বাইয়ের ওরলিতে । বোরখা-পরা মেয়েরাও শেখে, বোরখা না খুলেই আত্মরক্ষা আর আক্রমণের টেকনিক শেখে। রাধিকা ম্যাডাম নিজে বোরখা পরে ডিমন্সট্রেট করতেন । এসক্রিমা শিক্ষার স্লোগান ছিল, ‘সাপকে না মেরে তার বিষদাঁত খুলে নাও ‘।
—এসক্রিমা ! তুমি তো পেঁদিয়ে আইসক্রিম বানিয়ে দাও । হাঃ হাঃ । এবার বলো , কেসখানা কি ? রিমা চেয়ার থেকে নামলে টাকা নিয়ে পকেটে রেখে জিগ্যেস করল খগেন ।
—ওই বাঙলোবাড়িটায়, পাঁচ বছর আগে, যিনি সে-সময়ের থানা ইনচার্জ ছিলেন , তিনি ভিন্নসূত্রে সেখানে একটা কংকাল আবিষ্কার করেছিলেন । কংকালটা বিছানায় আধশোয়া হয়ে পড়েছিল আর তার পাশে মেঝের ওপর একটা কুকুরের কংকাল । মানুষের কংকালটা যেখানে ছিল সেখানেই পড়ে আছে , কুকুরের কংকালটা উনি মালখানায় রাখিয়ে দিয়েছিলেন । এখন আমাকে দাবিত্ব দেয়া হয়েছে কংকালটা খুন হয়েছিল নাকি আত্মহত্যা করেছিল তা অনুসন্ধান করে বের করতে । খুন হয়ে থাকলে খুনিকে খুঁজে বের করতে হবে , আর আত্মহত্যা হলে যে দায়ি তাকে বের করতে হবে । তোকে একদিন নিয়ে যাব, বলল রিমা ।
—না না না না , শেষে মরি আর কি , আমার খুব ভুতের ভয় । আঁৎকে উঠে, হেঁচকি তুলে, খগেনের কন্ঠ থেকে দ্রুত কথাগুলো বেরোল । তারপর, রিমা, সাহায্যের হাত গুটিয়ে নিতে পারে আশঙ্কায় বলল, এই কেসের জন্যে অন্য কি কাজে লাগতে পারি তা বলো ।
নিজের ভাবনা খগেনকে দিয়ে ভাবাবার উদ্দেশে রিমা ওকে জিগ্যেস করল, আচ্ছা, কংকাল বললেই তোর মনে কোনো মানুষের ছবি তৈরি হয় কি ? মহিলা না পুরুষের ? আমি তো কেসটা নেয়া অব্দি কুকুরের কংকালের জায়গায় কুকুরটার একটুখানি , শাদা-কালো চামড়ার ছিল বলে, মনের মধ্যে কুকুরের ছবি তৈরি করে নিতে পারছি, কিন্তু কংকাল শুনলে, দেখার পরও, বুঝতে পারছি না, লোকটাকে কেমন দেখতে ছিল ।
রেজাউল জ্ঞানীর ঢঙে বলল, ঠিকই বলেছেন রিমাদি, কংকাল বললে মনে হয় কংকাল জিনিসটা আলাদা আর মানুষ জিনিসটা তার থেকে আলাদা । অথচ কুকুরের কংকাল আর কুকুর যেন একই ব্যাপার । তাই তো বলে, যে, সবার উপর মানুষ সত্য তাহার উপর নাই ।
সেলুন থেকে বেরিয়ে, মোটর সাইকেলে স্টার্ট দিয়ে রিমা বলল, যাই, মা কিছু আইডিয়া দিয়েছে, সেই দিক দিয়ে এগোই । তোরা থুথ্থুরে বুড়োরা চুল কাটাতে এলে তাদের কাছ থেকে বাঙলোবাড়ির খবর-টবর পেলে যোগাড় করে রাখিস ; আগামি সোমবার আসব ।’
তিনজনেই একসঙ্গে বলে উঠল, মাসিমা ! পুলিসের মা তো !
রেজাউল বলল, আপনার বাবাও পুলিসে ছিলেন , তাই উনিও কেসের ব্যাপার শুনে-শুনে খুনি ধরার ফাঁদগুলো জেনে ফেলেছেন ।
রিমার সুজুকি হায়াবুসা লাল-কালো মোটর সাইকেলের আওয়াজ মিলিয়ে যেতে রেজাউল স্বগতোক্তি করল, মহিলা বটে একখানা , নিজের মাইয়ের কথা আমাদের খোলাখুলি বলছে , বুড়োগুনোও শুনছে তাতেও পরোয়া নেই, ওফ ।
শুনে, খগেন মুচকি হাসি দিয়ে, যে হাসির মানে, হেঃ হেঃ, আমি অনেক-কাল থেকে রিমাদির চুল কাটছি , কলেজে পড়ার সময় থেকে, রিমাদির বয়-কাট, সেই থেকে বিউটি পারলারে যায় না ।
রেজাউল ভুরু কুঁচকে বলল, তুই অমন হাসছিস যে ? ভুল বলেছি ? মাইয়ের সাইজ দেখেছিস ? টুসকি মারলে টন-টন শন্দ উঠবে । শুধু মাই ? রিমাদির রঙও কত ফর্সা অথচ ওনার মা অত ফর্সা নয় । রিমাদি বোধহয় নিজগুণে ফর্সা।
—আসলি জিনিস । খগেন সবজান্তার হাসি মুখময় ছড়িয়ে বলল, চুল কাটতে-কাটতে দেখে ফেলি, ওফ, ভেতরে পরেও না কিছু, গুঁড়ো-গুঁড়ো পাউডার লেগে থাকে ; ওই কাপসাইজের হয় না বোধহয় বাজারের বডিস !
পিনাকি, যে এতক্ষণ কোনো কথা বলেনি, বলল, হবে না কেন, বিলেতে তো কতো বড়ো বড়ো মাই হয় , ইংরিজি ফিলিমগুলোয় দেখিসনি ? কি এক-একখানা বুক, প্রাণ জুড়িয়ে যায় । তারপর যোগ করল , এতক্ষণ তোদের মুখে রা ফোটেনি , যেই রিমা খান গেল ওমনি তোদের পোঁদে খই ফুটছে । রিমাদি তোদের দুজনের চেয়েও লম্বা , এমন একখানা লাথি দেবে না, যে বংশের সম্পত্তি ফেটে নকশালবাঁড়া বেরিয়ে যাবে । রিমাদি পুলিসে ঢুকতে গেল কেন কে জানে , অমন ভালো ফিগার, দেখতে-শুনতে ভাল, গলার স্বরও মিষ্টি, পাতলা ঠোঁট, ফিলিমে যেতে হলে যা-যা দরকার ।
রেজাউল বলল, ওনার সামনে ওনার বিষয়ে মুখ ফসকে কথা বেরিয়ে গেলে পোঁদের চামড়া খুলে নেবে । যে-সে পুলিস নয় চাঁদু, প্যাঁদাতে ওনার জুড়ি নেই ; যে এলাকায় ওনার পোস্টিং হয় , সেখানের গুণ্ডারা সে এলাকা থেকে পালায় ; নেতাদের কথাও শোনেন না । নেতার টিভি চ্যানেলেই তো ওনাকে নোংরা পরি নাম দিয়েছে । চ্যানেলটা নাকি ওনাকে সাবানের মডেল হতে বলেছিল । সাবানের মডেল হলে দারুণ হতো , ওফ, শাওয়ারের তলায় খালি গায়ে রিমাদি, পেছনে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক, ভাবতেও ভাল্লাগে শালা ।
বাঙলোবাড়িটার দু-কিলোমিটারের মধ্যে যে ডাকতাররা আছে , ওষুধের দোকানগুলোয় খোঁজ নিয়ে-নিয়ে তাদের একটা তালিকা আড়াই দিনে তৈরি করল রিমা । ওষুধের দোকানগুলোয় খোঁজ নিয়ে মোটর সাইকেলে ঘুরে-ঘুরে তাদের চেম্বারগুলো কোথায় তা টুকে রাখল নিজের ডায়রিতে । বাঙলোবাড়ি থেকে যে-সমস্ত সামগ্রী প্রথম ও দ্বিতীয় ইনভেসটিগেটিং অফিসাররা বাজেয়াপ্ত করেছিলেন, তা থেকে জানা যায়নি যে মৃত ব্যক্তির কোনো ডাকতার ছিল কিনা । ওষুধের শিশি বা বড়ির কভার বা প্রেসক্রিপশান কিছুই পাননি তাঁরা । যা জিনিসপত্র পাওয়া গেছে, আর যা-যা পাওয়া উচিত ছিল অথচ পাওয়া যায়নি, রিমার অনুমান, মৃত্যুটা স্বাভাবিক নয় । হয় আত্মহত্যা নতুবা হত্যা । কংকাল প্রেমিক যাকে শেষনি বলে উল্লেখ করেছে সে আদপে ডাকতার না নার্স না সহায়ক স্পষ্ট টের পাওয়া যাচ্ছে না । কংকালটা সব ব্যাপারে এমন হেঁয়ালি করেছে যে মনে হয় খুন হবার জন্যে তৈরি হচ্ছিল ।
প্রশ্ন হল মোটিভ কী ? রিমা নিজেকে প্রশ্ন করল, মোটিভ কী ? কেউ খুন করে থাকলে সে কী জন্যে খুন করেছে ? বাড়িটা তো পড়ে রয়েছে পাঁচ বছর যাবত যেমনকার তেমন । সম্পত্তির জন্যে হলে সবচেয়ে আগে তো খুনি অতবড় বাড়িটাই হাতাত— কংকাল প্রেমিককে বাগানে পুঁতে দিলেই ব্যাস নিশ্চিন্ত । বাড়ির ভেতরেও দামি আসবাব তছনছ করা হয়নি । দামি-দামি কিউরিওগুলোতেও হাত দেয়নি কেউ । সরানো হয়ে থাকতে পারে নিবেশের কাগজপত্রগুলো ; আবার কংকালটা নিজেই সেসব ভাঙিয়ে ফেলে থাকতে পারে মরবার আগে । বাড়ির মধ্যেকার সাজানো গোছানো জিনিসপত্র দেখে মনে হয় , লোকটা, মারা যাবার সময়ে যেমন ছিল, তেমনই পড়ে আছে । তাহলে ?
ডিজিকে অনুরোধ করে কালকেই একজন বিশেষজ্ঞ ডাকতারকে নিয়ে গিয়ে সরেজমিন তদন্ত করবে, ঠিক করল রিমা, বিশেষজ্ঞ ডাকতারের মতামত নিয়ে নিশ্চিত হবে যে ঠিক কী কারণে মারা গেল কংকালটা ।
অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল । রিমা বাঙলোবাড়িটায় পৌঁছে, মোটর সাইকেলের আলো বাড়িটার বাগানের দিকে ফোকাস করে ঢুকলো । বেশ কিছুক্ষণ বাগানের আগাছা সরিয়ে ঘুরে-ঘুরে মাটিতে দেখতে লাগল সূক্ষ্ম কিছু পাওয়া যায় কিনা, যা দিনের আলোয় পায়নি । কয়েকটা মরা পিঁপড়ে দেখতে পেয়ে খুঁটে-খুঁটে তুলে বারবার শুঁকলো , পকেট থেকে রুমাল বের করে মুড়ে রাখল তাতে । ওর মনে হল এগুলো কাঠপিঁপড়ে । মোটর সাইকেলে বসে একটা সিগারেট শেষ করার পর ফরেনসিক ল্যাবের পথা রওনা হল ।
ফরেনসিক অ্যানালিস্ট রুচিষ্মিতা ঘোষ তখনও ছিলেন ল্যাবে । টেবিলে রাখা কোনো জিনিস খুঁটিয়ে দেখছিলেন, সাদা চোখেই । রিমাকে দেখে বললেন , কি রিমা, কিছু পেলেন ? আপনি তো কেসটা নেয়া অব্দি হাওয়ায় ছড়ি ঘোরাচ্ছেন বলে শুনেছি ; এখনও নাকি নিশ্চিত হতে পারেননি যে খুন না আত্মহত্যা ।
রিমা রুমালে-মোড়া পিঁপড়েগুলো টেবিলের ওপর রাখতে যাচ্ছিল , রুচিষ্মিতা উঁহু উঁহু করে একটা ছোট্টো কাচের পাত্র এগিয়ে দিলেন । রিমার দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করলেন, সন্দেহটা কি ?
—গন্ধ থেকে মনে হল পেস্টিসাইড । এতকাল পরও পেস্টিসাইডের গন্ধ রয়ে গেছে , বেশ স্ট্রং কোনো কেমিকাল, কিংবা প্রায়ই পেস্টিসাইড ছড়ানো হচ্ছে । আমার তিনটি জিজ্ঞাস্য । প্রথম, পেস্টিসাইডটা কি ? দ্বিতীয়, কতদিন আগে ছড়ানো হয়ে থাকতে পারে বলে অনুমান । তৃতীয়, পিঁপড়েগুলো কোন জাতের ?
—দারুণ । প্রথম দুটির উত্তর আমি তৈরি করে রাখব । তৃতীয়টার জন্য আপনি রাজ্যের এনটোমলোজিস্টকে অনুরোধ করুন । তবে প্রথম দর্শনে পিঁপড়েগুলোকে ডরিলাস প্রজাতির মনে হচ্ছে । যাহোক, পথ খুঁজে পেয়েছেন দেখছি । পরশু বিকালে ফোন করবেন । জানতে পারি কি যে এখান থেকে কি ভাবে এগোবেন ?
—মোটিভ, মোটিভ । মোটিভটা পাচ্ছি না । একটা বাচ্চা মেয়েকে পিঁপড়ের ঝাঁক আক্রমণ করেছিল বাঙলোবাড়ির বাইরে , পাঁচ বছর আগে । বাঙলোর ভেতরে সেই পিঁপড়েগুলো যদি এখনও থেকে থাকে, তাদের গায়ে পেস্টিসাইডের গন্ধ থাকবে নাকি !
—না থাকবে না । গ্রীষ্ম বর্ষা শরৎ হেমন্ত শীত বসন্তে পাঁচ বছর আগের সেসব পিঁপড়েদের মৃতদেহ মাটির সঙ্গে মিশে যাওয়াই স্বাভাবিক ।
—তার মানে, কেউ পেস্টিসাইড রেগুলারলি স্প্রে করাচ্ছে বা সম্প্রতি করিয়েছে ।
—কোনো কন্সটেবলকে লক্ষ রাখতে বলুন না, রাতের বেলায় ।
—আমার তো হিউমান রিসোর্স নেই । জানেন তো, নিলম্বিত, আই মিন সাসপেন্ডেড । একজন সাবইন্সপেক্টার পেয়েছি , তাকে আর কত খাটাব । দেখি আমার কয়েকজন প্রাইভেট শিষ্য আছে , তাদের বলে দেখব । আপনার কাছ থেকে স্প্রে করানোর ফ্রিকোয়েন্সি জানতে পারলে সুবিধা হবে ।
ল্যাবের টয়লেটে গিয়ে রিমা ঠোঁতের ওপর ফিকে গোলাপি লিপ্সটিক বোলালো । নিজেকে ও ভালোবাসে । আয়নায় মুখ ঘুরিয়ে নিজেকে নানা দিক থেকে দেখে সন্তুষ্ট হল । অ্যাট্র্যাকটিভ লেডি, বলল আয়নার দিকে প্রতিফলিত নিজেকে, অ্যান্ড রুথলেস টু ।
অক্টোবর 2, 2012 – 6:35 পুর্বাহ্ন ক্যাটাগরিসমূহ: Detective story | Post a commentTagged ডিটেকটিভ উপন্যাস |
সন্ধ্যা ।
অন্ধকার ঘরে দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগে মগ্ন ইন্সপেকটর রিমা খান । চারটে সিগারেটই ছিল প্যাকেটে । শেষ হয়ে গেছে দেখে প্যাকেটটা দুমড়ে টেবিলের তলায় রাখা পেপার-বিনে ফেলে দিল ।
ঘরে ঢুকেই রিমার মা সিগারেটের ধোঁয়া খেয়ে কাশতে শুরু করলেন। কাশতে-কাশতেই বললেন, কতবার বলেছি তোকে এত সিগারেট খাসনি । টেনশানের চাকরি, ছেড়েদে না । কাশি থামলে বললেন, পুলিসের চাকরি শুনে কেই বা বিয়ে করবে তোকে ? পুলিসের লোকেই করতে পারে ; তাও জোটাতে পারলি না । বিয়ের বয়সও পার করতে চললি । আবার কোনো তেএঁটে কেস এনেছিস বোধহয় । তোর সাসপেনশানের হিল্লে হল না, আবার কেস । কতবার বললুম, যা, দিল্লিতে সেজো মামার সঙ্গে দেখা কর ; ওনার অনেক জানাশোনা আছে দিল্লিতে , কাউকে ধরে এখানে মুখ্যমন্ত্রীকে একটা যদি ফোন করাতে পারতিস তাহলে তোর বিপদের সুরাহা হতো ।
রিমা বলল, মা, ধরাধরি করে দেখে নিয়েছি । ডিজি একটা কেস দিয়েছেন, বলেছেন, স্বরাষ্ট্র সচিবের নির্দেশ হল যে আমি যদি এই প্যাঁচালো কেসটার সুরাহা করতে পারি, তাহলে তার পর দিনই আমার পোস্টিং আর প্রোমোশানের অর্ডার বেরিয়ে যাবে । আর সিগারেট ? কলেজগুলোয় গিয়ে দ্যাখো, বেশির ভাগ মেয়েই আজকাল গ্যাঁজা, যাকে ওরা বলে পাতা, দিব্বি ফোঁকে । দিনে গ্যাঁজা, রাতে ডিলডো ।
প্রকৃতই আঁৎকে উঠলেন রিমার মা সুনয়না খান ; আশঙ্কা-থমথমে কন্ঠে বললেন, আবার প্যাঁচালো কেস ? ওই প্যাঁচালো কেসের সমাধান করতে গিয়েই তুই লক আপে একজনকে ঠেঙিয়ে বিপদ ডেকে এনেছিস । আবার ? ডিলডো কী রে ? কেমন খেতে ? ডিলডো কোনো নতুন সিগারেট ?
মাকে পাশের স্টুলে বসিয়ে রিমা বলল, না, মা, সেরকম প্যাঁচালো নয় । এটা একজন লোকের রহস্য , যে পাঁচ বছরেরও বেশি আগে মরে ভুত হয়ে গেছে , এখন কংকাল হয়ে পড়ে আছে সে, তারই বিশাল বাড়িতে । কেউ তাকে খুন করেছিল, নাকি সে আত্মহত্যা করেছিল, নাকি তার মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল, তা আমায় খুঁজে বের করতে হবে । ডিলডো কী তা জেনে তোমার কাজ নেই ; ওটা কলেজ-পড়ুয়া মেয়েদের খেলনা, অবশ্য স্কুল-পড়ুয়া মেয়েরাও খেলে হয়তো কেউ কেউ । তোমাদের সময়ে অমন খেলনা ছিল না । আর আশ্চর্য কী জানো ? সব খেলনাই আজকাল চিন থেকে আসে ; কিন্তু এই খেলনাটা আসে ইউরোপ-আমেরিকা থেকে । চিনে তৈরি হলে কুড়ি-পঁচিশ টাকায় পাওয়া যেত , ইউরোপ থেকে আসে বলে দু-তিন হাজার টাকা দাম ।আমিও একটা কিনব , কখনও-কখনও ইচ্ছে করে খেলতে ।
—হ্যাঁ, কিনে নিস, মনটা হালকা হবে । যখন কিছুই ভালো লাগবে না তখন একটু খেলে নিলে কাজে মন লাগবে । বললেন রিমার মা ।
রিমা, সমান্তরাল চিন্তায় অভ্যস্ত, ভাবল, এই ডিলডো জিনিসটা মন্দ নয়, নানা রঙের, নানা কায়দার, সঙ্গীতময় ডিলডো, জেলি-দেয়া ডিলডো, ব্যাটারিতে কাঁপুনি-তোলা ডিলডো । বিয়ে না করে যৌবনটা কাটিয়ে দেয়া যায় ডিলডোদের সঙ্গে প্রেম করে । কোনো নটবরের দায়-দায়িত্ব নেই , হাগিজ পালটাবার হ্যাঙ্গাম নেই, প্লে স্কুলে গিয়ে লাইন দেবার ঝামেলা নেই , ডোনেশানের দুশ্চিন্তা নেই । ভাইব্রেটারের আনন্দ নাও , আর গাঢ় ঘুমে রাত কাবার ।
—ও আবার কেমন পুলিসি কেস ? অমন তো শুনিনি আগে , বললেন সুনয়না । উপদেশের ঢঙে যোগ করলেন, তোর সঙ্গে তো সেই বিদেশি একজন বিখ্যাত ডিটেকটিভের আলাপ হয়েছিল দিল্লির কোন সেমিনারে, তা তাকে তোর এই প্যাঁচালো কেসের বিষয়ে কথা বলে পরামর্শ নিতে পারতিস । একদিন স্কাইপে কথা বলে দেখ ।
—সেটাই তো ধাঁধা , বলল রিমা । তারপর যোগ করল, এর আগে দুজন ডিটেকটিভ, মানে পুলিসেরই অফিসার, তুমি চেনো, সুমনদা আর রমেনদা, তদন্ত করে হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন । আমি সুযোগ পেয়েছি কিছু একটা করে দেখাবার, ছাড়ব কেন ! তুমি দেখে নিও, কয়েক সপ্তাহেই রহস্য ভেদ করব । দেখা তো বহু এদেশি-বিদেশি ডিটেকটিভের সঙ্গে হয়েছিল সেখানে, সে একখানা অভিজ্ঞতা বটে । ওই বিদেশি ডিটেকটিভের নাম এরকুল পয়েরো ; উনি বলছিলেন, ব্রিটিশ আমলে তোমাদের শহরেও স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড ছিল ; এখন তোমাদের দেশে ডিটেকটিভের আর দরকার কোথায় ? প্রতিদিন তোমাদের রাজ্যে দু-দশটা খুন হয় , আর সেগুলো তোমাদের মন্ত্রীরা রাজনৈতিক খুন নাম দিয়ে চাপা দিয়ে দেন । উনি বলছিলেন, তোমাদের বাংলাভাষায় ডিটেকটিভরা উধাও হয়ে গেল কারণ রাজনীতিকরা গুন্ডা পোষে , খুন করায়, ডাকাতি করায়, ট্রেন লুট করায়, নারী পাচার করায় , আর তারাই আবার আইন বানায় ; তোমাদের দেশে আমলা-রাজনীতিক-অপরাধীদের এমন চক্র তৈরি হয়ে গেছে যে অপরাধীরা হিরোর সন্মান পাচ্ছে , নির্বাচন জিতে আইনসভায় যাচ্ছে ।
—আরেকজন বিদেশি ডিটেকটিভের সঙ্গে তো এই শহরেই দেখা হয়েছিল । তিনি আমেরিকার রেড ইনডিয়ান মহিলা, নাম এলা ক্লাহ । উনি আরও মারাত্মক কথা বলেছিলেন । উনি বলেছিলেন যে তোমাদের শহরটা পৃথিবীর পঙ্কিল শহরগুলোর অন্যতম, তোমাদের সরকারি হাসপাতালগুলো সমাজবিরোধীদের আখড়া । এখানে তো বিনা চিকিৎসায় রোজ কতজন মারা যায় তার ইয়ত্তা নেই , না খেতে পেয়ে মানুষ মরছে ; ডিটেকটিভ থাকাটা তোমাদের সমাজে বিলাসিতা , একটা-দুটো খুনে কী-ই বা এসে যায় এরকম সমাজে !
মায়ের শাঁখা-নোয়া পরা বাঁ হাত নিজের দু হাতে নিয়ে রিমা বলল, আমি শুনে-শুনে শুধু ইয়েস স্যার ইয়েস স্যার ইয়েস ম্যাম ইয়েস ম্যাম করে গেলুম ।
—অসত্য বলেনি তো মা । তা তুই তোর কেসের কোনো সুলুক সন্ধান পেয়েছিস ? কেসটাই বা কেমনতরো, রিমার মা শুধোলেন ।
—দুপুর থেকে তা-ই তো চিন্তা করছি , বলল রিমা । যে লোকটা মরে গেছে তার কংকালই কেবল রয়েছে ; মেয়ে না পুরুষমানুষ তা জানি না , আর তার কুকুরের কংকাল রয়েছে আমাদের মালখানায় । আমার আগের অফিসাররা হাতের টিপছাপ সংগ্রহ করেছিলেন ঘরগুলো থেকে, তা পুলিসের ফাইলে রাখা কোনো অপরাধীর সঙ্গে মেলেনি । একগাদা কমপিউটার ডিস্ক পাওয়া গেছে, গানের, বাজনার, নাচের ; কয়েকটা তেলেগু ভাষায় ইজকুড়ি-বিজকুড়ি লেখা বলে আগের অফিসাররা আগ্রহ দেখাননি । ল্যাপটপ বা টেবিলটপ কমপিউটার পাওয়া যায়নি ।
রিমার মা বললেন, তুই কোনো ডাকতার দেখা ।
—ডাকতার আবার কী দেখাব , আমার কিছু হয়েছে নাকি ? শুধু ক্লান্ত, ব্যাস, রাগতস্বরে বলল রিমা ।
সুনয়না বললেন, পুলিস ইন্সপেক্টারবাবু, তোর অসুখের কথা বলিনি । বলছি যে কংকালটা কোনো ডাকতারকে দেখা , তারা তো জানবে যে ওটা মেয়ের না ছেলের, কেমন করে মরল, কবে মরল ।
চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল রিমা । বলে উঠল, আরে ঠিক বলেছ তো । কোন দিক দিয়ে এগোবো বুঝতেই পারছিলাম না । লোকটার লেখা পড়তে-পড়তে তাইতেই মশগুল হয়ে পড়েছিলাম ।
সুনয়না বললেন, যে-লোকটা মরেছে, মানে যার কংকাল, তারও তো কোনো ডাকতার ছিল , তারও অসুখ-বিসুখ করত নিশ্চয়ই । খোঁজখবর নে, দ্যাক গিয়ে আসেপাশে কোনো ডাকতার-টাকতার বা হাসপাতাল আছে কিনা । লোকটার আত্মীয়-স্বজন কেউ তো হবে ? অমন মানুষ হয় নাকি যার ভূভারতে কেউ নেই ?
রিমা বলল, চলি মা, তোমার কথামতন এগিয়ে দেখি । নিচে নেমে মোটর সাইকেলে স্টার্ট দিয়ে রিমা সোজা ঘটনাস্হলে পোঁছাল। দশ বছর আগে বাঙলোটার ধারে-কাছে কোনো ঘরবাড়ি ছিল না । কেবল বাঙলোবাড়িটা ছিল , একটা ফাঁকা মাঠের মধ্যে । যেমন-যেমন ফ্ল্যাটবাড়ি উঠেছে, এলাকাটার নাম হয়ে গেছে কংকাল-বাঙলো পাড়া । পাড়ার লোকেদের কাহিনী অনুযায়ী , বাঙলোবাড়িটায় রাতে অনেকগুলো কংকালভুত ঘুরে বেড়ায় , তারা ঘুঙুর পরে নাচে, গান গায়, বাজনা বাজায় , মেয়ে কংকালগুলো হাসাহাসি করে ; তাই বাঙলোটার মাঠের কাছাকাছি ফ্ল্যাটবাড়ি তৈরি হয়েছে, কিন্তু বিক্রি হয়নি , ভয়ে কেউ আসতে চায়নি । নতুন তৈরি বিল্ডিঙগুলোতে শ্যাওলা জমে কালচে হয়ে যাচ্ছে । এই বিল্ডাররাই চাইছে কেসটার তাড়াতাড়ি হিল্লে হোক , খুনি ধরা পড়ুক , বা রহস্যটার বিশ্বাসযোগ্য সমাধান হোক ।
রিমা এক নজরে বাঙলোবাড়িটা দেখে নিয়ে মোটরসাইকেলে থ্রটল ঘুরিয়ে প্রথম গেল গোবিন্দর সেলুনে , বিশ্বকর্মা হেয়ার কাটিং স্টুডিও, গোবিন্দ যে ফোটোগ্রাফার হতে চেয়েছিল , তার নিদর্শন । একটা চেয়ার খালি আছে , উঁকি মেরে দেখে ঢুকলো রিমা ; অন্য দুটো চেয়ারে দুজন ঘুমন্ত বৃদ্ধ চুল কাটাচ্ছেন । বুড়োরা বোধহয় সন্ধ্যাবেলা চুল কাটায় , নিজেকে বলল রিমা । ওর সমান্তরাল চিন্তা ওকে বলল, খগেনের কাছ থেকে খবর নেয়া যাক । খগেন গোবিন্দর ছেলে , দুটো নাপিত রেখে সেলুনটা চালাচ্ছে , বাস চাপা পড়ে গোবিন্দ মারা যাবার পর । ফাঁকা চেয়ারটায় গিয়ে বসতে বৃদ্ধ দুজন এক পলক দেখে নিয়ে নিজেদের নাপিততন্দ্রায় ফিরে গেলেন । ওপরের উঁচু তাকে রাখা মিউজিক সিসটেমে হিন্দি গান বাজছে ।
খগেনকে রিমা বলল, চেঁচিয়েই বলল, নে, বয়কাট করে দে , কানের ওপর চুল এসে গেছে, সুড়সুড়ি লাগে । আর তোর এই হিন্দি গান বন্ধ কর , কত ভালোভালো বাংলা গান আছে, সেসব বাজাতে পারিস না ?
মিউজিক সিসটেমের সুইচ অফ করে খগেন বলল, ওই দ্যাখো, তোমার ফোটো, মোবাইলে তুলেছিলুম, এনলার্জ করিয়ে টাঙিয়ে রেখেছি । ছোটকুর কমপিউটার দোকানে গিয়ে মোবাইল থেকে তোমার রঙিন ফোটো বানিয়ে নিলুম । কেন জানো ? তুমিই আমার একমাত্তর মেয়ে খদ্দের । আর তোমার নাম তো পৃথিবীতে সক্কোলে জানে । গর্বভরে বলল খগেন প্রামাণিক । তারপর ফিসফিস করে জিগ্যেস করল, চাকরিতে বহাল হলে ? যাও দুচারটাকা তোমার কাছ থেকে পেতুম, তাও তো বন্ধ ।
খগেন রিমার ইনফরমার বাহিনীর একজন । অনেকে চুল কাটতে আসে ওর সেলুনে , আর ও গল্প শুরু করে খবর আদায় করার মতলবে । কোনো একটা সূত্র পেলেই হল , রিমা তা অনুসরণ করে বেশ কয়েকটা আসামি ধরেছে ।
রিমা বলল, হ্যাঁ, একটা কেস বিশেষ করে আমাকেই দিয়েছেন ডিজি । জানিস তো, আমার থানায় কোনো কেস ঝুলে থাকত না । সমাধান করে তবে শ্বাস নিয়েছি । তুই ওই কংকাল-পাড়ার বাঙলোবাড়ির বিষয়ে জানিস কিছু ? এই যে রে , নতুন পাড়ার মাঠের ওপারে, কংকালবাঙলো পাড়ায় ?
—ও তো ভুতুড়ে বাড়ি গো । ওর ধারে-কাছে যায় না কেউ । চুল ছাঁটার বদলে কাঁচির বাজনা আর আঙুলের নাচ বেশি তুলছিল খগেন । ওই বাড়িটার গল্প নিয়ে নাকি হিন্দিতে ভুতবাংলা নামে একটা ফিলিম হয়েছিল , হিরো মামুদ মিউজিক আর ডি বর্মণ ; বাবার মুখে শুনেছিলুম । আমি তো জম্মে ও-মুখো হইনি ।
—ওই বাঙলোবাড়ি ভিষণ অপয়া , বলল জনৈক চুলকাটিয়ে বৃদ্ধ , ঝিমন্ত অবস্হাতেই । তারপর যোগ করল, আমিও মেশোমশায়ের কাছে শুনেছি ; রাতের বেলায় বাঙলোবাড়িটায় নীল আলো জ্বলত আর হিন্দি ফিলিমের গান বাজত , কখনও-কখীনও বিলিতি গান বাজতো । মেশোমশায় বলেছিলেন, ওই গান শোনার পরেই উনি কালা হয়ে যান ।
—ওটা হরিচরণ দত্ত নামে একজন জমিদারের বাগানবাড়ি ছিল, দিনাজপুর না মালদা কোথাকার জমিদার-জোতদার , অনেক জমিজমার মালিক ; সে বাইজি নাচাত বাড়িটায়, হিন্দুস্তানি বাইজিরা সারা রাত নাচত ওই বাড়িতে ; ওই বাড়ির ভেতরে গেলে মেয়েদের কিমারীত্ব সঙ্গে-সঙ্গে নষ্ট হয়ে যায় বলে শুনেছি । অন্য বৃদ্ধ, যাঁর চুল কাটানো হয়ে গিয়েছিল, জামা থেকে চুল ঝাড়তে-ঝাড়তে বলল।
—ওনার কি কেউ ছিল সন্তান ? জানতে চাইল রিমা । যে বহুবার ঢুকেছে বাড়িটায় আর এখনও যার কুমারীত্ব, পুরুষের বা লেসবিয়ানের দ্বারা ভাঙেনি; ওর নিজের মতে ইনট্যাক্ট — ম্যাস্টারবেশানে যদি কুমারীত্ব নষ্ট হয়ে থাকে তাহলে কোনো তরুণীই কুমারী আর কোনো যুবকই কুমার থাকে বলে মনে হয় না । তেনশান কমাতে ও মাঝে-মধ্যে ম্যাস্টারবেট করে ।
আয়নার দিকে তাকিয়ে, নিজেকে চোখ দিয়ে আদর করতে-করতে আর চুল আঁচড়াতে-আঁচড়াতে বৃদ্ধ বলল, তা জানি না, আমি তখন শহরের দক্ষিণে থাকতুম । মেসো ওনার বাড়িটা আমাকে লিখে দেবার পর গেল বছর এ-পাড়ায় এসেছি । তা তোমাকে তো চেনা-চেনা মনে হচ্ছে গো, কোথায় দেখেছি যেন ?
খগেন বলল, ইনি রিমা খান , বিখ্যাত পুলিস অফিসার , সাদা পোশাকে বলে চিনতে পারছেন না ; রিমাদি একবার উর্দি পরলে ওনার রোয়াব দেখে কে ? কোথায় দেখেছেন জানেন ? টিভিতে আর খবরের কাগজে , ওনার বিষয়ে রসালো সব গপ্পো বেরিয়েছিল গত বছর । টিভিতে চ্যাংড়ারা ওনার নাম দিয়েছিল….
—নোংরা পরি । খগেনের কথা মাঝপথে থামিয়ে বলল রিমা ।
—ও, তুমিই সেই পুলিসনি ; তুমি তো বিখ্যাত মহিলা গো ; তা লোকটা কি সত্যই লক আপে মরেছিল , না আগেই মরে গিসলো ? যে বৃদ্ধর দাড়ি কামিয়ে দিচ্ছিল খগেনের কর্মী রেজাউল, জানতে চাইল সেই বৃদ্ধ ।
—না, পিটিয়ে মেরে দিয়েছিলুম ; আর খভাতি জিনিসটা অন্যলোকে দেয় না স্যার , পাবলিকও দেয় না, ওটা আত্মআবিষ্কারের ব্যাপার , নিজেকে খুঁজে পাবার রহস্য , বুঝলেন দাদু । খ্যাতি জন্মায় উদ্বেগ-উৎকন্ঠা থেকে । নিজের ভেতরকার উদ্বেগ-উৎকন্ঠা , সাংসারিক দুশ্চিন্তা নয় , ঘাড় ঘুরিয়ে বলল রিমা ।
—আরে কি আবোল-তাবোল বকছ রিমাদি , পাবলিক ভাববে তুমিও থার্ড ডিগ্রি ঠ্যাঙাও । বলে উঠল রেজাউল । যার চুল কাটছিল, আয়নার দিকে তাকিয়ে তাকে বলল, গুণ্ডাটা অন্য একটা লোককে খুন করে তাকে নিজেরই নাম দিয়ে শ্মশানে নিয়ে গিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিল , আর তারপর মরা লোকটার আত্মপরিচয় নিয়ে দিব্বি কুকম্মো করে বেড়াচ্ছিল । রিমাদিই তো ধরেছিলেন ব্যাটাকে ; এখন তার মুখ থেকে তার অপরাধ না জানতে পারলে ঘুণ্ডাটা তো সারাজীবন ওই মরা লোকটার নামে নিজেকে চালাত, খুন করেও পার পেয়ে যেত । টিভিঅলারা পাবলিককে বুঝিয়েছিল যে শ্মশানে যে গুণ্ডাটা পুড়েছে সেটাকে রিমাদিই মেরে ফেলেছিলেন ।
রিমা গম্ভীর কন্ঠে চিবিয়ে-চিবিয়ে বলল, যে ক্রিমিনালরা জেরা করার সময়ে আমার পায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে তাদের দু-ডিগ্রি ঠ্যাঙাই, যারা মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে তাদের থার্ড ডিগ্রি ঠ্যাঙাই । যারা আমার বুকের দিকে তাকিয়ে থাকে তাদের ঠেঙিয়ে কথা আদায় করি না , আমার সাবইন্সপেক্টারের ওপর ছেড়ে দিই মিষ্টি-মিষ্টি কথা বলার জন্যে । এক ডিগ্রি বলে কোনো ঠ্যাঙানি হয় না ।
—কি বলছ রিমাদি , দেখছ বয়স্ক লোক এখানে , বলল খগেন ।
রিমা মুচকি হাসি ঠোঁটে মাখিয়ে বলল, এতে লুকোবার কি আছে ! তুইওতো চুল কাটতে-কাটতে আমার বুকের খাঁজ দেখছিলি, আয়নায় তোর কিত্তি দেখা যাচ্ছিল রে । পুরুষরা যুবতীদের দেখার সময়ে সবচেয়ে প্রথমে বুকের দিকে তাকায় , সেটাই স্বাভাবিক, মাদার-সান ইন্সটিংকট, মানে মা-ছেলে সম্পর্কের চেতনা । যে-ক্রিমিনালরা বুকের দিকে তাকায় , বুঝতে হবে ব্যাটা ততো বজ্জাত নয় ; আর আমার বুক নকল নয়, সিলিকন-পোরা নয়; কোনো প্রেমিকও ছিল না কস্মিনকালে যে তার ছোঁয়ায় ফুলে উঠেছে আজকালকার খুকিগুলোর মতন ।
—একেই বলে মডার্ন মেয়ে , এক বৃদ্ধ আরেক বৃদ্ধকে বলল, পার্স থেকে টাকা বের করে । দুজন বৃদ্ধই সারা মুখে খাঁটি ওথলানো-বুক দেখার আনন্দ ফুটিয়ে বেরিয়ে গেল সেলুন থেকে । বাইরে বেরিয়ে একজন আরেকজনকে বলল, এবার থেকে কালো চশমা পরতে হবে বুঝলে । আমিও মেয়েদের দিকে তাকালেই সবচে আগে বুকের দিকে তাকাই । ছুঁচলো-ছুঁচলো বডিস পরে ঘোরে, দেখেছেন, কচি-কচি মেয়েরাও । চোখের এমন অভ্যাস হয়ে গেছে ইসকুলে পড়ার সময় থেকে যে মন না চাইলেও চোখ চেয়ে ফ্যালে ।
অন্য বৃদ্ধ বলল, আজগাল বাংলা ফিলিমেও তো নায়িকারা বুকের খাঁজ দেখিয়ে নাচে । যাদের ভগবানের দেয়া খাঁজ নেই তারা বিদেশে গিয়ে শল্যচিকিৎসা করিয়ে নকল খাঁজ বানিয়ে আনে । কীই বা করবে বলুন , প্রতিযোগীতার বাজার ; নজর কাড়তে হলে করতেই হবে । তবে এখনকার মেয়েদের খাঁজগুলো বেশ মিষ্টি । উদারীকরণের মিষ্টতা ।
রেজাউলের দিকে তাকিয়ে খগেন বলল, রিমাদিও ক্যারাটে জানেন , একাই যে-কোনো লোককে পেড়ে ফেলতে পারেন ।
—উঁহু উঁহু, বাধা দিয়ে বলল রিমা , ক্যারাটে নয়, আমি যেটা শিখেছি তার নাম এসক্রিমা , ফিলিপাইনসের আত্মরক্ষার টাকনিক । চিরুনি , কলম, খবরের কাগজ, চটি, হাতের কাছে যা আছে তা দিয়েই আত্মরক্ষা করা যায় , আবার ধরেও ফেলা যায় আসামিকে, কোনো শারীরিক আঘাত না করে । সাবইন্সপেক্টার থাকার সময়ে আমাকে পাঠানো হয়েছিল রাধিকা শেখের ন্যাশানাল স্কুল অব কমব্যাট আর্টে , মুম্বাইয়ের ওরলিতে । বোরখা-পরা মেয়েরাও শেখে, বোরখা না খুলেই আত্মরক্ষা আর আক্রমণের টেকনিক শেখে। রাধিকা ম্যাডাম নিজে বোরখা পরে ডিমন্সট্রেট করতেন । এসক্রিমা শিক্ষার স্লোগান ছিল, ‘সাপকে না মেরে তার বিষদাঁত খুলে নাও ‘।
—এসক্রিমা ! তুমি তো পেঁদিয়ে আইসক্রিম বানিয়ে দাও । হাঃ হাঃ । এবার বলো , কেসখানা কি ? রিমা চেয়ার থেকে নামলে টাকা নিয়ে পকেটে রেখে জিগ্যেস করল খগেন ।
—ওই বাঙলোবাড়িটায়, পাঁচ বছর আগে, যিনি সে-সময়ের থানা ইনচার্জ ছিলেন , তিনি ভিন্নসূত্রে সেখানে একটা কংকাল আবিষ্কার করেছিলেন । কংকালটা বিছানায় আধশোয়া হয়ে পড়েছিল আর তার পাশে মেঝের ওপর একটা কুকুরের কংকাল । মানুষের কংকালটা যেখানে ছিল সেখানেই পড়ে আছে , কুকুরের কংকালটা উনি মালখানায় রাখিয়ে দিয়েছিলেন । এখন আমাকে দাবিত্ব দেয়া হয়েছে কংকালটা খুন হয়েছিল নাকি আত্মহত্যা করেছিল তা অনুসন্ধান করে বের করতে । খুন হয়ে থাকলে খুনিকে খুঁজে বের করতে হবে , আর আত্মহত্যা হলে যে দায়ি তাকে বের করতে হবে । তোকে একদিন নিয়ে যাব, বলল রিমা ।
—না না না না , শেষে মরি আর কি , আমার খুব ভুতের ভয় । আঁৎকে উঠে, হেঁচকি তুলে, খগেনের কন্ঠ থেকে দ্রুত কথাগুলো বেরোল । তারপর, রিমা, সাহায্যের হাত গুটিয়ে নিতে পারে আশঙ্কায় বলল, এই কেসের জন্যে অন্য কি কাজে লাগতে পারি তা বলো ।
নিজের ভাবনা খগেনকে দিয়ে ভাবাবার উদ্দেশে রিমা ওকে জিগ্যেস করল, আচ্ছা, কংকাল বললেই তোর মনে কোনো মানুষের ছবি তৈরি হয় কি ? মহিলা না পুরুষের ? আমি তো কেসটা নেয়া অব্দি কুকুরের কংকালের জায়গায় কুকুরটার একটুখানি , শাদা-কালো চামড়ার ছিল বলে, মনের মধ্যে কুকুরের ছবি তৈরি করে নিতে পারছি, কিন্তু কংকাল শুনলে, দেখার পরও, বুঝতে পারছি না, লোকটাকে কেমন দেখতে ছিল ।
রেজাউল জ্ঞানীর ঢঙে বলল, ঠিকই বলেছেন রিমাদি, কংকাল বললে মনে হয় কংকাল জিনিসটা আলাদা আর মানুষ জিনিসটা তার থেকে আলাদা । অথচ কুকুরের কংকাল আর কুকুর যেন একই ব্যাপার । তাই তো বলে, যে, সবার উপর মানুষ সত্য তাহার উপর নাই ।
সেলুন থেকে বেরিয়ে, মোটর সাইকেলে স্টার্ট দিয়ে রিমা বলল, যাই, মা কিছু আইডিয়া দিয়েছে, সেই দিক দিয়ে এগোই । তোরা থুথ্থুরে বুড়োরা চুল কাটাতে এলে তাদের কাছ থেকে বাঙলোবাড়ির খবর-টবর পেলে যোগাড় করে রাখিস ; আগামি সোমবার আসব ।’
তিনজনেই একসঙ্গে বলে উঠল, মাসিমা ! পুলিসের মা তো !
রেজাউল বলল, আপনার বাবাও পুলিসে ছিলেন , তাই উনিও কেসের ব্যাপার শুনে-শুনে খুনি ধরার ফাঁদগুলো জেনে ফেলেছেন ।
রিমার সুজুকি হায়াবুসা লাল-কালো মোটর সাইকেলের আওয়াজ মিলিয়ে যেতে রেজাউল স্বগতোক্তি করল, মহিলা বটে একখানা , নিজের মাইয়ের কথা আমাদের খোলাখুলি বলছে , বুড়োগুনোও শুনছে তাতেও পরোয়া নেই, ওফ ।
শুনে, খগেন মুচকি হাসি দিয়ে, যে হাসির মানে, হেঃ হেঃ, আমি অনেক-কাল থেকে রিমাদির চুল কাটছি , কলেজে পড়ার সময় থেকে, রিমাদির বয়-কাট, সেই থেকে বিউটি পারলারে যায় না ।
রেজাউল ভুরু কুঁচকে বলল, তুই অমন হাসছিস যে ? ভুল বলেছি ? মাইয়ের সাইজ দেখেছিস ? টুসকি মারলে টন-টন শন্দ উঠবে । শুধু মাই ? রিমাদির রঙও কত ফর্সা অথচ ওনার মা অত ফর্সা নয় । রিমাদি বোধহয় নিজগুণে ফর্সা।
—আসলি জিনিস । খগেন সবজান্তার হাসি মুখময় ছড়িয়ে বলল, চুল কাটতে-কাটতে দেখে ফেলি, ওফ, ভেতরে পরেও না কিছু, গুঁড়ো-গুঁড়ো পাউডার লেগে থাকে ; ওই কাপসাইজের হয় না বোধহয় বাজারের বডিস !
পিনাকি, যে এতক্ষণ কোনো কথা বলেনি, বলল, হবে না কেন, বিলেতে তো কতো বড়ো বড়ো মাই হয় , ইংরিজি ফিলিমগুলোয় দেখিসনি ? কি এক-একখানা বুক, প্রাণ জুড়িয়ে যায় । তারপর যোগ করল , এতক্ষণ তোদের মুখে রা ফোটেনি , যেই রিমা খান গেল ওমনি তোদের পোঁদে খই ফুটছে । রিমাদি তোদের দুজনের চেয়েও লম্বা , এমন একখানা লাথি দেবে না, যে বংশের সম্পত্তি ফেটে নকশালবাঁড়া বেরিয়ে যাবে । রিমাদি পুলিসে ঢুকতে গেল কেন কে জানে , অমন ভালো ফিগার, দেখতে-শুনতে ভাল, গলার স্বরও মিষ্টি, পাতলা ঠোঁট, ফিলিমে যেতে হলে যা-যা দরকার ।
রেজাউল বলল, ওনার সামনে ওনার বিষয়ে মুখ ফসকে কথা বেরিয়ে গেলে পোঁদের চামড়া খুলে নেবে । যে-সে পুলিস নয় চাঁদু, প্যাঁদাতে ওনার জুড়ি নেই ; যে এলাকায় ওনার পোস্টিং হয় , সেখানের গুণ্ডারা সে এলাকা থেকে পালায় ; নেতাদের কথাও শোনেন না । নেতার টিভি চ্যানেলেই তো ওনাকে নোংরা পরি নাম দিয়েছে । চ্যানেলটা নাকি ওনাকে সাবানের মডেল হতে বলেছিল । সাবানের মডেল হলে দারুণ হতো , ওফ, শাওয়ারের তলায় খালি গায়ে রিমাদি, পেছনে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক, ভাবতেও ভাল্লাগে শালা ।
বাঙলোবাড়িটার দু-কিলোমিটারের মধ্যে যে ডাকতাররা আছে , ওষুধের দোকানগুলোয় খোঁজ নিয়ে-নিয়ে তাদের একটা তালিকা আড়াই দিনে তৈরি করল রিমা । ওষুধের দোকানগুলোয় খোঁজ নিয়ে মোটর সাইকেলে ঘুরে-ঘুরে তাদের চেম্বারগুলো কোথায় তা টুকে রাখল নিজের ডায়রিতে । বাঙলোবাড়ি থেকে যে-সমস্ত সামগ্রী প্রথম ও দ্বিতীয় ইনভেসটিগেটিং অফিসাররা বাজেয়াপ্ত করেছিলেন, তা থেকে জানা যায়নি যে মৃত ব্যক্তির কোনো ডাকতার ছিল কিনা । ওষুধের শিশি বা বড়ির কভার বা প্রেসক্রিপশান কিছুই পাননি তাঁরা । যা জিনিসপত্র পাওয়া গেছে, আর যা-যা পাওয়া উচিত ছিল অথচ পাওয়া যায়নি, রিমার অনুমান, মৃত্যুটা স্বাভাবিক নয় । হয় আত্মহত্যা নতুবা হত্যা । কংকাল প্রেমিক যাকে শেষনি বলে উল্লেখ করেছে সে আদপে ডাকতার না নার্স না সহায়ক স্পষ্ট টের পাওয়া যাচ্ছে না । কংকালটা সব ব্যাপারে এমন হেঁয়ালি করেছে যে মনে হয় খুন হবার জন্যে তৈরি হচ্ছিল ।
প্রশ্ন হল মোটিভ কী ? রিমা নিজেকে প্রশ্ন করল, মোটিভ কী ? কেউ খুন করে থাকলে সে কী জন্যে খুন করেছে ? বাড়িটা তো পড়ে রয়েছে পাঁচ বছর যাবত যেমনকার তেমন । সম্পত্তির জন্যে হলে সবচেয়ে আগে তো খুনি অতবড় বাড়িটাই হাতাত— কংকাল প্রেমিককে বাগানে পুঁতে দিলেই ব্যাস নিশ্চিন্ত । বাড়ির ভেতরেও দামি আসবাব তছনছ করা হয়নি । দামি-দামি কিউরিওগুলোতেও হাত দেয়নি কেউ । সরানো হয়ে থাকতে পারে নিবেশের কাগজপত্রগুলো ; আবার কংকালটা নিজেই সেসব ভাঙিয়ে ফেলে থাকতে পারে মরবার আগে । বাড়ির মধ্যেকার সাজানো গোছানো জিনিসপত্র দেখে মনে হয় , লোকটা, মারা যাবার সময়ে যেমন ছিল, তেমনই পড়ে আছে । তাহলে ?
ডিজিকে অনুরোধ করে কালকেই একজন বিশেষজ্ঞ ডাকতারকে নিয়ে গিয়ে সরেজমিন তদন্ত করবে, ঠিক করল রিমা, বিশেষজ্ঞ ডাকতারের মতামত নিয়ে নিশ্চিত হবে যে ঠিক কী কারণে মারা গেল কংকালটা ।
অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল । রিমা বাঙলোবাড়িটায় পৌঁছে, মোটর সাইকেলের আলো বাড়িটার বাগানের দিকে ফোকাস করে ঢুকলো । বেশ কিছুক্ষণ বাগানের আগাছা সরিয়ে ঘুরে-ঘুরে মাটিতে দেখতে লাগল সূক্ষ্ম কিছু পাওয়া যায় কিনা, যা দিনের আলোয় পায়নি । কয়েকটা মরা পিঁপড়ে দেখতে পেয়ে খুঁটে-খুঁটে তুলে বারবার শুঁকলো , পকেট থেকে রুমাল বের করে মুড়ে রাখল তাতে । ওর মনে হল এগুলো কাঠপিঁপড়ে । মোটর সাইকেলে বসে একটা সিগারেট শেষ করার পর ফরেনসিক ল্যাবের পথা রওনা হল ।
ফরেনসিক অ্যানালিস্ট রুচিষ্মিতা ঘোষ তখনও ছিলেন ল্যাবে । টেবিলে রাখা কোনো জিনিস খুঁটিয়ে দেখছিলেন, সাদা চোখেই । রিমাকে দেখে বললেন , কি রিমা, কিছু পেলেন ? আপনি তো কেসটা নেয়া অব্দি হাওয়ায় ছড়ি ঘোরাচ্ছেন বলে শুনেছি ; এখনও নাকি নিশ্চিত হতে পারেননি যে খুন না আত্মহত্যা ।
রিমা রুমালে-মোড়া পিঁপড়েগুলো টেবিলের ওপর রাখতে যাচ্ছিল , রুচিষ্মিতা উঁহু উঁহু করে একটা ছোট্টো কাচের পাত্র এগিয়ে দিলেন । রিমার দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করলেন, সন্দেহটা কি ?
—গন্ধ থেকে মনে হল পেস্টিসাইড । এতকাল পরও পেস্টিসাইডের গন্ধ রয়ে গেছে , বেশ স্ট্রং কোনো কেমিকাল, কিংবা প্রায়ই পেস্টিসাইড ছড়ানো হচ্ছে । আমার তিনটি জিজ্ঞাস্য । প্রথম, পেস্টিসাইডটা কি ? দ্বিতীয়, কতদিন আগে ছড়ানো হয়ে থাকতে পারে বলে অনুমান । তৃতীয়, পিঁপড়েগুলো কোন জাতের ?
—দারুণ । প্রথম দুটির উত্তর আমি তৈরি করে রাখব । তৃতীয়টার জন্য আপনি রাজ্যের এনটোমলোজিস্টকে অনুরোধ করুন । তবে প্রথম দর্শনে পিঁপড়েগুলোকে ডরিলাস প্রজাতির মনে হচ্ছে । যাহোক, পথ খুঁজে পেয়েছেন দেখছি । পরশু বিকালে ফোন করবেন । জানতে পারি কি যে এখান থেকে কি ভাবে এগোবেন ?
—মোটিভ, মোটিভ । মোটিভটা পাচ্ছি না । একটা বাচ্চা মেয়েকে পিঁপড়ের ঝাঁক আক্রমণ করেছিল বাঙলোবাড়ির বাইরে , পাঁচ বছর আগে । বাঙলোর ভেতরে সেই পিঁপড়েগুলো যদি এখনও থেকে থাকে, তাদের গায়ে পেস্টিসাইডের গন্ধ থাকবে নাকি !
—না থাকবে না । গ্রীষ্ম বর্ষা শরৎ হেমন্ত শীত বসন্তে পাঁচ বছর আগের সেসব পিঁপড়েদের মৃতদেহ মাটির সঙ্গে মিশে যাওয়াই স্বাভাবিক ।
—তার মানে, কেউ পেস্টিসাইড রেগুলারলি স্প্রে করাচ্ছে বা সম্প্রতি করিয়েছে ।
—কোনো কন্সটেবলকে লক্ষ রাখতে বলুন না, রাতের বেলায় ।
—আমার তো হিউমান রিসোর্স নেই । জানেন তো, নিলম্বিত, আই মিন সাসপেন্ডেড । একজন সাবইন্সপেক্টার পেয়েছি , তাকে আর কত খাটাব । দেখি আমার কয়েকজন প্রাইভেট শিষ্য আছে , তাদের বলে দেখব । আপনার কাছ থেকে স্প্রে করানোর ফ্রিকোয়েন্সি জানতে পারলে সুবিধা হবে ।
ল্যাবের টয়লেটে গিয়ে রিমা ঠোঁতের ওপর ফিকে গোলাপি লিপ্সটিক বোলালো । নিজেকে ও ভালোবাসে । আয়নায় মুখ ঘুরিয়ে নিজেকে নানা দিক থেকে দেখে সন্তুষ্ট হল । অ্যাট্র্যাকটিভ লেডি, বলল আয়নার দিকে প্রতিফলিত নিজেকে, অ্যান্ড রুথলেস টু ।
Tagged ডিটেকটিভ উপন্যাস |
৬. পিট বুল
হরিশচন্দ্র স্ট্রিটের মোড়ে পরাশর বর্মাকে দেখতে পেয়ে, মোটর সাইকেল থামিয়ে, পাশে দাঁড় করিয়ে, ওনার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল রিমা । পরাশর বললেন , আরে তুই ? চাকরি ফিরে পেয়ে গেলি নাকি ? তোর বিষয়ে খবর পড়ে আর টিভিতে দেখে মনটা সত্যিই খারাপ হয়ে গিয়েছিল । তা এদিকে কি জন্যে ? তোরা তো উত্তরে চলে গেছিস বলে জানি ।
রিমা বলল, হ্যাঁ কাকু, আমরা ওদিকে চলে গেছি । এসেছিলাম কালীঘাটে ; এখানের এক পুজারী আমার ইনফরমারের কাজ করেন , তাঁকে একটা কেসের ব্যাপারে বলে এলাম । আপনার কাছেই যাচ্ছিলাম , একটা খুনের কেসের কিনারা করার ব্যাপারে পরামর্শ নিতে ।
পরাশর বললেন, আমি তো, প্রেমেন মারা যাবার পর কাজ ছেড়ে দিয়েছি ; বয়সও হয়েছে, দেখতেই পাচ্ছিস । তাছাড়া সময়টা বড্ডো খারাপ , যখন-তখন রাস্তায় লাশ পড়ছে, খবরের কাগজ খুললেই প্রথম পাতায় হিসাব দেয়া থাকে কোথায় কজন দলাদলি করে খুন হল । ডিটেকতিভকে এককালে বলা হতো সত্যান্বেষী , আর এখন সত্য যে কাকে বলে তা-ই তর্কসাপেক্ষ । একাধিক সত্য হলে কী অন্বেষণ করবে মানুষ ? সত্য এবং মিথ্যার ফারাকও প্রায় নেই বললেই চলে , তা সে সংসদে বল বা বিধানসভায় । মনটা খারাপ থাকে রে , কীই বা বলি ! প্রেমেনের বাড়িটার স্মৃতি ঝালাই করতে এদিকে এসেছিলাম , কিন্তু কে একজন কেন্দ্রিয় নেতার আগমন হবে বলে ঢোকার বেরোবার কড়াকড়ি দেখে ফিরে যাচ্ছি ।
রিমা জিগ্যেস করল, আপনার হাতে সময় আছে ?
পরাশর বর্মা বললেন, এখন তো সময়ই সময় , সময় কাটানোই কঠিন , টিভি দেখতে ভালো লাগে না । সংবাদপত্র, এক্ষুনি যা বললাম, পড়া মানে নিজেকে কষ্ট দেয়া । আমাদের কালের মতন সরাসরি খবর তো আর পরিবেশন করে না মিডিয়া ; সবেতেই নুন-লঙ্কা মিশিয়ে খবর বানায় , তাতে পদ্য-লিখিয়েরা ওপর থেকে পোঁচ দেয় ।
তাহলে আমার সঙ্গে চলুন, আপনার বিশেষজ্ঞ মতামত দেবেন , তারপর আমি আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দেব , রিমা বলল ওনাকে ।
কোথায় যেতে হবে রে ? জিগ্যেস করলেন পরাশর, তারপর স্বগতোক্তির সুরে বললেন, মোটর সাইকেলে কি বসতে পারব ? আচ্ছা চল, যাই । তুই মেয়ে হয়ে মোটর সাইকেল চালাচ্ছিস, আমি না হয় মেয়েদের মতন একপাশে পা ঝুলিয়ে যাব, বললেন পরাশর ।
মোটর সাইকেলে পরাশর বর্মাকে বসিয়ে রিমা ওনাকে নিয়ে গেল থানার মালখানায় । হাত ধরে ওসির ঘরে নিয়ে গিয়ে, এক গ্লাস জল খাইয়ে ওনাকে মালখানার ভেতরে নিয়ে গেল । ভেতরটা এমন ধুলো-পড়া যে পরাশর নাকে রুমাল চাপা দিয়ে বললেন, আমার আজকাল ধুলোর অ্যালার্জি দেখা দিয়েছে । তা কিসের ব্যাপারে জানতে চাস ?
বাঙলোবাড়িতে কুকুরের যে কংকাল পাওয়া গেছে তার ওপর থেকে প্লাসটিকের চাদর তুলে রিমা জিগ্যেস করল, এই কুকুরটা কোন ব্রিডের আর এর বিশেষত্ব কী ? কুকুরের এই কংকালটা পাওয়া গেছে একজন মানুষের পাশে । মানুষটা কে ঠিকমতন আইডেনটিফাই করা যাচ্ছে না । যতটুকু জেনেছি, কংকাল ভদ্রলোক কুকুর পুষতেন না । তাহলে কুকুরটা তাঁর পাশে এলো কোথা থেকে, কোন উদ্দেশে , এবং কুকুর আর মানুষটির রহস্যটা ঠিক কী ? আমার মনে হয় কুকুরটাকে যদি আইডেনটিফাই করতে পারি, তাহলে কুকুরের মালিককেও খুঁজে বের করতে পারব । কুকুরটা দেখুন না কেমন বিদকুটে কাঠামোর ।
কংকালের চারপাশে প্রদক্ষিণ করলেন পরাশর, খুলিটা দেখলেন কাছ থেকে, যেটুকু চামড়া টিকে আছে কুকুরটার তাও খুঁটিয়ে দেখলেন । মাটিতে উবু হয়ে বসে দেখলেন । উঠে দাঁড়িয়ে চিন্তামগ্ন হলেন । নিষ্কর্ষে পোঁছোতে সময় নিলেন মিনিট দশেক । তারপর বললেন, আমি যা বলছি তা তুইম লিখে নিবি তো ? লিখে নিলে ভালো হয় । তুই তা দেখাতে পারবি তোর ভেটেরিনারি দাকতারকে , কেননা কোর্টে তো আমার মতামতের গুরুত্ব নেই , আমি একজন বেসরকারি লোক ।
—আপনি বলুন কাকু, আমি আমার এই ছোট্ট টেপরেকর্ডারে ধরেরাখছি । বলল রিমা ।
পরাশর বললেন, তোদের কত সুবিধা হয়ে গেছে, আমাদের সময়ে এই সমস্ত টেকনিকাল গ্যাজেট ছিল না । হ্যাঁ, শোন, এটা হল পিট বুল প্রজাতির কুকুর , বিদেশ থেকে এনে থাকবে, যে-ই এনে থাকুক , তা সে কোনো ডগ কেনেলের মালিক হোন বা ব্যক্তিগতভাবে কেউ এনে থাকুন । আমাদের দেশে ব্রিটিশরা যা-যা প্রজাতির কুকুর এনেছিল বা আজকাল সচরাচর যেসব কুকুর বাচ্চা কেনেল মালিকরা বিক্রি করে, তাতে পিট বুল পাবি না । ১৯ শতকের আগে ইং।্যান্ডে ব্লাডস্পোর্ট বা রক্তাক্ত-খেলা খেলত রাজতন্ত্রের লোকেরা ; সাধারণ মানুষও খেলত , কিন্তু তারা ছিল দর্শক, এই ধরণের কুকুর পোষার খরচ আর হ্যাপা অনেক । এই কুকুরগুলোকে ষাঁড় বা ভাল্লুকের ওপর ছেড়ে দেয়া হত , ষাঁড়ের মাংস খাবার জন্যে ,ষাঁড়টা বেশ নরম হয়ে যেত অবিরাম কামড় খেয়ে-খেয়ে , টেনডারিং আরকি । জুয়ার বাজিও ধরত দর্শকরা । আইন করে তা যখন বন্ধ করে দেয়া হল তখন কুকুরে-কুকুরে লড়াই লড়াবার খেলা শুরু হল । লোকে পিট বুল কুকুর পোষা আরম্ভ করল , অন্য জাতের কুকুরদের হারাবার জন্যে । এক ধরণের হিংস্র আমোদ বলতে পারিস । ষাঁড় আর ভাল্লুকের সঙ্গে যে পিট বুল কুকুরদের লড়ানো হতো সেগুলো এখনকার পিট বুল কুকুরদের থেকে বড় ছিল । পরে তো বুল ডগ আর টেরিয়ার ক্রস করিয়ে পোষবার মতন কুকুর প্রজনন করানো শুরু হল । এটা ওরকম প্রজনন করানো কুকুর , তবে এর জিনে হয়তো হিংস্রতা বেশি থাকতে পারে । এদের বাড়ির বাইরে নিয়ে গেলে মুখে চামড়ার মাজল বা বাঁধন পরিয়ে নিয়ে যেতে হয় । ইউরোপ-আমেরিকায় এ-বিষয়ে আইনের কড়াকড়ি আছে । অনেককে কামড়ে মেরে ফেলেছে এরা । তাই কুকুর-মালিকরা মোটা টাকার বিমা করিয়ে রাখেন, কাউকে কামড়ে দিলে বা অঘটন ঘটলে খেসারত মেটাবার উদ্দেশ্যে । আমাদের দেশে সেসব বালাই নেই , যার যে ব্রিড ইচ্ছে পুষছে, পোষা কুকুরের কামড় খেয়ে মানুষ মরলে কারোর কিছু আসে-যায় না । পাবলিকের মারই তখন একমাত্র উপায় ।
—কাকু, কেনেল সোসাইটির কাউকে চেনেন কি ? কেননা আমি যদি বলে যে পুলিসের তরফ থেকে এসেছি, একটা খুনের তদন্ত করতে, তাহলে ওরা ভয় পেয়ে চেপে যাবে । আপনি একটা ফোন করে দিলে আমি কাউকে ক্রেতা সাজিয়ে পাঠাব, নিজে তো যেতে পারব না । বলল রিমা । লোকে ওকে দেখলেই চিনে যাবে, আরে সেই নোংরা পরি, মোটর সাইকেলে বসে আকাশে ওড়ে ।
—আমার কাছে ফোন নেই , আমো ওসব আর সামলাতে পারি না । বললেন পরাশর ।
রিমা নিজের মোবাইলে কেনেল সোসাইটির নম্বর খুঁজে , ফোন করল তাদের, রিং হওয়া আরম্ভ হলে পরাশরকে দিয়ে বলল, এই নিন কাকু কথা বলুন ।
ওপাশ থেকে সাড়া পেয়ে পরাশর বললেন, কে ব্রততী ? আমি পরাশর বলছি, পরাশর বর্মা ।
…………
—না না, আমার নিজের জন্যে নয় , এ বয়সে কি আর কুকুর পোষা যায় !
…………
—আমি একজনকে পাঠাচ্ছি , মহিলার নাম শারদা পারিখ , বহুকাল কলকাতায় আছেন , ভালো বাংলা জানেন , পাহারা দিতে পারে এমন কুকুর কিনতে চান ।
…………
—হ্যাঁ হ্যাঁ, ওনাকে বিভিন্ন ব্রিডের কথা জানিও , ডগ ব্রিডারদের ঠিকানাগুলো দিও , উনি যা ভালো বুঝবেন তাই করবেন ।
…………
—উনি বিদেশে ছিলেন কয়েক বছর ।
………….
—লন্ডনে । ওখানে কারোর বাড়ি পিট বুল দেখে ওনার ভালো লেগে গেছে ব্রিডটা ।
…………
—কে ? মাইক সান্যাল ? মানে আমাদের মুকুন্দ সান্যাল ? ও এই ব্রিডের কুকুর ইমপোর্ট করে বুঝি ? নিজে ব্রিড করায় না ?
………….
—ও ! আগে করাতো ? এখন ইমপোর্টও করে আর ব্রিডও করায় ? পেডিগ্রির রেকর্ড পাওয়া যাবে তো ? মানে ধর যাদের বিক্রি করা হয়েছে , মিসেস পারিখ যদি তাদের কারোর সঙ্গে পিট বুল পোষার ব্যাপারে কথা বলতে চান, তাহলে উনি তাঁদের বাড়ি গিয়ে কথা বলতে পারবেন । অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়েই যাবেন । তুমি মিসেস পারিখকে তাঁদের ফোন নম্বর আর ঙিকানা দিয়ে দিও ।
…………
—ঠিক আছে , রাখছি, ভালো থেকো ।
রিমাকে ওর মোবাইল ফেরত দিতে রিমা বন্ধ করে বলল, ধন্যবাদ কাকু, এবার একটু সুড়ঙ্গের শেষে আলো দেখতে পাচ্ছি । চলুন, আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিই ।
পরাশর বললেন, মানুষের কংকালটার রহস্য কি ফাঁস করতে পেরেছিস ? না, কেবল কুকুরটার দিক থেকে এগোতে চাইছিস বলে মনে হল । তাছাড়া এই যে কুকুরের কংকাল দেখালি, এই কুকুরটা কি করে আর কবে মারা পড়ল তা জানার জন্যে তোকে একজন ফরেনসিক অ্যানথ্রপলজিস্টের মতামত নিতে হবে । মানুষের কংকালটার ক্ষেত্রে যদি ফরেনসিক অ্যানথ্রপলজিস্টের রিপোর্ট না নিয়ে থাকিস তা-ও নিতে হবে ।
—ফরেনসিক অ্যানথ্রপলজিস্ট ? না, আমি সরকারি বিশেষজ্ঞ ডাকতারের মতামত নিয়েছি । ফরেনসিক অ্যানথ্রপলজিস্ট কোথায় পাবো । আমাদের রাজ্যে কি আছেন কেউ ? সরকারে তো নেই ।
—না, কেন্দ্রীয় রসায়নাগারে একজন আছেন, মিস্টার মনসুর হামিদ, বিদেশে ছিলেন , শিকাগোতে, ওখান থেকে অবসর নেবার পর ভারতে সেটল করেছেন বটে, তবে বিভিন্ন রাজ্য সরকারকে সাহাজ্যের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার ওনাকে বিশেঢ় অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিয়েছেন । ডিজিকে বল, ডিজির অনুরোধে উনি সরকারিভাবে দুটো কংকাল দেখে রিপোর্ট দেবেন । ওনার মতামত কোনো আদালত অস্বীকার করতে পারে না । বললেন পরাশর বর্মা ।
—এটা তো জানতামই না । ওঃ এটা তো খুবই প্রয়োজন ছিল । কি বলব আপনাকে । আপনাদের প্রজন্ম চলে যাবার পর আমাদের পথ দেখাবার কেউ নেই । আগে তবু নিতিন মাসি ছিলেন, পি কে বাসু ছিলেন, গোয়েন্দা গর্জন ছিলেন । রিমা পরাশরের পায়ে হাত দিয়ে আবার প্রণাম করল ।
পরাশর জিগ্যেস করলেন , তুই তো দিল্লিতে আন্তর্জাতিক ডিটেকটিভ কনফারেন্সে গিয়েছিলি ; তা কারা-কারা এসেছিলেন ।
রিমা বলল, দাঁড়ান বলছি, আমি ওনাদের ঠিকানা আর কয়েক জনের ফোন নম্বর , ই-মেল আইডি আমার ডায়রিতে লিখে রেখেছি , কখন কোন কাজে লাগে বলা যায় না । মা বলে এটা আমার বদস্বভাব , এই যা পাই টুকে রাখি ।
—না না, তুই ঠিক কাজই করিস, ঘড়ঘড়ে গলায় বললেন পরাশর ।
—এই যে, পড়ব ? নামগুলো ?
—হ্যাঁ হ্যাঁ , শোনা ।
—প্রায়ভেট ডিটেকটিভ এসেছিলেন চেন কাও , ডেভিড স্মল, নিও উল্ফ, ভি আই ওয়ারশসস্কি, শন স্পেনসার, স্যাম স্পেড, শার্লক হোমস, কিনসে মিলোনে, এরকিউল পয়েরো, লিউ আর্চার, পল আর্টিজান, লিন্ডসে গর্ডন, জো ক্যানোলি, রেক্স কার্ভার, এলভিস কোল, হ্যারি ড্রেসডেন, ড্যান ফরচুন, ডার্ক জেন্টলি, এলেনি কুইন, এমারসন কড, কেট ব্যানিংগান, ক্লিফ হার্ডি, মাইক হ্যামার, টমাস ম্যাগনাম, ভেরেনিকা মার্স, ফিলিপ মারলো, জিম রকফোর্ড, জন শাফ্ট আর ম্যাথিউ শাডার ।
—বিখ্যাত লোকেরাই এসেছিল দেখছি । কয়েকজন মহিলা ডিটেকটিভও তো এসেছিলেন । যাক তোর মনের জোর বাড়ল ।
—আজ্ঞে হ্যাঁ ।
—সরকারি ডিটেকটিভরা আসেননি ?
—এসেছিলেন তো । দাঁড়ান তাঁদের নাম বলছি , অন্য পাতায় লেখা আছে নামগুলো । হ্যাঁ, এই যে । জঁ ব্যাপটিস্ট অ্যাডেমবার্গ , রডেরিক অ্যালেন , এলা ক্লাহ– ইনি রেড ইনডিয়ান, তারপর অরেলো জেন, থিও কোজাক, রিচার্ড জুকি, বারবারা হ্যাভার্স, এড গ্রিন, রবার্ট গোরেস, রাইনস দ্য গয়ে , জর্জ গিডেন, জ্যাক ফ্রস্ট, ক্রিস্টোফার ফয়েলস, অ্যাডাম ডালগ্লিশ, রে কারলিং, গিদো ব্রুনেতি, মাইক ব্রিজ, হ্যারি ব্রশ, মাইক বোল্ট, জিম বেরাগেরাক, কেট বেকেট, মার্টিন বেক, টম বার্নবি, জন বারোলি আর অ্যালান ব্যাংকস । আরও অনেক পুলিস অফিসার ছিলেন বিভিন্ন দেশের , দ্বিতীয় তালিকাটা শেষ দিন যোগাড় করা হয়ে ওঠেনি ।
—বেশ জমজমাট সেমিনার ছিল তাহলে । মহিলা পুলিস অফিসাররাও এসেছিলেন দেখছি ।
—আজ্ঞে হ্যাঁ । তবে প্রায় সকলেই সাইডলাইনে দাঁড়িয়ে বলছেলেন যে সরকারিভাবে এত খুনোখুনি হয় যে ডিটেকটিভদের প্রয়োজন ফুরিয়েছে । এখন কেবল বাচ্চাদের ভোলাবার আর ট্রেনযাত্রীদের ঘুম পাড়াবার কাজে লাগে ডিটেকটিভদের অভিজ্ঞতা । চিন থেকে উন্সপেকটর চেন এসেছিলেন , উনি বলছিলেন যে চিনে প্রতি বছর হাজারখানেক শ্রমিক কেবল কয়লাখনির বিস্ফোরণে মারা যায় , আর কত হাজার মানুষকে যে উন্নতির নামে ঘরছাড়া করা হয় তার হিসাব নেই । প্যালেস্টাইনের ওমার ইউসুফ বলছিলেন যে ইজরায়েলের বোমা খেয়ে রোজই বউ-বাচ্চারা মরছে , সেক্ষেত্রে একটা খুনের তদন্ত করাটা বিলাসিতা ।
—এক দিক থেকে ওনারা ঠিকই বলেছেন । আমাদের পি সি মিটারও সেরকম কথাই আড়ালে-আবডালে বলেন । রাজ্য সরকার কতো লোককে নকশাল, মাওবাদী নাম দিয়ে খুন করে আবার মাওবাদী বা যারা নকশাল করে গেছে এককালে , তাদের নিয়ে পিসি মিটার তাই কখনও মুখ খোলেননি । দেবেন্দ্রবিজয় আর অরিন্দমের সঙ্গে সেদিন যাদবপুরে দেখা হয়েছিল । ওনারাও দুঃখ করছিলেন , এদেশের রাজনীতিকরা কোটি-কোটি টাকা চুরি করে সুইস ব্যাংকে লুকিয়ে রাখছে , সেখানে একটা-আধটা গুপ্তধনের কেস নিয়ে ডিটেকটিভের মাথা ঘামানোর কোনো মানে হয় না , সব পণ্ডশ্রম ।
রিমা বলল, আজ্ঞে ঢাকা থেকে কিশোর পাশা, মাসুদ রাণা আর মুসা আমন এসেছিল। ওরাও বলছিল, খালেদা জিয়ার ছেলে কোটি-কোটি টাকা মেরে দুবাই আর সুইস ব্যাংকে নিয়ে গেছে ; তাছাড়া টিক্কা খান কতোজন বাঙালিকে যে খুন করেছিল তার ইয়ত্তা নেই । বঙ্গবন্ধু আর ওনার পরিবারের সদস্যদের খুন করে কয়েকজন সেনার লোক তো হিরো হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে কতকাল ; হুমায়ুন আজাদ চোখের সামনে খুন হলেন যখন কিনা রাষ্ট্র জানত যে উনি খুন হবেন । এরকম সময়ে শিশুপাঠ্যা বইয়ের খাবার তৈরির নুডলস পাকানো ছাড়া ডিটেকটিভের আর কিছু করার নেই ।
পরাশর বললেন, ব্যোমকেশও অনেকটা এরকম কথাই বলছিল সেদিন আমায় ; ওর সঙ্গে অনেক দিন পর গড়িয়াহাটের বাজারে দেখা হয়েছিল , বেশ বড়ো একটা ইলিশ কিনছিল দু কিলোর কাছাকাছি ওজনের । ও বলছিল ডজনে-ডজনে ঝিন্দের বন্দি তো আমাদের রাজনীতিকরা আকছার বানাচ্ছেন আর কিডন্যাপের পয়সা তুলছেন । বিধানসভায় ভোটাভুটি সামাল দিতে সদস্যদের ঝিন্দের বন্দি বানিয়ে ফাইভ স্টার হোটেলে কড়া পাহারায় রাখা হচ্ছে । সেসব কোটি-কোটি টাকার ব্যাপার । আমাদের সময়ে দু’দশ লাখ হাপিশ করা নিয়ে কত চিন্তায় পড়তেন ডিটেকটিভরা ।
আপনি যা বলছেন, হুকাকাশি, কল্কেকাশি, নিশীথ রায়, ইন্দ্রনাথ রুদ্র সবাই এই সুরেই মতামত দিচ্ছিলেন । এমনকি জয়ন্ত-মাণিক-সিন্দরবাবু জুটি , গুপি-পানু-ছোটোমামা জুটি, গোন্ডালু, কিকিরা, পাণ্ডব গোয়েন্দা, ট্যাঁপা-মদনা জুটি, গোগোল সব্বাই এই লাইনে কথা বলাবলি করছিলেন । বলছিলেন, সমাজটাই রসাতলে গেল তো ডিটেকটিভরা করবেটা কী , শুধু বিয়ের সময়ে কনে-পার্টি বা বর-পার্টিকে ভেতরের খবর জোগানো । সে-ব্যাপারেও ডিটেকটিভ তো আর যাচাই করে বলতে পারবে না যে বিয়ের বর বা কনে আগে কতজনের সঙ্গে শোয়াশুয়ি করেছে ।
—তা যা বলেছিস । দেখি তো আজকালকার ছেলেমেয়েদের ।
পরাশরকে পেছনে বসিয়ে রিমা প্রথমে ওনাকে বাড়ি পৌঁছে দিল , তারপর গেল দিদি-জামাইবাবুর বাড়ি । দিদিকে বুঝিয়ে বলল ব্যাপারটা , যাতে দিদি সীমা নিজেকে শারদা পারিখে বদলে নিতে সময় পান । অন্য কেউ তেমন নেই যাকে বিশ্বাস করে কাজটা দিতে পারবে রিমা ।দিদি এর আগে রিমাকে ওর কাজের ব্যাপারে নানাভাবে সাহায্য করেছেন ; এখন সাসপেন্ড হয়ে রিমা ওর দপতরে তেমন সাহায্য পাবে না তাো জানেন । রিমা নিজে শারদা পারিখ সাজতে পারবে না , কেননা সংবাদপত্র আর টিভির রিপোর্টাররা ওর মুখ চিনিয়ে দিয়েছে জনসাধারণকে । পাবলিকের চোখে রিমা খান এখন নোংরা পরি, একটা বহুল-প্রচারিত দৈনিকে পরির ঢঙে ডানা এঁকে দাখানো হয়েছিল , ভয়ার্ত পুরুষদের ওপর উড়ছে পায়ে ঈগল-নখ বের করে, আর পুরুষেরা কুঁচকিতে হাত চাপা দিয়ে কুঁকড়ে কুঁজো হয়ে রয়েছে, দেখেছেন দিদি, কাটিংটা আছে ওনার কাছে ।
দামি সিল্কের শাড়িতে শারদা পারিখে রূপান্তরিত সীমা ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছ থেকে মাইক সান্যালের মোবাইল আর অফিসের টেলিফোন নম্বর নিয়ে যোগাযোগ করতে, মাইক সান্যাল পরশু সকাল দশটার সময় দিলেন ।
নির্ধারিত দিন ও সময়ে সীমা পোঁছে গেল মাইক সান্যালের ডগ ব্রিডিং সেন্টারে । মাইক সান্যালের কেনেলে পিট বুল কুকুরের বাচ্চা ছিল না । বললেন, আনিয়ে দিতে পারে, দক্ষিণ ভারতের সন্মুখানন্দনের পিট বুল বিচ সম্প্রতি তিনটে বাচ্চা দিয়েছে । সীমার অনুরোধে উনি কলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গের অন্যত্র যাদের পিট বুল বিক্রি করা হয়েছে তাদের দশ বছরের খতিয়ান দিলেন । ছোটো বোন যেমন নির্দেশ দিয়েছে , আরও পুরানো রেকর্ড পাওয়া যাবে কি না জেনে নিয়ে সীমা তার একটা তালিকার জেরক্স নিয়ে মাইক সান্যালকে জানাল, এনাদের মধ্যে কয়েকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করবে কিছুদিনের মধ্যেই ।
ফরেনসিক অ্যানালিস্ট রুচিষ্মিতা ঘোষ ইতিমধ্যে রিমাকে জানিয়েছেন যে পিঁপড়েগুলোকে দুই ধরণের পেস্টিসাইড প্রয়োগ করে মারা হয়েছে । কয়েকটি পিঁপড়েতে পাওয়া গেছে চিনির সঙ্গে মেশানো বোরিকাম অ্যাসিডাম । অন্য কয়েকটি পিঁপড়েতে পাওয়া গেশে এনডোসালফান , যা ওনার মতে মাটিতে ছিল , এবং পিঁপড়েগুলোর গায়ে লেগে থাকা মাটিতে কেমিকালটির অবশেষ থেকে থাকবে । বাড়িটিতে যেহেতু ফুলের বাগান ছিল, হয়তো ফলেরও, মনে হয় বাগানে কখনও এনডোসালফান ছড়ানো হতো। এনডোসালফান অন্যান্য দেশে নিষিদ্ধ হয়ে গিয়ে থাকলেও ভারতবর্ষে হয়নি । ভারতে হিন্দুস্তান ইনসেকটিসাইডস তা তৈরি করে । পিঁপড়েগুলো মাসখানেক আগে মরেছে । সেকারণে অনুমান করা যায় যে চিনির সঙ্গে মেশানো বোরিকাম অ্যাসিডামই তাদের মৃত্যু ডেকে এনেছে । কোনো পেস্টিসাইডই চিনির সঙ্গে মিশিয়ে বিক্রি হয় না । পিঁপড়ে মারার জন্যেই চিনি মেশানো হয়ে থাকবে । অন্য কীটেদের মিষ্টিমুখ করাবার দরকার হয় না ।
রুচিষ্মিতার কাছ থেকে সংবাদ পেয়ে পর্যন্ত রিমা এমন কাউকে ভেবে পাচ্ছে না যাকে বলবে বাঙলোবাড়িটার দিকে রাতে নজর রাখতে ।ম খগেন-রেজাউলরা ভুতের ভয়ে যাবে না কাছাকাছি একটা ফ্ল্যাটে মাসখানেকের ডেরা ডালতে । কোনো ছিঁচকে অপরাধী বা ইনফরমারকে হাজতের ভয় দেখিয়ে যে নজর রাখতে বলবে, তারও উপায় নেই । জানাজানি হলে পরের দিনই খবরের কাগজের প্রথম পাতায় ডানা-ওড়ানো মোটর সাইকেলে নোংরা পরির কার্টুন বেরোবে ।
অক্টোবর 2, 2012 – 6:34 পুর্বাহ্ন ক্যাটাগরিসমূহ: Detective story | Post a commentTagged ডিটেকটিভ উপন্যাস |
হরিশচন্দ্র স্ট্রিটের মোড়ে পরাশর বর্মাকে দেখতে পেয়ে, মোটর সাইকেল থামিয়ে, পাশে দাঁড় করিয়ে, ওনার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল রিমা । পরাশর বললেন , আরে তুই ? চাকরি ফিরে পেয়ে গেলি নাকি ? তোর বিষয়ে খবর পড়ে আর টিভিতে দেখে মনটা সত্যিই খারাপ হয়ে গিয়েছিল । তা এদিকে কি জন্যে ? তোরা তো উত্তরে চলে গেছিস বলে জানি ।
রিমা বলল, হ্যাঁ কাকু, আমরা ওদিকে চলে গেছি । এসেছিলাম কালীঘাটে ; এখানের এক পুজারী আমার ইনফরমারের কাজ করেন , তাঁকে একটা কেসের ব্যাপারে বলে এলাম । আপনার কাছেই যাচ্ছিলাম , একটা খুনের কেসের কিনারা করার ব্যাপারে পরামর্শ নিতে ।
পরাশর বললেন, আমি তো, প্রেমেন মারা যাবার পর কাজ ছেড়ে দিয়েছি ; বয়সও হয়েছে, দেখতেই পাচ্ছিস । তাছাড়া সময়টা বড্ডো খারাপ , যখন-তখন রাস্তায় লাশ পড়ছে, খবরের কাগজ খুললেই প্রথম পাতায় হিসাব দেয়া থাকে কোথায় কজন দলাদলি করে খুন হল । ডিটেকতিভকে এককালে বলা হতো সত্যান্বেষী , আর এখন সত্য যে কাকে বলে তা-ই তর্কসাপেক্ষ । একাধিক সত্য হলে কী অন্বেষণ করবে মানুষ ? সত্য এবং মিথ্যার ফারাকও প্রায় নেই বললেই চলে , তা সে সংসদে বল বা বিধানসভায় । মনটা খারাপ থাকে রে , কীই বা বলি ! প্রেমেনের বাড়িটার স্মৃতি ঝালাই করতে এদিকে এসেছিলাম , কিন্তু কে একজন কেন্দ্রিয় নেতার আগমন হবে বলে ঢোকার বেরোবার কড়াকড়ি দেখে ফিরে যাচ্ছি ।
রিমা জিগ্যেস করল, আপনার হাতে সময় আছে ?
পরাশর বর্মা বললেন, এখন তো সময়ই সময় , সময় কাটানোই কঠিন , টিভি দেখতে ভালো লাগে না । সংবাদপত্র, এক্ষুনি যা বললাম, পড়া মানে নিজেকে কষ্ট দেয়া । আমাদের কালের মতন সরাসরি খবর তো আর পরিবেশন করে না মিডিয়া ; সবেতেই নুন-লঙ্কা মিশিয়ে খবর বানায় , তাতে পদ্য-লিখিয়েরা ওপর থেকে পোঁচ দেয় ।
তাহলে আমার সঙ্গে চলুন, আপনার বিশেষজ্ঞ মতামত দেবেন , তারপর আমি আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দেব , রিমা বলল ওনাকে ।
কোথায় যেতে হবে রে ? জিগ্যেস করলেন পরাশর, তারপর স্বগতোক্তির সুরে বললেন, মোটর সাইকেলে কি বসতে পারব ? আচ্ছা চল, যাই । তুই মেয়ে হয়ে মোটর সাইকেল চালাচ্ছিস, আমি না হয় মেয়েদের মতন একপাশে পা ঝুলিয়ে যাব, বললেন পরাশর ।
মোটর সাইকেলে পরাশর বর্মাকে বসিয়ে রিমা ওনাকে নিয়ে গেল থানার মালখানায় । হাত ধরে ওসির ঘরে নিয়ে গিয়ে, এক গ্লাস জল খাইয়ে ওনাকে মালখানার ভেতরে নিয়ে গেল । ভেতরটা এমন ধুলো-পড়া যে পরাশর নাকে রুমাল চাপা দিয়ে বললেন, আমার আজকাল ধুলোর অ্যালার্জি দেখা দিয়েছে । তা কিসের ব্যাপারে জানতে চাস ?
বাঙলোবাড়িতে কুকুরের যে কংকাল পাওয়া গেছে তার ওপর থেকে প্লাসটিকের চাদর তুলে রিমা জিগ্যেস করল, এই কুকুরটা কোন ব্রিডের আর এর বিশেষত্ব কী ? কুকুরের এই কংকালটা পাওয়া গেছে একজন মানুষের পাশে । মানুষটা কে ঠিকমতন আইডেনটিফাই করা যাচ্ছে না । যতটুকু জেনেছি, কংকাল ভদ্রলোক কুকুর পুষতেন না । তাহলে কুকুরটা তাঁর পাশে এলো কোথা থেকে, কোন উদ্দেশে , এবং কুকুর আর মানুষটির রহস্যটা ঠিক কী ? আমার মনে হয় কুকুরটাকে যদি আইডেনটিফাই করতে পারি, তাহলে কুকুরের মালিককেও খুঁজে বের করতে পারব । কুকুরটা দেখুন না কেমন বিদকুটে কাঠামোর ।
কংকালের চারপাশে প্রদক্ষিণ করলেন পরাশর, খুলিটা দেখলেন কাছ থেকে, যেটুকু চামড়া টিকে আছে কুকুরটার তাও খুঁটিয়ে দেখলেন । মাটিতে উবু হয়ে বসে দেখলেন । উঠে দাঁড়িয়ে চিন্তামগ্ন হলেন । নিষ্কর্ষে পোঁছোতে সময় নিলেন মিনিট দশেক । তারপর বললেন, আমি যা বলছি তা তুইম লিখে নিবি তো ? লিখে নিলে ভালো হয় । তুই তা দেখাতে পারবি তোর ভেটেরিনারি দাকতারকে , কেননা কোর্টে তো আমার মতামতের গুরুত্ব নেই , আমি একজন বেসরকারি লোক ।
—আপনি বলুন কাকু, আমি আমার এই ছোট্ট টেপরেকর্ডারে ধরেরাখছি । বলল রিমা ।
পরাশর বললেন, তোদের কত সুবিধা হয়ে গেছে, আমাদের সময়ে এই সমস্ত টেকনিকাল গ্যাজেট ছিল না । হ্যাঁ, শোন, এটা হল পিট বুল প্রজাতির কুকুর , বিদেশ থেকে এনে থাকবে, যে-ই এনে থাকুক , তা সে কোনো ডগ কেনেলের মালিক হোন বা ব্যক্তিগতভাবে কেউ এনে থাকুন । আমাদের দেশে ব্রিটিশরা যা-যা প্রজাতির কুকুর এনেছিল বা আজকাল সচরাচর যেসব কুকুর বাচ্চা কেনেল মালিকরা বিক্রি করে, তাতে পিট বুল পাবি না । ১৯ শতকের আগে ইং।্যান্ডে ব্লাডস্পোর্ট বা রক্তাক্ত-খেলা খেলত রাজতন্ত্রের লোকেরা ; সাধারণ মানুষও খেলত , কিন্তু তারা ছিল দর্শক, এই ধরণের কুকুর পোষার খরচ আর হ্যাপা অনেক । এই কুকুরগুলোকে ষাঁড় বা ভাল্লুকের ওপর ছেড়ে দেয়া হত , ষাঁড়ের মাংস খাবার জন্যে ,ষাঁড়টা বেশ নরম হয়ে যেত অবিরাম কামড় খেয়ে-খেয়ে , টেনডারিং আরকি । জুয়ার বাজিও ধরত দর্শকরা । আইন করে তা যখন বন্ধ করে দেয়া হল তখন কুকুরে-কুকুরে লড়াই লড়াবার খেলা শুরু হল । লোকে পিট বুল কুকুর পোষা আরম্ভ করল , অন্য জাতের কুকুরদের হারাবার জন্যে । এক ধরণের হিংস্র আমোদ বলতে পারিস । ষাঁড় আর ভাল্লুকের সঙ্গে যে পিট বুল কুকুরদের লড়ানো হতো সেগুলো এখনকার পিট বুল কুকুরদের থেকে বড় ছিল । পরে তো বুল ডগ আর টেরিয়ার ক্রস করিয়ে পোষবার মতন কুকুর প্রজনন করানো শুরু হল । এটা ওরকম প্রজনন করানো কুকুর , তবে এর জিনে হয়তো হিংস্রতা বেশি থাকতে পারে । এদের বাড়ির বাইরে নিয়ে গেলে মুখে চামড়ার মাজল বা বাঁধন পরিয়ে নিয়ে যেতে হয় । ইউরোপ-আমেরিকায় এ-বিষয়ে আইনের কড়াকড়ি আছে । অনেককে কামড়ে মেরে ফেলেছে এরা । তাই কুকুর-মালিকরা মোটা টাকার বিমা করিয়ে রাখেন, কাউকে কামড়ে দিলে বা অঘটন ঘটলে খেসারত মেটাবার উদ্দেশ্যে । আমাদের দেশে সেসব বালাই নেই , যার যে ব্রিড ইচ্ছে পুষছে, পোষা কুকুরের কামড় খেয়ে মানুষ মরলে কারোর কিছু আসে-যায় না । পাবলিকের মারই তখন একমাত্র উপায় ।
—কাকু, কেনেল সোসাইটির কাউকে চেনেন কি ? কেননা আমি যদি বলে যে পুলিসের তরফ থেকে এসেছি, একটা খুনের তদন্ত করতে, তাহলে ওরা ভয় পেয়ে চেপে যাবে । আপনি একটা ফোন করে দিলে আমি কাউকে ক্রেতা সাজিয়ে পাঠাব, নিজে তো যেতে পারব না । বলল রিমা । লোকে ওকে দেখলেই চিনে যাবে, আরে সেই নোংরা পরি, মোটর সাইকেলে বসে আকাশে ওড়ে ।
—আমার কাছে ফোন নেই , আমো ওসব আর সামলাতে পারি না । বললেন পরাশর ।
রিমা নিজের মোবাইলে কেনেল সোসাইটির নম্বর খুঁজে , ফোন করল তাদের, রিং হওয়া আরম্ভ হলে পরাশরকে দিয়ে বলল, এই নিন কাকু কথা বলুন ।
ওপাশ থেকে সাড়া পেয়ে পরাশর বললেন, কে ব্রততী ? আমি পরাশর বলছি, পরাশর বর্মা ।
…………
—না না, আমার নিজের জন্যে নয় , এ বয়সে কি আর কুকুর পোষা যায় !
…………
—আমি একজনকে পাঠাচ্ছি , মহিলার নাম শারদা পারিখ , বহুকাল কলকাতায় আছেন , ভালো বাংলা জানেন , পাহারা দিতে পারে এমন কুকুর কিনতে চান ।
…………
—হ্যাঁ হ্যাঁ, ওনাকে বিভিন্ন ব্রিডের কথা জানিও , ডগ ব্রিডারদের ঠিকানাগুলো দিও , উনি যা ভালো বুঝবেন তাই করবেন ।
…………
—উনি বিদেশে ছিলেন কয়েক বছর ।
………….
—লন্ডনে । ওখানে কারোর বাড়ি পিট বুল দেখে ওনার ভালো লেগে গেছে ব্রিডটা ।
…………
—কে ? মাইক সান্যাল ? মানে আমাদের মুকুন্দ সান্যাল ? ও এই ব্রিডের কুকুর ইমপোর্ট করে বুঝি ? নিজে ব্রিড করায় না ?
………….
—ও ! আগে করাতো ? এখন ইমপোর্টও করে আর ব্রিডও করায় ? পেডিগ্রির রেকর্ড পাওয়া যাবে তো ? মানে ধর যাদের বিক্রি করা হয়েছে , মিসেস পারিখ যদি তাদের কারোর সঙ্গে পিট বুল পোষার ব্যাপারে কথা বলতে চান, তাহলে উনি তাঁদের বাড়ি গিয়ে কথা বলতে পারবেন । অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়েই যাবেন । তুমি মিসেস পারিখকে তাঁদের ফোন নম্বর আর ঙিকানা দিয়ে দিও ।
…………
—ঠিক আছে , রাখছি, ভালো থেকো ।
রিমাকে ওর মোবাইল ফেরত দিতে রিমা বন্ধ করে বলল, ধন্যবাদ কাকু, এবার একটু সুড়ঙ্গের শেষে আলো দেখতে পাচ্ছি । চলুন, আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিই ।
পরাশর বললেন, মানুষের কংকালটার রহস্য কি ফাঁস করতে পেরেছিস ? না, কেবল কুকুরটার দিক থেকে এগোতে চাইছিস বলে মনে হল । তাছাড়া এই যে কুকুরের কংকাল দেখালি, এই কুকুরটা কি করে আর কবে মারা পড়ল তা জানার জন্যে তোকে একজন ফরেনসিক অ্যানথ্রপলজিস্টের মতামত নিতে হবে । মানুষের কংকালটার ক্ষেত্রে যদি ফরেনসিক অ্যানথ্রপলজিস্টের রিপোর্ট না নিয়ে থাকিস তা-ও নিতে হবে ।
—ফরেনসিক অ্যানথ্রপলজিস্ট ? না, আমি সরকারি বিশেষজ্ঞ ডাকতারের মতামত নিয়েছি । ফরেনসিক অ্যানথ্রপলজিস্ট কোথায় পাবো । আমাদের রাজ্যে কি আছেন কেউ ? সরকারে তো নেই ।
—না, কেন্দ্রীয় রসায়নাগারে একজন আছেন, মিস্টার মনসুর হামিদ, বিদেশে ছিলেন , শিকাগোতে, ওখান থেকে অবসর নেবার পর ভারতে সেটল করেছেন বটে, তবে বিভিন্ন রাজ্য সরকারকে সাহাজ্যের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার ওনাকে বিশেঢ় অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিয়েছেন । ডিজিকে বল, ডিজির অনুরোধে উনি সরকারিভাবে দুটো কংকাল দেখে রিপোর্ট দেবেন । ওনার মতামত কোনো আদালত অস্বীকার করতে পারে না । বললেন পরাশর বর্মা ।
—এটা তো জানতামই না । ওঃ এটা তো খুবই প্রয়োজন ছিল । কি বলব আপনাকে । আপনাদের প্রজন্ম চলে যাবার পর আমাদের পথ দেখাবার কেউ নেই । আগে তবু নিতিন মাসি ছিলেন, পি কে বাসু ছিলেন, গোয়েন্দা গর্জন ছিলেন । রিমা পরাশরের পায়ে হাত দিয়ে আবার প্রণাম করল ।
পরাশর জিগ্যেস করলেন , তুই তো দিল্লিতে আন্তর্জাতিক ডিটেকটিভ কনফারেন্সে গিয়েছিলি ; তা কারা-কারা এসেছিলেন ।
রিমা বলল, দাঁড়ান বলছি, আমি ওনাদের ঠিকানা আর কয়েক জনের ফোন নম্বর , ই-মেল আইডি আমার ডায়রিতে লিখে রেখেছি , কখন কোন কাজে লাগে বলা যায় না । মা বলে এটা আমার বদস্বভাব , এই যা পাই টুকে রাখি ।
—না না, তুই ঠিক কাজই করিস, ঘড়ঘড়ে গলায় বললেন পরাশর ।
—এই যে, পড়ব ? নামগুলো ?
—হ্যাঁ হ্যাঁ , শোনা ।
—প্রায়ভেট ডিটেকটিভ এসেছিলেন চেন কাও , ডেভিড স্মল, নিও উল্ফ, ভি আই ওয়ারশসস্কি, শন স্পেনসার, স্যাম স্পেড, শার্লক হোমস, কিনসে মিলোনে, এরকিউল পয়েরো, লিউ আর্চার, পল আর্টিজান, লিন্ডসে গর্ডন, জো ক্যানোলি, রেক্স কার্ভার, এলভিস কোল, হ্যারি ড্রেসডেন, ড্যান ফরচুন, ডার্ক জেন্টলি, এলেনি কুইন, এমারসন কড, কেট ব্যানিংগান, ক্লিফ হার্ডি, মাইক হ্যামার, টমাস ম্যাগনাম, ভেরেনিকা মার্স, ফিলিপ মারলো, জিম রকফোর্ড, জন শাফ্ট আর ম্যাথিউ শাডার ।
—বিখ্যাত লোকেরাই এসেছিল দেখছি । কয়েকজন মহিলা ডিটেকটিভও তো এসেছিলেন । যাক তোর মনের জোর বাড়ল ।
—আজ্ঞে হ্যাঁ ।
—সরকারি ডিটেকটিভরা আসেননি ?
—এসেছিলেন তো । দাঁড়ান তাঁদের নাম বলছি , অন্য পাতায় লেখা আছে নামগুলো । হ্যাঁ, এই যে । জঁ ব্যাপটিস্ট অ্যাডেমবার্গ , রডেরিক অ্যালেন , এলা ক্লাহ– ইনি রেড ইনডিয়ান, তারপর অরেলো জেন, থিও কোজাক, রিচার্ড জুকি, বারবারা হ্যাভার্স, এড গ্রিন, রবার্ট গোরেস, রাইনস দ্য গয়ে , জর্জ গিডেন, জ্যাক ফ্রস্ট, ক্রিস্টোফার ফয়েলস, অ্যাডাম ডালগ্লিশ, রে কারলিং, গিদো ব্রুনেতি, মাইক ব্রিজ, হ্যারি ব্রশ, মাইক বোল্ট, জিম বেরাগেরাক, কেট বেকেট, মার্টিন বেক, টম বার্নবি, জন বারোলি আর অ্যালান ব্যাংকস । আরও অনেক পুলিস অফিসার ছিলেন বিভিন্ন দেশের , দ্বিতীয় তালিকাটা শেষ দিন যোগাড় করা হয়ে ওঠেনি ।
—বেশ জমজমাট সেমিনার ছিল তাহলে । মহিলা পুলিস অফিসাররাও এসেছিলেন দেখছি ।
—আজ্ঞে হ্যাঁ । তবে প্রায় সকলেই সাইডলাইনে দাঁড়িয়ে বলছেলেন যে সরকারিভাবে এত খুনোখুনি হয় যে ডিটেকটিভদের প্রয়োজন ফুরিয়েছে । এখন কেবল বাচ্চাদের ভোলাবার আর ট্রেনযাত্রীদের ঘুম পাড়াবার কাজে লাগে ডিটেকটিভদের অভিজ্ঞতা । চিন থেকে উন্সপেকটর চেন এসেছিলেন , উনি বলছিলেন যে চিনে প্রতি বছর হাজারখানেক শ্রমিক কেবল কয়লাখনির বিস্ফোরণে মারা যায় , আর কত হাজার মানুষকে যে উন্নতির নামে ঘরছাড়া করা হয় তার হিসাব নেই । প্যালেস্টাইনের ওমার ইউসুফ বলছিলেন যে ইজরায়েলের বোমা খেয়ে রোজই বউ-বাচ্চারা মরছে , সেক্ষেত্রে একটা খুনের তদন্ত করাটা বিলাসিতা ।
—এক দিক থেকে ওনারা ঠিকই বলেছেন । আমাদের পি সি মিটারও সেরকম কথাই আড়ালে-আবডালে বলেন । রাজ্য সরকার কতো লোককে নকশাল, মাওবাদী নাম দিয়ে খুন করে আবার মাওবাদী বা যারা নকশাল করে গেছে এককালে , তাদের নিয়ে পিসি মিটার তাই কখনও মুখ খোলেননি । দেবেন্দ্রবিজয় আর অরিন্দমের সঙ্গে সেদিন যাদবপুরে দেখা হয়েছিল । ওনারাও দুঃখ করছিলেন , এদেশের রাজনীতিকরা কোটি-কোটি টাকা চুরি করে সুইস ব্যাংকে লুকিয়ে রাখছে , সেখানে একটা-আধটা গুপ্তধনের কেস নিয়ে ডিটেকটিভের মাথা ঘামানোর কোনো মানে হয় না , সব পণ্ডশ্রম ।
রিমা বলল, আজ্ঞে ঢাকা থেকে কিশোর পাশা, মাসুদ রাণা আর মুসা আমন এসেছিল। ওরাও বলছিল, খালেদা জিয়ার ছেলে কোটি-কোটি টাকা মেরে দুবাই আর সুইস ব্যাংকে নিয়ে গেছে ; তাছাড়া টিক্কা খান কতোজন বাঙালিকে যে খুন করেছিল তার ইয়ত্তা নেই । বঙ্গবন্ধু আর ওনার পরিবারের সদস্যদের খুন করে কয়েকজন সেনার লোক তো হিরো হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে কতকাল ; হুমায়ুন আজাদ চোখের সামনে খুন হলেন যখন কিনা রাষ্ট্র জানত যে উনি খুন হবেন । এরকম সময়ে শিশুপাঠ্যা বইয়ের খাবার তৈরির নুডলস পাকানো ছাড়া ডিটেকটিভের আর কিছু করার নেই ।
পরাশর বললেন, ব্যোমকেশও অনেকটা এরকম কথাই বলছিল সেদিন আমায় ; ওর সঙ্গে অনেক দিন পর গড়িয়াহাটের বাজারে দেখা হয়েছিল , বেশ বড়ো একটা ইলিশ কিনছিল দু কিলোর কাছাকাছি ওজনের । ও বলছিল ডজনে-ডজনে ঝিন্দের বন্দি তো আমাদের রাজনীতিকরা আকছার বানাচ্ছেন আর কিডন্যাপের পয়সা তুলছেন । বিধানসভায় ভোটাভুটি সামাল দিতে সদস্যদের ঝিন্দের বন্দি বানিয়ে ফাইভ স্টার হোটেলে কড়া পাহারায় রাখা হচ্ছে । সেসব কোটি-কোটি টাকার ব্যাপার । আমাদের সময়ে দু’দশ লাখ হাপিশ করা নিয়ে কত চিন্তায় পড়তেন ডিটেকটিভরা ।
আপনি যা বলছেন, হুকাকাশি, কল্কেকাশি, নিশীথ রায়, ইন্দ্রনাথ রুদ্র সবাই এই সুরেই মতামত দিচ্ছিলেন । এমনকি জয়ন্ত-মাণিক-সিন্দরবাবু জুটি , গুপি-পানু-ছোটোমামা জুটি, গোন্ডালু, কিকিরা, পাণ্ডব গোয়েন্দা, ট্যাঁপা-মদনা জুটি, গোগোল সব্বাই এই লাইনে কথা বলাবলি করছিলেন । বলছিলেন, সমাজটাই রসাতলে গেল তো ডিটেকটিভরা করবেটা কী , শুধু বিয়ের সময়ে কনে-পার্টি বা বর-পার্টিকে ভেতরের খবর জোগানো । সে-ব্যাপারেও ডিটেকটিভ তো আর যাচাই করে বলতে পারবে না যে বিয়ের বর বা কনে আগে কতজনের সঙ্গে শোয়াশুয়ি করেছে ।
—তা যা বলেছিস । দেখি তো আজকালকার ছেলেমেয়েদের ।
পরাশরকে পেছনে বসিয়ে রিমা প্রথমে ওনাকে বাড়ি পৌঁছে দিল , তারপর গেল দিদি-জামাইবাবুর বাড়ি । দিদিকে বুঝিয়ে বলল ব্যাপারটা , যাতে দিদি সীমা নিজেকে শারদা পারিখে বদলে নিতে সময় পান । অন্য কেউ তেমন নেই যাকে বিশ্বাস করে কাজটা দিতে পারবে রিমা ।দিদি এর আগে রিমাকে ওর কাজের ব্যাপারে নানাভাবে সাহায্য করেছেন ; এখন সাসপেন্ড হয়ে রিমা ওর দপতরে তেমন সাহায্য পাবে না তাো জানেন । রিমা নিজে শারদা পারিখ সাজতে পারবে না , কেননা সংবাদপত্র আর টিভির রিপোর্টাররা ওর মুখ চিনিয়ে দিয়েছে জনসাধারণকে । পাবলিকের চোখে রিমা খান এখন নোংরা পরি, একটা বহুল-প্রচারিত দৈনিকে পরির ঢঙে ডানা এঁকে দাখানো হয়েছিল , ভয়ার্ত পুরুষদের ওপর উড়ছে পায়ে ঈগল-নখ বের করে, আর পুরুষেরা কুঁচকিতে হাত চাপা দিয়ে কুঁকড়ে কুঁজো হয়ে রয়েছে, দেখেছেন দিদি, কাটিংটা আছে ওনার কাছে ।
দামি সিল্কের শাড়িতে শারদা পারিখে রূপান্তরিত সীমা ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছ থেকে মাইক সান্যালের মোবাইল আর অফিসের টেলিফোন নম্বর নিয়ে যোগাযোগ করতে, মাইক সান্যাল পরশু সকাল দশটার সময় দিলেন ।
নির্ধারিত দিন ও সময়ে সীমা পোঁছে গেল মাইক সান্যালের ডগ ব্রিডিং সেন্টারে । মাইক সান্যালের কেনেলে পিট বুল কুকুরের বাচ্চা ছিল না । বললেন, আনিয়ে দিতে পারে, দক্ষিণ ভারতের সন্মুখানন্দনের পিট বুল বিচ সম্প্রতি তিনটে বাচ্চা দিয়েছে । সীমার অনুরোধে উনি কলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গের অন্যত্র যাদের পিট বুল বিক্রি করা হয়েছে তাদের দশ বছরের খতিয়ান দিলেন । ছোটো বোন যেমন নির্দেশ দিয়েছে , আরও পুরানো রেকর্ড পাওয়া যাবে কি না জেনে নিয়ে সীমা তার একটা তালিকার জেরক্স নিয়ে মাইক সান্যালকে জানাল, এনাদের মধ্যে কয়েকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করবে কিছুদিনের মধ্যেই ।
ফরেনসিক অ্যানালিস্ট রুচিষ্মিতা ঘোষ ইতিমধ্যে রিমাকে জানিয়েছেন যে পিঁপড়েগুলোকে দুই ধরণের পেস্টিসাইড প্রয়োগ করে মারা হয়েছে । কয়েকটি পিঁপড়েতে পাওয়া গেছে চিনির সঙ্গে মেশানো বোরিকাম অ্যাসিডাম । অন্য কয়েকটি পিঁপড়েতে পাওয়া গেশে এনডোসালফান , যা ওনার মতে মাটিতে ছিল , এবং পিঁপড়েগুলোর গায়ে লেগে থাকা মাটিতে কেমিকালটির অবশেষ থেকে থাকবে । বাড়িটিতে যেহেতু ফুলের বাগান ছিল, হয়তো ফলেরও, মনে হয় বাগানে কখনও এনডোসালফান ছড়ানো হতো। এনডোসালফান অন্যান্য দেশে নিষিদ্ধ হয়ে গিয়ে থাকলেও ভারতবর্ষে হয়নি । ভারতে হিন্দুস্তান ইনসেকটিসাইডস তা তৈরি করে । পিঁপড়েগুলো মাসখানেক আগে মরেছে । সেকারণে অনুমান করা যায় যে চিনির সঙ্গে মেশানো বোরিকাম অ্যাসিডামই তাদের মৃত্যু ডেকে এনেছে । কোনো পেস্টিসাইডই চিনির সঙ্গে মিশিয়ে বিক্রি হয় না । পিঁপড়ে মারার জন্যেই চিনি মেশানো হয়ে থাকবে । অন্য কীটেদের মিষ্টিমুখ করাবার দরকার হয় না ।
রুচিষ্মিতার কাছ থেকে সংবাদ পেয়ে পর্যন্ত রিমা এমন কাউকে ভেবে পাচ্ছে না যাকে বলবে বাঙলোবাড়িটার দিকে রাতে নজর রাখতে ।ম খগেন-রেজাউলরা ভুতের ভয়ে যাবে না কাছাকাছি একটা ফ্ল্যাটে মাসখানেকের ডেরা ডালতে । কোনো ছিঁচকে অপরাধী বা ইনফরমারকে হাজতের ভয় দেখিয়ে যে নজর রাখতে বলবে, তারও উপায় নেই । জানাজানি হলে পরের দিনই খবরের কাগজের প্রথম পাতায় ডানা-ওড়ানো মোটর সাইকেলে নোংরা পরির কার্টুন বেরোবে ।
Tagged ডিটেকটিভ উপন্যাস |
৭. কংকাল পরিদর্শন
—আমাকে তো বলা হয়েছিল যে একজন পুলিস অফিসার এসে আমাকে পিক আপ করে নেবেন । তা আপনি ? ডাকতার ওহদেদার বললেন রিমাকে । ওহদেদার পুলিস-প্যানেলের একজন খ্যাতিমান শল্যচিকিৎসক ; একটি বেসরকারি হাসপাতালে, যাতে উনি অংশীদারও বটেন, অপারেশান থিয়েটারে মাস্ক পরার জন্যেই পাঁচ অঙ্কের ফিস নেন , সব-সমব তা বিল বহির্ভূত ; বিলে যে চার্জ দেখানো হয় তা আলাদা । স্নাতকোত্তর ছাত্রছাত্রীদের শল্যচিকিৎসার ক্লাস নেন । জটিল পুলিস কেস থাকলে ওনার ডাক পড়ে । রিমা খান দৌড়ধুপ করে ওহদেদারের ডাক পড়িয়েছে কংকাল প্রেমিক কেসের জন্য।
—স্যার, আমিই সেই পুলিস অফিসার । আমার নাম রিমা খান । বিরক্তি চাপার অভ্যাস হয়ে গেছে রিমার, এই ধরণের বাতুল প্রশ্ন শুনে-শুনে । কেউই সহজে মেনে নিতে পারে না যে বাঙালি-সমাজে মহিলা পুলিস ইন্সপেক্টর হতে পারে । বড়োজোর আই পি এস অব্দি তাদের কাছে অ্যালাউড । সকলেরই চাই ন্যালা-ক্যাবলা নেকি-নেকি বাঙালি মেয়ে , যে গান গাইবে আর নাচবে, রঙমাখা ফিল্ম বা টিভি স্টারদের ঢঙে , সেই সঙ্গে রান্নাঘরে মিক্সি ঘোরাবে, মাইক্রোওয়েভে দুধ গরম করবে, টোস্টারে ব্রেড ঢোকাবে বের করবে, ওয়াশিং মেশিন চালাবে , পর্দা টাঙাবে, আলো নেভাবে, কনডোম পরিয়ে দেবে, তারপর চিৎ হয়ে শুয়ে দুর্গন্ধ আর দুর্ব্যবহার সহ্য করবে , ডে ইন ডে আউট । বাইরের কাজ মানেই পুরুষ ।
—খান ? মহিলা পুলিস অফিসার আমাদের দেশে আছেন জানতাম না তো । অথচ সবাই ব্যাড পাবলিসিটি করে যে আমাদের দেশটায় কোনো সামাজিক প্রগতি হয়নি, বাঙালি মুসলমানরা নাকি দেশভাগের পর আরও খারাপ অবস্হায় পড়েছে । অবাক, সত্যিই অবাক, সার্জেন ওহদেদার হেরো-হেরো প্রশ্ন তুললেন ।
—খান আমার পদবি স্যার । আমরা রাঢ়িশ্রেণী ব্রাহ্মণ , ভরদ্বাজ গোত্র । সুলতানি আমলে আমরা ময়মনসিংহে জায়গিরদারি ্রেয়েছিলাম , তার সঙ্গে খান উপাধিও । রিমার এই বাক্যটা ওগরাবারও অভ্যাস হয়ে গেছে , মেয়ে-পুরুষ নির্বিশেষে এই ধরণের বোকা-বোকা প্রস্নের জবাব দিয়ে-দিয়ে । যারা উঁচু জাতের তাদের ঠোকরানো যায় ব্রহ্মণ প্রসঙ্গ তুলে আর জায়গিরদারিটা বাড়িতি ক্যাঁৎকা । অবশ্য অবস্হা বুঝে নিজেকে মুসলমান বলেও চালিয়ে দেয় অনেক সময়ে ; কোনো মুসলমানের কাছ থেকে তথ্য পেতে হলে তরকিবটা ভালো কাজ দেয় ।
—গুড গুড । আমাদের পৈতৃক বাড়ি ছিল বগুড়ায় । আমার দাদু অবশ্য আগেই চলে এসেছিলেন । আমাদের এই তিনতলা বাড়ি ওনারই তৈরি । আপনি বেশ বোল্ড । এরকম একটা কেস নিলেন , এ তো একেবারে ডেডম্যানস ডেড কেস বলে শুনেছি । ওহদেদার ইঙ্গিতে জানাতে চাইলেন যে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসেননি ; সন্মানের সঙ্গে এসেছেন ।
—এই কেসটা আমায় সমাধান করতেই হবে স্যার । ডিজি, মানে, ডায়রেকটর জেনারাল বলেছেন এই কেসটা সমাধান করলে আমি প্রোমোশান পাবো । প্রোমোশান আটকে আছে লক আপ ডেথ কেসের কারণে । কংকালের কেসটা প্রায় ক্লোজ করে দেয়া হয়েছিল । ওনার আদেশে আবার ওন করা হয়েছে । আমি চ্যালেঞ্জ হিসাবে নিয়েছি । ঘ্যামাঘ্যামা ইনভেসটিগেশান অফিসার তিনচার বার কংকালটা দেখে রিপোর্ট দিয়েছেন যে কোনো ক্লু নেই । নিছক স্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা । আপনার নাম আমি বিশেষ জোর দিয়ে ইনক্লুড করিয়েছি । বুড়োটাকে খোঁচানোর ফল উল্টো হতে পারে অনুমান করে রিমা যৎসামান্য পিছু হাঁটলো । বুড়োটার কানেকশান-টানেকশান নাকি সরকারি-বেসরকারি ওপরে-নিচে সব স্তরে ।
—তাই নাকি । ও আপনিই সেই মহিলা অফিসার যার থানায় বেকসুর লোককে ধরে নিয়ে গিয়ে পেটানো হয়েছিল । পেপারে পড়েছিলাম , পুলিসের দৌরাত্ম্য এমন অবস্হায় গিয়ে ঠেকেছে যে মহিলা রইসারও পিটিয়ে মেরে ফেললেন কাউনে । টিভিতেও বোধহয় প্রোগ্রাম দেখেছিলুম আপনাকে নিয়ে কী যেন একটা । খোঁচা-খাওয়া ওহদেদার পালটা-খোঁচা দিলেন । ভিজিটের ফিস তো পাবেনই । খোঁচা দেয়াটা উপরি আয় হল–ইগোর মাশুল ।
—পিটিয়ে মারা হয়নি স্যার । অযথা মিডিয়া একটা স্টোরি তৈরি করে আমার বিরুদ্ধে পাবলিসিটি করেছিল । ওদেরও ধারণা ছিল যে আমি মুসলমান এবং অ্যাডিশানালি মহিলা । আপনি কি এখন যাবেন ?
রিমা বলল না যে পিটিয়ে মারেনি, স্রেফ ববিটাইজ করে দেবার ভয় দেখিয়েছিল । মহিলা বলে মাস্তানটা টিটকিরি মেরেছিল , তাও থানার ভেতরে, কন্সটেবলদের সামনে । রিমা বলেছিল, তোরা ছেড়ে দে , একে আমিই বাতলাচ্ছি , রিমার হুড়কো বলতে কী বোঝায় । তারপর ইন্সপেক্টর রিমা খানের চোস্ত এমসিবিসি । কোনও যুবতীর মুখ থেকে যে এরকম গালাগালের ফোয়ারা বেরোতে পারে তা বেচারা পাকতাড়ুয়া অপরাধী অনুমান করতে পারেনি । শুধু অপরাধীদের মনে ভীতি উৎপাদনের জন্য নয় , অধস্তনদের কাছেও একটা ছবি তৈরি করার প্রয়াস কাজ করেছে রিমার মধ্যে , চাকরিতে যোগ দেবার পরই । তাছাড়া পুরুষদের ভয় দেখালে ওর বেশ যৌন আরাম হয় । ববিটাইজ করার ভয় দেখিয়ে যখন শরীরে অরগ্যাজম হবার ঝিলিক ওঠে, তখন পেটানির কাজটা সাবইন্সপেকটর আর হেড কন্সটেবলের হাতে-পায়ে-জুতো-লাঠিতে ছেড়ে দেয় । একবার তো হয়েও গিয়েছিল ; এত ভালো লেগেছিল সেদিনকে ।
—হ্যাঁ হ্যাঁ, বললেন ডাকতার ওহদেদার, যাব বলেই তো রেডি হয়ে আছি ; আমার জরুরি জিনিসপত্র আগেই গাড়িতে রাখিয়ে দিয়েছি । ওহদেদার চশমার কাঁচ ওপরে তুলে ঝুলন্ত মাকড়সার জাল দেখতে পেলেন । কাজের বউটাকে, ফিরে এসে, ঝুল ঝাড়তে বলতে হবে — কোথা থেকে যে আসে এই ফিনফিনে মাকড়সাগুলো, চশমাপরেও দেখা যায় না ব্যাটাদের । সার্জেনের স্ত্রী বলে মিসেস ওহদেদার কোনো-কিছুর দিকেই তেমন নজর দেন না , আয়নার দিকে ছাড়া , নিজেকে নিঃশব্দে শোনালেন ওহদেদার ।
—আমো মোটর সাইকেলে এগোচ্ছি স্যার , আপনার ড্রাইভারকে ঠিকানা দিয়ে পথনির্দেশ করে দিয়েছি । আমি এগোচ্ছি । আপনি আসুন তাহলে । একটা সিনপসিস লিখে রেখেছি কেসটার; আপনি গাড়িতে বসেই পড়ে নিতে পারবেন । একটা পুরানো কংকাল দেখে বিশেষজ্ঞের মতামত দিতে হবে আপনাকে , যাতে আমরা একটা নির্ণয় নিতে পারি যে মৃত্যু স্বাভাবিক নাকি অস্বাভাবিক ছিল, অস্বাভাবিক হলে হত্যা না আত্মহত্যা । এই নিন স্যার । বার বার স্যার বলতে হচ্ছে বলে একটু আবছা অপমান বোধ করছিল রিমা । কিছু করার নেই । লোকটা অধ্যাপনাও করে ; ফলে স্যার শুনতে অভ্যস্ত । যদিও কলেজে-কলেজে ছাত্র-ছাট্রীরা আজকাল অধ্যাপকদের অ্যাবরিভিয়েট করে ফেলেছে । লেকচারারকে লেকচু, রিডারকে রেড্ডি, প্রফেসরকে পাফি ।
বিশাল বাঙলোবাড়িটায় আগেই, এক-কালের সাকরেদ এক সাব-ইন্সপেকটরকে দুজন কন্সটেবলের সঙ্গে পাঠিয়ে দিয়েছিল রিমা খান । কন্সটেবল দুজনকে রিমা ব্যক্তিগত অনুরোধ করে এনেছে । তারা গেট খুলে যে-ঘরে কংকাল প্রেমিক হাসিমুখে দাঁত বের করে শুয়ে আছে , সেখানে মুখ গোমড়া করে বা মুখে গুটকা পুরে অপেক্ষা করছিল। রিমাকে আসতে দেখে স্যালুট ঠুকল । রিমা বলল, তোরা গেটের কাছে গিয়ে অপেক্ষা কর , বুড়ো ডাকতার এলে খাতির করে একজন নিয়ে আসিস । বেশি কথা বলিসনি । বুড়োটার পয়সার আর অপারেশান টেবিলে রুগি মারার গোমর আছে । কম বয়সে জেলা হাসপাতালে থাকতে ওষুধের হেরফের করত পাবলিকের ঠ্যাঙানিও খেয়েছিল তাই , এখন অগাধ টাকার মালিক ।
সার্জেন ওহদেদারকে ঘরে পৌঁছে দিয়ে কন্সটেবল দুটো গেটে চলে গেল পাহারা দিতে যাতে কোনো অনুসন্ধিৎসু ঢুকে না পড়ে । এত বেকার দেশটায় যে যারা রাজনীতিকদের পোঁ হতে পারেনি বা বিচি ধরে ঝুলতে পায়নি তারা কোথাও কিছু দেখলেই জুটে যায় ; বাড়ি ফিরবে দুপুরের খাবার সময় । নানা খবর জুটিয়ে বিকালে চায়ের ঠেকে গিয়ে গপপো ফাঁদবে ।। তারপর ক্লাবে গিয়ে এইসান হল, ওইসান হল, গেঁড়া একটা চাদে , কালো, খাতায় লিখে নিস । কালীপুজো বা দুর্গাপুজোর চাঁদা তোলার পর কালো চা-অলার হিসাব হবে । প্রমোদ দাশগুপ্ত অবিবাহিত ছিলেন তো কি ; ক্লাবে-ক্লাবে ওনার বংশধররা অবিবাহের ভোজ খাচ্ছে ।
—আসুন স্যার । কংকালটা যেভাবে ছিল তেমনভাবেই রাখা আছে । কেউ এর ক্লেম করেনি ; কোনো উত্তরাধিকারীরও কংকালটার আছে কি না খোঁজ পাওয়া যায়নি । আমরা ঘরের ভেতরে আরও কয়েকটা জিনিস পেয়েছি , তবে আপনি কেবল কংকালটা সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত দেবেন । প্রথম প্রশ্ন হল, কংকালটা পুরুষের না নারীর ?
—কংকালটা যে পুরুষের তা আপনি লে-ম্যান, আই মিন মহিলাদেরও তো লে-ম্যান বলা হয় বোধহয় , লে-উওম্যান তো শুনিনি, এনি ওয়ে, সাধারণ মানুষ হিসাবেও দেখলে বুঝতে পারবেন । তবে যেহেতু এটা পুলিস কেস, আপনারা মনে করছেন সামবডি মাস্ট হ্যাভ অ্যারেঞ্জড ফর হিজ ডেথ, তাই কংকালটার সেক্স আইডেনটিফাই করার পয়েন্টগুলো বলি আপনাকে ।
সকালে ডেড বডি দেখলে ওহদেদার শ্রীহরি শ্রীহরি বলেন, হরি তাঁদের পারিবারিক দেবতা, বগুড়ার সময় থেকে । মনে-মনে বললেন মন্তরটা । এমবিবিএস আর এমএস পাশ করেছেন এই মন্তরের জোরে । স্কুলের প্রথম শ্রেণী থেকে এই মন্তরটা কাজে দিচ্ছে । অবশ্য অপারেশান টেবিলে শোয়া কোনো-কোনো রোগির ক্ষেত্রে কেন যে মন্তরটা কাজে দেয় না তার একটা উত্তর উনি নিজেকে বুঝিয়েছেন : ফিসটা কাটাকাটির ঘামের চেয়ে কম ছিল ।
—প্রফেসর ওহদেদার, আমি কংকালের একটা ড্রইং এনেছি । আপনি স্পটগুলো ডিমারকেট করতে থাকুন, আমি ড্রইংটায় সেই জায়গাগুলো মার্ক করে লিখে নেবো । কেসটা যদি শেষ পর্যন্ত আদালতে পৌঁছোয়, তাহলে পাবলিক প্রসিকিউটারকে ব্রিফ দিতে সুবিধা হবে । আপনি যা-যা বলবেন তা-ও রেকর্ড করে নেবো । আমি সঙ্গে টেপ রেকর্ডার এনেছি । কেননা লে-উওম্যান হিসাবে টেকনিকাল ডিটেইলসগুলো মনে রাখতে পারব না ।
—ডোন্ট টেক ইট আদারওয়াইজ, পুরুষদের কংকাল মাপে বড় , লম্বা আর ভারি হয় । স্ত্রীলোকের বক্ষপিঞ্জর পুরুষের চেয়ে আকারে ছোটো কিন্তু ওপরের অংশ পুরুষের চেয়ে তুলনামূলকভাবে চওড়া । মুচকি হাসি সহযোগে মুচমুচ করে বললেন ওহদেদার সার্জেন । বিদেশ হলে এই কংকালটা নারীর কিনা তা নিয়ে আপনাকে প্রাথমিকভাবে চিন্তা করতে হতো , এর উচ্চতার জন্য । আমাদের দেশে এত দীর্ঘাঙ্গী মেয়ে হয় না , আই মিন মহিলা হন না । এমনকি এই পুরুষটিও আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে দীর্ঘদেহী । বিশেষ করে বাঙালিরা সচরাচর এত লম্বা হন না ।
—আজ্ঞে, আমরা যা এভিডেন্স পেয়েছি, তা থেকে একটা নির্ণয়ে পৌঁছোনো গেছে যে ইনি বাঙালি, ভারতে নানা অঞ্চলে ঘুরেছেন, বিদেশেও ছিলেন , অনেক নরক-স্বর্গের শরবত খেয়েছেন ।
লোকটা যে মাগিবাজ ছিল তা সংগ্রহ করা তথ্যসামগ্রী থেকে জেনে গেছে রিমা । লম্পট পুরুষ শুনলে ওর নিজেরই যৌনতা টনটন করে , দেহে ফুরফুরে অনুভূতি হয় । সমকামী শুনলে অসহ্য লাগে, তা সে নারী হোক বা পুরুষ ; ওর মনে হয়, দিই জানোয়ারগুলোকে অন্তিমযাত্রার খোরাক । রিমা এখনও ভার্জিন ; ভার্জিনত্বের ব্যাখ্যাহীন গর্ব আছে ওর । ওটা ইনট্যাক্ট রেখেছে লিগাল বরের জন্য । যদিও ম্যাস্টারবেট করার দরুণ হাইমেন ছিঁড়ে গিয়ে থাকবে । লিগাল বর কবে জুটবে বা অদৌ জুটবে কি না জানে না । কাউকেই রিমার পছন্দ হয় না । বিয়ের জুন্যে যে-পুরুষেরই ফোটো মা-বাবা গত এক দশক থেকে দেখছেন দেখাচ্ছেন , সবকটাকেই ওর মনে হয় ক্রিমিনাল টাইপের । পুরুষ মাত্রেই সম্ভবত ক্রিমিনাল , ওর আবছে ধারণা । তাছাড়া যাকে বিয়ে করবে তাকে ধরে আচ্ছা করে উত্তম-মধ্যম না দিলে অরগ্যাজম তো হবে না । আর, কোনো পুরুষের নিচে শুয়ে সন্তান উৎপাদনের প্রক্রিয়াটা প্রাগৈতিহাসিক । সমাজ যখন মাতৃতান্ত্রিক ছিল তখন মেয়েরা থাকত ওপরে আর পুরুষরা নিচে । এক-এক জন নারীনেতার দশ-বারোটা করে বাঁদা থাকত । নাঃ, কী আবোল-তাবোল ভাবনা আসছে মাথায় ।
—হাঃ হাঃ, এই যে বাহুর হাড়, হিউমেরাস বা প্রগণ্ডাস্হি , উলনা বা অন্তঃপ্রকোষ্ঠী আর রেডিয়াস বা বহিঃপ্রকোষ্ঠী , আর এই যে ডাইয়াফাইসিস আর এপিফাইসিস , দেখুন, বেশ মোটা আর লম্বা । সার্জেন জানে এবার তার টেকনিকাল জার্গন হেঁকে মাঠ দখল করার পালা । বড় এসেছেন মহিলা পুলিস, বোঝো এবার ।
—হাতের পাতা ? রিমা টের পেল যে ওহদেদার এবার দেদার জার্গন ঝাড়বেন । ঝাড়ুন । টেপরেকর্ডার আছেই । চিহ্ণগুলো দিয়ে রাখছে , পরে ডিটেইলসে লিখে নিতে পারবে ।
—বলছি, আই অ্যাম কামিং টু দ্যাট । এই যে দেখছেন হাতের পাতার অস্হি, ওসা ক্র্যানাস । এটা করতলাস্হি বা কারপালস ; এগুলো করাঙ্গুলিমূল-শলাকা বা মেটাকারপালস , আর এই অঙ্গুলিফলক যাকে, আপনি জানেন নিশ্চই, আমরা বলি ফ্যালানজেস । পুরুষ বলে এদের মাপ বড়ো । আগেই বলেছি, বাঙালি জনগোষ্ঠীর প্রেক্ষিতে ইনি দীর্ঘদেহী ছিলেন , এবং এনার বাহুও লম্বা ছিল , যাকে আমরা বাঙালিরা বলি আজানুলম্বিত, হাৎ হাঃ । বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে অবশ্য এমন দীর্ঘদেহী লোকজন পাওয়া যাবে । তা তাঁরা তো বাংলাদেশে চলে গেছেন , আই মিন তখনকার পাকিস্তানে । এখানকার বাঙালি মুসলমান, এমনকি কৃষকদের মধ্যেও, এই উচ্চতার মানুষ বিরল । মাঠ দখল করে ফেলায় ওহদেদার খেলতে শুরু করে দিয়েছেন । খেলতে-খেলতে ক্রমে সাবলীল হয়ে গেলেন, যেন ক্লাস নিচ্ছেন ।
—আর তলাকার অংশ ? ড্রইঙে ১, ২, ৩, ৪ এইভাবে নম্বর দিয়ে লিখে নিচ্ছিল রিমা ।
—দেহের নিম্নপ্রান্তে, কংকালে থাকে শ্রোণীবৃত্ত ও নিম্নপ্রান্তের অস্হিগুলো । শ্রোণীবৃত্তের দুদিকে থাকে দুটি প্রসস্ত পেলভিস অস্হি । ত্রিকাস্হি ও অনুত্রিকাস্হির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পেলভিস অস্হিগুলো সৃষ্টি করে শ্রোণীচক্র , এই যে, এই অংশে । মুক্ত নিম্নপ্রান্তের অস্হিগুলোর মধ্যে পড়ে উর্বাস্হি , নিম্ন-পায়ের ও চরণের অস্হিগুলো । আর চরণের এই অস্হিগুলোর মধ্যে থাকে গুল্ফাস্হি , পদতলাস্হি ও পদাঙ্গুলিফলক । লিখে নিন, লিখে নিন, ইউ হ্যাভ ইয়োর ওন টাইম ।
—না, স্যার, প্রথমে আমরা ইনি মহিলা না পুরুষ সেই পয়েন্টগুলো আইডেনটিফাই করে নিই । আমি জানি ইনি পুরুষ । কিন্তু কোর্টকে তো জানাতে হবে কি-কি দেখে এনাকে পুরুষ ঘোষণা করা হল , এবং কোন বিশেষজ্ঞ তা করলেন ।
—ফাইন । পুরুষ ও মহিলা কংকালের প্রধান পার্থক্য হল, মহিলাদের দেহে সন্তান জন্ম দেবার ব্যবস্হা থাকে । এই যে এই দিকে নজর দিন , আপনার ড্রইঙে মার্ক করে নিন । মেয়েদের পেলভিস আকারে ছোটো হলেও তা শ্যালো এবং চওড়া ; ক্যাভিটি গোলাকৃতি । এটা দেখছেন , মেয়ে হলে ইলিয়াম অস্হির ডানার অংশ বেশি ছড়ানো হতো , ত্রিকাস্হির প্রমোন্টারি পেলভিসের শূন্যস্হানের ভেতর কম ঢোকা হতো । ইনি পুরুষ বলে দেখুন এনার ক্ষেত্রে সিমফাইসিসের নিচে দুই পিউবিসের নিচের শাখা দুটো নিজেদের মধ্যে যে-কোণ রচনা করেছে তা সমকোণের চেয়ে ছোটো । মহিলাদের ক্ষেত্রে তা স্হুলকোণ আর তা প্রায় ধনুকের মতন । গাইনাকদের তো পেলভিসের মাপ জানা খুবই জরুরি । যাক সার্জেন এবার পুলিসি প্রয়োজনে সিরিয়াস হচ্ছেন ।
—স্যার, আপনারা দেহের ভেতরটা ভাবতেই অভ্যস্ত । আমরা বাইরেটা । মৃদু খোঁচা দিল রিমা । দশজনের ভিড়ের ভেতর কেবল মেয়েদের দিকেই তাকিয়ে দেখে পুরুষগুলো , কি বুড়ো, কি ছোঁড়া ।
—কশেরুকার শেষভাগের খোঁচা-অস্হি বা কচিক্স, মানুষের পূর্বপুরুষদের ল্যাজের অংশ , এই যে, মহিলাদের ক্ষেত্রে এটা মুভেবল । পুরুষদের হাড়কে আকৃতি দেয় টেসটোসটেরোন হরমোন আর মহিলাদের এসট্রোজেন ।
—মাথাটা সম্পর্কে জানা হয়নি ।
—মাথা ? ইউ মিন করোটি , কৈনিয়াম ? এদিকে আসুন । হাত দেবো কি ? আচ্ছা, বসুন, বসে দেখুন, হাত দেবার দরকার নেই । করোটির পেছন দিকটা দেখছেন , উঁচু একটা বাল্জ , এক্সটারনাল অক্সিপেটাল প্রোট্রুবারেন্স , ইনি পুরুষ বলে এই অংশ বেশ প্রোনাউন্সড । চোয়ালের হাড় দেখুন , আমরা বলি ম্যানডিবল, এটি পুরুষের বলে অ্যাংগুলার আর চৌকো । মহিলাদের ক্ষেত্রে এটা গোলাকার এবং পয়েন্টেড হয় । প্রকৃতি নারীকে হাড়ের দিক থেকেও সুন্দর রেখেছে । আপনাকে জন্ম নিতে হলে একটি সুন্দর জায়গা থেকেই তো পৃথিবীতে আসতে হবে । আসার পথটা অবশ্য রক্তময় , তা জীবনযুদ্ধে আপনাকে তৈরি করে পাঠাবার জন্যে সুন্দর গৃহে গড়েপিটে তারপর পাঠানো হয় যুদ্ধক্ষেত্রের রক্তভূমিতে । এইবার আপনি জগতে এসে কী করবেন তা আপনাকে নির্ণয় নিতে হবে ।
—করোটিতে কি কোনো আঘাত দেখছেন ?
—না, আঘাত অ্যাজ সাচ, মানে কেউ পিটিয়ে বা ভারি জিনিস দিয়ে মাথায় মেরে খুন করেনি এনাকে । কিন্তু কিছু ব্যাপার স্ট্রেঞ্জ । তা হল হাড়ের সঙ্গে হাড়ের সংযোগগুলো দেখুন । অস্হিসন্ধিগুলো কয়েকটা অংশে খুলে গেছে । আপনারা পুলিসের লোকেরা আর হলিউডের ক্রিমিনালরা শুনি হাত-পা টেনে-টেনে থার্ড ডিগ্রি দিয়ে কথা আদায় করলে যেমন হবে । কিন্তু সেক্ষেত্রেও এভাবে ডিসজয়েন্টেড হবে না । আরেকটা ব্যাপার লক্ষ করছি । তা হল দাগগুলো । এরকম আঁচড়ের দাগ কেন হাড়গুলোয় , বিভিন্ন জায়গায়, এবং কেবল একদিকেই বেশি । খাট থেকে ভদ্রলোক কি করে পড়ে গেলেন ? পড়ে মরে গেলেন ? নাকি হঅর্ট অ্যাটাকটা ওনাকে ফেলে দিল ? হ্যাঁ, তাও হতে পারে , ম্যাসিভ একটা হার্ট বা সেরিব্রাল কান্ডিশান হয়ে থাকতে পারে । ভদ্রলোক ডেথ বেডে থাকলে আমি বলতে পারতাম তা ঘটৈছে কিনা । এখন এনার যা অবস্হা , আপনাকে কোনো ফরেনসিক বিশেষজ্ঞের মতামত নিতে হবে ।
—কোন কোন জয়েন্টগুলো ডিসজয়েন্টেড , তা যদি একটু বিস্তারিত বলেন তো ভালো হয় স্যার ।
—এই দেখুন, স্কন্ধবৃত্তের অস্হিসন্ধি ; অক্ষকাস্হি বা ক্ল্যাভিকুলা তার দুই অন্তভাগ দিয়ে জোড়া থাকবার কথা , একদিকে উরঃফলক বা বক্ষাস্হির ম্যানুব্রিয়ামের সঙ্গে ও অন্যদিকে অংশফলকের অ্যাক্রোমিয়াল উদগত অংশের সঙ্গে , ফলে তৈরি হয় দুটি অস্হিসন্ধি । উরৎফলক-অক্ষকাস্হি সন্ধি আর অ্যাক্রমিয় অক্ষকাস্হি সন্ধি । ভালো করে লক্ষ করুন , সন্ধিগুলো আলগা । এবার ডান হাতের কনুইয়ের অস্হিসন্ধি লক্ষ করুন । এটা তৈরি হয় তিনটি অস্হিসংযোগে : প্রগণ্ডাস্হি , অন্তঃপ্রকোষ্ঠাস্হি আর বহিঃপ্রকোষ্ঠাস্হি । আলগা । খুলে গেছে । জোড় আলগা হয়ে রয়েছে । একইভাবে হাঁটুর, ডান হাঁটুর, অস্হিসন্ধিও ডিসজয়েন্টেড । দেখুন , এটা তিনটে অস্হির সংযোগে তৈরি : উর্বাস্হি , জঙ্ঘাস্হি আর জানুকাপালিক । আমরা ডাকতারি পড়ার সময়ে ডেডবডির এই জয়েন্টগুলো স্টাডি করতুম । কেসটা এরকম ইনটারেসটিং জানলে আমি কয়েকজন ছাত্রকে সঙ্গে আনতুম ।
—কেস শেষ হয়ে গেলে কংকালটা অযথা আমাদের মালখানায় পড়ে থাকবে । তার চেয়ে আপনাদের দেবার জন্যে আমি অনুরোধ করব । আপনিও ডিজি সায়েবকে বলে রাখবেন । আর কোনো জয়েন্টে আছে কি ব্যাপারটা ?
—হ্যাঁ, বক্ষদেশের সংযুক্তি , ডান পায়ের কব্জির অস্হিসন্ধি , রগের ও চোয়ালের অস্হিসন্ধি এবং ডান দিকের উরুসন্ধি । দেখুন, দেখুন, এতক্ষণে তো আপনিও কিছুটা এক্সপার্ট হয়ে গেছেন ।
—ওকে, থ্যাংক ইউ সো মাচ স্যার ।
—আপনারা কি অনুমান করছেন ? আত্মহত্যা না মাডফার ? স্বাভাবিক মৃত্যু যে নয় তা আমি আপনাকে এখনই বলে রাখছি । এনার স্পাইন আর ব্রেনে সম্ভবত ইনফেকশান হয়েছিল । আপনার আগে যিনি তদন্ত করেছিলেন তিনি কিছু খুঁজে পাননি ? অবশ্য কেউ যদি কংকালটা টানাটানি করে থাকেন তাহলে আলাদা কথা ।
—আমরা অস্বাভাবিক মৃত্যু মনে করেই এগোচ্ছি । আসলে প্রবলেম হল যে বাড়িটা আর বাড়ির এই ঘর, দুটোই ভেতর থেকে বন্ধ ছিল । তার আগের তদন্তকারী আধিকারিকদের প্রসঙ্গ ওঠায় বিরক্ত হল রিমা । সুমন মিশ্র , সে তো পুরুষ অফিসার, ফাঁকিবাজ, রাজনীতি নিয়ে কপচানিতে তার দিন কাবার হতো , পার্টি না করলে বাজে জায়গায় পোস্টিঙের ভয় ছিল । এ-সব কেসে তো আর মাল-কড়ি নেই । মাল-কড়ি না থাকলে রিমাও বিশেষ আগ্রহ দেখায় না, মানে দেখাত না, সাস পেন্ড হবার আগে পর্যন্ত । এই কেসটা বাধ্য হয়ে তদন্ত করছে । খুঁজে বের করতেই হবে অপরাধীকে । ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ আগের তদন্তকারী অফিসারকে যে রিপোর্ট দিয়েছেন , তা নির্ভুল নয়, কেননা তখন ফরেনসিক দপতরটায় লোকবল আর যন্ত্রপাতি-কেমিকাল ছিল না । তবু উনি যে রিপোর্ট দিয়েছেন, তাতে আছে যে কংকালটা আনিমানিক দশ বছর পড়ে আছে ; স্পাইনে ইনফেকশান হলেও, তা মৃত্যুর কারণ নয় । যদি কংকালটা অসুখের কারণে কোমায় চলে গিয়ে থাকে , তাও নাকি মৃত্যুর কারণ নয় । কংকালের গায়ে আঁচড়ের দাগ আর অস্হিসংযোগের বিচ্ছিন্নতা সন্দেহ জাগায় । বাড়িটা এতকাল পড়ে আছে অথচ প্রোমোটার বা জবলদখলকারীদের নজরে না পড়ায় কংকালটা শুয়ে আছে দশ বছর হাসি-মুখে । পুলিস সিল করে দিয়েছিল বাড়িটার গেট আর সদর দরজা , সেগুনকাঠের সদর দরজা ।
—তাহলে এত মাথা ঘামাচ্ছেন কেন ? আপনাদের তো প্রতিদিনকার ক্রিমিনাল ডাটাই প্রচুর । অপরাধ কম দেখানোতেই যখন আপনাদের স্বার্থ তখন কেন এই কেঁচো খোঁড়া ?
—তার কারণ এই ভদ্রলোক, নিরঞ্জন দতত, যদিও ওটা ওনার প্রকৃত নাম না ছদ্মনাম তা এখনও লিগালি স্পষ্ট নয়, এই লোকটি যে প্রচুর বিত্ত-বৈভবের মালিক তা ঘরগুলোর ডেকোরেশান আর কিউরিও সামগ্রী থেকে স্পষ্ট । স্হাবর সম্পত্তির কাগজ পাচ্ছি না আমরা । অস্হাবর কি-কি ছিল তাও ক্লিয়ার হয়নি এখনও । ব্যাংকের, নিবেশের কাগজ, মোবাইল ফোন, মানে এনার টাকাকড়িউর হিসাব পাওয়া যাচ্ছে না । সেগুলো গেল কোথায় ? আত্মীয়-স্বজন একেবারেই নেই এরকম মানুষ তো বিরল । আর বৈভবশালীর মৃত্যুতে সাধারণত আত্মীয়দের কিউ লেগে যাবার কথা !
—আচ্ছা, আমি চলি । একটা ক্লাস আছে আজকে । যদি আরো কিছু জানার থাকে কনট্যাক্ট করবেন ।
—চলুন স্যার আপনাকে পৌঁছে দিই ।
—না না, আপনি নিজের ইনভেসটিগেশান কমপ্লিট করুন । আমি তো গাড়ি করে এসেছি । প্রায়ভেট ডিটেকটিভ কেউ আগ্রহ দেখাননি ? কেসটা তো ইনটারেসটিং । ওনারা তো এই টাইপের কেস হিসট্রি থেকে জব্বর একখানা বেস্টসেলার নামিয়ে দেন ।
—আমি নিজেই গিয়েছিলাম ব্যোমকেশ বক্সি, কিরীটি রায় আর পি সি মিটারের কাছে । ব্যোমকেশবাবু বৃদ্ধ হয়েছেন , চোখে দেখতে পান না । ফেলুদা সিনেমা থেকে সময় করে উঠতে পারছেন না , আর কিরীটি রায় তো নীহাররঞ্জন মশায়ের নতুন অমনিবাস সংস্করণ বের করায় ব্যস্ত । তবে তিন জনেই মনে করেন যে ওনারা যখন কেস নিতেন তখন ডিটেকটিভকে বলা হতো সত্যান্বেষী ; বর্তমানকালে সত্য জিনিসটা বলপ্রয়োগের ব্যাপার , যার হাতে ক্ষমতা সে-ই সত্যের মালিক ।
—আমার সঙ্গে একজন অভিজ্ঞ সত্যান্বেষীর পরিচয় আছে । কর্ণেল নিলাদ্রী সরকার । ডিটেকটিভ হিসাবে নাম-ডাক করেছেন । বলেন তো ওনাকে কেসটার কথা বলি ।
—না স্যার, ওনারা বেশ ব্যস্ত লোক । পূজা-পার্বণ লেগেই থাকে পত্রিকার অফিসগুলোয় , জানেনই তো । কর্ণেল সায়েবের সঙ্গে দেখা করেছিলাম । উনি বললেন, ইরাকে আফগানিস্তানে চেচনিয়ায় প্রতিদিন অগুন্তি মানুষ খুন হচ্ছে , তা তো ইতিহাসের পাহাড়ে চাপা পড়ে যায় ; একটা-দুটো হত্যা আর গুপ্তধনের গল্প বইয়ের পাতাতেই শোভা পায় , স্কুলের ছাত্রদেরও কিছুটা টেনশান দূর করে । বললেন, তোর চাকরির ব্যাপার, তুই মাথা ঘামা ।
—তা ঠিক । আরেকজন ছিলেন । আগে বেশ নাম শুনতুম । কিন্তু তিনি আজকাল অ্যাস্ট্রলজির দিকে ঝুঁকেছেন শুনেছি । আপনারা সরকারি ডিটেকটিভরাই সব কেস নিয়ে নিচ্ছেন তো ওনারা কী করবেন বলুন ? ওনাদেরও তো করে-কম্মে খেতে হবে !
—আপনি দীপক চ্যাটার্জির কথা বলছেন তো ? হ্যাঁ, উনি প্রফেশান চেঞ্জ করেছেন । উনি বলছিলেন উত্তরপ্রদেশের ফরেনসিক অ্যাস্ট্রলজিস্ট উপাধ্যায়জির সঙ্গে দেখা করতে । কে খুন করেছে জানলে বা কে খুন হয়েছে জানলে না হয় ফরেনসিক অ্যাস্ট্রলজিস্ট কনসাল্ট করা যেতো । উপাধ্যায়জী, অপরাধী বা সাক্ষীকে প্রশ্ন করেন আর তার ছক তৈরি করে উত্তর খোঁজেন । কে খুন হয়েছে আর কে খুন করেছে সে-দুটোই তো খুঁজছি । তাছাড়া এনারা সবাই প্যাট্রিয়ার্কাল মাইন্ডসেটের লোক । মহিলা পুলিস অফিসার শুনলে অফেন্ডেড হন , ঘাবড়ে যান ।
—ইজ ইট ? মে বি । বাঙালির সমাজে বিপ্লব-বিদ্রোহ নিয়ে বেশির ভাগ মানুষ প্লে অ্যাকটিং করেন । প্রকৃত সমাজে তা ঘটতে দেন না । দেখুন না, শতকরা তেত্রিশভাগ মহিলা ক্যান্ডিডেট কোনো দলই দেন না , বিধানসভা বা লোকসভায় সিট দেয়া তো দূরের কথা । কাকাবাবু-সন্তু কী বললেন ? গিয়েছিলেন নাকি তাঁদের কাছে ?
—না স্যার । কাকাবাবুর শুনেছি দুটো হাঁটুই অপারেশান করে পালটাতে হয়েছে । গাড়ি ছাড়া নড়েন না । তাই শান্তিনিকেতনে একটা বাড়ি করেছেন । ওনার ডিটেকটিভ জীবনের যাবতীয় নথিপত্রের একটা সংগ্রহশালা রেখে যাবেন বলে শুনেছি ।
—গুড ডিসিশান । রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিচিহ্ণ তো চোরেরা নিয়ে কোথায় পালিয়েছে আপনারাও জানেন না । নতুন চোরেদের জন্যে নতুন সংগ্রহশালা গড়ে ওঠা প্রয়োজন । গুড গুড ।
ডক্টর ওহদেদারকে গাড়িতে সি অফ করে ফিরে এসে সাবইন্সপেক্টর আর কন্সটেবলদের রিমা খান আদেশ দিল সদর দরজা আর গেট বন্ধ করে সিল করে দিতে । সিল মানে তালায় কাপড় বেঁধে গালা লাগিয়ে চাবির দাগ করে দেয়া । সরকারি সিলের হাজার হ্যাঙ্গাম । পাবলিককে থামাবার জন্যে গালার সিল থাকাটা জরুরি । নয়তি জবরদখল হবে বা প্রোমোটার ঢুকে যাবে । এভিডেন্সগুলো নিয়ে বসতে হবে , ভাবতে হবে, প্রচুর কমপিউটার ডিস্ক পাওয়া গেছে বাড়িটায়, সেগুলো দেখতে হবে । কেননা যেকটা দেখেছে সেগুলো তেলেগু ভাষায় লেখা , অনুবাদ করাতে সময় লাগছে । অক্ষর তেলেগু, লেখা বাংলা ন্যারেটিভ, তাই আরও অসুবিধা । একটা ঘরের খামের ভেতরে মহিলার চুল পাওয়া গেছে । সেটা কার । ড্রেসিং টেবিলের ব্রাশে যে-কটা চুল পাওয়া গেছে, আগের ইনভেসটিগেটিং অফিসার রমেনবাবু লিখেছেন যে সাধারণ চোখে দেখে মনে হয় যে তা একই মহিলার নয় । কুকুরটার দাঁতের ডিএনএ নিয়ে দেখতে হবে যে কংকালটার মাংস কুকুরটাই খেয়েছে কিনা ।
বাড়ির দিকে মোটরসাইকেল হাঁকালো রিমা ।
( For rest of the story click on Older Posts )
অক্টোবর 2, 2012 – 6:32 পুর্বাহ্ন ক্যাটাগরিসমূহ: Detective story | Post a commentTagged ডিটেকটিভ উপন্যাস |
—আমাকে তো বলা হয়েছিল যে একজন পুলিস অফিসার এসে আমাকে পিক আপ করে নেবেন । তা আপনি ? ডাকতার ওহদেদার বললেন রিমাকে । ওহদেদার পুলিস-প্যানেলের একজন খ্যাতিমান শল্যচিকিৎসক ; একটি বেসরকারি হাসপাতালে, যাতে উনি অংশীদারও বটেন, অপারেশান থিয়েটারে মাস্ক পরার জন্যেই পাঁচ অঙ্কের ফিস নেন , সব-সমব তা বিল বহির্ভূত ; বিলে যে চার্জ দেখানো হয় তা আলাদা । স্নাতকোত্তর ছাত্রছাত্রীদের শল্যচিকিৎসার ক্লাস নেন । জটিল পুলিস কেস থাকলে ওনার ডাক পড়ে । রিমা খান দৌড়ধুপ করে ওহদেদারের ডাক পড়িয়েছে কংকাল প্রেমিক কেসের জন্য।
—স্যার, আমিই সেই পুলিস অফিসার । আমার নাম রিমা খান । বিরক্তি চাপার অভ্যাস হয়ে গেছে রিমার, এই ধরণের বাতুল প্রশ্ন শুনে-শুনে । কেউই সহজে মেনে নিতে পারে না যে বাঙালি-সমাজে মহিলা পুলিস ইন্সপেক্টর হতে পারে । বড়োজোর আই পি এস অব্দি তাদের কাছে অ্যালাউড । সকলেরই চাই ন্যালা-ক্যাবলা নেকি-নেকি বাঙালি মেয়ে , যে গান গাইবে আর নাচবে, রঙমাখা ফিল্ম বা টিভি স্টারদের ঢঙে , সেই সঙ্গে রান্নাঘরে মিক্সি ঘোরাবে, মাইক্রোওয়েভে দুধ গরম করবে, টোস্টারে ব্রেড ঢোকাবে বের করবে, ওয়াশিং মেশিন চালাবে , পর্দা টাঙাবে, আলো নেভাবে, কনডোম পরিয়ে দেবে, তারপর চিৎ হয়ে শুয়ে দুর্গন্ধ আর দুর্ব্যবহার সহ্য করবে , ডে ইন ডে আউট । বাইরের কাজ মানেই পুরুষ ।
—খান ? মহিলা পুলিস অফিসার আমাদের দেশে আছেন জানতাম না তো । অথচ সবাই ব্যাড পাবলিসিটি করে যে আমাদের দেশটায় কোনো সামাজিক প্রগতি হয়নি, বাঙালি মুসলমানরা নাকি দেশভাগের পর আরও খারাপ অবস্হায় পড়েছে । অবাক, সত্যিই অবাক, সার্জেন ওহদেদার হেরো-হেরো প্রশ্ন তুললেন ।
—খান আমার পদবি স্যার । আমরা রাঢ়িশ্রেণী ব্রাহ্মণ , ভরদ্বাজ গোত্র । সুলতানি আমলে আমরা ময়মনসিংহে জায়গিরদারি ্রেয়েছিলাম , তার সঙ্গে খান উপাধিও । রিমার এই বাক্যটা ওগরাবারও অভ্যাস হয়ে গেছে , মেয়ে-পুরুষ নির্বিশেষে এই ধরণের বোকা-বোকা প্রস্নের জবাব দিয়ে-দিয়ে । যারা উঁচু জাতের তাদের ঠোকরানো যায় ব্রহ্মণ প্রসঙ্গ তুলে আর জায়গিরদারিটা বাড়িতি ক্যাঁৎকা । অবশ্য অবস্হা বুঝে নিজেকে মুসলমান বলেও চালিয়ে দেয় অনেক সময়ে ; কোনো মুসলমানের কাছ থেকে তথ্য পেতে হলে তরকিবটা ভালো কাজ দেয় ।
—গুড গুড । আমাদের পৈতৃক বাড়ি ছিল বগুড়ায় । আমার দাদু অবশ্য আগেই চলে এসেছিলেন । আমাদের এই তিনতলা বাড়ি ওনারই তৈরি । আপনি বেশ বোল্ড । এরকম একটা কেস নিলেন , এ তো একেবারে ডেডম্যানস ডেড কেস বলে শুনেছি । ওহদেদার ইঙ্গিতে জানাতে চাইলেন যে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসেননি ; সন্মানের সঙ্গে এসেছেন ।
—এই কেসটা আমায় সমাধান করতেই হবে স্যার । ডিজি, মানে, ডায়রেকটর জেনারাল বলেছেন এই কেসটা সমাধান করলে আমি প্রোমোশান পাবো । প্রোমোশান আটকে আছে লক আপ ডেথ কেসের কারণে । কংকালের কেসটা প্রায় ক্লোজ করে দেয়া হয়েছিল । ওনার আদেশে আবার ওন করা হয়েছে । আমি চ্যালেঞ্জ হিসাবে নিয়েছি । ঘ্যামাঘ্যামা ইনভেসটিগেশান অফিসার তিনচার বার কংকালটা দেখে রিপোর্ট দিয়েছেন যে কোনো ক্লু নেই । নিছক স্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা । আপনার নাম আমি বিশেষ জোর দিয়ে ইনক্লুড করিয়েছি । বুড়োটাকে খোঁচানোর ফল উল্টো হতে পারে অনুমান করে রিমা যৎসামান্য পিছু হাঁটলো । বুড়োটার কানেকশান-টানেকশান নাকি সরকারি-বেসরকারি ওপরে-নিচে সব স্তরে ।
—তাই নাকি । ও আপনিই সেই মহিলা অফিসার যার থানায় বেকসুর লোককে ধরে নিয়ে গিয়ে পেটানো হয়েছিল । পেপারে পড়েছিলাম , পুলিসের দৌরাত্ম্য এমন অবস্হায় গিয়ে ঠেকেছে যে মহিলা রইসারও পিটিয়ে মেরে ফেললেন কাউনে । টিভিতেও বোধহয় প্রোগ্রাম দেখেছিলুম আপনাকে নিয়ে কী যেন একটা । খোঁচা-খাওয়া ওহদেদার পালটা-খোঁচা দিলেন । ভিজিটের ফিস তো পাবেনই । খোঁচা দেয়াটা উপরি আয় হল–ইগোর মাশুল ।
—পিটিয়ে মারা হয়নি স্যার । অযথা মিডিয়া একটা স্টোরি তৈরি করে আমার বিরুদ্ধে পাবলিসিটি করেছিল । ওদেরও ধারণা ছিল যে আমি মুসলমান এবং অ্যাডিশানালি মহিলা । আপনি কি এখন যাবেন ?
রিমা বলল না যে পিটিয়ে মারেনি, স্রেফ ববিটাইজ করে দেবার ভয় দেখিয়েছিল । মহিলা বলে মাস্তানটা টিটকিরি মেরেছিল , তাও থানার ভেতরে, কন্সটেবলদের সামনে । রিমা বলেছিল, তোরা ছেড়ে দে , একে আমিই বাতলাচ্ছি , রিমার হুড়কো বলতে কী বোঝায় । তারপর ইন্সপেক্টর রিমা খানের চোস্ত এমসিবিসি । কোনও যুবতীর মুখ থেকে যে এরকম গালাগালের ফোয়ারা বেরোতে পারে তা বেচারা পাকতাড়ুয়া অপরাধী অনুমান করতে পারেনি । শুধু অপরাধীদের মনে ভীতি উৎপাদনের জন্য নয় , অধস্তনদের কাছেও একটা ছবি তৈরি করার প্রয়াস কাজ করেছে রিমার মধ্যে , চাকরিতে যোগ দেবার পরই । তাছাড়া পুরুষদের ভয় দেখালে ওর বেশ যৌন আরাম হয় । ববিটাইজ করার ভয় দেখিয়ে যখন শরীরে অরগ্যাজম হবার ঝিলিক ওঠে, তখন পেটানির কাজটা সাবইন্সপেকটর আর হেড কন্সটেবলের হাতে-পায়ে-জুতো-লাঠিতে ছেড়ে দেয় । একবার তো হয়েও গিয়েছিল ; এত ভালো লেগেছিল সেদিনকে ।
—হ্যাঁ হ্যাঁ, বললেন ডাকতার ওহদেদার, যাব বলেই তো রেডি হয়ে আছি ; আমার জরুরি জিনিসপত্র আগেই গাড়িতে রাখিয়ে দিয়েছি । ওহদেদার চশমার কাঁচ ওপরে তুলে ঝুলন্ত মাকড়সার জাল দেখতে পেলেন । কাজের বউটাকে, ফিরে এসে, ঝুল ঝাড়তে বলতে হবে — কোথা থেকে যে আসে এই ফিনফিনে মাকড়সাগুলো, চশমাপরেও দেখা যায় না ব্যাটাদের । সার্জেনের স্ত্রী বলে মিসেস ওহদেদার কোনো-কিছুর দিকেই তেমন নজর দেন না , আয়নার দিকে ছাড়া , নিজেকে নিঃশব্দে শোনালেন ওহদেদার ।
—আমো মোটর সাইকেলে এগোচ্ছি স্যার , আপনার ড্রাইভারকে ঠিকানা দিয়ে পথনির্দেশ করে দিয়েছি । আমি এগোচ্ছি । আপনি আসুন তাহলে । একটা সিনপসিস লিখে রেখেছি কেসটার; আপনি গাড়িতে বসেই পড়ে নিতে পারবেন । একটা পুরানো কংকাল দেখে বিশেষজ্ঞের মতামত দিতে হবে আপনাকে , যাতে আমরা একটা নির্ণয় নিতে পারি যে মৃত্যু স্বাভাবিক নাকি অস্বাভাবিক ছিল, অস্বাভাবিক হলে হত্যা না আত্মহত্যা । এই নিন স্যার । বার বার স্যার বলতে হচ্ছে বলে একটু আবছা অপমান বোধ করছিল রিমা । কিছু করার নেই । লোকটা অধ্যাপনাও করে ; ফলে স্যার শুনতে অভ্যস্ত । যদিও কলেজে-কলেজে ছাত্র-ছাট্রীরা আজকাল অধ্যাপকদের অ্যাবরিভিয়েট করে ফেলেছে । লেকচারারকে লেকচু, রিডারকে রেড্ডি, প্রফেসরকে পাফি ।
বিশাল বাঙলোবাড়িটায় আগেই, এক-কালের সাকরেদ এক সাব-ইন্সপেকটরকে দুজন কন্সটেবলের সঙ্গে পাঠিয়ে দিয়েছিল রিমা খান । কন্সটেবল দুজনকে রিমা ব্যক্তিগত অনুরোধ করে এনেছে । তারা গেট খুলে যে-ঘরে কংকাল প্রেমিক হাসিমুখে দাঁত বের করে শুয়ে আছে , সেখানে মুখ গোমড়া করে বা মুখে গুটকা পুরে অপেক্ষা করছিল। রিমাকে আসতে দেখে স্যালুট ঠুকল । রিমা বলল, তোরা গেটের কাছে গিয়ে অপেক্ষা কর , বুড়ো ডাকতার এলে খাতির করে একজন নিয়ে আসিস । বেশি কথা বলিসনি । বুড়োটার পয়সার আর অপারেশান টেবিলে রুগি মারার গোমর আছে । কম বয়সে জেলা হাসপাতালে থাকতে ওষুধের হেরফের করত পাবলিকের ঠ্যাঙানিও খেয়েছিল তাই , এখন অগাধ টাকার মালিক ।
সার্জেন ওহদেদারকে ঘরে পৌঁছে দিয়ে কন্সটেবল দুটো গেটে চলে গেল পাহারা দিতে যাতে কোনো অনুসন্ধিৎসু ঢুকে না পড়ে । এত বেকার দেশটায় যে যারা রাজনীতিকদের পোঁ হতে পারেনি বা বিচি ধরে ঝুলতে পায়নি তারা কোথাও কিছু দেখলেই জুটে যায় ; বাড়ি ফিরবে দুপুরের খাবার সময় । নানা খবর জুটিয়ে বিকালে চায়ের ঠেকে গিয়ে গপপো ফাঁদবে ।। তারপর ক্লাবে গিয়ে এইসান হল, ওইসান হল, গেঁড়া একটা চাদে , কালো, খাতায় লিখে নিস । কালীপুজো বা দুর্গাপুজোর চাঁদা তোলার পর কালো চা-অলার হিসাব হবে । প্রমোদ দাশগুপ্ত অবিবাহিত ছিলেন তো কি ; ক্লাবে-ক্লাবে ওনার বংশধররা অবিবাহের ভোজ খাচ্ছে ।
—আসুন স্যার । কংকালটা যেভাবে ছিল তেমনভাবেই রাখা আছে । কেউ এর ক্লেম করেনি ; কোনো উত্তরাধিকারীরও কংকালটার আছে কি না খোঁজ পাওয়া যায়নি । আমরা ঘরের ভেতরে আরও কয়েকটা জিনিস পেয়েছি , তবে আপনি কেবল কংকালটা সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত দেবেন । প্রথম প্রশ্ন হল, কংকালটা পুরুষের না নারীর ?
—কংকালটা যে পুরুষের তা আপনি লে-ম্যান, আই মিন মহিলাদেরও তো লে-ম্যান বলা হয় বোধহয় , লে-উওম্যান তো শুনিনি, এনি ওয়ে, সাধারণ মানুষ হিসাবেও দেখলে বুঝতে পারবেন । তবে যেহেতু এটা পুলিস কেস, আপনারা মনে করছেন সামবডি মাস্ট হ্যাভ অ্যারেঞ্জড ফর হিজ ডেথ, তাই কংকালটার সেক্স আইডেনটিফাই করার পয়েন্টগুলো বলি আপনাকে ।
সকালে ডেড বডি দেখলে ওহদেদার শ্রীহরি শ্রীহরি বলেন, হরি তাঁদের পারিবারিক দেবতা, বগুড়ার সময় থেকে । মনে-মনে বললেন মন্তরটা । এমবিবিএস আর এমএস পাশ করেছেন এই মন্তরের জোরে । স্কুলের প্রথম শ্রেণী থেকে এই মন্তরটা কাজে দিচ্ছে । অবশ্য অপারেশান টেবিলে শোয়া কোনো-কোনো রোগির ক্ষেত্রে কেন যে মন্তরটা কাজে দেয় না তার একটা উত্তর উনি নিজেকে বুঝিয়েছেন : ফিসটা কাটাকাটির ঘামের চেয়ে কম ছিল ।
—প্রফেসর ওহদেদার, আমি কংকালের একটা ড্রইং এনেছি । আপনি স্পটগুলো ডিমারকেট করতে থাকুন, আমি ড্রইংটায় সেই জায়গাগুলো মার্ক করে লিখে নেবো । কেসটা যদি শেষ পর্যন্ত আদালতে পৌঁছোয়, তাহলে পাবলিক প্রসিকিউটারকে ব্রিফ দিতে সুবিধা হবে । আপনি যা-যা বলবেন তা-ও রেকর্ড করে নেবো । আমি সঙ্গে টেপ রেকর্ডার এনেছি । কেননা লে-উওম্যান হিসাবে টেকনিকাল ডিটেইলসগুলো মনে রাখতে পারব না ।
—ডোন্ট টেক ইট আদারওয়াইজ, পুরুষদের কংকাল মাপে বড় , লম্বা আর ভারি হয় । স্ত্রীলোকের বক্ষপিঞ্জর পুরুষের চেয়ে আকারে ছোটো কিন্তু ওপরের অংশ পুরুষের চেয়ে তুলনামূলকভাবে চওড়া । মুচকি হাসি সহযোগে মুচমুচ করে বললেন ওহদেদার সার্জেন । বিদেশ হলে এই কংকালটা নারীর কিনা তা নিয়ে আপনাকে প্রাথমিকভাবে চিন্তা করতে হতো , এর উচ্চতার জন্য । আমাদের দেশে এত দীর্ঘাঙ্গী মেয়ে হয় না , আই মিন মহিলা হন না । এমনকি এই পুরুষটিও আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে দীর্ঘদেহী । বিশেষ করে বাঙালিরা সচরাচর এত লম্বা হন না ।
—আজ্ঞে, আমরা যা এভিডেন্স পেয়েছি, তা থেকে একটা নির্ণয়ে পৌঁছোনো গেছে যে ইনি বাঙালি, ভারতে নানা অঞ্চলে ঘুরেছেন, বিদেশেও ছিলেন , অনেক নরক-স্বর্গের শরবত খেয়েছেন ।
লোকটা যে মাগিবাজ ছিল তা সংগ্রহ করা তথ্যসামগ্রী থেকে জেনে গেছে রিমা । লম্পট পুরুষ শুনলে ওর নিজেরই যৌনতা টনটন করে , দেহে ফুরফুরে অনুভূতি হয় । সমকামী শুনলে অসহ্য লাগে, তা সে নারী হোক বা পুরুষ ; ওর মনে হয়, দিই জানোয়ারগুলোকে অন্তিমযাত্রার খোরাক । রিমা এখনও ভার্জিন ; ভার্জিনত্বের ব্যাখ্যাহীন গর্ব আছে ওর । ওটা ইনট্যাক্ট রেখেছে লিগাল বরের জন্য । যদিও ম্যাস্টারবেট করার দরুণ হাইমেন ছিঁড়ে গিয়ে থাকবে । লিগাল বর কবে জুটবে বা অদৌ জুটবে কি না জানে না । কাউকেই রিমার পছন্দ হয় না । বিয়ের জুন্যে যে-পুরুষেরই ফোটো মা-বাবা গত এক দশক থেকে দেখছেন দেখাচ্ছেন , সবকটাকেই ওর মনে হয় ক্রিমিনাল টাইপের । পুরুষ মাত্রেই সম্ভবত ক্রিমিনাল , ওর আবছে ধারণা । তাছাড়া যাকে বিয়ে করবে তাকে ধরে আচ্ছা করে উত্তম-মধ্যম না দিলে অরগ্যাজম তো হবে না । আর, কোনো পুরুষের নিচে শুয়ে সন্তান উৎপাদনের প্রক্রিয়াটা প্রাগৈতিহাসিক । সমাজ যখন মাতৃতান্ত্রিক ছিল তখন মেয়েরা থাকত ওপরে আর পুরুষরা নিচে । এক-এক জন নারীনেতার দশ-বারোটা করে বাঁদা থাকত । নাঃ, কী আবোল-তাবোল ভাবনা আসছে মাথায় ।
—হাঃ হাঃ, এই যে বাহুর হাড়, হিউমেরাস বা প্রগণ্ডাস্হি , উলনা বা অন্তঃপ্রকোষ্ঠী আর রেডিয়াস বা বহিঃপ্রকোষ্ঠী , আর এই যে ডাইয়াফাইসিস আর এপিফাইসিস , দেখুন, বেশ মোটা আর লম্বা । সার্জেন জানে এবার তার টেকনিকাল জার্গন হেঁকে মাঠ দখল করার পালা । বড় এসেছেন মহিলা পুলিস, বোঝো এবার ।
—হাতের পাতা ? রিমা টের পেল যে ওহদেদার এবার দেদার জার্গন ঝাড়বেন । ঝাড়ুন । টেপরেকর্ডার আছেই । চিহ্ণগুলো দিয়ে রাখছে , পরে ডিটেইলসে লিখে নিতে পারবে ।
—বলছি, আই অ্যাম কামিং টু দ্যাট । এই যে দেখছেন হাতের পাতার অস্হি, ওসা ক্র্যানাস । এটা করতলাস্হি বা কারপালস ; এগুলো করাঙ্গুলিমূল-শলাকা বা মেটাকারপালস , আর এই অঙ্গুলিফলক যাকে, আপনি জানেন নিশ্চই, আমরা বলি ফ্যালানজেস । পুরুষ বলে এদের মাপ বড়ো । আগেই বলেছি, বাঙালি জনগোষ্ঠীর প্রেক্ষিতে ইনি দীর্ঘদেহী ছিলেন , এবং এনার বাহুও লম্বা ছিল , যাকে আমরা বাঙালিরা বলি আজানুলম্বিত, হাৎ হাঃ । বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে অবশ্য এমন দীর্ঘদেহী লোকজন পাওয়া যাবে । তা তাঁরা তো বাংলাদেশে চলে গেছেন , আই মিন তখনকার পাকিস্তানে । এখানকার বাঙালি মুসলমান, এমনকি কৃষকদের মধ্যেও, এই উচ্চতার মানুষ বিরল । মাঠ দখল করে ফেলায় ওহদেদার খেলতে শুরু করে দিয়েছেন । খেলতে-খেলতে ক্রমে সাবলীল হয়ে গেলেন, যেন ক্লাস নিচ্ছেন ।
—আর তলাকার অংশ ? ড্রইঙে ১, ২, ৩, ৪ এইভাবে নম্বর দিয়ে লিখে নিচ্ছিল রিমা ।
—দেহের নিম্নপ্রান্তে, কংকালে থাকে শ্রোণীবৃত্ত ও নিম্নপ্রান্তের অস্হিগুলো । শ্রোণীবৃত্তের দুদিকে থাকে দুটি প্রসস্ত পেলভিস অস্হি । ত্রিকাস্হি ও অনুত্রিকাস্হির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পেলভিস অস্হিগুলো সৃষ্টি করে শ্রোণীচক্র , এই যে, এই অংশে । মুক্ত নিম্নপ্রান্তের অস্হিগুলোর মধ্যে পড়ে উর্বাস্হি , নিম্ন-পায়ের ও চরণের অস্হিগুলো । আর চরণের এই অস্হিগুলোর মধ্যে থাকে গুল্ফাস্হি , পদতলাস্হি ও পদাঙ্গুলিফলক । লিখে নিন, লিখে নিন, ইউ হ্যাভ ইয়োর ওন টাইম ।
—না, স্যার, প্রথমে আমরা ইনি মহিলা না পুরুষ সেই পয়েন্টগুলো আইডেনটিফাই করে নিই । আমি জানি ইনি পুরুষ । কিন্তু কোর্টকে তো জানাতে হবে কি-কি দেখে এনাকে পুরুষ ঘোষণা করা হল , এবং কোন বিশেষজ্ঞ তা করলেন ।
—ফাইন । পুরুষ ও মহিলা কংকালের প্রধান পার্থক্য হল, মহিলাদের দেহে সন্তান জন্ম দেবার ব্যবস্হা থাকে । এই যে এই দিকে নজর দিন , আপনার ড্রইঙে মার্ক করে নিন । মেয়েদের পেলভিস আকারে ছোটো হলেও তা শ্যালো এবং চওড়া ; ক্যাভিটি গোলাকৃতি । এটা দেখছেন , মেয়ে হলে ইলিয়াম অস্হির ডানার অংশ বেশি ছড়ানো হতো , ত্রিকাস্হির প্রমোন্টারি পেলভিসের শূন্যস্হানের ভেতর কম ঢোকা হতো । ইনি পুরুষ বলে দেখুন এনার ক্ষেত্রে সিমফাইসিসের নিচে দুই পিউবিসের নিচের শাখা দুটো নিজেদের মধ্যে যে-কোণ রচনা করেছে তা সমকোণের চেয়ে ছোটো । মহিলাদের ক্ষেত্রে তা স্হুলকোণ আর তা প্রায় ধনুকের মতন । গাইনাকদের তো পেলভিসের মাপ জানা খুবই জরুরি । যাক সার্জেন এবার পুলিসি প্রয়োজনে সিরিয়াস হচ্ছেন ।
—স্যার, আপনারা দেহের ভেতরটা ভাবতেই অভ্যস্ত । আমরা বাইরেটা । মৃদু খোঁচা দিল রিমা । দশজনের ভিড়ের ভেতর কেবল মেয়েদের দিকেই তাকিয়ে দেখে পুরুষগুলো , কি বুড়ো, কি ছোঁড়া ।
—কশেরুকার শেষভাগের খোঁচা-অস্হি বা কচিক্স, মানুষের পূর্বপুরুষদের ল্যাজের অংশ , এই যে, মহিলাদের ক্ষেত্রে এটা মুভেবল । পুরুষদের হাড়কে আকৃতি দেয় টেসটোসটেরোন হরমোন আর মহিলাদের এসট্রোজেন ।
—মাথাটা সম্পর্কে জানা হয়নি ।
—মাথা ? ইউ মিন করোটি , কৈনিয়াম ? এদিকে আসুন । হাত দেবো কি ? আচ্ছা, বসুন, বসে দেখুন, হাত দেবার দরকার নেই । করোটির পেছন দিকটা দেখছেন , উঁচু একটা বাল্জ , এক্সটারনাল অক্সিপেটাল প্রোট্রুবারেন্স , ইনি পুরুষ বলে এই অংশ বেশ প্রোনাউন্সড । চোয়ালের হাড় দেখুন , আমরা বলি ম্যানডিবল, এটি পুরুষের বলে অ্যাংগুলার আর চৌকো । মহিলাদের ক্ষেত্রে এটা গোলাকার এবং পয়েন্টেড হয় । প্রকৃতি নারীকে হাড়ের দিক থেকেও সুন্দর রেখেছে । আপনাকে জন্ম নিতে হলে একটি সুন্দর জায়গা থেকেই তো পৃথিবীতে আসতে হবে । আসার পথটা অবশ্য রক্তময় , তা জীবনযুদ্ধে আপনাকে তৈরি করে পাঠাবার জন্যে সুন্দর গৃহে গড়েপিটে তারপর পাঠানো হয় যুদ্ধক্ষেত্রের রক্তভূমিতে । এইবার আপনি জগতে এসে কী করবেন তা আপনাকে নির্ণয় নিতে হবে ।
—করোটিতে কি কোনো আঘাত দেখছেন ?
—না, আঘাত অ্যাজ সাচ, মানে কেউ পিটিয়ে বা ভারি জিনিস দিয়ে মাথায় মেরে খুন করেনি এনাকে । কিন্তু কিছু ব্যাপার স্ট্রেঞ্জ । তা হল হাড়ের সঙ্গে হাড়ের সংযোগগুলো দেখুন । অস্হিসন্ধিগুলো কয়েকটা অংশে খুলে গেছে । আপনারা পুলিসের লোকেরা আর হলিউডের ক্রিমিনালরা শুনি হাত-পা টেনে-টেনে থার্ড ডিগ্রি দিয়ে কথা আদায় করলে যেমন হবে । কিন্তু সেক্ষেত্রেও এভাবে ডিসজয়েন্টেড হবে না । আরেকটা ব্যাপার লক্ষ করছি । তা হল দাগগুলো । এরকম আঁচড়ের দাগ কেন হাড়গুলোয় , বিভিন্ন জায়গায়, এবং কেবল একদিকেই বেশি । খাট থেকে ভদ্রলোক কি করে পড়ে গেলেন ? পড়ে মরে গেলেন ? নাকি হঅর্ট অ্যাটাকটা ওনাকে ফেলে দিল ? হ্যাঁ, তাও হতে পারে , ম্যাসিভ একটা হার্ট বা সেরিব্রাল কান্ডিশান হয়ে থাকতে পারে । ভদ্রলোক ডেথ বেডে থাকলে আমি বলতে পারতাম তা ঘটৈছে কিনা । এখন এনার যা অবস্হা , আপনাকে কোনো ফরেনসিক বিশেষজ্ঞের মতামত নিতে হবে ।
—কোন কোন জয়েন্টগুলো ডিসজয়েন্টেড , তা যদি একটু বিস্তারিত বলেন তো ভালো হয় স্যার ।
—এই দেখুন, স্কন্ধবৃত্তের অস্হিসন্ধি ; অক্ষকাস্হি বা ক্ল্যাভিকুলা তার দুই অন্তভাগ দিয়ে জোড়া থাকবার কথা , একদিকে উরঃফলক বা বক্ষাস্হির ম্যানুব্রিয়ামের সঙ্গে ও অন্যদিকে অংশফলকের অ্যাক্রোমিয়াল উদগত অংশের সঙ্গে , ফলে তৈরি হয় দুটি অস্হিসন্ধি । উরৎফলক-অক্ষকাস্হি সন্ধি আর অ্যাক্রমিয় অক্ষকাস্হি সন্ধি । ভালো করে লক্ষ করুন , সন্ধিগুলো আলগা । এবার ডান হাতের কনুইয়ের অস্হিসন্ধি লক্ষ করুন । এটা তৈরি হয় তিনটি অস্হিসংযোগে : প্রগণ্ডাস্হি , অন্তঃপ্রকোষ্ঠাস্হি আর বহিঃপ্রকোষ্ঠাস্হি । আলগা । খুলে গেছে । জোড় আলগা হয়ে রয়েছে । একইভাবে হাঁটুর, ডান হাঁটুর, অস্হিসন্ধিও ডিসজয়েন্টেড । দেখুন , এটা তিনটে অস্হির সংযোগে তৈরি : উর্বাস্হি , জঙ্ঘাস্হি আর জানুকাপালিক । আমরা ডাকতারি পড়ার সময়ে ডেডবডির এই জয়েন্টগুলো স্টাডি করতুম । কেসটা এরকম ইনটারেসটিং জানলে আমি কয়েকজন ছাত্রকে সঙ্গে আনতুম ।
—কেস শেষ হয়ে গেলে কংকালটা অযথা আমাদের মালখানায় পড়ে থাকবে । তার চেয়ে আপনাদের দেবার জন্যে আমি অনুরোধ করব । আপনিও ডিজি সায়েবকে বলে রাখবেন । আর কোনো জয়েন্টে আছে কি ব্যাপারটা ?
—হ্যাঁ, বক্ষদেশের সংযুক্তি , ডান পায়ের কব্জির অস্হিসন্ধি , রগের ও চোয়ালের অস্হিসন্ধি এবং ডান দিকের উরুসন্ধি । দেখুন, দেখুন, এতক্ষণে তো আপনিও কিছুটা এক্সপার্ট হয়ে গেছেন ।
—ওকে, থ্যাংক ইউ সো মাচ স্যার ।
—আপনারা কি অনুমান করছেন ? আত্মহত্যা না মাডফার ? স্বাভাবিক মৃত্যু যে নয় তা আমি আপনাকে এখনই বলে রাখছি । এনার স্পাইন আর ব্রেনে সম্ভবত ইনফেকশান হয়েছিল । আপনার আগে যিনি তদন্ত করেছিলেন তিনি কিছু খুঁজে পাননি ? অবশ্য কেউ যদি কংকালটা টানাটানি করে থাকেন তাহলে আলাদা কথা ।
—আমরা অস্বাভাবিক মৃত্যু মনে করেই এগোচ্ছি । আসলে প্রবলেম হল যে বাড়িটা আর বাড়ির এই ঘর, দুটোই ভেতর থেকে বন্ধ ছিল । তার আগের তদন্তকারী আধিকারিকদের প্রসঙ্গ ওঠায় বিরক্ত হল রিমা । সুমন মিশ্র , সে তো পুরুষ অফিসার, ফাঁকিবাজ, রাজনীতি নিয়ে কপচানিতে তার দিন কাবার হতো , পার্টি না করলে বাজে জায়গায় পোস্টিঙের ভয় ছিল । এ-সব কেসে তো আর মাল-কড়ি নেই । মাল-কড়ি না থাকলে রিমাও বিশেষ আগ্রহ দেখায় না, মানে দেখাত না, সাস পেন্ড হবার আগে পর্যন্ত । এই কেসটা বাধ্য হয়ে তদন্ত করছে । খুঁজে বের করতেই হবে অপরাধীকে । ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ আগের তদন্তকারী অফিসারকে যে রিপোর্ট দিয়েছেন , তা নির্ভুল নয়, কেননা তখন ফরেনসিক দপতরটায় লোকবল আর যন্ত্রপাতি-কেমিকাল ছিল না । তবু উনি যে রিপোর্ট দিয়েছেন, তাতে আছে যে কংকালটা আনিমানিক দশ বছর পড়ে আছে ; স্পাইনে ইনফেকশান হলেও, তা মৃত্যুর কারণ নয় । যদি কংকালটা অসুখের কারণে কোমায় চলে গিয়ে থাকে , তাও নাকি মৃত্যুর কারণ নয় । কংকালের গায়ে আঁচড়ের দাগ আর অস্হিসংযোগের বিচ্ছিন্নতা সন্দেহ জাগায় । বাড়িটা এতকাল পড়ে আছে অথচ প্রোমোটার বা জবলদখলকারীদের নজরে না পড়ায় কংকালটা শুয়ে আছে দশ বছর হাসি-মুখে । পুলিস সিল করে দিয়েছিল বাড়িটার গেট আর সদর দরজা , সেগুনকাঠের সদর দরজা ।
—তাহলে এত মাথা ঘামাচ্ছেন কেন ? আপনাদের তো প্রতিদিনকার ক্রিমিনাল ডাটাই প্রচুর । অপরাধ কম দেখানোতেই যখন আপনাদের স্বার্থ তখন কেন এই কেঁচো খোঁড়া ?
—তার কারণ এই ভদ্রলোক, নিরঞ্জন দতত, যদিও ওটা ওনার প্রকৃত নাম না ছদ্মনাম তা এখনও লিগালি স্পষ্ট নয়, এই লোকটি যে প্রচুর বিত্ত-বৈভবের মালিক তা ঘরগুলোর ডেকোরেশান আর কিউরিও সামগ্রী থেকে স্পষ্ট । স্হাবর সম্পত্তির কাগজ পাচ্ছি না আমরা । অস্হাবর কি-কি ছিল তাও ক্লিয়ার হয়নি এখনও । ব্যাংকের, নিবেশের কাগজ, মোবাইল ফোন, মানে এনার টাকাকড়িউর হিসাব পাওয়া যাচ্ছে না । সেগুলো গেল কোথায় ? আত্মীয়-স্বজন একেবারেই নেই এরকম মানুষ তো বিরল । আর বৈভবশালীর মৃত্যুতে সাধারণত আত্মীয়দের কিউ লেগে যাবার কথা !
—আচ্ছা, আমি চলি । একটা ক্লাস আছে আজকে । যদি আরো কিছু জানার থাকে কনট্যাক্ট করবেন ।
—চলুন স্যার আপনাকে পৌঁছে দিই ।
—না না, আপনি নিজের ইনভেসটিগেশান কমপ্লিট করুন । আমি তো গাড়ি করে এসেছি । প্রায়ভেট ডিটেকটিভ কেউ আগ্রহ দেখাননি ? কেসটা তো ইনটারেসটিং । ওনারা তো এই টাইপের কেস হিসট্রি থেকে জব্বর একখানা বেস্টসেলার নামিয়ে দেন ।
—আমি নিজেই গিয়েছিলাম ব্যোমকেশ বক্সি, কিরীটি রায় আর পি সি মিটারের কাছে । ব্যোমকেশবাবু বৃদ্ধ হয়েছেন , চোখে দেখতে পান না । ফেলুদা সিনেমা থেকে সময় করে উঠতে পারছেন না , আর কিরীটি রায় তো নীহাররঞ্জন মশায়ের নতুন অমনিবাস সংস্করণ বের করায় ব্যস্ত । তবে তিন জনেই মনে করেন যে ওনারা যখন কেস নিতেন তখন ডিটেকটিভকে বলা হতো সত্যান্বেষী ; বর্তমানকালে সত্য জিনিসটা বলপ্রয়োগের ব্যাপার , যার হাতে ক্ষমতা সে-ই সত্যের মালিক ।
—আমার সঙ্গে একজন অভিজ্ঞ সত্যান্বেষীর পরিচয় আছে । কর্ণেল নিলাদ্রী সরকার । ডিটেকটিভ হিসাবে নাম-ডাক করেছেন । বলেন তো ওনাকে কেসটার কথা বলি ।
—না স্যার, ওনারা বেশ ব্যস্ত লোক । পূজা-পার্বণ লেগেই থাকে পত্রিকার অফিসগুলোয় , জানেনই তো । কর্ণেল সায়েবের সঙ্গে দেখা করেছিলাম । উনি বললেন, ইরাকে আফগানিস্তানে চেচনিয়ায় প্রতিদিন অগুন্তি মানুষ খুন হচ্ছে , তা তো ইতিহাসের পাহাড়ে চাপা পড়ে যায় ; একটা-দুটো হত্যা আর গুপ্তধনের গল্প বইয়ের পাতাতেই শোভা পায় , স্কুলের ছাত্রদেরও কিছুটা টেনশান দূর করে । বললেন, তোর চাকরির ব্যাপার, তুই মাথা ঘামা ।
—তা ঠিক । আরেকজন ছিলেন । আগে বেশ নাম শুনতুম । কিন্তু তিনি আজকাল অ্যাস্ট্রলজির দিকে ঝুঁকেছেন শুনেছি । আপনারা সরকারি ডিটেকটিভরাই সব কেস নিয়ে নিচ্ছেন তো ওনারা কী করবেন বলুন ? ওনাদেরও তো করে-কম্মে খেতে হবে !
—আপনি দীপক চ্যাটার্জির কথা বলছেন তো ? হ্যাঁ, উনি প্রফেশান চেঞ্জ করেছেন । উনি বলছিলেন উত্তরপ্রদেশের ফরেনসিক অ্যাস্ট্রলজিস্ট উপাধ্যায়জির সঙ্গে দেখা করতে । কে খুন করেছে জানলে বা কে খুন হয়েছে জানলে না হয় ফরেনসিক অ্যাস্ট্রলজিস্ট কনসাল্ট করা যেতো । উপাধ্যায়জী, অপরাধী বা সাক্ষীকে প্রশ্ন করেন আর তার ছক তৈরি করে উত্তর খোঁজেন । কে খুন হয়েছে আর কে খুন করেছে সে-দুটোই তো খুঁজছি । তাছাড়া এনারা সবাই প্যাট্রিয়ার্কাল মাইন্ডসেটের লোক । মহিলা পুলিস অফিসার শুনলে অফেন্ডেড হন , ঘাবড়ে যান ।
—ইজ ইট ? মে বি । বাঙালির সমাজে বিপ্লব-বিদ্রোহ নিয়ে বেশির ভাগ মানুষ প্লে অ্যাকটিং করেন । প্রকৃত সমাজে তা ঘটতে দেন না । দেখুন না, শতকরা তেত্রিশভাগ মহিলা ক্যান্ডিডেট কোনো দলই দেন না , বিধানসভা বা লোকসভায় সিট দেয়া তো দূরের কথা । কাকাবাবু-সন্তু কী বললেন ? গিয়েছিলেন নাকি তাঁদের কাছে ?
—না স্যার । কাকাবাবুর শুনেছি দুটো হাঁটুই অপারেশান করে পালটাতে হয়েছে । গাড়ি ছাড়া নড়েন না । তাই শান্তিনিকেতনে একটা বাড়ি করেছেন । ওনার ডিটেকটিভ জীবনের যাবতীয় নথিপত্রের একটা সংগ্রহশালা রেখে যাবেন বলে শুনেছি ।
—গুড ডিসিশান । রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিচিহ্ণ তো চোরেরা নিয়ে কোথায় পালিয়েছে আপনারাও জানেন না । নতুন চোরেদের জন্যে নতুন সংগ্রহশালা গড়ে ওঠা প্রয়োজন । গুড গুড ।
ডক্টর ওহদেদারকে গাড়িতে সি অফ করে ফিরে এসে সাবইন্সপেক্টর আর কন্সটেবলদের রিমা খান আদেশ দিল সদর দরজা আর গেট বন্ধ করে সিল করে দিতে । সিল মানে তালায় কাপড় বেঁধে গালা লাগিয়ে চাবির দাগ করে দেয়া । সরকারি সিলের হাজার হ্যাঙ্গাম । পাবলিককে থামাবার জন্যে গালার সিল থাকাটা জরুরি । নয়তি জবরদখল হবে বা প্রোমোটার ঢুকে যাবে । এভিডেন্সগুলো নিয়ে বসতে হবে , ভাবতে হবে, প্রচুর কমপিউটার ডিস্ক পাওয়া গেছে বাড়িটায়, সেগুলো দেখতে হবে । কেননা যেকটা দেখেছে সেগুলো তেলেগু ভাষায় লেখা , অনুবাদ করাতে সময় লাগছে । অক্ষর তেলেগু, লেখা বাংলা ন্যারেটিভ, তাই আরও অসুবিধা । একটা ঘরের খামের ভেতরে মহিলার চুল পাওয়া গেছে । সেটা কার । ড্রেসিং টেবিলের ব্রাশে যে-কটা চুল পাওয়া গেছে, আগের ইনভেসটিগেটিং অফিসার রমেনবাবু লিখেছেন যে সাধারণ চোখে দেখে মনে হয় যে তা একই মহিলার নয় । কুকুরটার দাঁতের ডিএনএ নিয়ে দেখতে হবে যে কংকালটার মাংস কুকুরটাই খেয়েছে কিনা ।
বাড়ির দিকে মোটরসাইকেল হাঁকালো রিমা ।
( For rest of the story click on Older Posts )
Tagged ডিটেকটিভ উপন্যাস |
৮. মায়াবিনী
আমাদের চালাঘরটা, যাকে আমরা বলি কুটির, দুজনে মিলে পুর্ননির্মাণ করে নিয়েছি । ছাত্রছাত্রীরাও সাহায্য করেছিল , তাদের ব্ল্যাকবোর্ড যাতে তাড়াতাড়ি লেপে নিয়ে শুকিয়ে নেয়া যায় । আগের চেয়ে ভালো করে মাটি লেপে নেয়া হয়েছে । মাটি আর পেঁপের গুঁড়ি আনতে বেশ দূরে যেতে হয়েছিল। গাছের ডালে রেখে মশারি শুকোবার আগে আমরা ভিজে মশারি টাঙিয়েই শুয়েছি। আমি এখনও ফোলানো বালিশের অভ্যাস ছাড়তে পারিনি । মায়া এখানে আসার কয়েক দিনের মধ্যেই বিনা বালিশে শোবার অভ্যাস করে নিয়েছে । আমি অনেক সময়ে আমার বাহুটা এগিয়ে দিই , যাতে বালিশের মত ব্যবহার করতে পারে । মায়া বলে, বদভ্যাস করাবেন না প্লিজ ,বলে জড়িয়ে ধরে । ওকে বলি, ইংরেজি শব্দ থেকে মুক্ত হতে পারছি না আমরা , আপনি তবু চেষ্টা করেন যাতে অসাবধানে বলে না ফেলেন ; আমি পড়েছি গণিত, বাড়িতে ইংরেজিতে কেউই কথা বলতেন না , তবু বলে ফেলি ।
মায়া বলেছিল, আবার অতীতকে টেনে আনছেন ; আমাকে দেখুন , অতীত একেবারে মুছে ফেলেছি , যদিও মস্তিষ্কে অতীতের ঘুণপোকা সহজে মরে না , মারার চেষ্টা করে যাচ্ছি ; একটা ঘুণপোকা মরেনি এখনও । তারপর যোগ করেছিল, দুজনে পরস্পরকে নিয়ে থাকতে পারি, দেখছেন তো ? আধুনিকতার প্রয়োজন একেবারে নেই । আমাদের মধ্যে কোনো মতসংঘর্ষও ঘটেনি ; তার প্রধান কারণ আপনি, আপনার বদান্যতা, উদারচিত্ততা । আমার সব কথাই মেনে নেন ।
—মানব না কেন ? এক ডাকে চলে এসেছি । কত শেখার আছে প্রকৃতিতে । কত কিছু জানেন আপনি । আমাদের চারপাশে এত গাছপালা ঝোপঝাড় , এগুলোর নাম জানি না ; বালু সিরিসৈলমরা শেখায়, অথচ দেখুন, তা সংখ্যায় এত বেশি যে মনে রাখতে পারি না ।
—আমিও তো কত কীট-পতঙ্গ প্রতিদিন দেখছি, সিরিসৈলম, কালেসরম বলেও ওগুলোর নাম, তারপর ভুলে যাই । বাংলায় হলে বোধহয় মনে রাখতে পারতাম।
—লোকে তো কীট বা প্রজাপতি সংগ্রহ করে অ্যালবামে রাখে ।
মায়া উঠে বসল , অত্যন্ত ক্ষুব্ধ । কন্ঠস্বরে বোঝা যাচ্ছিল যে ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করে বলছে , বলল, আপনাকে বলেছিলাম না , কোনো প্রাণীর ক্ষতি করা যাবে না ; আমাদের অশেষ ভাগ্য যে আমরা এরকম একটা জনবসতি [পেয়েছি যেখানের মানুষ মাছ-মাংস-দুধ-ডিম খাবার সংস্কৃতির বাইরে থাকে ; তার সুযোগ নেই বলেই হয়তো গড়ে উঠেছে এই শাকাহারী অল্পাহারী জীবনযাত্রা । প্রাণী হত্যা আমি বরদাস্ত করতে পারি না । গোরুর দুধ হয় তার বাছুরের জন্য, তাও মানুষ খেয়ে ফেলে , ইনজেকশান দিয়ে গোরুমোষের দুধ বাড়ায়, এতই নির্দয় হয়ে গেছি আমরা । অকল্পনীয় নির্দয়তা নিষ্ঠুরতায় আক্রান্ত হয়েছে মানুষ । তাই জনে-জনে এত ঘৃণা আর দ্বেষ ; দেশে-দেশে যুদ্ধ , মানুষে-মানুষে হানাহানি । সবাইকে না পারি, নিজেকে তো বদলাতে পারি , আপনাকেও তো পারি ।
কি উত্তর দেবো ভেবে পেলুম না । সবকিছু ছেড়েছুড়ে, ‘চলুন পালাই’ ডাক শুনে যখন বেরিয়ে পড়েছিলুম, মনে হয়েছিল অ্যাডভেঞ্চারে যাচ্ছি । তখন ভাবিনি যে মায়াকে ভালোবেসে থেকে যাব , ওকে ভালোবাসাটাই থেকে যাবার একমাত্র কারণ হবে । অনেক্ষণ চুপচাপ থেকে বলেছিলুম, জানেন, হয়তো জেনে ফেলেছেন, আপনাকে ভালোবাসাটাই আমার জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য এখন , সব সময় মনে হয় হঠাৎ যদি ‘চলুন পালাই’-এর ঢঙে একদিন বলে ওঠেন, ‘আচ্ছা চলি’ , তাহলে কী করব ? নিজের ঠোট দিয়ে আমার মুখ বন্ধ করে মায়া বলেছিল, না, কখনও যাব না, এখানেই মরব, বুড়ি হয়ে ; আপনিও তখন বুড়ো হয়ে যাবেন , আপনার চুল-দাড়ি সব পেকে যাবে । কেমন হবে দেখতে তখন আপনাকে ? নাভি পর্যন্ত পাকা দাড়ি , কাঁধ ছাপিয়ে পাকা চুল । আমার চোখের প্রতিফলনে তো নিজেকে আর দেখতে পাবেন না তখন, কেননা আমার চোখ ঘোলাটে হয়ে যাবে, হয়তো ছানি-পড়া ।
আমি জঙ্গলের গভীর অঞ্চলে যেতে চাইলে মায়া বলে, যান, কিন্তু বেশি দূরে যাবেন না , নয়তো কাউকে সঙ্গে নিয়ে যান । নয়তো বলে, যান, কিন্তু আমি হাঁক পাড়লে চলে আসতে পারেন, এমন দূরত্বেই যাবেন । মায়াও জল ভরতে গিয়ে দেরি হতে থাকলে, আমারও চিন্তা হয়–এই ধরণের চিন্তার অভিজ্ঞতা হয়নি কখনও এর আগে । কুয়োতলায় ও বেশ সময় কাটায় , জ্ঞান দেয় মহিলাদের, অবিবাহিতা কিশোরীদের— জানতে চাইতে ইচ্ছা হতো যে কীই বা আলোচনা করে তাদের সঙ্গে এতো, কিন্তু মেয়েলি ব্যাপারে নাক গলানোটা উচিত হবে না মনে করে কখনও জানতে চাইনি । একটা চালা থেকে আরেকটা চালা এমন দূরে-দূরে যে কুয়োতলাটাই মহিলাদের মিটিং প্লেস । বালুদের কাছ থেকে যতটা জেনেছি, ওরা নিজেরাই যতটা বলেছে, কুয়োতলাটা মায়ার ভাষা শিক্ষার ক্লাস, সমাজশিক্ষার ক্লাস, আচার-ব্যবহার শেখার ক্লাস । ও অন্তত স্হানীয় বুলি বুঝে ফেলতে, ভাঙা ভাঙা বলতে শুরু করেছে । আমি এখনও বালু-সিরিসৈলমদের ব্যাখ্যার ওপর নির্ভরশীল।
কাঁঠাল গাছের দাগ দেখে অনুমান করতে পারি যে আমরা সাড়ে তিন বছরের মতন সময় কাটিয়ে দিয়েছি এখানে । ফেলে-আসা জীবন মনেই পড়ত না প্রায় । আমার গণিত নয় , মায়ার নিজস্ব শারীরিক-গাণিতিক অঙ্কের কারণে ওর গর্ভসঞ্চার হয়নি । কী ভয়ানক বিপদ হতো যদি তা ঘটে যেত । যদিও স্হানীয় বয়স্কা বৃদ্ধারা গর্ভপাতের বনৌষধি হদিশ জানেন, মায়ার মুখেই শুনেছি, তা অত্যন্ত বিপজ্জনক বলে মনে হতো আমার । প্রকৃতির উচিত ছিল নারীকে এমন একটা ইচ্ছাশক্তি দেয়া যে তারা চাইলেই তাদের মেন্সের দেহপ্রক্রিয়া থেমে যাবে সে যতদিন চায় ।
একদিন ভুলে জিগ্যেস করে ফেলেছিলুম, আপনি গান জানেন ? মায়া মৃদু হেসে বলেছিল, সত্যি অতীত আপনাকে ছাড়তে পারছে না । তারপর অনেকক্ষণ চুপ থেকে বলেছিল, আমি বাংলা বা হিন্দি গান জানি না, পাশ্চাত্য গান জানি , জানতুম, বলা উচিত । আমি কিছু জানি কিনা প্রশ্ন করবে না মায়া , জানতুম, তাই যেচে বললুম, আমার রবীন্দ্রসঙ্গীত ভালো লাগত, স্কুল কলেজের ফাংশানে গাইতামও । বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে বাংলা-হিন্দি সিনেমার গানও ভালো লাগে ।
এই অঞ্চলে কারোর হাতে ট্র্যানজিসটারও দেখিনি । এরা নিজেদের ভাষায় অনেক সময়ে গেয়ে ওঠে , সে গানগুলো কেমন যেন দুঃখি-দুঃখি লাগে ।
—হ্যাঁ, আপনার কন্ঠস্বর আপনার মতই দরাজ । গণিতবিশেষজ্ঞরা সঙ্গীতে পারদর্শী হন ; সঙ্গীত তো গণিতনির্ভর , ধ্বনির মাপ দিয়ে গড়া । যাকগে, বর্তমানেই বসবাস করুন । কত সুন্দর আমাদের বর্তমান , ভাবুন আপনি, কত শান্তি, আজ পর্যন্ত আমাদের জ্বরজারিও হয়নি । তার কারণ আমরা আধুনিকতার বিষ থেকে মুক্ত ।
আরেক দিন, মায়া শুয়েছিল চাটাইয়ের ওপর, দেখলুম ওর বাঁ পায়ে নুপুরের মতন উলকি আঁকা । বললুম, দেখুন, অতীতের স্মৃতি বহন করছেন শরীরে । দুটো পায়েই করাতে পারতেন । মায়া ফিরে গেল অতীতে, বলল, কলেজের স্মৃতি, ক্লাসের সকলে ট্যাটু আঁকিয়ে নেবার জন্য আমরা দল বেঁধে গিয়েছিলাম ; জনৈক ট্যাটু আর্টিস্ট নতুন স্টুডিও খুলেছিলেন , ফ্রি ট্যাটু এঁকে দেবার প্রস্তাব দিলেন । হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন অতীতের দৃশ্য-অদৃশ্য ভুল বহন করছি শরীরে । তারপর বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলেছিল, মনেও ।
আমি আর প্রস্ন করিনি । চোখ বুজে আমি ওর উলকি-আঙকা পা দেখতে পাই, কী অপূর্ব । দেয়ালে গোবর লেপার সময়ে ওর শাড়ি একটু উঠে গিয়ে উলকি মেলে ধরত , আর মনে হত নৃত্যরতা মায়া ।
মায়া, তুমি এখন কোথায় ? দ্যাখো, আমি চুল-দাড়ি রাখি না । প্রায় প্রতিদিনই শেভার দিয়ে মাথা শেভ করে ন্যাড়া হয়ে থাকি, কেননা আমার চুল বেশ পেকে গেছে , আর আমি মাথাভরা পাকাচুল নিয়ে তোমার অনুপস্হিতির ভার বইতে পারব না । শেষনিকেও বলেছি যে আমি যদি ন্যাড়া হতে ভুলে যাই, কোনোদিন যদি চুল দেখা যায় মাথায়, তাহলে যেন শেভ করে দেয় । শেষনি তোমার গল্প শোনার জন্যে উন্মুখ । শেষনিকে কিন্তু তোমার নাম বলিনি এখনও । তোমার নাম উচ্চারণ করার অধিকার একমাত্র আমার ।
টাইপ করতে বসে কান্না পেয়ে যাচ্ছে আমার , আবেগে আক্রান্ত হয়ে উদ্বেল হয়ে উঠছি । আবার রাতে লিখব বা কাল সকালে লিখব । শেষনি বিকালে আসবে বলেছে , জানতে চায় কতদূর লেখা হল , কোন পর্যায়ে পৌঁছোলুম । ও যখন বাংলায় ট্র্যান্সক্রিপ্ট নিয়ে বা ইংরেজিতে অনুবাদ করে পড়বে তখন জানতে পারবে ।
এতটা পড়ে, রিমাও দীর্ঘশ্বাস ফেলল, স্বগতোক্তি করল, তোমার লাভস্টোরি তাহলে অ্যাবরাপ্টলি থেমে গেল কেন কংকাল প্রেমিক ? যাকগে, আমিও টায়ার্ড তোমার রহস্য নিয়ে । দেখি, তোমায় নরক থেকে উদ্ধার করতে পারি কিনা ! তুমি মরার পর তোমার আত্মার শান্তি-সস্ত্যয়ন আমাকেই করতে হবে বোধহয় , কেননা, তোমায় তো আমরা অমর করে দেব, মেডিকাল ছাত্ররা তোমার কংকাল দেখে-দেখে পড়াশুনা করবে । আর প্রেমিক-প্রেমিকা ছাত্রছাত্রীরা অবাকচোখে তোমায় দেখতে আসবে ।
আমাদের চালাঘরটা, যাকে আমরা বলি কুটির, দুজনে মিলে পুর্ননির্মাণ করে নিয়েছি । ছাত্রছাত্রীরাও সাহায্য করেছিল , তাদের ব্ল্যাকবোর্ড যাতে তাড়াতাড়ি লেপে নিয়ে শুকিয়ে নেয়া যায় । আগের চেয়ে ভালো করে মাটি লেপে নেয়া হয়েছে । মাটি আর পেঁপের গুঁড়ি আনতে বেশ দূরে যেতে হয়েছিল। গাছের ডালে রেখে মশারি শুকোবার আগে আমরা ভিজে মশারি টাঙিয়েই শুয়েছি। আমি এখনও ফোলানো বালিশের অভ্যাস ছাড়তে পারিনি । মায়া এখানে আসার কয়েক দিনের মধ্যেই বিনা বালিশে শোবার অভ্যাস করে নিয়েছে । আমি অনেক সময়ে আমার বাহুটা এগিয়ে দিই , যাতে বালিশের মত ব্যবহার করতে পারে । মায়া বলে, বদভ্যাস করাবেন না প্লিজ ,বলে জড়িয়ে ধরে । ওকে বলি, ইংরেজি শব্দ থেকে মুক্ত হতে পারছি না আমরা , আপনি তবু চেষ্টা করেন যাতে অসাবধানে বলে না ফেলেন ; আমি পড়েছি গণিত, বাড়িতে ইংরেজিতে কেউই কথা বলতেন না , তবু বলে ফেলি ।
মায়া বলেছিল, আবার অতীতকে টেনে আনছেন ; আমাকে দেখুন , অতীত একেবারে মুছে ফেলেছি , যদিও মস্তিষ্কে অতীতের ঘুণপোকা সহজে মরে না , মারার চেষ্টা করে যাচ্ছি ; একটা ঘুণপোকা মরেনি এখনও । তারপর যোগ করেছিল, দুজনে পরস্পরকে নিয়ে থাকতে পারি, দেখছেন তো ? আধুনিকতার প্রয়োজন একেবারে নেই । আমাদের মধ্যে কোনো মতসংঘর্ষও ঘটেনি ; তার প্রধান কারণ আপনি, আপনার বদান্যতা, উদারচিত্ততা । আমার সব কথাই মেনে নেন ।
—মানব না কেন ? এক ডাকে চলে এসেছি । কত শেখার আছে প্রকৃতিতে । কত কিছু জানেন আপনি । আমাদের চারপাশে এত গাছপালা ঝোপঝাড় , এগুলোর নাম জানি না ; বালু সিরিসৈলমরা শেখায়, অথচ দেখুন, তা সংখ্যায় এত বেশি যে মনে রাখতে পারি না ।
—আমিও তো কত কীট-পতঙ্গ প্রতিদিন দেখছি, সিরিসৈলম, কালেসরম বলেও ওগুলোর নাম, তারপর ভুলে যাই । বাংলায় হলে বোধহয় মনে রাখতে পারতাম।
—লোকে তো কীট বা প্রজাপতি সংগ্রহ করে অ্যালবামে রাখে ।
মায়া উঠে বসল , অত্যন্ত ক্ষুব্ধ । কন্ঠস্বরে বোঝা যাচ্ছিল যে ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করে বলছে , বলল, আপনাকে বলেছিলাম না , কোনো প্রাণীর ক্ষতি করা যাবে না ; আমাদের অশেষ ভাগ্য যে আমরা এরকম একটা জনবসতি [পেয়েছি যেখানের মানুষ মাছ-মাংস-দুধ-ডিম খাবার সংস্কৃতির বাইরে থাকে ; তার সুযোগ নেই বলেই হয়তো গড়ে উঠেছে এই শাকাহারী অল্পাহারী জীবনযাত্রা । প্রাণী হত্যা আমি বরদাস্ত করতে পারি না । গোরুর দুধ হয় তার বাছুরের জন্য, তাও মানুষ খেয়ে ফেলে , ইনজেকশান দিয়ে গোরুমোষের দুধ বাড়ায়, এতই নির্দয় হয়ে গেছি আমরা । অকল্পনীয় নির্দয়তা নিষ্ঠুরতায় আক্রান্ত হয়েছে মানুষ । তাই জনে-জনে এত ঘৃণা আর দ্বেষ ; দেশে-দেশে যুদ্ধ , মানুষে-মানুষে হানাহানি । সবাইকে না পারি, নিজেকে তো বদলাতে পারি , আপনাকেও তো পারি ।
কি উত্তর দেবো ভেবে পেলুম না । সবকিছু ছেড়েছুড়ে, ‘চলুন পালাই’ ডাক শুনে যখন বেরিয়ে পড়েছিলুম, মনে হয়েছিল অ্যাডভেঞ্চারে যাচ্ছি । তখন ভাবিনি যে মায়াকে ভালোবেসে থেকে যাব , ওকে ভালোবাসাটাই থেকে যাবার একমাত্র কারণ হবে । অনেক্ষণ চুপচাপ থেকে বলেছিলুম, জানেন, হয়তো জেনে ফেলেছেন, আপনাকে ভালোবাসাটাই আমার জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য এখন , সব সময় মনে হয় হঠাৎ যদি ‘চলুন পালাই’-এর ঢঙে একদিন বলে ওঠেন, ‘আচ্ছা চলি’ , তাহলে কী করব ? নিজের ঠোট দিয়ে আমার মুখ বন্ধ করে মায়া বলেছিল, না, কখনও যাব না, এখানেই মরব, বুড়ি হয়ে ; আপনিও তখন বুড়ো হয়ে যাবেন , আপনার চুল-দাড়ি সব পেকে যাবে । কেমন হবে দেখতে তখন আপনাকে ? নাভি পর্যন্ত পাকা দাড়ি , কাঁধ ছাপিয়ে পাকা চুল । আমার চোখের প্রতিফলনে তো নিজেকে আর দেখতে পাবেন না তখন, কেননা আমার চোখ ঘোলাটে হয়ে যাবে, হয়তো ছানি-পড়া ।
আমি জঙ্গলের গভীর অঞ্চলে যেতে চাইলে মায়া বলে, যান, কিন্তু বেশি দূরে যাবেন না , নয়তো কাউকে সঙ্গে নিয়ে যান । নয়তো বলে, যান, কিন্তু আমি হাঁক পাড়লে চলে আসতে পারেন, এমন দূরত্বেই যাবেন । মায়াও জল ভরতে গিয়ে দেরি হতে থাকলে, আমারও চিন্তা হয়–এই ধরণের চিন্তার অভিজ্ঞতা হয়নি কখনও এর আগে । কুয়োতলায় ও বেশ সময় কাটায় , জ্ঞান দেয় মহিলাদের, অবিবাহিতা কিশোরীদের— জানতে চাইতে ইচ্ছা হতো যে কীই বা আলোচনা করে তাদের সঙ্গে এতো, কিন্তু মেয়েলি ব্যাপারে নাক গলানোটা উচিত হবে না মনে করে কখনও জানতে চাইনি । একটা চালা থেকে আরেকটা চালা এমন দূরে-দূরে যে কুয়োতলাটাই মহিলাদের মিটিং প্লেস । বালুদের কাছ থেকে যতটা জেনেছি, ওরা নিজেরাই যতটা বলেছে, কুয়োতলাটা মায়ার ভাষা শিক্ষার ক্লাস, সমাজশিক্ষার ক্লাস, আচার-ব্যবহার শেখার ক্লাস । ও অন্তত স্হানীয় বুলি বুঝে ফেলতে, ভাঙা ভাঙা বলতে শুরু করেছে । আমি এখনও বালু-সিরিসৈলমদের ব্যাখ্যার ওপর নির্ভরশীল।
কাঁঠাল গাছের দাগ দেখে অনুমান করতে পারি যে আমরা সাড়ে তিন বছরের মতন সময় কাটিয়ে দিয়েছি এখানে । ফেলে-আসা জীবন মনেই পড়ত না প্রায় । আমার গণিত নয় , মায়ার নিজস্ব শারীরিক-গাণিতিক অঙ্কের কারণে ওর গর্ভসঞ্চার হয়নি । কী ভয়ানক বিপদ হতো যদি তা ঘটে যেত । যদিও স্হানীয় বয়স্কা বৃদ্ধারা গর্ভপাতের বনৌষধি হদিশ জানেন, মায়ার মুখেই শুনেছি, তা অত্যন্ত বিপজ্জনক বলে মনে হতো আমার । প্রকৃতির উচিত ছিল নারীকে এমন একটা ইচ্ছাশক্তি দেয়া যে তারা চাইলেই তাদের মেন্সের দেহপ্রক্রিয়া থেমে যাবে সে যতদিন চায় ।
একদিন ভুলে জিগ্যেস করে ফেলেছিলুম, আপনি গান জানেন ? মায়া মৃদু হেসে বলেছিল, সত্যি অতীত আপনাকে ছাড়তে পারছে না । তারপর অনেকক্ষণ চুপ থেকে বলেছিল, আমি বাংলা বা হিন্দি গান জানি না, পাশ্চাত্য গান জানি , জানতুম, বলা উচিত । আমি কিছু জানি কিনা প্রশ্ন করবে না মায়া , জানতুম, তাই যেচে বললুম, আমার রবীন্দ্রসঙ্গীত ভালো লাগত, স্কুল কলেজের ফাংশানে গাইতামও । বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে বাংলা-হিন্দি সিনেমার গানও ভালো লাগে ।
এই অঞ্চলে কারোর হাতে ট্র্যানজিসটারও দেখিনি । এরা নিজেদের ভাষায় অনেক সময়ে গেয়ে ওঠে , সে গানগুলো কেমন যেন দুঃখি-দুঃখি লাগে ।
—হ্যাঁ, আপনার কন্ঠস্বর আপনার মতই দরাজ । গণিতবিশেষজ্ঞরা সঙ্গীতে পারদর্শী হন ; সঙ্গীত তো গণিতনির্ভর , ধ্বনির মাপ দিয়ে গড়া । যাকগে, বর্তমানেই বসবাস করুন । কত সুন্দর আমাদের বর্তমান , ভাবুন আপনি, কত শান্তি, আজ পর্যন্ত আমাদের জ্বরজারিও হয়নি । তার কারণ আমরা আধুনিকতার বিষ থেকে মুক্ত ।
আরেক দিন, মায়া শুয়েছিল চাটাইয়ের ওপর, দেখলুম ওর বাঁ পায়ে নুপুরের মতন উলকি আঁকা । বললুম, দেখুন, অতীতের স্মৃতি বহন করছেন শরীরে । দুটো পায়েই করাতে পারতেন । মায়া ফিরে গেল অতীতে, বলল, কলেজের স্মৃতি, ক্লাসের সকলে ট্যাটু আঁকিয়ে নেবার জন্য আমরা দল বেঁধে গিয়েছিলাম ; জনৈক ট্যাটু আর্টিস্ট নতুন স্টুডিও খুলেছিলেন , ফ্রি ট্যাটু এঁকে দেবার প্রস্তাব দিলেন । হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন অতীতের দৃশ্য-অদৃশ্য ভুল বহন করছি শরীরে । তারপর বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলেছিল, মনেও ।
আমি আর প্রস্ন করিনি । চোখ বুজে আমি ওর উলকি-আঙকা পা দেখতে পাই, কী অপূর্ব । দেয়ালে গোবর লেপার সময়ে ওর শাড়ি একটু উঠে গিয়ে উলকি মেলে ধরত , আর মনে হত নৃত্যরতা মায়া ।
মায়া, তুমি এখন কোথায় ? দ্যাখো, আমি চুল-দাড়ি রাখি না । প্রায় প্রতিদিনই শেভার দিয়ে মাথা শেভ করে ন্যাড়া হয়ে থাকি, কেননা আমার চুল বেশ পেকে গেছে , আর আমি মাথাভরা পাকাচুল নিয়ে তোমার অনুপস্হিতির ভার বইতে পারব না । শেষনিকেও বলেছি যে আমি যদি ন্যাড়া হতে ভুলে যাই, কোনোদিন যদি চুল দেখা যায় মাথায়, তাহলে যেন শেভ করে দেয় । শেষনি তোমার গল্প শোনার জন্যে উন্মুখ । শেষনিকে কিন্তু তোমার নাম বলিনি এখনও । তোমার নাম উচ্চারণ করার অধিকার একমাত্র আমার ।
টাইপ করতে বসে কান্না পেয়ে যাচ্ছে আমার , আবেগে আক্রান্ত হয়ে উদ্বেল হয়ে উঠছি । আবার রাতে লিখব বা কাল সকালে লিখব । শেষনি বিকালে আসবে বলেছে , জানতে চায় কতদূর লেখা হল , কোন পর্যায়ে পৌঁছোলুম । ও যখন বাংলায় ট্র্যান্সক্রিপ্ট নিয়ে বা ইংরেজিতে অনুবাদ করে পড়বে তখন জানতে পারবে ।
এতটা পড়ে, রিমাও দীর্ঘশ্বাস ফেলল, স্বগতোক্তি করল, তোমার লাভস্টোরি তাহলে অ্যাবরাপ্টলি থেমে গেল কেন কংকাল প্রেমিক ? যাকগে, আমিও টায়ার্ড তোমার রহস্য নিয়ে । দেখি, তোমায় নরক থেকে উদ্ধার করতে পারি কিনা ! তুমি মরার পর তোমার আত্মার শান্তি-সস্ত্যয়ন আমাকেই করতে হবে বোধহয় , কেননা, তোমায় তো আমরা অমর করে দেব, মেডিকাল ছাত্ররা তোমার কংকাল দেখে-দেখে পড়াশুনা করবে । আর প্রেমিক-প্রেমিকা ছাত্রছাত্রীরা অবাকচোখে তোমায় দেখতে আসবে ।
৯. আচ্ছা চলি
মায়ার সংস্পর্শে আসার আগে জীবনের উদ্দেশ্য আছে না নেই ভাবিনি কখনও । সবই ছিল চলে যাচ্ছে চলে যাচ্ছে চলে যাচ্ছে । ভাবতে শুরু করেছিলুম, মায়াই আমার উদ্দেশ্য , ওকে ভালোবাসাই বেঁচে থাকার প্রাপ্তি ; ভালোবাসা, মনে হচ্ছিল, আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা । শহরে থাকলে, এই অভিজ্ঞতা কখনই সম্ভব ছিল না । ও এমনভাবে আমার আত্মপরিচয় নিজের মধ্যে বিলুপ্ত করে দিয়েছিল যে আমি বিলীন হয়ে গিয়েছিলুম মায়ায় ।
মাঝরাতে, পুলিসের মতে রাত একটা থেকে তিনটের মাঝে , পোস্টমর্টেম রিপোর্টে সেরকমই লেখা, সামনের কাঁঠাল গাছটার ডাল থেকে একটি সিনথেটিক ওড়না গলায় বেঁধে, প্রথমে ছোটো টুল, তারপর উঁচু টুলটায় দাঁড়িয়ে, আত্মহত্যা করেছিল মায়া । ওর এই সিনথেটিক ওড়নাটা কোথায় যে লুকিয়ে রেখেছিল জানতেও পারিনি ; আমরা তো সবই ফেলে দিয়ে নতুন জামা-কাপড় কিনে এসেছিলুম এখানে !
আমার পাশেই তো ঘুমিয়েছিল , যেমন প্রতিদিন ঘুমোই । কখন ক্যারি ব্যাগ থেকে ওড়নাটা বের করেছে , টুল দুটো নিয়ে গেশে, টুলে উঠে দাঁড়িয়েছে , গলায় ফাঁস তৈরি করেছে , কাঁঠাল গাছের ডালে বেঁধেছে , তারপর উঁচু টুলটাকে লাথি মেরে সরিয়ে দিয়েছে । রোদ উঠে যাবার পরও আমি ঘুমোচ্ছিলুম । অদ্ভূত । আমার ভেতরের কুকুরগুলো ওই সময়েই মানুষ হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল ।
চেঁচামেচি কান্নাকাটি শুনে ঘুম ভাঙতে, বাইরে বেরিয়ে দেখি, কাঁঠাল গাছ ঘিরে জটলা । গাছের ডাল থেকে মায়া ঝুলছে । মায়া । সত্যিই মায়া । ওফ । মায়া। মায়া সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে ঝুলছে । মায়া, সম্পূর্ণ উলঙ্গ , এতগুলো মানুষের চোখের সামনে । মায়া, যাকে নগ্ন দেখার অধিকার একা আমাকে দিয়েছিল মায়া ; সে অধিকারটুকুও মারা যাবার সময়ে ছিনিয়ে নিয়েছে মায়া । কাঁঠাল গাছটা ভরেছিল পাকা আধপাকা কাঁঠালে ; সেগুলোও ঝুলছিল গাছ থেকে , গাছটার একেবারে গোড়া পর্যন্ত কাঁঠালে ভরা, এমন কি আমার দেয়া দাগের ওপরও হয়ে রয়েছে আধপাকা কাঁঠাল । আশ্চর্য, মারা গিয়ে আরও সুন্দর হয়ে উঠেছে মায়া । নিটোল ভরাট বুক, পাতলা কোমর, চেটালো পেট, ছোট্ট নাভি, ঢেউ-খেলানো পাছা । তিন দিন আগে ওর ছোট্ট উদগ্রীব যোনি ধুয়ে পুঁছে দিয়েছিলুম, যখন মায়া বলেছিল, মিস্টার মায়ালিঙ্গা, আজকে আমার পিরিয়ড শেষ হয়েছে , আমার সেক্সুয়াল অর্গান ওয়াশ করে দিন প্লিজ ,ঘড়ায় জল আছে ।
দুই বছরের বেশি হয়ে গেল এই কাজ করার ভার আমার ওপর দিয়েছিল মায়া ।
ঘরে কাগজ-পেনসিল নেই যে , ইচ্ছে হলেও, আত্মহত্যার চিরকুট লিখে যাবে মায়া পাল , এখানকার লোকেদের আম্মা, জীবন্ত ঈশ্বরী । আমার প্রচণ্ড কান্না পেল, আমি নিজেকে কান্নার হাতে ছেড়ে দিলুম ; এভাবে বাঁধনহারা কান্না আমি কখনও কাঁদিনি । মা মারা যেতেও এমনকরে কাঁদিনি । আমি কাঁদতে-কাঁদতে ছুটে গেলুম ঘরের পেছন দিকে, যেদিকের দেয়াল ব্ল্যাকবোর্ড হিসাবে ব্যবহার হয় । কাল, সূর্যাস্তের আগে, মাটির ওই দেয়ালে দুটো বৃত্ত এঁকেছিল মায়া , তাতে ফুটকি দিয়ে চোখ আঁকা, খাড়া লাইন টেনে আঁকা নাক । একটা বৃত্তে ওপর দিকে ঢেউ-খেলানো ঠোঁট, কাঁদো-কাঁদো গোমড়া দেখাবার জন্যে । অন্য বৃত্তটার নিচের দিকে ঢেউ-খেলানো ঠোঁট, যাতে তা হাসুমুখ দেখায় । দুটোর তলায় বাংলায় ‘আ’ লিখে মায়া বলেছিল, মায়াগারু, এই হাসিমুখটার ‘আ’ হল ‘আমি’ আর এই কাঁদো-কাঁদো মুখটার ‘আ’ হল ‘আপনি’ । আমি বলেছিলুম, আমি তো সব সময় হাসিমুখে থাকি , আপনাকে দেখলেই উদ্ভাসিত হয়ে উঠি , এত আনন্দে থাকিনি কখনও জীবনে ; আপনিই বরং অনেক সময়ে সিরিয়াস থাকেন, কোথায় যেন হারিয়ে যান কোনো স্বপ্নের জগতে ।
মায়া বলেছিল, লাইফ ভিষণ আনপ্রেডিকটেবল মিস্টার মায়ালিঙ্গা , আপনি কি এরকম ওয়র্স্ট নাইটমেয়ারের কল্পনা করেছিলেন কখনও, যে আমার মতন অলমোস্ট অচেনা একজনমানুষের ডাকে সাড়া দিয়ে অসহ্য জীবন কাটাবেন ? আমি বলেছিলুম, হ্যাঁ, জানতুম, যারা বাবা-মায়ের পছন্দ-করা মেয়ে বিয়ে করে, সেই মেয়েটিও তো তাদের কাছে আরও বেশি স্ট্রেঞ্জার ; আমি আমার সুপরিচিত কাউকে বিয়ে করলে বা তার সঙ্গে লিভটুগেদার করলে, সেও যে আমায় আনন্দিত রাখত, ক্রমশ স্ট্রেঞ্জার হয়ে ্ধঠত না তা তো জোর গলায় বলা যায় না ।
মায়া জবাবে বলেছিল, আমি তো আপনার পছন্দ-করা নই , আপনাকে দেখে আমি স্প্লিট সেকেন্ড ডিসিশান নিয়েছিলাম , তার আগে কিছুই ভাবিনি , আপনাকেও সময় দিইনি ভাববার ।
স্প্লিট সেকেণ্ড ! তা তো নয় মায়া । স্প্লিট সেকেন্ড নির্ণয়ে আত্মহত্যার অমন তোড়জোড় করা যায় না । দেয়ালে মুখ দুটো আঁকার সময়ে আমি কিছুই অনুমান করতে পারিনি । আমি তোমার প্রেমে অন্ধ । সত্যিই মানুষ প্রেমে অন্ধ হয় । অন্ধবিশ্বাস গড়ে ওঠে । জানি না কেন এরকম করেছিলে । কখনও অতীতের কথা বলোনি , কোনো লুকানো ক্ষত-আঘাতের আভাস দাওনি ।
আমি চালায় ঢুকে খুঁজে দেখেছিলুম তুমি হয়তো কোথাও কোনো উত্তর লিখে গেছ মায়া । কিছুই পেলুম না । কেবল তোমার অনুপস্হিতির এক মোহক গন্ধ ছিল ঘরময় , যেন কেউ বিদেশি আতরের সুবাস ছড়িয়ে দিয়েছে । মৃত্যুর কি সুগন্ধ হয় ? নাকি তা ছিল আত্মহত্যার সুরভি !
কি করব বুঝে উঠতে না পেরে কতক্ষণ বসে-বসে কেঁদেছিলুম জানি না । জানো মায়া,একজনের অতীত তার নিজের কাছে অত মূল্যবান নয়, কিন্তু অন্যের কাছে তা যে কত মূল্যবান তা আমিই জানি ।
কী করব বুঝে উঠতে না পেরে কতক্ষণ বসেবসে কেঁদেছিলুম । অনন্তকাল. অনন্তকাল, অনন্তকাল ।
বালুর বাবা আর অন্যরা যখন আমায় প্রায় ধরাধরি করে চালাঘরের বাইরে নিয়ে গেল, দেখলুম তোমায় গাছের ডাল থেকে নামিয়ে কাঁচা কাঠের মইতে বেঁধে ফেলা হয়েছে, কোনো লতানে গাছ দিয়েই । কেউ তোমায় কাপড় পরিয়ে দিয়ে থাকবে । কোন কাপড় জানো ? সেই দক্ষিণ ভারতীয় শাড়িটা যেটা পরে তুমি প্রথম এখানে এসেছিলে । তালপাতা পোড়া ধোঁয়ার অনুষ্ঠান করে তোমায় সবাই নিয়ে চলল শ্মশানে । তোলার পর কেবল একবার কাঁধ দিয়েছিলুম আমি । কেন জানো ? আমি তোমার ওই মুখ দেখতে চাইনি । তোমার সুশ্রী মুখখানা বীভৎস হয়ে উঠেছিল । শক্ত হয়ে গিয়েছিল বলে তোমার চোখের পাতা বন্ধ করা যায়নি । জিভ বেরিয়ে এসেছিল, দাঁতের পাটি দিয়ে চাপা, তাও ঢুকিয়ে দিতে পারেনি কেউ তোমার মুখের ভেতরে । নাক দিয়ে বেরোনো শ্লেষ্মা-মাখা রক্ত পুঁছে দিয়েছিলুম লুঙ্গির খুঁট দিয়ে । যোনি থেকে রক্ত আর বোধহয় কালকের রাতের সঙ্গমের বীর্য বেরিয়েছিল, তাও সবায়ের সামনে পুঁছে দিতে লজ্জা করেনি । তোমার মুখের দিকে তাকাতে পারিনি বলে তোমার বুকে চুমো খেয়েছিলুম বারবার ।
মেঠো পথে, জঙ্গলের ভেতর দিয়ে হেঁটে, খনি শহরে যাবার রাস্তায়, শ্মশান অনেকটা পথ। তোমার প্রিয় আম বাগানের ভেতর ছায়াময় পথ, গাছে-গাছে আম হয়ে আছে , সবুজ, হলুদ , গোলাপি আভা মাখা আম হয়ে আছে , ঠুকরে খাচ্ছে পাখিরা, তোমার মতন সেসব পাখির নামও আমি জানি না , তুমি তাদের নামের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে, কিন্তু আমি ভুলে যেতুম। তারপর পাতিলেবুর বাগান, কত সুন্দর গন্ধ যা তোমার ভালো লাগত । আমি কতদিন হাঁটতে-হাঁটতে গিয়ে তোমার জন্যে লেবুপাতা পেড়ে আনতুম, চটকে ঘরে ছড়িয়ে দিতুম তার সুবাস । নকল রাসায়নিক পারফিউমের চেয়ে তুমি পছন্দ করতে প্রাকৃতিক সুগন্ধ , মনে পড়ছিল শ্মশানের দিকে হাঁটতে-হাঁটতে । তুমি বলতে, পশুদের জগতে বিশেষ সময়ে দেহগন্ধ গড়ে ওঠে আর সেই গন্ধে আকৃষ্ট হয় পুরুষ পশু , বহুদূর থেকে সেই গন্ধে মোহিত হয়ে ছুটে চলে যায় সিংহ বাঘ হাতি গন্ডার হরিণ সেই দিকে মাইলের পর মাইল । মানুষ সেই প্রাকৃতিক সুগন্ধকে নষ্ট করে ফেলেছে ।
প্রায় ঘন্টা দুয়েক, অন্তত আমার মনে হয়েছিল দু’ঘন্টা, সময় কি করে জানব, ঘড়ি তো তুমি ফেলে দিয়েছিলে, শ্মশানে পোঁছোলুম । তোমাকে যারা ঈশ্বরীতে উন্নীত করে দিয়েছিল, তাদের কয়েকজন আগেই শ্মশানে গিয়ে চিতা সাজাবার ব্যবস্হা করে থাকবে । শুকনো কাঠ আর তালপাতা সংগ্রহ করে আনতে হয়েছে জঙ্গল থেকে । তোমার কেউ আছেন কিনা জানি না , আমি ছাড়া । কাউকে খবর দেবার সময়-সুযোগ নেই । আমরা নিজেদের পরিবারের পিছুটান সম্পর্কে আলোচনা করিনি, তুমি করতে দাওনি, আমার কাছে তোমার পরিবার-স্বজন-জ্ঞাতিদের নাম-সাকিন নেই ।
শবযাত্রীরা সবাই বলছিল, এখানের গরমে মৃতদেহ বেশিক্ষণ রাখা যাবে না । দ্রুত সৎকার করে ফেলাই প্রথা । স্হানীয় বয়স্করা, তাদের তৎপরতা দেখে, অনুমান করতে পারছিলুম, তারা এবিষয়ে অভিজ্ঞ ।
সাজানো চিতায় তোমার দেহ রাখা গেল না মায়া । উন্মুক্ত শ্মশানে এসে আচমকা থামল, ধুলো-ওড়ানো জিপ, সরকারি জিপ, যা দেখলেই টের পাওয়া যায়। কয়েকজন কন্সটেবল আর ব্যাটন হাতে, পরে জেনেছি ইন্সপেক্টর রামাইয়া, দ্রুত জিপ থেকে নেমে, যাকে সামনে পেল, চড়-থাপ্পড় মেরে হুমকি দিতে লাগল । আস্ফালন বুঝতে পারছিলুম, ভাষা নয় । ইন্সপেক্টর আমার সামনে এসে, কোনো কথা না বলে, হাতে কোমরে সজোরে কয়েক ঘা ব্যাটন কষিয়ে দিল । মায়া, তখন আমায় চাবুক মারতে থাকলেও সহ্য করে নিতুম ; মনে হচ্ছিল এটাই আমার প্রাপ্য ।
কাঠকুচির ধুঁয়া-ওঠা হাঁড়ি মাটিতে নামিয়ে রেখে, আমি হাত জোড় করে ইংরেজিতে বললুম, কেননা আমার সীমিত তেলেগু জ্ঞানে নিজের বক্তব্য স্পষ্ট করা সম্ভব ছিল না, যে, স্যার আমার স্ত্রী আত্মহত্যা করেছে, আমার মন খুবই খারাপ, দাহকর্ম হয়ে যাক, তারপর আপনি যা জানতে চান প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দেবো, আপনার কাছে থানাতে যাব, আমার অসাবধানতার খেসারত আমি দেব ।
আশ্চর্য, সেই প্রথম আমি তোমাকে নিজের স্ত্রী হিসাবে উচ্চারণ করেছিলুম । প্রচণ্ড ভুল হয়ে গিয়েছিল মায়া । তুমি বলেছিলে আমরা স্বামী-স্ত্রী মার্কা জীবন কাটাব না, আমরা মানুষ-মানুষী হয়ে বেঁচে থাকব ।
ইংরেজি ভাষা আরও বিরক্ত, এমনকি অপমানিত করল ইন্সপেক্টরকে । আমি বুঝতে পারলুম, ইন্সপেক্টর এখন প্রশাসনের প্রতিনিধি নয়, সেই রাষ্ট্র । রাষ্ট্রের হুকুমে আমাকে হাতকড়া পরিয়ে, কোমরে দড়ি বেঁধে তোলা হল জিপগাড়িতে । দড়ির অপর প্রান্ত একজন পেটমোটা কালো টাকমাথা কন্সটেবলের হাতে । কন্সটেবলগুলো অভিব্যক্তিহীন, এধরণের ডিউটি বহুবার করে-করে যন্ত্রে রুপান্তরিত ; তারাও তো নিজস্ব অস্তিত্বে রাষ্ট্র ।
ইন্সপেক্টর ভালো ইংরেজি বলতে পারে না, হয়তো কোনো দলীয় তদবিরে বা ঘুষের জোরে চাকরি পেয়ে থাকবে । সাধারণ দক্ষিণ ভারতীয়রা গড়পড়তা বাঙালির চেয়ে ভালো ইংরেজি বলে থাকে । ইন্সপেক্টার যেটুকু ইংরেজি পারে সেটুকু শুনে আমি জানতে পারলুম যে আমিই এই মহিলাকে খুন করে গাছে টাঙিয়ে দিয়েছি। মহিলাটি স্ত্রী কিনা এ-ব্যাপারে রাষ্ট্র নিশ্চিত নয় । রাষ্ট্রের কাছে খবর আছে যে, তারা দুজন যে জীবন এখানে কাটাচ্ছিল, তা থেকে রাষ্ট্রের সন্দেহ যে মিস্টার মায়ালিঙ্গা এই মহিলাকে ভাগিয়ে ফুসলিয়ে এনেছে । ইংরেজি জানা পড়াশুনা করা একটা লোক এরকম একটা দুর্গম এলাকায় এসে পড়ে আছে কেন তাও রাষ্ট্রের বিবেচ্য । রাষ্ট্রর ধারণা যে মিস্টার মায়ালিঙ্গা নিশ্চয় কোনো রাষ্ট্রবিরোধী কুকর্মে লিপ্ত । থানায় নিয়ে গিয়ে উচিত শাস্তি দিলে মায়ালিঙ্গা কয়েক মিনিটেই সত্য ওগরাবে ।
মায়া, তুমি তো বলে যাওনি সত্য কী, তোমার সত্য ! প্রেম ছাড়া অন্য কোনো সত্যের কথা তো তোমার সংস্পর্শে এসে ঝানিনি মায়া । এখন জানছি যে প্রেমও রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপের পর্যায়ে পড়ে ।
জিপে বসে, জিপের মেঝেতে শোয়ানো তোমার দেহের দিকে তাকিয়ে রইলুম সারাটা পথ । কন্সটেবলরা যে টিটকিরি মারছে, তাদের ভাষা সঙিক বুঝতে না পারলেও , হেঁচকি-তোলা হাসাহাসি থেকে মায়ার মায়াবী দেহের ওপর কাদার ফোঁটার মতন ঝরে-ঝরে আবহকে পঙ্কিল করে তুলছিল । । এই শেষ সান্নিধ্য অন্তত পাচ্ছি । জিপগাড়ি আমাদের নিয়ে খনিশহরের পথে যেতে কম সময় লাগেনি । অথচ যেদিন প্রথম এসেছিলুম এই অঞ্চলে, সেদিক কত কম সময় লেগেছিল । সেদিনও সঙ্গে ছিল মায়া । আজও মায়া আমার সঙ্গে । তাহলে কতরকম হতে পারে মানুষীর মায়া !
কেই বা খবর দিয়ে থাকবে পুলিশকে ? যাদের দৃষ্টিতে মায়া হয়ে উঠেছিল ঈশ্বরী, তধাদেই কেউ ? সেই সংবাদ-বহনকারীর চোখে আমি নেহাতই একজন সাধারণ মানুষ , সম্ভবত ঈশ্বরীর সেবায়েত ! কেন এ-কাজ করল ঈশ্বরী ? আমার জন্য জীবন নষ্ট করল । যে-ভাবে যে-উচ্চারণে কনভেন্ট স্কুলের ইংরেজি প্রয়োগ করত, আচরণ, শিষ্টতায়, স্পষ্ট ছিল যে শিক্ষিত রুচিশীল পরিবারে প্রতিপালিত যুবতী । স্বাভাবিক, সুখি, গতানুগতিক দাম্পত্যজীবন কাটাতে পারত , শশুর-শাশুড়ি-স্বামী, ছেলে-মেয়ে নাতি-নাতনি নিয়ে । আমার পাল্লায় পড়ে নিজে কে ধ্বংস করে ফেলল । কেন যে ওর ডাকে সাড়া দিয়েছিলুম ।
কেন উলঙ্গ হয়ে আত্মহত্যা করল মায়া । অসাধারণ দেহকাঠামো, মৃত্যুর পরেও তা উপজাতি গ্রামবাসীদের দেখাবার জন্য ? যাতে তারা তাদের ঈশ্বরীকে স্বরূপে দেখে নিতে পারে ? এখানকার লোকগুলোকে, যারা নিজেরাই অর্ধনগ্ন থাকে ? পুলিশের লোকেদের, যারা প্রায়ই ল্যাংটো লাশের সমস্যায় পড়ে বিরক্ত হয় ?” নাকি আমাকে ? যাতে একই সঙ্গে মায়ার সুন্দর আর বীভৎস রূপ আমার স্মৃতিতে আজীবন গিঁথে থাকে ? যাতে সারাটা জীবন দুঃস্বপ্নে পীড়িত থাকি, প্রশ্নে-প্রশ্নে জর্জরিত হই , চিন্তার তীরহীন সমুদ্রে ভাসতে থাকি চিরকাল ?
মায়ার মুখের ওপর থেকে আঁচল উড়ে গিয়েছিল । দেখতেই, প্রথমে ফুঁপিয়ে, তারপর জোরে-জোরে কান্না পেয়ে বসল আমায় । চেষ্টা করেও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলুম না । চোখে আর ঠোঁটে, ছুটন্ত , ধুলো-ওড়ানো গাড়িতেও, মাছি বসছিল। পাকা আমের স্বাদ ছেড়ে মাছিরাও তোমার স্নেহসুধা শেষবার খেতে এসেছে মায়া । মাছির সংখ্যা বাড়তে থাকলে, রোগাটে ঢ্যাঙা কন্সটেবলটা, জিপে পড়ে থাকা চট তুলে, ঝপ করে ফেলে দিল মায়ার মুখের ওপর । আমি ককিয়ে ‘না না’ চিৎকার করে উঠতে, ড্রাইভারের পাশে-বসা ইন্সপেক্টর বলল, শাট আপ ইউ ব্লাডি মার্ডারার । আমার কান্ন তখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে, হাউহাউ পর্যায়ে চলে গেছে ।
পেটমোটা কন্সটেবল, যে হাতকড়া পরিয়ে কোমরে দড়ি বেঁধেছিল, এখনও ধরে আছে ডযির প্রান্ত, বেশ শক্ত করেই ধরে আছে, পরে জেনেছিলুম তার নাম সংক্রান্তিগারু, বলল, বোধহয় আমার মুখ দিয়ে ‘না না’ আর্ত চিৎকার বেরোবার কারণে, জিগ্যেস করেছিল, ‘তুম হিন্দি’ ? কন্সটেবলটার প্রশ্ন শুনে নিজের ভুল বুঝতে পারলুম । শহরে ইংরেজিতে কথা কইলে রাষ্ট্রের প্রতিনিধিকে, তা কেন, রাষ্ট্রকেই, যত ওপর দিকে তুলে নিয়ে যাওয়া যায়, শহরের বাইরে ওই ভাষাটা তাদের ততই নিচে নামিয়ে আনে । যত বড় শহর, রাষ্ট্রের ক্ষমতা যেখানে যত কুক্ষীগত, সেখীআনে কাজকে মসৃণ করে দেয় ইংরেজি ভাষা, গর্বিত করে আধিকারিককে । হিন্দিও এখানে গ্রাহ্য ভাষা নয় । তবু ইংরেজির তুলনায় কম ক্ষতিকর । যেটুকু হিন্দি জানি, তাতে আমার বক্তব্য ও মানসিক দুর্দশাকে আরও বোধগম্য করে তুলতে পারতুম হয়তো।
আমি মাথা নাড়লুম । ভাঙা হিন্দিতে বললুম, আমি বাঙালি । আমি আমার এত সুন্দরী স্ত্রীকে কেনই বা খুন করব ; ও ছাড়া পৃথিবীতে আমার আর কেউ নেই । আমরা এখানে এসেছিলুম নতুনভাবে থাকারজন্যে, শহর থেকে অনেক দূরে , অচেনা জায়গায় , সাধারণ মানুষের মতন , শহরের যাবতীয় সুবিধার বাইরে , যাতে একজন আরেকজনকে নিয়ে জীবন কাটিয়ে দিতে পারি।
ইন্সপেক্টর হায়দ্রাবাদি হিন্দিতে, বোথহয় জেরা করার সূত্রপাত ঘটিয়ে, গম্ভির গলায় প্রশ্ন করেছিল, তাহলে তোমার সোকল্ড ওয়াইফ আত্মহত্যা করল কেন ? মঙ্গলসূত্র নেই, নর্থ ইনডিয়ান সধবাদের মতন বিন্দি-সিন্দুর নেই । তোমরা রাজনৈতিক ফেরারি কিনা তার খোঁজখবরের জন্য আমরা পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে আগেই জানাতে বলেছি । তোমাদের ওপর আমরা এক বছরের বেশি নজর রাখছি । উপজাতিদের পড়াশুনা শিখিয়ে তোমরা যে এই অঞ্চলের ভারসাম্য নষ্ট করছিলে সে সংবাদ আছে আমাদের কাছে । তার সুরাহা হল না, এখন তুমি এই নতুন সমস্যা পাকালে । তোমাদের মধ্যে নিশ্চই কিছুদিন যাবত বনিবনা হচ্ছিল না, হয়তো ডিসিজড ফিরে যেতে চাইছিল, তুমি রেজিস্ট করছিলে । সে-কারণেই তোমার স্তী তোমার সঙ্গে তার বিয়ের চিহ্ণও রাখেনি নিজের শরীরে । সুইসাইড না হোমিসাইড তা অটপসি হলেই জানতে পারব ।
আমার মুখ দিয়ে বেরোল, বলে ফেলে টের পেলুম যে বোকামি হয়ে গেল, নিছক মূর্খের মতন, যে, ও একজন মডার্ন মহিলা, বিন্দি-সিন্দুরে বিশ্বাস করত না , ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর । ব্যঙ্গ করল ইন্সপেক্টর, মডার্ন ? এই এলাকায় ? জঙ্গলে ? যেখানে ভালভাবে ছোঁচাতে হলে লোকে ঝর্ণায় যায় ? বছরে একবার কেবল সংক্রান্তির দিন জামা-কাপড় পালটায় , সেখানে ? মুখ খুললেই আবাএ বেফাঁস কিছু বেরিয়ে যাবে এই আশঙ্কায় নিজেকে দুঃখের শামুকের খোলে গুটিয়ে নিলুম । কেন এই দুর্গম অঞ্চলে এসেছিলুম , তার উত্তর তো একমাত্র মায়াই দিতে পারত । আমি এসেছিলুম মায়ার ডাক শুনে ।
একজন কন্সটেবল, দেখে অনুমান হয় ব্যায়াম-করা শরীর, শ্মশানযাত্রীদের এলোপাতাড়ি পেটানোয় অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল , ইন্সপেক্টরকে শুধোল, যদিও তেলেগুতে, তবু বুঝতে আমার অসুবিধা হল না, স্যার, আমাদের থানার কাছে শরবতের দোকানটা থেকে বরফের স্ল্যাব যোগাড় করে লাশটাকে সংরক্ষণ করতে হবে, ফার্স্ট ইনফরমেশান রিপোর্ট লিখে নেবার পর পোস্টমর্টেমের জন্যে পাঠাতে হবে মর্গে , সেও তো সতেরো কিলোমিটার দূরে, লাশ খারাপ হয়ে গেলে মুশকিল হবে । কন্সটেবলটা তেলেগুতে বললেও, যতটা তেলেগু আঁচ করতে পারার অভিঞ্জতা হয়েছে এই কয় বছরে, আর কয়েকটা পরিচিত শব্দপ্রয়োগের দরুণ বুঝতে পারলুম ।
লাশ। মায়া, লাশ । লাশ ! অপরিসীম ব্যখ্যাহীনতা ।
থানায় জিপ পোঁছোলে, আমাকে প্রথমে নামিয়ে, ভেতরে নিয়ে গিয়ে ঢুকিয়ে দেয়া হল লক আপে । যে লোকগুলো আগে থাকতেই লক আপে ছিল, তারা আমার খালি গায়ে নোংরা লুঙ্গিতে, না-কামানো দাড়ি, আর প্রায় জট-পড়া দীর্ঘ চুলের কারণে , হঠাৎ চুপ করে গেল । যেন মানুষের খাঁচায় ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে দাঁতালো কোনো অচেনা জীব । অদ্ভুত । ক্রিমিনালরাই আমাকে দেখে ভয় পাচ্ছে । ভাবছে হয়ত আমি একজন সিরিয়াল নারী হত্যাকারী ।
মায়াকে কোথায় নিয়ে গেল জানি না । কোথায়ই বা রেখেছিল জানি না ।
মায়ার কাপড়ে-মোড়া দেহ চিতায় তুলে , ষোল দিন পর, আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল মুখাগ্নি করার জন্য । আইন আদালত , গ্রেপ্তারের চব্বিশ ঘন্টার ভেতর সোপর্দ, কোনো কিছুই হয়তো এই জঙ্গলে প্রযোজ্য নয় । লক আপেই বন্দী ছিলুম । বা এরা হয়তো আদালত থেকে হুকুম এনে ধরে রেখেছে আমায় । মায়া, তোমার মুখাগ্নি করার কথা তুমি একবার বলেছিলে । হাতে আগুন নিয়ে সে কথাই আমার মনে পড়ছিল । ওরা চিতায় শোয়ানো তোমার মুখ আমায় দেখতে দেয়নি । ভালই করেছিল ; এখন এও মনে হয় যে তুমি কোথাও আছো, হয়তো কুয়োতলায় গিয়ে স্হানীয় মহিলাদের উপদেশ দিচ্ছ । তাদের ছেলেমেয়েদের পড়াশুনার কথা বলছ ; পৃথিবীর বিশালতার কথা বলছ কিংবা আরও কোনো জ্ঞানের কথা ভাগ করে নিচ্ছ তাদের সঙ্গে । এবার হঠাৎ তুমি এসে পড়বে কাঁখে প্লাসটিকের কালো ঘড়া নিয়ে । এসে বলবে, আজকে চলুন, ঝর্ণার জলে স্নান করি, কয়েকদিন তো হয়ে গেল স্নান করে । কিংবা বলবে, চলুন, একটা কাঁঠাল পেকেছে , পেড়ে খাই ; আমি ছাড়াব, আপনি ততক্ষণ বালুদের দলটাকে ডেকে আনুন ।
যৌথ লক আপ থেকে বের করে নিয়ে, অন্য একটা ফাঁকা লক আপে, যে-দিন পুলিস ধরে নিয়ে গিয়েছিল , সে-দিন সন্ধ্যায় , আমার লুঙ্গি একটানে খুলে ফেলে রুলের বাড়ি মারা হয়েছিল , কত বার মনে নেই । আমি ক্রুদ্ধ হইনি , অপমানিত বোধ করিনি । কেউ কোনো প্রশ্নও করেনি । জেরা করে প্রস্নের উত্তর না দিলে পুলিস ঠ্যাঙায় জানতুম । কেননা লক আপের বাইরে তো রাষ্ট্র । আমার লিঙ্গকেও ব্যাটন দিয়ে নাড়িয়ে-নাড়িয়ে হাসাহাসি করা হয়েছিল । আমাকে খেতে দেয়া হয়েছিল পরের দিন । আমি খেয়ে নিলুম , মায়া, কেননা এর চেয়েও খারাপ খাবার খাওয়ায় তুমি অভ্যস্ত করে দিয়ে গেছ । আমাকে কোর্টে তোলা হয়নি । মিডিয়ার জগত, খবরের জগত, এখান থেকে বহু দূরে । যে কন্সটেবলের পাহারায় শৌচালয়ে যেতুম, সে জানিয়েছিল যে বরফ না পাওয়া যাওয়ায় লাশ পচে গিয়েছিল, তাই ঠিকমতন অটপসি হয়নি ।
মায়া, তুমি পচে গিয়েছিলে , আর তা আমায় শুনতে হয়েছিল।
থানাতেই আটক ছিলুম । কিছু শহুরে ধরণের লোকজন, শার্ট-বুশশার্ট পরা, আমায় দেখতে এসেছিল মাঝে একদিন । বোধহয় নারী হন্তারকদের কেমন দেখতে হয় তা দেখার জন্য । আমার অনুমান, পশ্চিমবঙ্গ সরকার থেকে আমার রাজনৈতিক ক্লিয়ারেন্স আসার পর ছাড়া পাই । টাও হয়তো পেতুম না । ছাড়া পেলুম সেদিন, যেদিন বালুর বাবা আর কয়েকজন গ্রামবাসী থানায় এসে ঘুষ দিয়ে গেল । আশ্চর্য, না ? যারা একবেলা খেয়ে জীবন কাটায় , তারা কী করে টাকা তুলল ? টাকা যে যোগাড় করে ছাড়িয়ে নিয়ে যেতে হবে তা কি থানার লোকেরা গ্রামে গিয়ে বলে এসেছিল ? জানি না । মায়া, টাকার ব্যবস্হা তুমি নিজেই করে গিয়েছিলে । বালুর বাবার কাছ থেকে জেনেছিলুম, শ্মশানে পিটুনি খাবার পর ফিওরে গিয়ে সবাই ভেঙে পড়েছিল । ওরা শেষে একদিন মনস্হির করে যে আমাদের স্মৃতিতে চালাঘরটাকে মন্দিরের পবিত্রতা দেয়া হবে । চালাঘরের ভেতরে তোমার ক্যারিব্যাগে তোমারই পাঁচশ টাকার নোটের তাড়া ছিল , ঝড়ের জলে কিছুটা নোংরা । ওরা সেই নোটের তাড়া নিয়ে থানায় এসে আমাকে ছাড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল।
নোটের তাড়াটা কেনই বা রেখেছিলে ? আমার ক্যারিব্যাগে তো কিচ্ছু রাখিনি, শহরকে জলাঞ্জলি দিয়েছিলুম , অতীতের কোনো স্মৃতি রাখিনি । তুমি কেন রেখেছিলে ? বিপদের আশঙ্কায় ?
আমাদের চালাঘরে আর ফিরিনি মায়া । কী হবে ফিরে ? তুমি নেই । তোমারই ফেলে-যাওয়া টাকায় বালুর বাবা নাপিতের দোকানে নিয়ে গিয়ে আমার চুল কাটিয়ে দাড়ি কামিয়ে জামা-প্যান্ট কিনিয়ে অচেনা এক রেলস্টেশানে পৌঁছে দিয়েছিল, নাম মনে নেই , জানতেও চাইনি কোন স্টেশান । বালুর বাবা আর কি দিয়েছিল জানো ? তোমার চুলের একটা গোছা । ওদের প্রথা অনুযায়ী, ওরা সধবাদের চুলের একটা গোছা কামিয়ে রেখে নেয় । বলেছিল, চুলের কয়েকগাছা ওরা রেখে নিয়েছে, চালাঘরের মাটিতে পুঁতে দেয়ার জন্য ।
আমি কলকাতায় ফিরলুম, পুনরায় নিরঞ্জন দত্তের আত্মপরিচয় ফেরত নিয়ে । এ কোন নিরঞ্জন ? তোমার সঙ্গে বসবাসের নিরঞ্জন নয় , তার আগেরও নয় । এ এক সম্পূর্ণ ভিন্ন নিরঞ্জন ।
ওহ হো, বলে উঠল রিমা, ওহ হো, বেচারা প্রেমিক । এরকম আত্মবলি দেয়া সত্বেও তাহলে প্রেমিকের এমন অভিশপ্ত মৃত্যু কেন , নিজেকে প্রশ্নটা করে একটা সিগারেট ধরিয়ে টেবিলে ঠ্যাং তুলে চোখ বুজে আত্ম মগ্ন হল রিমা খান । যেতে হবে জায়গাটায় । কলকাতাভ ছেড়ে একজন বাঙাংলি যুবতী আর তার প্রেমিক চলে গেল অজানা অচেনা মানুষে ঘেরা জঙ্গলে বসবাস করতে । থেকে গেল সেখানে । অসাধারণ জায়গা নিশ্চয়ই । যেতে হবে, হুম, যেতে হবে ।
Tagged ডিটেকটিভ উপন্যাস |
১০. সে নেই
একাগ্র হয়ে নতুন প্রিন্টআউটটা পড়তে আরম্ভ করল ইন্সপেকটার রিমা খান । নেট সার্ফ করে জেলি ডিলডো কিনে আনিয়েছিল । ম্যাস্টারবেট করে এখন একঘেয়েমিটা কেটেছে । নয়তো, এই কংকাল প্রেমিকের গল্পটার খেই হারিয়ে ফেলছিল। খুনিকে অনুসন্ধানের বদলে প্রেমকাহিনির দিকে ঝুঁকে পড়ছিল।
অন্ধ্র থেকে ফিরে এলুম । কোথাও কোনো পরিবর্তন দেখলুম না , আমার জীবনে ছাড়া । অফিসে একটা রেজিগনেশান লেটার পাঠাবার পর ওরা আমার বকেয়া পাঠিয়ে দিয়েছিল, যার কোনো দরকার ছিল না । পরিচিতদের কেবল জানাতে চাইছিলুম যে আমি জীবিত । কিছুই আর ভালো লাগছিল না । মায়া নেই । মায়া যে ছিল , আমি একজন অল্প পরিচিতার সঙ্গে একেবারে দুর্গম বনাঞ্চলে গিয়ে বসবাস করতুম, তা নিজের কাছেই অবিশ্বাস্য ঠেকছিল। বসে থাকতুম আর ভাবতুম । মায়া আমার চুল পেকে যাবার কথা বলত , তাই ক্ষোভে এতই উতলা হয়ে উঠলুম যে মনস্হ করলুম ন্যাড়া হয়ে যাই । তারপর ভাবলুম বিদেশে কোথাও চলে যাই। নতুন জায়গায় গেলে অন্তত মায়ার স্মৃতির অ্রহ উপস্হিতি থেকে কিছুটা মুক্ত হতে পারব ।
পাসপোর্টে তো ন্যাড়া নই । ন্যাড়া হবার আইডিয়া স্হগিত রাখলুম। ফিরে এসে দেখা যাবে । কোন দেশে যাব ? রাসেল স্ট্রিটে ঘুরে বেড়াবার সময়ে একটা ট্র্যাভেল এজেন্সির বিরাট সাইনবোর্ড দেখে ঢুকে পড়লুম। ওরাই বলল, শেনজেন দেশগুলোর ভিসা করিয়ে দেবে । বা, চাইলে, ভিসা অন অ্যারাইভাল কোনো দেশে যেতে পারি ; ওদের পেমেন্ট করে দিলে , হোটেল বুকিং করে দেবে । থাইল্যাণ্ড যান স্যার , ভিসা বিভাগের যুবকটি বলল, যৌবন থাকতে-থাকতে একা যাবার অতিঅবশ্য গন্তব্য ।
শেনজেন মানে তো ইউরোপের কয়েকটা দেশ । যৌবনে একা থাকার ও উচ্ছন্নে যাবার সবচেয়ে লোভনীয় শহর হল অ্যাম্সটারডাম । যাই, কোনো দেশ অনুমতি দিলে থেকে যাব ইউরোপের কোথাও , নয়তো থাইল্যাণ্ডের কোথাও । একাই হারিয়ে যাব এবার ।
মায়াকে ভুলে যাওয়া অসম্ভব । কিন্তু কিই বা করি যাতে মন অন্য দিকে পালিয়ে বাঁচে । এসকেপিজম থেকেও এসকেপ করা কত কঠিন !
বাড়িটাকে মজুর লাগিয়ে পরিষ্কার করালুম , তারপর রঙ করালুম। বাবার পছন্দের গোলাপি রঙ তুলে দিয়ে বাড়ির বাইরেটা ফিকে হলুদ রঙ করালুম। গোলাপি বা পিংক তো প্রেমের রঙ । কোন চেতনাকে প্রশ্রয় দিতে বাবা গোলাপি রঙ করিয়েছিলেন ? ঘরের ভেতরগুলো এশিয়ান পেইন্টসের প্রতিনিধিকে ডেকে ওদের পরামর্শ অনুযায়ী পেইন্ট করালুম। বাবার এবং অন্যান্য ঘরের আসবাব পালিশ করালুম। বাবার দাদুর ঘর পেইন্ট করাইনি ; কেবল পরিষ্কার করিয়েছি , কেননা ওখানে যেকোনো পরিবর্তন ওনাকে অনুপস্হিত করে দেবে ঘরটায় । মায়ের ঘরে বেশি যাই না । এত মনকেমন করে মায়ের জন্যে । এই বয়সে সবায়ের করে কি ! মায়ার জীবনে ঢোকার আগে থাকতেই তো খবরের কাগজে পড়তুম যে আজকালকার ছেলেমেয়েরা মা-বাবাকে অবহেলা করে । অদ্ভূত ! মা বেঁচে থাকলে আমি মায়ার ডাকে সাড়া দিতুম না । মা বেঁচে থাকলে আমার জীবন এরকম খেইহীন হতো না ।
আমি যদি মায়ার সঙ্গে না যেতুম তাহলে কি মায়া অন্য কারোর হাত ধরে বলে উঠতে পারত, ‘চলুন পালাই ?’
এই প্রশ্নের উত্তর কোনোদিনও পাবো না ।
বাবা প্রচুর রোজগার করেছেন । জানতেন বোধহয় যে আমি কোনো কম্মের নই । কলেজের বন্ধুদের সঙ্গেও দেখা-সাক্ষাৎ নেই বহুকাল । কে যে কোথায় আছে জানি না । আমরা নিজেদের বলতুম ডগ-স্কোয়াড । আমার কুকুরপনা ছিল বায়বীয় , এক-এক দিন এক-এক প্রজাতির কুকুর । বন্ধদের তা পছন্দ ছিল না । ওরা কুকুর-প্রজাতি বাছাই করে যা যার নিজের কুকুর-বৈশিষ্ট্য অপরিবর্তনীয় করে নিয়েছিল।
বাঁকুড়ার মুরারিমোহন মাজী ছিল বুল টেরিয়ার, বীরভূমের যামিনীরঞ্জন অর্ণব ছিল অ্যালসেশিয়ান । হুগলির রণজয় কর্মকার ছিল ব্লাড হাউন্ড । পুরুলিয়ার নিজামুদ্দিন মুদি ছিল জার্মান শেপার্ড । মুর্শিদাবাদের নগেন্দ্রনাথ সূত্রধর ছিল ককার স্প্যানিয়েল । বর্ধমানের সীতারাম কুণ্ডু ছিল ল্যাবরাডর । মেদিনীপুরের সুকান্ত বেসরা ছিল ডোবারম্যান । জলপাইগুড়ির নিমাই মাইতি ছিল বিগল। কোচবেহারের বেঁটে-বজ্জাত পরমেশহ্বর সাহা ছিল বক্সার । দল বেঁধে কলগার্ল হান্টিং করতুম আমরা । কোনো রিসর্ট ভাড়া নিয়ে কল গার্লদের সঙ্গে যৌনহুল্লোড় । ওই জীবনে ফিরে যেতে পারলে বোধহয় মায়ার ছবিটা অন্তত চোখের আলো থেকে অস্পষ্ট করে তুলতে পারব অন্তত কিছুটা।
একবার আমরা পুরো ডগ-স্কোয়াড গিয়েছিলুম ডায়ামন্ড হারবারের এক রিসর্টে । প্রি-ম্যারেজ পার্টি দিয়েছিল রণজয় । ব্যাচেলরেটদের ধুমধামাকা । পার্টি অরগানাইজার রুমঝুম বিশ্বাসকে কনট্র্যাক্ট দিয়েছিল রণজয় । দিল্লি থেকে স্ট্রিপার আনিয়েছিল রুমঝুম। দুজন স্ট্রিপার । একজন নাইজেরিয়ার কৃষ্ণকলি আর অন্যজন লাটভিয়ার গোলাপি রম্ভা । লাটভিয়ার মেয়েটা না জানত ইংরেজি, না জানত হিন্দি, আর বাংলা জানার তো কথাই নেই –ভারতীয় এজেন্ট দিয়ে নাকি কাজ চালায় , দেহবাণিজ্যে জিভ তো আর কথা বলার কাজে লাগে না , অন্য কাজে লাগে । এজেন্ট বুঝিয়ে দ্যায় ক্লায়েন্ট কী চায় । ওরা সেই অনুযায়ী উলঙ্গ হয় বা নির্দিষ্ট যৌনখেলা খেলে । রুমঝুম জানতে চেয়েছিল কোন শতকের পোশাকে স্ট্রিপাররা আসবে । কেননা যখন স্ট্রিপার মাঝখানের টেবিলের ওপর দাঁড়াবে তখন তো পুরো ঢেকেঢুকে আসবে । রণঝয় বলে দিয়েছিল লাটভিয়ান আসবে জার নিকোলাস ওয়ানের রাজরানির বেশে । অবশ্য সে খরচও রণজয়ের ।
তার আগে কেক কাটা হল । কেকের আকার নারীর যোনির মতন । কেকের দোকানে নাকি ব্যাচেলারেট পার্টির কেক চাই বললে, ওরা হ্যাপিনেস অ্যালবাম দেখায় — রুমঝুমের সৌজন্যে । মেয়েরাও এরকম পার্টি করে — তারা কি তাদের পার্টিকে বিচপার্টি বলে ? গড নোজ । তাদের জন্যে পুরুষের যৌনাঙ্গের আকারের কেক, যে-মাপের চাই, যে রঙের চাই, বীভৎস চাইলে তাও পাওয়া যাবে । পুরুষ স্ট্রিপারও মিলবে । যুবতীদের পার্টির জন্য অবশ্য রুমঝুম নয়, কে একজন মৌসম বানু তার বিশেষজ্ঞ অরগানাইজার । রুমঝুম বলেছিল, যুবতীদের পার্টিগুলো পুরুষদের চেয়েও রসালো হয় । অনেকের মুখ দিয়ে মাতাল অবস্হায় বেফাঁস কথা বেরিয়ে পড়ে ; কবে প্রথমবার করেছিল , চেনা না অচেনা, রেভ পার্টি না হঠাৎ-পরিচিত ; কে কতবার করেছে , ভার্জিনিটি রিপেয়ার করিয়ে নিয়েছে কিনা । কেউ-কেউ ফেসবুকে সেসব খেলাখেলির ফোটোও পোস্ট করে দেয় । ভার্জিন যখন তখন হবু বরের মুখ বন্ধ ।
ইনডিয়ানরা এত ভার্জিন খোঁজে কেন তা নিয়েও জব্বর হাসাহাসি হয় যুবতী মহলে । তাহলে আর স্বর্গে গিয়ে বাহাত্তরটা ভার্জিনের আশায় বোমাবেল্ট-পরা টেরারিস্টদের সঙ্গে ইনডিয়ান বরগুলোর তফাত কোথায় !
রুমঝুমের অ্যাসিস্ট্যান্ট ঘরে প্রবেশ করলে, রুমঝুমের কন্ঠস্বর শোনা গেল, মেল সেক্স টয়েজ আছে , যে খোকারা এই খেলনা নিয়ে খেলতে চায়, তারা বেছে নিতে পারে, এইডস থেকে বাঁচার এর চায়ে ভালো উপায় আরনেই । আমার কাছেও এলো ট্রে নিয়ে ; উলটে-পালটে দেখলুম সবই বিদেশি ; কোম্পানি অ্যামেরিকান বা ইউরোপীয় কিন্তু প্রতিটি তৈরি হয়েছে চিনে । ভারতীয় টাকায় এক-একটির দাম হাজার টাকার ওপর । দেখতে কিন্তু খুবই সুন্দর । মনে হবে যেন বিদেশিনীর যোনি । পায়ুকামীদের জন্য বিদেশিনীদের পায়ু । নামও মজার ; পকেট পুসি, পকেটে নিয়ে ঘোরার জন্য । মহিলার মুখের আকারের ব্লো জব সিমুলেটর , ওরাল সেক্সের চাহিদা মেটায় , ইলেকট্রিকে বা ব্যাটারিতে চলে । পর্নস্টার ভ্যাজাইনা, আকারে বড়, রন্ধ্রপথে ছোটো, ওটাও বিজলিচালিত । রিয়্যালিস্টিক ভ্যাজাইনা , একেবারে আসল যোনির মত , ইলেকট্রিকে বা ব্যাটারিতে চলে । সিলিকোন ম্যাস্টারবেটার , ভেতরে কিছুই দেয়া নেই , কিন্তু পিচ্ছিলতার অনুভব হবে । কেউ-কেউ কিনল , বোধহয় অন্যান্য বন্ধুদের দেখাবার জন্যে আর দরকারে প্রয়োগ করার খাতিরে । আমি শুধু হাতে নিয়ে জ্ঞান বাড়ালুম । কৃত্রিম নারীঅঙ্গ আমি একেবারেই মেনে নিতে পারি না ।
একটু পরে, কয়েক রাউন্ড হুইস্কির শেষে, অন্ধকার ঘরে জার নিকোলাস ওয়ানের রাজরানি এলো , ঘুর ঘুরে আমাদের সবাইকে উইশ করল , মানে টোপ দিতে থাকল, কে নিজের সঙ্গে নিয়ে যাবার সবচেয়ে বেশি দর হাঁকবে । আমি তো অপেক্ষা করছিলুম কখন টেবিলের ওপর দাঁড়িয়ে স্ট্রিপিং শুরু করবে । আমি এর আগে এই খেলাটা দেখিনি । বন্ধুদের অনেকেই এসব ব্যাপারে আমার চেয়ে দশপা এগিয়ে । বাবার জন্যে আমার ঘুড বয় ইমেজটা ঘোচাতে সময় লেগেছে । গণিতে বেশি নম্বর পাওয়াটাও একটা ফ্যাক্টর । বন্ধুরা ভাবত, নিরঞ্জনটা রসকসহীন, অষ্টপ্রহর শুধু তিনে কত্তে তিন হাতে রইল পেনসিল নিয়েই আছে । খোলস ছাড়ার পর আমিই হয়ে গিয়েছিলুম মধ্যমণি । তার কারণ আমি বেহিসেবি খরচ করতে ওস্তাদ ছিলুম ।
এখন মায়ার কথা মনে এলেই ভাবি কী ছিলুম আর মায়া কী করে দিয়েছিল। আমাকে তাই আগের সেই মায়াবর্জিত জীবনে ফিরতেই হবে । শেষনি, জানি তুমি এসব পড়বে আর তোমার মধ্যবিত্ত পিলে চমকে যাবে , ভাববে বুড়োটা মহাকলম্পট । তাই তোমার জন্য গড়ে তুলছি তেলেগু অক্ষরের ভুলভুলাইয়া ।
লাটভিয়ার স্ট্রিপারে রাজরানিত্ব খসাবার কায়দাটিই ছিল খাসা । প্রথমে বাঁ পায়ের সোনালি জুতো খুলে ছুড়ে দিল মুরারীমোহনের দিকে । তারপর ডান পায়েরটা যামিনিরঞ্জনের দিকে । এই ভাবে নেটের কালো স্টকিংস, পালকদেয়া রাজকীয় টুপির সামনে-ঝোলা মুখঢাকা জাল । মুখ দেখা যেতেই সবায়ের কি চেঁচামেচি, প্রেম জানাবার উচ্ছ্বাস, যেন হাঙরের ঝাঁকে পড়েছে তুলতুল সি-লায়ন । রুমঝুম মুখের ওপরেই তখন কেবল ফোকাস করাচ্ছে আলো । কি একখানা মুখ , একেবারে গোলাপি ; টকটকে রক্তখোর ঠোঁট । নগেন সূত্রধর তখন চেঁচাচ্ছে, ইন হুইচ পার্ট অব আওয়ার বডি ইজ দিস কান্ট্রি নেমড লাটভিয়া পোজিশানড , ইন দি হঅর্ট অর সামহোয়্যার এল্স ?
মাইকে রুমঝুমের কন্ঠস্বর শোনা গেল, দেয়ার আর মোর উওমেন দ্যান মেন ইন লাটভিয়া, ইউ মে গো দেয়ার ইফ ইউ ওয়ান্ট টু ব্রিং এ গার্ল ফ্রম দ্যাট কান্ট্রি অ্যাজ ইওর ওয়াইফ । ইয়োর ব্রিড মে হ্যাভ চান্সেস টু গেট ফেয়ারার ।
কে চেঁচিয়ে উঠল , নিরঞ্জন তুই চলে যা , তুই তো ঝাড়া হাত-পা । নিয়ে আয় গিয়ে, তারপর সবাই মিলে তাকে বিয়ে করে নেব । তোর বাড়ি তো বিরাট, লোকচক্ষের বাইরে, নিয়ায় নিয়ায়, সমাজ-টামাজের তোয়াক্কা করিসনে । । আমি বলেছিলুম, নিয়ে আসব, আপাতত আজকে আমি একেই নিয়ে যাব, তা সে যত টাকাই লাগুক।
ওরা যখন বলল, বিয়ে ! আমার কেমন যেন অদ্ভূত রহস্যময় মনে হয়েছিল শব্দটা সেদিন । কারোর সঙ্গে সারাজীবন একসঙ্গে থাকা ! তখন তো জানতুম না মায়ার মতন কেউ জীবনের কেন্দ্র ভেদ করে ঢুকে আসতে পারে । মায়া, যার সঙ্গে আমি সারাজীবন একসঙ্গে থাকতে চেয়েছিলুম , যে আমাকে স্বপ্ন দেখিয়েছিল, রুপোলি চুলদাড়ির বুড়োবুড়ির জীবন । লিখতে বসে, মায়াকেই মনে পড়ছে , অথচ লাটভিয়ার মেয়েটি যখন এক-এক করে ওর পোশাক খুলছে আর ছুঁড়ে-ছুঁড়ে আমাদের দিকে ফেলছে তখন কি কাড়াকাড়ি , তখনও কেউ জানে না যে প্রতিটি জিনিসে দাম লেখা আছে , আর যার কোলে লাটভিয়ার মেয়েটি ছুঁড়েছে তাকে সেই বস্ত্রটির দাম দিতে হবে ; কেউ বোধহয় ফাইনপ্রিন্ট পড়ে দেখেনি । সবচেয়ে বেশি দাম ছিল লনজারির , যেটা রাজরানি ছুঁড়লো না কারোর দিকে ।
রুমঝুমের কন্ঠস্বর শোনা গেল , ওকে চিলড্রেন, স্টার্ট ফ্রম থাউজেন্ড রুপিজ । নিলাম জিতল পরমেশ্বর সাহা , এগারো হাজার দিয়ে । ব্যাটা ইলেট্রনিক্সে এম টেক করতে যাচ্ছে আমেরিকা, ওরই অফিসের টাকায় , আর এখানে জাঙিয়া কিনতে হামলে পড়ল ; আমেরিকা গিয়ে কী করবে কে জানে ! বলেছে, আর ফিরবে না , কেননা ওখানে বারবার ডিভোর্স দেয়া যায় , বউকে কেবল এডালটারির সুযোগ করে দিয়ে চোখ বুজে থাকতে হয় , ব্যাস, কেল্লা ফতে , অ্যালিমনি থেকে মুক্তি ।
লাল টকটকে ফিনফিনে প্যান্টিটা খোলার আগে ঘর অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল। শোনা গেল রুমঝুমের কন্ঠস্বর , চিলড্রেন অব স্যাটির, ইয়োর অ্যাটেনশান প্লিজ , বি প্রিপেয়ার্ড ফর বিশ্বরূপ দর্শন । আলো জ্বলল, একটিই বিন্দুতে, সারা ঘরে নয় । ফিকে নীলাভ আলো । রাজরানির যৌনাঙ্গে । এতক্ষণের হিচই একেবারে স্তব্ধ । দি বোল্ডেস্ট লেচার মে টাচ ইট ফর থ্রি থাউজেন্ড রুপিজ , বলল রুমঝুমের কন্ঠস্বর । পরমেশ্বরই উঠে দাঁড়াল । রুমঝুমের কন্ঠস্বর বলে উঠল, ওকে, প্রোসিড । হঠাৎ অন্ধকার ।
পরমেশ্বর বলেছিল, হাত দিয়ে ছুঁইনি রে, ঠোঁট দিয়ে অনুভব করেছিলুম , ফেল্ট লাইক স্লিপিং ভলক্যানো ।
রুমঝুম এবার আলোকিত ঘরে প্রবেশ করে বলল, এনি টেকার্স ? এক লাখ টাকা , ক্যাশ ডাউন । আমি পকেট থেকে হাজার টাকার প্যাকেটটা দিয়ে দিলুম ।
রুমঝুম বলেছিল, অন্যান্য আইটেমের জন্য ক্রেডিট কার্ড থাকলেও চলবে , আমি এখানের ম্যানেজমেন্টকে বলে কার্ড সোয়াইপিং করানোর ব্যবস্হা রেখেছি । আমার দিকে কিছুই ছোঁড়েনি মেয়েটা ; আমি বলেছিলুম, আমার ঝাড়া হাত-পা, সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি , এখানের কোনো ঘরে ঢুকে কিছু করা নোংরামি মনে হবে ।
রুমঝুম বললে, ওকে, নো প্রবলেম । কালকে দুপুরের ফ্লাইটে ওর দিল্লি যাবার টিকিট, আপনি এয়ারপোর্টে পৌঁছে দেবেন ।
নিয়ে গিয়েছিলুম লাটভিয়ার যুবতীটিকে । দাদুর বাবার ঘর দেখে ও ভেবেছিল আমিও এখানকার কোনো জার নিকোলাসের পরিবারের । মেয়েটি নিজের ভাষায় কি যে বলতে থাকল জানি না, ওভাবেই বোথহয় ওদের দেশে প্রেমালাপ করে । ওর হাসি, যাকে গিগল বললে সঠিক বোঝা যাবে, অমন গিগলিং আমি মিলির কন্ঠেও শুনিনি । ননস্টপ গিগল । ওই গিগল শুনতে থাকলে মেজাজ আপনা থেকেই স্বর্গীয় হয়ে ওঠে । দেখলুম সঙ্গে দেহ-ব্যবসার যাবতীয় টুকিটাকি নিয়ে ঘোরে । এর দাদু হয়ত একদা সোভিয়েত বিপ্লবে অংশ নিয়েছিল ।
বেশ কেটেছিল রাতটা । ঘুমোবার আগে পর্যন্ত গিগল করেছিল । মেয়েটির সবকিছুই বড়-বড় , বুক হাত পাছা পায়ের গোছ উরুর বেড় । যাবার সময়ে চটি জোড়া নিতে ভুলে গিয়েছিল । তা রয়ে গেছে বাথরুমে , এক রাতের ফ্লিং-এর স্মৃতি হিসাবে । আমি ওর গিগল ধরে রেখেছিলুম মোবাইলে । তারপর তুলে নিয়েছি কমপিউটারে । রাতে যখন কেবল ঝিঁঝির ডাক ভেসে আসে তখন ওর গিগলটার ভল্যুম বাড়িয়ে শুনি বহুক্ষণ । মন হালকা হয়ে যায় ।
মায়া মোবাইল নিয়ে ফেলে দিয়েছিল । নয়তো আমার ঘরে মায়ার কন্ঠস্বরের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি উঠত , বারবার শুনতুম।
‘চলুন পালাই, বলার আগেই কি মায়া আত্মহত্যার পরিকল্পনা করে রেখেছিল ? বলত, আমায় ভালোবাসে, অথচ ও আত্মহত্যা করলে আমাকে যে কি হেনস্হা পোয়াতে হবে তা চিন্তা করেনি । আমি বোধহয় ছিলুম ওর কোনো আধ্যাত্মিক উদ্দেশ্যপূর্তির মাধ্যম ! মায়া, তুমি আমাকে ভালোবাসা শেখালে, আর এভাবে হঠাৎ আমার জীবন থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে গেলে । তোমার নিরুদ্দেশে যেতে চাইবার উদ্দেশ্য আজ আবছাভাবে বুঝতে পারি , কিন্তু তার কারণ জানি না, সেই কারণের উৎসসূত্র জানি না । আমি তোমাকে মিলির কথা, লাটভিয় যুবতীটির কথা, অন্যান্য নারীদের কথা কতবার বলতে চেয়েছি । বলতে দাওনি । তুমি অতীতকে মুছে ফেলার শর্তে জোর দিয়েছ বারবার । তাহলে ঝুলে গেলে কেন গাছ থেকে ? অতীতকে একেবারে নিজের সঙ্গে নিশ্চিহ্ণ করে দিতে ?
এতখানি পড়ার পর রিমা স্বগতোক্তি করল, ওঃ, চটিজোড়া তাহলে জনৈকা বিদেশিনীর । কত লীলেই দেখালে গো কংকাল প্রেমিক ! আর পুরুষদের খেলনার কথা তো জানতুম না । তার ওপর আবার কেক । কেক কাটছেন কে ? না আজ বাদে কাল যার বিয়ে ! ওঃ, খুব বেঁচেছি বিয়ে না করে । এরকমই কোনো সাতঘাটিয়া ছোঁড়ার সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে দিলেই হয়েছিল আরকি । পুলিস ডিপার্টমেন্ট কি এই যৌথ যৌন কাজ-কারবারের তথ্য রাখছে ? ডিসি ডিডিকে বলে রাখতে হবে ।
প্রিন্টআউট পড়া বজায় রাখল রিমা ।
আমার টেলিফোনের ব্যক্তিগত ডায়েরিটা খুঁজে বের করলুম । ফোনে চেষ্টা করলুম বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে । নিমাই মাইতিকে পেলুম, বিয়ে করে সংসারি , হাগবার পর্যন্ত ফুরসত নেই । ও বললে, প্রায় সবাই পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে কেটে পড়েছে , তার মধ্যে বেশির ভাগই বিদেশে । যারা বিদেশে তাদে কোনো খোঁজখবর নেই । সীতারাম বুড়ো মা-বাবাকে ফেলে পালাতে চায়নি বলে রয়ে গেছে , বিয়েথা করেনি , রাজারহাটে নতুন ফ্ল্যাট কিনেছে , তোর বাঙলোর ওদিকেই কোথাও , একদিন দেখা হয়েছিল পার্কস্ট্রিটে, পার্ক হোটেলে । নিজামুদ্দি এসেছে বোধহয়, ওর বাড়িতে ঢুঁ মার, বিয়েটিয়ে করেনি , একটা হিন্দু মেয়েকে বিয়ে করতে চেয়েছিল , তুই তো বাঙালি হিন্দুর মেন্টালিটি জানিস, অসাম্প্রদায়িক হবার চেষ্টা করেও ভয়ে পেছিয়ে আসে, বেচারা । নিজামুদ্দিরও সেম কেস ; ইসতামবুলে কায়রোয় আলজিরিয়ায় ছিল । কি করে ওসব দেশে ছিল জানি না , ওসব দেশে তো সেক্স একেবারে নো নো । এত কোয়ালিফায়েড , যেতে পারত কোনো ইউরোপীয় দেশে , মেয়েমানুষ আর ইউরো ভোগ করত, তা নয়, একেবারে মজনু হয়ে কাটিয়ে দিচ্ছে ; শালা এই লায়লা-মজনু রোমিও-জুলিয়েট পারু-দেবদাস গালগল্পগুলোই প্রেমিক-প্রেমিকাদের ডোবল । তুই শান্তনুকে চিনিস ? আমাদের চেয়ে এক বছর সিনিয়ার ? ও তো অ্যামস্টারডামে পোস্টিং পেয়েছে ; একদিন ফোনে বলছিল ওরকম শহর আর হয় না , নেপোলিয়ান নাকি প্রসটিটিউশান লিগালাইজ করে দিয়েছিল সে দেশে, সেই থেকে এদেশে একটা এলাকাই আছে ডি ওয়ালেন নামে । ওই রাস্তার কাছেপিঠে ও ফ্ল্যাট নিয়েছে ; তবে ভিষণ কস্টলি শহর । তোর তো বাপের অফুরন্ত টাকা আছে, বেড়েই চলেছে শুনি । চলে যা । লাটভিয়া গিয়েছিলি ? ও যাসনি । চলে যা , পড়ে পড়ে কি করবি ? চাকরিও করবি না । তাহলে করবিটা কি ? ওকে ছাড়ছি । আবার কথা হবে একদিন । বাইইইইই ।
Tagged ডিটেকটিভ উপন্যাস |
১১. আম্মার সন্ধানে
হায়দ্রাবাদ পোঁছে, সেখানকার ডিজি মিস্টার সুন্দরাইয়ার সঙ্গে দেখা করল রিমা। রিমার ডিজি পবিত্র মুখোপাধ্যায় হায়দ্রাবাদের ডিজির ব্যাচমেট , সরকারি চিঠি দিয়েছেন যাতে রিমা ব্যারাইট মাইনসের থানা আর অগ্রমগাগি আউটার এরিয়া অঞ্চলে গিয়ে মায়া পাল ও কংকাল প্রেমিকের মৃত্যুর ক্লু পেতে পারে । রিমা ওনাকে নিজের পরিকল্পনা জানিয়েছে । সিভিল ড্রেসে যাবে গ্রামটায় , শাড়ি পরে, কাঁধে ব্যাগ আর ক্যামেরা ঝুলিয়ে । মিস্টার সুন্দরাইয়া রিমাকে বললেন সতর্ক থাকতে , কেননা অন্যান্য খনিজের খোঁজ পাওয়া গেছে অঞ্চলটিতে । মাইনিং মাফিয়া সম্পর্কে কর্ণাটকের লোকায়ুক্ত জাস্টিস রঙ্গনাথনের পুলিসকর্মীদের অনুসন্ধানের ফলে কর্ণাটকের রাজনীতিতে যথেষ্ট উথাল-পাথাল চলছে। রিমা যেখানে যাবে তা অন্ধ্রপ্রদেশ-কর্ণাটক সীমান্তে, জঙ্গল-ঘেরা উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল । ফলে উগ্র মার্কসবাদী , মাওবাদী আর প্রতিবাদকারী এন জি ওদের সন্দেহ হতে পারে ওকে দেখে। অন্ধ্রপ্রদেশের ডিজি রিমাকে পাঠালেন উপজাতি উন্নয়ন দপতরের সচিবের কাছে , যাঁর কাছ থেকে মাইনস মিনারেলস অ্যান্ড পিপল নামের এন জি ও প্রতিনিধি রুক্মিনী রাও-এর নামে চিঠি নিল রিমা । রুক্মিনীকে সচিব লিখে জানিয়েছেন যে রিমা অগ্রমগাগিন আউটার এরিয়া অঞ্চলে যেতে চাইছে ওর হারিয়ে-যাওয়া কাকা-কাকিমার খোঁজে, যাঁরা দশ বছরেরও বেশি আগে ওই অঞ্চলের উপজাতিদের সঙ্গে থাকতে এসেছিলেন কিন্তু আর বাড়ি ফেরেননি ; তাঁদের সম্পর্কে কানাঘুষা শুনেছেন রিমা যে তাঁরা আর নেই , তাঁদের শেষকৃত্য হয়নি । সচিব ওদের সঙ্গে একজন সরকারী গ্রামকর্মী দিয়েছেন , শিভারামাইয়া, যে দোভাষীরও কাজ করবে ।
রিমার সঙ্গে এসেছে ওর সাবইন্সপেক্টর রজত মণ্ডল । রজতকে নিয়ে রিমা, পুলিসের পোশাকেই, প্রথমে গেল ব্যারাইট খনির থানায় । এখন অবশ্য আকরিক লোহা আর ম্যঙ্গানিজ পাওয়া যাওয়ায় ব্যারাইটের চেয়ে সেগুলোই বেশি তোলা হচ্ছে খনি থেকে। পাঁচ বছরের বেশি পুরানো এফ আই আর রুজু করার রেজিস্টারগুলো ওরা দুজনে, সারা দিন লাইনের পর লাইন দেখেও পেল না কিছু । রিমা রজতকে বলল, এখানেও হয়ত আমাদের মতন মনভোলানো এফ আই আর লেখা হয় , তুই সেইসব লাইনগুলো দ্যাখ যেগুলো কেটে ফেলা হয়েছে । সচিব যাকে সঙ্গে দিয়েছিলেন, শিভারামাইয়া, তার সাহায্যে ওরা ওই ভাবেই খুঁজতে-খুঁজতে একটা কাটা এনট্রি পেয়ে গেল, একজন মহিলার গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যার, গ্রাম পঞ্চায়েত অগ্রমগাগি আউটার এরিয়া, ছয় বছর আগের ঘটনা । মায়ালিঙ্গা নামে একজন বাঙালি যুবকের বিরুদ্ধে মহিলাটিকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করার অভিযোগ । শুনে রিমা লাফিয়ে উঠল, আরে রজত, এইটাই এইটাই, কংকাল প্রেমিক লিখে গেছে যে ওকে উপজাতিরা সবাই মায়ালিঙ্গা নাম দিয়েছিল।
তারিখ অনুযায়ী মহাফেজখানা থেকে রেকর্ড খুঁজে, নথির ঝুল-ধুলো ঝেড়ে রিমাকে ফাইলের লেখা পড়ে শোনাল শিভারামাইয়া । অগ্রমগাগি আউটার এরিয়া নিবাসী খনি শ্রমিক জনৈক নরসিমহার অভিযোগে পুলিস অগ্রমগাগি গ্রামপঞ্চায়েতের আউটার এরিয়ায় একজন মহিলার আত্মহত্যার সংবাদ পেয়ে সেখানকার শ্মশান থেকে মহিলার শব বাজেয়াপ্ত করে , আর তার স্বামীকে হেফাজতে নেয়। পুলিসের সন্দেহ ছিল যে দম্পতিটি নিষিদ্ধ কোনো রাজনৈতিক গোষ্ঠীর এবং লুকিয়ে থাকার জন্যে ওই দুর্গম অঞ্চলে এসেছেন । পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছ থেকে ফ্যাক্সে খবর পেয়ে জানা যায় যে তারা দুজনে টার্নওভার ইনকরপোরেটেড নামে একটি বহুজাতিকের উচ্চপদস্হ কর্মী , ইলোপ করে এসেছে , এবং সবায়ের নজর এড়িয়ে সংসার পেতেছে অগ্রমগাগির আউটার এরিয়ায় ; তাদের সঙ্গে রাজনীতির সংস্রব নেই।
পোস্টমর্টেম রিপোর্টটাও ফাইলে পায় রিমা । ডাকতার লিখেছেন যে কন্ঠের লিগেচার মার্ক গোল না ভি শেপড তা অস্পষ্ট। কন্ঠের সার্ভিকাল ফ্র্যাকচার হয়েছে , যার দরুন স্পাইনাল কর্ডে ট্রম্যাটিক ইনজুরি রয়েছে । শরীরে কোনো আঘাতচিহ্ণ নেই , যদিও সাত-আট ঘন্টা পূর্বের যৌনমিলনের প্রমাণ রয়েছে । পাকস্হলিতে স্বাভাবিক খাবার, কোনো বিষ পাওয়া যায়নি, দেহের বাইরেও কোনো বিষক্রিয়ার চিহ্ণ পাওয়া যায়নি । তিনি সুপারিশ করেছেন যে নাক ও মুখগহ্বরের লালার কেমিকাল অ্যানালিসিস করালে ভালো হয় , কেননা তাঁর সন্দেহ হয়তো কোনো ঘুমের রসায়ন বা ক্লোরোফর্ম পাওয়া যেতে পারে , যদিও অমন বনাঞ্চলে কোনো রসায়ন পাওয়া দুষ্কর । শেষে ডাকতার যোগ করেছেন যে ক্যাডাভার নিয়মানুযায়ী সংরক্ষণ না করার কারণে অটপসি রিপোর্ট সম্পূর্ণ নির্ভুল নয় । সে সময়ের থানা ইনচার্জ, নিজের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা চাপা দিতে লিখেছেন যে ঘটনাটি সুইসাইড , হোমিসাইড নয় ; সেকারণে মিস্টার মায়ালিঙ্গার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে নিয়ে তাঁকে ছেড়ে দেয়া হোক। তাছাড়া পোস্টমর্টেম রিপোর্টে ডাকতারের সই নিতে ভুলে গিয়েছিলেন থানা ইনচার্জ ।
রিমা রজতকে বলল, এ তো দেখছি আমাদের রাজ্যের চেয়েও কেলো । তারপর বর্তমান থানা ইনচার্জের কাছে জানতে চাইল সেই থানা ইনচার্জ কি বেঁচে আছেন ? তাঁর সঙ্গে দেখা করা যায় কি ? রিমা জানতে পারল তিনি অবসর নিয়েছেন, অবসর নিয়ে কর্ণাটকে রেড্ডিদের মাইনসে সিকিউরিটি অফিসারের চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন। ব্যাঙ্গালুরুতে গিয়ে রেড্ডিদের দপতরে খোঁজখবর করলে জানা যেতে পারে তিনি এখন কোথায় থাকেন ।
সে আইডিয়া পরিত্যাগ করে রিমা জরুরি কাগজপত্রগুলোর একটা করে সার্টিফায়েড জেরক্স কপি নিল ।
রিমা তাঁতের শাড়িতে আর রজত ধুতি পাঞ্জাবি পরে রুক্মিণী রাওয়ের সঙ্গে দেখা করতে, তিনি বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি শুনেছি ঘটনাটা। ওখানে যে মন্দিরটা আছে সেটাই তো আপনার কাকিমা, মানে আম্মার নামে, স্হানীয় লোকেরা বলে তিনি ছিলেন সাক্ষাৎ দেবী । রিমা বলল, শুনেছি আম কলা লেবু পেঁপে ইত্যাদি ফলের বাগানের ভেতর দিয়ে যেতে হয় , অত্যন্ত সুন্দর প্রাকৃতিক জায়গা ।
রুক্মিণী বললেন, কে বলেছে আপনাকে এই সমস্ত গল্প ? ছিল হয়ত, সেই সময়ে, যখন আপনার কাকা-কাকিমা এখানে থাকতে এসেছিলেন । বাগান-টাগান আর নেই । জঙ্গলও নিশ্চিহ্ণ । নানা খনিজ পাওয়া যাচ্ছে আর উপজাতিদের অঞ্চলগুলো বেদখল হয়ে যাচ্ছে । উদারীকরণের উপসর্গ! এখন সোজা গাড়ি করে যাওয়া যায় । শ্রমিকদের জন্যে বাজার দোকান চায়ের স্টল মদের ঠেক ঝুপড়ি গড়ে উঠে জঘন্য হয়ে গেছে এলাকাটা । লোহা-ম্যাঙ্গানিজ মাফিয়াদের দৌরাত্ম্যে এলাকাটা এখন নরক।
ভাড়া-করা প্রায়ভেট গাড়িতে বসে রিমা জিগ্যেস করল , আমার কাকা-কাকিমার গ্রামটা নেই ?
রুক্মিণী জবাবে জানালেন, ওটা গ্রাম কোনো দিনই ছিল না , ওটা গ্রামের আউটার এরিয়া , তুরপু-স্পিকিং ট্রাইবালরা থাকত । এখন এ-আধ ঘর টিকে আছে । বাদবাকি সবাই ছত্রভঙ্গ হয়ে নানা খনিতে শোষিত ও নিপীড়িত হচ্ছে ।
রিমা বোকার ভান করে, যাতে গাড়িতে পথটা গল্প শুনে কাটে, বলল, খনিজের সঙ্গে উপজাতিদের কী করার আছে !
রুক্মিণী স্বরূপে এলেন এবং বক্তৃতা দিতে আরম্ভ করলেন । ভারতের বনাঞ্চলে বেশিরভাগ থাকেন উপজাতিরা । দুর্ভাগ্যের বিষয় এই সমস্ত অঞ্চল জুড়ে পাওয়া গেছে খনিজ ; ভারতের প্রায় দশ লক্ষ হেক্টরে আছে কয়লা, ম্যাঙ্গানিজ, ম্যাগনেসিয়াম, পেট্রলিয়াম, অ্যালুমিনিয়াম, সোনা, রুপা, ক্রোমিয়াম, লোহা, তামা, সিসা-দস্তা, ইউরেনিয়াম, থোরিয়াম, টাইটেনিয়াম, জিক্রনিয়াম, টিন, নিকেল, ফসফেট, জিপসাম, মার্বেল, লাইমস্টোন ইত্যাদি। আপনাদের কলকাতার কতগুণ এলাকা চিন্তা করে দেখুন। আর তা নিয়ে লুটের প্রতিযোগীতা শুরু হয়েছে । অবৈধ খনিতে ছেয়ে গেছে দেশটা এবং এই খনি-মালিকরা এতই শক্তিশালী যে তাদের ঘাঁটাতে গেলে রাজ্য সরকার পড়ে যায় । তাদের লোভ বেড়েই চলেছে ; কোথায় গিয়া থামবে জানি না । চিনের সঙ্গে মুখে-মুখে রাজনৈতিক তুই-তোকারি চলছে অথচ সবায়ের চোখের সামনে দিয়ে ট্রাকের পর ট্রাক খনিজ চোরাচালান হয়ে যাচ্ছে চিনে । সবাই সব কিছু জেনে না জানার ভান করে ঘুমিয়ে আছে ।
রিমা শুনতে শুনতে মাথা নাড়াচ্ছিল ।
রুক্মিণী বলতে থাকলেন, এই খনিগুলোর জন্য দরকার পরিশুদ্ধ করার কারখানা, তার জন্য দরকার বিদ্যুৎ, অর্থাৎ আরও চার লক্ষ হেক্টার । কাগজ খুললেই দেখবেন প্রায় প্রতিদিন কোথাও না কোথাও পুলিস প্রতিবাদকারীদের ওপর গুলি চালিয়েছে বা খনির যারা ইজারা নিয়েছে তাদের গুণ্ডারা ঝাঁপিয়ে পড়েছে এদের ওপর । প্রতিবাদকারী কারা ? এই সমস্ত দরিদ্র উপজাতি বা তফসিলি জাতির মানুষ । এই এলাকাটা অন্ধ্রপ্রদেশের অন্তর্গত হলেও খনির মাফিয়ারা মূলত কর্ণাটকের — তাও এক প্রশাসনিক সমস্যা ।
আপনাদের ভূমিকা কী , জানতে চাইল রিমা । রুক্মিণী বললেন, আমরা আর কী করব , তিনটি ফ্রন্টে লড়াই করছি । প্রদূষণের বিরুদ্ধে, শোষণের বিরুদ্ধে, আর শ্রমিকদের স্বাস্হ্যরক্ষার দেখাশোনার তদারকি করতে । এতো স্ট্রং লবি যে আমরা প্রায় অসহায় ।
অগ্রমগাগি আউটার এরিয়ায় পৌঁছে অনুসন্ধানী সূত্রের মুখ খুলল রিমা । রুক্মিণীকে জিগ্যেস করল, সেই সময়ের কেউ আছেন কি এই অঞ্চলে ? রুক্মিনী বললেন, চলুন খুঁজে দেখি, কয়েকজনকে পাওয়া যাবে নিশ্চয় , যারা তখন কিশোর-কিশোরী ছিল । তবে তারা আপনার কাকা-কাকিমার সংস্পর্শে এসেছিল কিনা তা ওদের দেখা মিললে জানা যাবে ।
পাওয়া গেল বালু আর সিরিসৈলম নামে দুজন শ্রমিককে, অনেককে জিজ্ঞাসা করার পর । তারা এখন যুবক । তাদের মনে আছে মায়াগারু আর আম্মাকে। খনির প্রসার বোধহয় সর্বভারতীয় হিন্দির জগাখিচুড়িরও প্রসার ঘটিয়েছে । ওদের হিন্দি বুঝতে কোনও অসুবিধা হল না । স্মৃতিচারণ করতে -করতে বস্তুত তারা কেঁদে ফেলল । আম্মা আর মায়ালিঙ্গার যে কাহিনি ওরা চায়ের ঠেকে বসে শোনাতে লাগল, তা রিমার জানা ; তবু ওদের তরফ থেকে গল্পটা শুনল।
বালু বলল, আম্মা বলতেন মাছ-মাংস ডিম দুধ খাওয়া পাপ । প্রকৃতি কত ফলমূল দিয়েছে, তবুও মানুষের আশ মেটে না । আম্মা প্রতিদিন কুয়োতলায় যেতেন বাচ্চাদের কোলে নেবার জন্য , বাচ্চাদের কী ভাবে সুস্হ রাখা যায় তা মা-বউদের বোঝাবার জন্য । মায়েরা ওনার কোলে বাচ্চা দিয়ে জল তুলত ; ওই তো ওই ছেলেটাকে দেখছেন, ও-ও চেপেছে আম্মার কোলে । সে-সব বাচ্চারা কেউ-কেউ বলে যা তারা আম্মার গায়ের গন্ধও মনে রেখেছে আর কখনও ওই গন্ধ পেলে দূর থেকে বলে দিতে পারবে যে আম্মা আছেন কাছে-পিঠে ।
ওরা দুজনে রিমাদের নিয়ে গেল আম্মার মন্দিরে। রিমা দেখল কংকাল প্রেমিক বর্ণিত চালাবাড়ি আর নেই, তার সামনের কাঁঠাল গাছটিও আর নেই । চালার জায়গায় মন্দির ; মাটির ছিল আগে । যিনি আসেপাশের এলাকার খনিগুলোর ঠিকেদারি নিয়েছেন, তিনি দয়া করে ইঁট-সিমেন্ট-পাথর দিয়ে তৈরি করিয়ে দিয়েছেন , চিরাচরিত দক্ষিণ ভারতীয় মন্দিরের আদলে : ভেতরে কালো কুচকুচে কোনো দেবীমূর্তি, সিঁদুরে-সিঁদুরে লাল । সিরিসৈলম জানাল, মূর্তির তলায় আম্মার চুল পোঁতা আছে ; জাগ্রত দেবী , দূর-দূর থেকে মানুষ এখানে মানত করতে আসে , কেননা আম্মার কাছে কিছু চাইলে তিনি ফিরিয়ে দেন না ।
রিমা মানত করল, কংকাল প্রেমিকের কেসটা যেন তাড়াতাড়ি সুরাহা হয় , জানা যায় যে ওটা সুইসাইড না হোমিসাইড । মন্দিরের, মূর্তির, বালু-সিরিসৈলমের, এলাকার দোকানপাটের কয়েকটা ফোটো তুলে নিল, প্রমাণ হিসাবে কাজে লাগতে পারে ।
কলকাতায় ফিরে রিমা জানতে পারল যে স্পেশাল ব্র্যাঞ্চ থেকে খোঁজখবর করে টার্নওভার ইনকরপোরেটেড কর্মীদ্বয়ের সংবাদ অন্ধ্র পুলিসকে পাঠিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকার । অন্ধ্র সরকার মৃত মায়া পালের মুখের ফোটো আর কংকাল প্রেমিকের ফোটো পাঠিয়েছিল ফ্যাক্স করে, মায়া পালের মৃত্যুর কেসের তথ্য সংগ্রহের জন্য। তারই সূত্র ধরে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ওই দুজনের খবর যোগাড় করেছিল । ফোটোগুলোকে স্পেশাল ব্র্যাঞ্চের নথিতে খুঁজে পেল না। ওদের কমপিউটারে কেবল রেকর্ডটুকু রয়েছে । ভাগ্যিস কমপিউটারে রয়েছে নয়তো খুঁজা বের করা যেত না পচা ফাইলের ধুলোমাখা পাহাড় থেকে । ডিলিং ক্লার্ক জানাল, অত পুরানি নটি রাখা সম্ভব নয়, প্রতিদিন এত খোঁজখবর যোগাড় করতে আর তার রেকর্ড রাখতেই ডিপার্টমেন্ট হিমশিম খাচ্ছে । তাছাড়া এ-ধরণের কেস ওদের ডিপার্টমেন্টের নয় । মিসিং পার্সনস বিভাগ ওটা স্পেশাল ব্র্যাঞ্চে পাঠিয়ে নিজেদের কাজ হালকা করেছিল ।
প্রথম ইনভেসটিগেটিং অফিসার সুমন মিশ্র যদি স্পেশাল ব্র্যাঞ্চে খোঁজ নিতেন তাহলে তদন্তে এগিয়ে যেতে পারতেন । হয়তো ফোটোদুটোও পাওয়া যেত । টার্নওভার ইনকরপোরেটেড অফিসের ঠিকানা টেলিফোন ডিরেকটরিতে পাওয়া গেল না। বাড়িতে বসে গুগল সাচহ করে রিমা জানতে পারল যে মার্কিন কোম্পানিটা কেরানি আন্দোলনের ধাক্কায় কলকাতার পাত্তাড়ি গুটিয়ে দিল্লি চলে গেছে । অগত্যা দিল্লি পাড়ি মারতে হল রিমা আর রজতকে , অনুমোদন নিয়ে।
দিল্লিতে টার্নওভার ইনকরপোরেটেড-এর রিসেপশানিস্ট মিস সিমরন খান্না পুলিসের পোশাক দেখে ওদের দুজনকে দিয়ে রেজিস্টারে নাম-ঠিকানা লিখিয়ে, গলায় ইলেকট্রনিক এন্ট্রিপাস ঝুলিয়ে, নিয়ে গেলেন লিয়েজঁ অফিসারের কাছে । তিনি বসতে বললেন, চা খাওয়ালেন, কমপিউটারে কিছু পেলেন না, হার্ড ডিস্কে নেই। পাঁচ বছর আগের সিডির গোছা নিয়ে এলেন এবং তা থেকে একটা বেছে নিয়ে, দেখে, এক সময় বললেন, হ্যাঁ, শ্রীমতী মায়া পাল, বিজনেস ডেভেলাপমেন্ট এগজিকিউটিভ আর নিরঞ্জন দত্ত প্রোজেক্ট ফোরকাস্ট অ্যাডভাইজার, দুজনেই ছিলেন কলকাতা অফিসে । মায়া পাল আর রিপোর্ট করেননি ; তাঁকে প্রদত্ত টাকা পাঠানো হয়েছিল বাড়িতে, যা ফেরত আসে ওই ঠিকানায় তিনি না থাকায় ; যাঁরা ওই ঠিকানায় ছিলেন তাঁরা নিতে অস্বীকার করেছিলেন। নিরঞ্জন দত্ত চার বছর পর ডাকযোগে পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছিলেন , যদিও ওনার সার্ভিসেস ছয় মাস রিপোর্ট না করায় টার্মিনেট করে দেয়া হয়েছিল। ওনাকে ওনার দেয় প্রথমে ফেরত এসেছিল, তা পরে আবার ডাকযোগে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল।
রিমা দুজনেরই কলকাতার ঠিকানা নিয়ে নিল , মোবাইল নম্বর নিয়ে নিল; ওদের সংগ্রহে ফোটো ছিল, তার কালার জেরক্স তো নিলই, নিজের মোবাইলে ফোটোও তুলে নিল। ঠিকানা থেকে প্রমাণিত যে নিরঞ্জন দত্তই কংকাল প্রেমিক। দুজনের ফোটো দেখে রজত বলল , একেবারে এক দুজেকে লিয়ে জুটি ; এখানেই ঘর করতে পারত, তা নয়, মগজে পোকা ঢুকিয়ে ওনারা চলে গেলেন নন্দনবাগিচায়।
ঠিক বলেছিস, মোটামুটি ভালই দেখতে ছিল মায়া পালকে , আর কংকাল প্রেমিক তো বেশ হ্যান্ডসাম । চুল-দাড়ি বাড়িয়ে একেবারে যিশুখ্রিস্ট হয়ে গিয়েছিল বোধহয়, স্বগতোক্তি করল রিমা ।
কংকাল প্রেমিককে কি সত্যিই ‘চলুন পালাই’ বলেছিলেন মায়া পাল, নাকি ভাবে-চিন্তে অমন একজন নির্ভরযোগ্য স্বাস্হ্যবান যুবককে বাছাই করেছিলেন ? কে জানে ! এর উত্তর তো ইনভেসটিগেশানের বাইরে । অগ্রমগাগি মাইনসের মন্দিরে আম্মার পাশে হিরোকেও মূর্তি করে রাখা উচিত ছিল, শিব-পার্বতী জুটি । প্রেমের খাতিরে জীবনটাই নষ্ট করে ফেলল বেচারা ।
রজত বলল, আরে মায়া পাল এই হিরোকে বেশ কিছুদিন যাবত লক্ষ করে গেঁথে তুলেছিল, দেখছেন না, ওনার বাড়ি সল্ট লেকে আর হিরো থাকত দমদমে । নিশ্চয় শোভাবাজার বা শ্যামবাজার থেকে মেট্রো চেপে দমদমে গিয়ে অপেক্ষা করছিল ; হিরোকে দেখামাত্র হুক করে তুলেছে, ভেবেদেখার সময়টুকুও দেয়নি । প্রিন্টআউট যতটুকু পড়েছি, হিরোবাবু সুশ্রী মেয়ে দেখলেই গলে যেতেন , আর মায়া পাল তো গলিয়ে দেবার সাক্ষাথ আগ্নেয়গিরি । দিয়েছে এক গরম-পরশ, ব্যাস, হিরো গলে ধোঁয়া।
বলেছিস বটে, মন্তব্য করল রিমা ।
কলকাতায় ফিরে, যে ঠিকানা থেকে মায়া পালের মাইনের টাকা টার্নওভার ইনকরপোরেটেডে ফেরত গিয়েছিল, সেখানে শালোয়ার-কুর্তায় একাই ঢুঁ মারল রিমা ; রজত হাতে থাকুক, প্রয়োজন হলে পরে রজতকে আবার পাঠানো যাবে বাড়িটায় । সল্ট লেকের বাড়িটার গেটে সিমেন্টে আর ভেতরে দরজায় পিতলের চকচকে নেমপ্লেটে বিশ্বদেব পালের নাম দেখে আশান্বিত হয়েছিল রিমা । কিন্তু জনৈইক রোগা, পাকাচুল, ঘড়ঘড়ে-গলা বৃদ্ধ বহুক্ষণ পর দরজা খুলে, প্রশ্ন শুনে বললেন, না, মায়া পাল নামে কাউকে চেনেন না তাঁরা। রিমার অপর প্রস্নের জবাবে বৃদ্ধ জানালেন যে, হ্যাঁ, তিনিই বিশ্বদেব পাল । এই বাড়িতে তাঁরা চার বছর হল এসেছেন । ভেতরে ঢুকে বসতেও বললেন না বৃদ্ধ । ওই কটি কথা বলে বন্ধ করে দিলেন দরজা ।
রিমা ফোনে রজতকে বলল, তুই বিধাননগর মিউনিসিপালিটিতে খোঁজ নে বাড়িটা কার নামে । যদি দেখিস বাড়িটা বিশ্বদেব পালের নামে তাহলে ওদের ল্যান্ডলাইনের লাইনটা পো থেকে ডিসকানেক্ট করে দিস , আর পরের দিন সকালে লাইনম্যান সেজে ভেতরে ঢুকে কথায়-কথায় যতটা পারিস পাল পরিবার সম্পর্কে খোঁজ নিস । আমি পুরানো ভোটার লিস্ট থেকে মায়া পালের ওই বাড়িতে থাকার এভিডেন্স নিয়ে নেবো , অবশ্য উনি যদি এনরোল করিয়ে থাকেন। ধনী মহিলারা সাধারণত নাগরিকত্বের ধারে-কাছে যান না , তাঁদের বিদেশ পালাবার পাসপোর্ট হলেই হল।
রজত বিধাননগর মিউনিসিপালিটির কুড়ি বছরের রেকর্ড থেকে জানতে পারল যে বাড়িটা বিশ্বদেব পালের, প্রথম আবন্টনেই জমি পেয়েছিলেন। সল্ট লেকের স্হানীয় পুজো কমিটিতে রজতের পরিচিত অবসরপ্রাপ্ত অ্যাসিসট্যান্ট কমিশনার অব পুলিস ছিলেন বলে টেলিফোন লাইন ডিসকানেক্ট না করে রিমাকে নিয়ে তাঁর কাছেই গেল রজত। তিনি মিস্টার মৃগাঙ্কশেখর ব্যানার্জি, বললেন, বিশ্বদেব পাল বিশেষ মেশেন না কারোর সঙ্গে, চাঁদা দিয়েই খালাস, ওনার স্ত্রী নাকি কারোর সঙ্গে পালিয়ে যাবার পর থেকে উনি অমন উদাসীন হয়ে গেছেন । না, পলাতকা স্ত্রীর নাম মৃগাঙ্কশেখর জানেন না । কানাঘুষায় তাঁর যতটুকু জানা আছে, মহিলা নাকি ঘোর শাকাহারী ছিলেন এবং তা নিয়ে ওদের বাড়িতে প্রতিনিয়ত খিটিমিটি লেগে থাকত । মেয়ের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে বেশ চেঁচামেচি করে ঝগড়া হয়েছিল, আর তার পরেই ওনার ম্যাডাম প্রেমিকের সঙ্গে ইলোপ করে । চেঁচামেচির কারণেই প্রতিবেশীদের কাছে ব্যাপারটা আরও বেশি জানাজানি হয়ে গিয়েছিল। বিশেষ জানি না; কেউ কি আর ওসব অযথা খোঁচায় ! তবে বিশ্বদেব পালের মেয়ে পুজোয় পার্টিসিপেট করে, সে খুব চটপটে । দক্ষিণ কলকাতার কোথাও ওনার মেয়ের নার্সং হোম আছে । ভালো ডাকতার , এম ডি, অথচ আগে যেখানে পলিক্লিনিক খুলেছিল সেখানে কোনো কারণে পশার গড়ে তুলতে পারেনি, দমদমের ওদিকে কোথাও। ওর লিভ-ইন প্রেমিকের সঙ্গে নাকি ছাড়াছাড়ি হবার ফলে ঠাঁই বদল করে চলে এসেছে , এরকম কানাঘুষা শোনা যায় ।
স্যার, ওনাদের বাড়িতে কি পোষা কুকুর ছিল ? মৃগাঙ্ক ব্যানার্জিকে জিগ্যেস করল রিমা ।
না, কুকুর দেখেছি বলে মনে পড়ছে না । ডাকও শুনিনি । বললেন মৃগাঙ্ক।
বিশ্বদেবের বাড়িতে খোঁজ করার সময়ে কোনো ডাকতারের নেমপ্লেট লক্ষ করেনি রিমা । রজতকে বলল, তুই ওই ডাকতার সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে আমায় জানাস ।
বিশ্বদেব পাল মিথ্যা বলল কেন, চিন্তায় আক্রান্ত রিমার সন্দেহ হল যে নিরঞ্জন দত্তকে কংকাল প্রেমিকে পরিবর্তন করায় এনার হাত থাকতে পারে । তবে বিশ্বদেব পাল কি করেই বা জানবে যে মায়া পাল কার সঙ্গে পালিয়েছিল । যার বউ পালায় তার পক্ষে তো পালানো বুয়ের খোঁজখবর করা বেশ এমব্যারাসিং । টার্নওভার লিমিটেড-এর লিয়েজঁ অফিসার তো জানালেন মায়া পাল আর নিরঞ্জন দত্ত সম্পর্কে কেউ তাঁদের অফিসে খোঁজ নেয়নি, কেননা যে-ই তাঁদের অফিসে আসে তাকে রিসেপশানের রেজিস্টারে নাম-ঠিকানা সই করে ইলেকট্রনিক এনট্রি পাস নিতে হয় , অটোমেটিকালি ডাটাব্যাংকে রেকর্ড হয়ে যায় ।
পুরানো ভোটার লিস্টে মায়া পালের নাম পাওয়া গেল না ; বিশ্বদেব পালের নাম আছে । চোখ বুলিয়ে পাতা উলটিয়ে ওনার কোনো আত্মীয়ের নাম পেল না ; হয়তো ওনার মেয়ে তখন স্বামীর বাড়িতে ছিল ।
মেয়ে ? মেয়েটা তাহলে মায়া পালের ; দুধের শিশুকে ফেলে রেখেই পালিয়েছিলেন মহিলা, কংকাল প্রেমিকের সঙ্গে । তার মানে অবনিবনা এমন অবস্হায় পোঁছেছিল যে ভাঙন জোড়া লাগার কোনো সম্ভাবনা আর ছিল না । আবার বিয়ে করেছিলেন কি বিশ্বদেব পাল ? করেননি বলেই মনে হয়। করলে ভোটার লিস্টে নাম থাকত , দ্বিতীয় পক্ষের ছেলেপুলের নাম থাকত । অবশ্য হালের লিস্ট তো দেখা হয়নি । বিশ্বদেব পালের আঙুলের ছাপ নিয়ে মেলাতে হবে , কংকাল প্রেমিকের বাড়িতে পাওয়া আঙুলের ছাপের সঙ্গে মিল আছে কিনা ।
খগেনকে কুরিয়ার বয় সাজিয়ে বিশ্বদেব পালের বাড়ি পাঠিয়ে একটা ভুয়ো নিবেশ কোম্পানির কমপিউটার-চিঠি খামে ঢুকিয়ে বিশ্বদেব পালের আঙুলের ছাপ সংগ্রহ করেছিল রিমা । কিন্তু, নাঃ, যে-কটা আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে বাঙলোবাড়িটায়, তার কোনোটার সঙ্গেই মেলেনি বিশ্বদেব পালের আঙুলের ছাপ । রাজ্য ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোয় রাখা কোনো ক্রিমিনালের আঙুলের ছাপের সঙ্গেও মেলেনি ওই বাড়িটায় পাওয়া ছাপগুলোর কোনোটা। মিললে, অনুমান করা যেত কেউ কাউকে দিয়ে খুন করিয়েছে । তবে বউ পালালে কোনো স্বামীই বোধহয় অমন খুন করাবার রিস্ক নেবে না । বউ পালালে বরং আরেকটা নারিদেহ পাবার সুযোগ ঘটে ।
রিমার দিদি, দশ বছরের আগে যারা পিট বুল কুকুরের বাচ্চা কিনেছে, তাদের নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করে এনেছেন । যারা ঠিকানা পালটায়নি তাদের কারোর বাড়িতে পিট বুল কুকুর আর নেই , রজত বাড়ি-বাড়ি খোঁজ নিয়ে জেনে এসেছে । সে-প্রজাতির কুকুর কবেই মারা গেছে জানিয়েছেন তাঁরা , এবং অন্য প্রজাতির কুকুর পুষেছেন, পিট বুল পোষার হ্যাপা এড়াতে । ইনটারনেটে টেলিফোন ডিরেকটরি থেকে আরও কয়েকজন ক্রেতের নতুন ঠিকানা সংগ্রহ করেও কুল পাওয়া যায়নি।
একদিন দুপুরে নিচে থেকে পরিচিত কন্ঠস্বরে কারোর রিমাদি রিমাদি হাঁক শুনে বারান্দা থেকে রিমা দেখল জনৈকা বৃদ্ধার সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে রেজাউল। ওপরে ডেকে আনতে রেজাউল বলল, আমাদের গ্রামের পিসি, সবাই খালা বলে ডাকে । তুমি বলেছিলে বাঙলোবাড়ি সম্পর্কে খোঁজ নিতে । তা খালা এককালে ওবাড়িতে কাজ করত ।
বলুন খালা, কী জানেন আপনি ? রিমা জিগ্যেস করল, কাচের গ্লাস ভরা চা আর বিস্কুট এগিয়ে দিয়ে ।
খালা বললেন, আমি ওবাড়িতে অনেককাল কাজ করিচি গো ; পেরথমে বাবু মারা গেল, তাপ্পর মা মারা গেল, দাদাবাবু আমায় কাজ থেকে ছাইড়ে দিলে । তা উনি অনেক ট্যাকা দিইছেল । বলেছেল, একা বাড়িতে তুমায় দিয়ে কাজ করালে তুমাকেই বদনাম করে যদি, তাই। তাপ্পর তো দাদাবাবু মনের দুঃখে কোতায় চলে গেল ; কত বছর সাধু হয়ে ঘুরল । তাপ্পর একবার গিয়ে দেকি দাদাবাবু ফিরেচে, অ্যাগবারে ন্যাড়া, এই আমি যেমন বুড়ো, তারচে আরো বুড়ো। এক ডাকতারনি আসতো ওঁয়াকে স্যাবা করতে, চশমা-পরা, লাল রঙের মটরগাড়ি চেপে ; সেবারো দাদাবাবু ট্যাকা দিইছেল । তা ডাকতারনি আমায় বললে, তুমি বাপু ঘন-ঘন এসোনি, দেকচোনি দাদাবাবুর শরিল খারাপ । ডাকতার বারণ করেচে , আর যাই কি, আর যাই না। সেই শেষ দ্যাখা ।
ঠিক আছে খালা, আপনি আজ আমার বাড়ি থেকে যান , আপনাকে দরকার । রিমা কিছু টাকা দিল খালাকে, বলল, খালা আপনি কি একা ওই বাড়িতে থাকতে পারবেন ? আপনার ভুতের ভয় নেই তো ? আমি জানতে চাই আপনার দাদাবাবু কী ভাবে মারা গেলেন ।
সেলিমা বেওয়া বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ, কেন পারবুনি , ওই বাড়িতে রাজত্ব করিচি এককালে, তা ভুত যদি থাকে তো বাবু বা মা বা দাদাবাবুর ভুতই থাগবে ; তাদের সঙ্গে কতা কইব । বাড়িটায় কত ধুলোজালা পড়েছে, পোষ্কারও করে দেব । ও বাড়ির খুঁটিনাটি আমার জানা । আমি তো ছাতের ওপরে যে ঘরটা আছে সেইটেয় থাগতুম গো । অত বড় বাড়িতে কতদিন একা থেকেচি । বাবুরাব বেড়াতে গেলে আমিই তো থাগতুম।
না না, পরিষ্কার টরিষ্কার এখন করতে হবে না , এখন সব জিনিসপত্র যেখানে যেমন আছে তেমনই থাকুক, খালাকে বলল রিমা । রেজাউলের দিকে তাকিয়ে রিমা বলল, কি রে, খালা এই বয়সে একলা থাকতে রাজি আর তুই টাটকা যোয়ান ছেলে হয়ে ভয় পাচ্ছিস ।
রেজাউল: আমি আবার কোথায় ভয় পেইচি। ও তো খগেনদা বলেছি।। আমার ভুতের ভয়টয় নেই।
রিমা খালা আর রেজাউলকে বুঝিয়ে দিল যে কেউ যেন জানতে না পারে যে তারা ওই বাড়িতে রয়েছে। সন্ধ্যা হবার পর আলো না জ্বেলে লক্ষ্য রাখতে হবে যে কোনো লোক বাড়ির কাছাকাছি আসছে কি না ; যদি আসে তাহলে সে কি করছে । এখন আমি কেবল সন্দেহ করছি । পরে দেখা যাবে তাকে বা তাদের ধরা যায় কি না । পরের দিন সকালে এসে আমায় জানালেই হবে ।
খালা আর রেজাউলকে ট্যাক্সিতে চাপিয়ে বাঙলোবাড়িতে পৌঁছে দিল রিমা ; দেখিয়ে দিল কোন ঘরে ওরা থাকবে আর কোন-কোন ঘরে ঢুকবে না ।
তারপর বাড়ি ফিরে ভাবতে বসল । এই ডাকতারকে কি করে খুঁজে বের করা যায় ? লাল রঙের গাড়ি ; কে নাজে , এখন হয়তো বেচে দিয়ে থাকবে । কোনো ডাকতারের নাম পিট বুল ক্রেতার তালিকায় আছে চোখ বোলাতে বোলাতে বিনোদিনী পাল নামে এক ডাকতারের নাম পেল রিমা । কিন্তু কেনেল ক্লাবের রেজিস্টারে দেয়া ঠিকানাগুলোতে ওনার নাম নেই । কোথায় গেলেন ? বিদেশে পাড়ি মারলেন নাকি !
রজতকে দিয়ে মেডিকাল অ্যাসোশিয়েশান থেকে বিনোদিনী পালের চেম্বারের ঠিকানা যোগাড় করে টেলিফোনে বাসন্তী নস্করের নামে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিল রিমা । নির্ধারিত দিনে ও সময়ে শাঁখা-সিঁদুর আর সস্তা প্রিন্টেড শাড়িতে গৃহবধু সেজে , রজতকে ধুতি পাঞ্জাবিতে স্বামী সাজিয়ে হাজির হল ডাকতারের কসবাস্হিত নার্সিং হোমে । বাসন্তী নস্করের পিঠে অসহ্য ব্যথা , স্বামীর মুখ কাঁচু-মাচু, কেননা মোটা ফিস আগেই জমা দিতে হয়েছে । ডাকতার পরীক্ষা করলেন বাসন্তী নস্করকে । বাসন্তী আর ওর স্বামী পরীক্ষা করতে লাগল বিনোদিনী পালের চেম্বারটা । ডাকতার তো প্রেসক্রিপশান লেখার সময়ে আঙুলের ছাপ দিয়ে দিয়েছেন ।
বাসন্তী বলল, ডাকতারবাবু, আপনার চুলের ক্লিপটা আমায় দিন না, আমার অনেক দিনের শখ অমন একটা ক্লিপের , ওকে বলি তো কিনে দেয় না ।
বিনোদিনী পাল অবাক-চোখে তাকালেন বাসন্তী নস্করের মুখের দিকে । বললেন, সত্যই চাই ? এটা তো বেশ পুরানো । আচ্ছা নিন, আমার কাছে অন্যান্য রঙের এই রকম ক্লিপ আছে । হাসিমুখে ক্লিপটা দিয়ে দিলেন বিনোদিনী পাল।
দেয়ালে টাঙানো কুকুরের ফোটো দেখে বাসন্তীর স্বামী জানতে চাইল, ডাকতারবাবু, কুকুরটার মুখ চামড়ার জাল দিয়ে বাঁথা কেন ? আপনার কুকুর ? মাদি কুকুর ? বাচ্চা হলে কি করেন ? কেমন যেন বিটকেল চেহারা কুকুরটার !
ফোটোর দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে ডাকতার বললেন , হ্যাঁ, আমার কুকুর , ভয়ানক হিংস্র এই পিট বুল কুকুররা , তাই বাড়ির বাইরে বেরোলে মুখে মাজল পরিয়ে বেঁধে রাখতে হয় । তবে কুকুরটা মারা গেছে কয়েকবছর আগে ।
বাসন্তী জানতে চাইল, কুকুরের কী নাম রেখেছিলেন গো ডাকতারবাবু ? কী খেতে দিতেন ?
বিনোদিনী পাল বললেন, ওর নাম রাসকেল , মাংস ছাড়া কিচ্ছু খেতো না ।
রাসকেল ? খুব ভালো নাম তো ! প্রেসক্রিপশানের ওষুধ বুঝে নিয়ে বললে বাসন্তী ।
বিনোদিনী পালের চেম্বার থেকে বেরিয়ে নার্সিং হোমের চত্বরে কোনো লাল গাড়ি দেখা গেল না ।
চত্বরের বাইরে বেরিয়ে লাল-কালো সুজুকি হায়াবুসার পিলিয়নে বসে, রিমা রজতকে হুকুম করল ফরেনসিক ল্যাবে যেতে । রুচিষ্মিতা ঘোষকে ক্লিপটা দিয়ে বলল, এই ক্লিপে লেগে-থাকা এক-দু গাছা চুলের সঙ্গে সেই ব্রাউন খামে রাখা চুলগুলোর ডিএনএ মিলিয়ে দেখতে । মিলে গেলে নিশ্চিত হওয়া যাবে যে আসামী পাকড়াও করা গেছে ।
Tagged ডিটেকটিভ উপন্যাস |
১২. প্রতিশোধ
বিনোদিনী পালের প্রেসক্রিপশানে, যে-প্রেসক্রিপশান গরিব গৃহবধু সেজে যোগাড় করেছিল রিমা, বিশ্বদেব পালের বাড়ির ঠিকানা ছিল, যা থেকে প্রমাণ হয় যে ওই বাড়িতেই থাকেন উনি । বাসন্তী নস্করের নামে যে প্রেসক্রিপশান রিমা নিয়েছিল তার সঙ্গে দীপ্যমান গোস্বামীর মেয়ের প্রেসক্রিপশানের সই আর হাতের লেখা মিলিয়ে দেখার জন্য রাজ্য হস্তলিপি বিশারদকে দিয়ে একটা রিপোর্ট নিয়েছে রিমা । উনি ওনার রিপোর্টে বিস্তারিত দেখিয়াছেন যে কী ভাবে দুটির হাতের লেখা আর সই যে একই ব্যক্তির তা প্রমাণ হয় ।
প্রেসক্রিপশানে বিনোদিনী পালের আঙুলের ছাপের সঙ্গে মিলিয়ে নিয়েছে বাংলোবাড়িতে পাওয়া আঙুলের ছাপগুলো ।
রুচিষ্মিতা ঘোষ ওনার ফরেনসিক রিপোর্টে জানিয়েছেন যে ক্লিপের চুল ও ব্রাউন খামে রাখা চুলের ডিএনএতে বংশগত মিল আছে ।
বাঙলোবাড়ির বাগানে রাতের বেলায় একজন পেস্টিসাইড স্প্রে করতে এসেছিল তা জানা গেছে । রুচিষ্মিতা ঘোষ পিঁপড়ে মারার যে কেমিকাল উল্লেখ করেছেন, সেই কেমিকালের স্প্রে করানো হচ্ছিল। পেস্টিসাইড কোম্পানির সঙ্গে বিনোদিনী পালের কন্ট্র্যাক্টের কপি পাওয়া গেছে ।
বিনোদিনী পাল একটা পিট বুল কুকুর কিনেছিলেন , তার কাগজপত্রের কপি যোগাড় করা হয়েছে।
ফরেনসিক অ্যানথ্রোপলজিস্ট রিপোর্ট দিয়েছেন যে কংকালের দেহের দাগগুলো কুকুরের কামড়ের । কুকুরের কংকালের দাঁতে নিরঞ্জন দত্তের ডিএনএ পাওয়া গেছে ।
প্রাথমিক তথ্যগুলো ডিজির সামনে উপস্হিত করে রিমা অনুরোধ করল যাতে বিশ্বদেব পালের বাড়িতে পুলিসের একটা টিম পাঠিয়ে হত্যা সংক্রান্ত প্রমাণগুলো সংগ্রহ করা যায় ।
সিজার ওয়ারেন্ট নিয়ে থানার বর্তমান ওসি বিশ্বম্ভর শূর আর তাঁর সঙ্গী চারজন কন্সটেবল আর রজতকে সঙ্গে নিয়ে ঢুঁ মারল রিমা । বিশ্বদেব পাল দরোজা খুলে বন্ধ করে দেবার আগেই বিশ্বম্ভর ওয়ারেন্টের কপিটা দিয়ে একপ্রকার জোর করেই ঢুকে পড়ল। বিশ্বম্ভর বিশ্বদেবকে বলল, আসুন বিশ্বদেববাবু, আপনার মেয়ের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ আছে , আমরা যাবতীয় তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করে ফেলেছি।
বিশ্বদেব পাল কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, হ্যাঁ, আমার মেয়ে যে এইরকম কিছু একটা করার জন্যে তৈরি হচ্ছে তা আমি আঁচ করেছিলাম।
রিমা জিগ্যেস করল, তাহলে মায়া পালই আপনার স্ত্রী এবং বিনোদিনী দেবী আপনার আর মায়া পালের মেয়ে ?
হ্যাঁ, স্তিমিতকন্ঠে বললেন বিশ্বদেব।
Tagged ডিটেকটিভ উপন্যাস |
১৩. বিনোদিনী পাল
বিনোদিনীকে লিখে জানানো হয়েছে যে প্রেমিক কংকালের অতীত সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য সংগ্রহ করে গেছে, এবং তিনি সকাল এগারটায় পুলিসের সদর দপ্তরে এলে তাঁকে সেই সমস্ত তথ্য জানানো হবে। রিমা টেলিফোনে অবশ্য জানিয়ে দিয়েছিল যে বিনোদিনী যদি সময়মত না আসেন তাহলে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হতে পারে । পুলিসের কয়েকজন উচ্চপদস্হ আধিকারিক তাঁর সঙ্গে কথা বলতে চান। সেই মত পুলিসের দপ্তরে ঠিক সময়েই পোঁছে গিয়েছিলেন বিনোদিনী পাল, এম ডি। কিন্তু তথ্যসমূহ তাঁকে দেখাবার পরিবর্তে সমবেত পুলিস অফিসারদের কাছে, বিনোদিনীর উপস্হিতিতে রিমা খান শুরুতেই অভিযোগ করেন যে প্রেমিক কংকালের রহস্যের ব্যাপারে বিনোদিনী যথেষ্ট অবগত , এবং রিমার কাছে যে-সমস্ত প্রমাণ রয়েছে, তা থেকে প্রতীয়মান হয় যে প্রেমিক কংকালের হত্যায় তাঁর হাত আছে।
পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের উচ্চপদস্হ আধিকারিকরা ছাড়াও সেখানে উপস্হিত ছিলেন অন্ধ্র আর কর্ণাটকের পুলিস ডিজিপি, ফরেনসিক অ্যানথ্রপলজিস্ট মনসুর হামিদ, ফরেনসিক অ্যস্টৌলজিস্ট শ্রী উপাধ্যায়, ফরেনসিক অ্যানালিস্ট রুচিষ্মিতা ঘোষ, ডক্টর ওহদেদার, ডক্টর কাকলি সোম, ডক্টর অনিল পাসেলকর প্রমুখ।
বিনোদিনী হঠাৎ উঠে দাঁড়ান, আর মিথ্যা কথা বলে তাঁকে ডেকে আনার জন্য রিমার উর্দির কলার চেপে ধরেন, ইংরেজিতে অশোভন উক্তি করতে থাকেন রিমার উদ্দেশ্যে । প্রেসিডেন্সি রেঞ্জের আই জি তাঁকে শান্ত হতে বলেন, বিনোদিনী চেয়ারে বসলে এক গ্লাস জল এগিয়ে দেন । এডিজি উপস্হিত দুজন কন্সটেবলকে বলেন দরজা বন্ধ করে দিয়ে বাইরে গিয়ে দাঁড়াতে ।
এসএসপি ওনার পেশাদার পুলিসি কন্ঠস্বরে বিনোদিনীর দিকে তাকিয়ে বলেন, আমাদের কাছে আপনার বিরুদ্ধে যে প্রমাণ রয়েছে তার ওপর নির্ভর করে আমরা আপনাকে এখনই গ্রেপ্তার করতে পারি, কিন্তু পুলিস চায় না যে আপনার সুনাম ক্ষুন্ন হোক । এই কেসে আপনার ভূমিকা যদি খোলসা করেন তাহলে আপনারই মঙ্গল।
ঘরে প্রায় দশ মিনিটের স্তব্ধতা । রিমা এবং তার উর্ধতন অফিসাররা জানেন যে অপরাধীকে সামলে নেবার জন্য সময় দেয়া উচিত। অপরাধী কী বলে, না-বলে, তা তাকে বুঝে ওঠার জন্য জরুরি । দশ মিনিট পর অর্ধেক গ্লাস জল খেয়ে ডক্টর বিনোদিনী পাল, এম ডি ধীর-স্হির অথচ চাপা গলায় বলা আরম্ভ করলেন, যেন নিজেকেই শোনাচ্ছেন তিনি ।
মিস্টার পালের ভাইরাল ফিভার হয়েছিল বলে আমাকে কল দিয়েছিলেন । ভাইরাল ফিভারের ট্রিটমেন্টের জন্য উনি আমাকে বলেছিলেন প্রতিদিন সকালে এক বার ভিজিট দিতে । উনি সেরে উঠছিলেন, কিন্তু বার্ধক্যেও উনি নারীসঙ্গ চাইছিলেন । নারীসঙ্গ বলতে আমি যৌনতার কথা বলছিনা । উনি নৈকট্য চাইছিলেন। যৌনকর্মের উপযোগী ছিলও না ওনার কাহিল শরীর । তবে উনি ধারণা করে থাকবেন যে আমি ওনার শেষ প্রেমিকা , তাই আমাকে শিষনি বলে ডাকতেন । আমার সঙ্গে উনি ওনার অতীত জীবনের গল্প করতেন । আমার পদবি পাল দেখে উনি প্রথমবার আমার চেম্বারে এসেছিলেন প্রস্টেটের সমস্যা নিয়ে । আমি জেনারাল ফিজিশিয়ান , সবরকম রোগিকে দেখি এবং প্রয়োজন হলে স্পেশালিস্টের কাছে রেফার করি । প্রস্টেটের প্রাথমিক স্তর ছিল, একটা কোর্সেই ওনার উপশম হয় ; সেরে যায় বা বৃদ্ধি থেমে যায় বলা ভাল, যদিও রেগুলার ওষুধও প্রেসক্রাইব করেছিলাম , যাতে আবার না সমস্যা দেখা দেয়। সরকারি দপতরের নোংরাটে চিলতে-ওঠা মেঝের দিকে তাকিয়ে কথা বলছিলেন বিনোদিনী । ক্রমশ আবেগ তাঁকে ঘিরে ধরছিল, যা তিনি ডান পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে ঘষে-ঘষে সামলাচ্ছিলেন । রিমা দেখছিল বিনোদিনীর ডান পায়ের বুড়ো আঙুল চটির বাইরে বেরিয়ে রয়েছে , অথচ বাঁ পায়েরটা তত বড় নয়, স্বাভাবিক মাপের ।
আমার হাতে সময় থাকত না । উনি মানসিকভাবে কিছুটা ভারসাম্যহীনও ছিলেন । আমি তাই ওনাকে বলেছিলাম নিজের জীবন সম্পর্কে যা মনে আসে তা একটু-একটু করে প্রতিদিন লিখে রাখতে । ওনার জীবনে বেশিরভাগ ঘটনাই বোধহয় লজ্জাজনক । উনি লেখা আরম্ভ করলেন তেলেগু ভাষায় । তেলেগু ভাষায় কেন লিখছেন জানতে চাইলে উনি জানান যে সেখানকার এক গ্রামে তাঁর জীবনে এমন একটি ঘটনা ঘটেছিল যা তাঁর জীবনের উদ্দেশ্য পরিবর্তন করে দিয়েছিল । সেখানে তিনি এক অবিশ্বাস্য আর অলৌকিক জগতে বাস করছিলেন । এক দিন কথা বলতে-বলতে উনি ক্যারিড অ্যাওয়ে হয়ে মায়া পাল নামে একজন মহিলার নাম বলেন।
মায়া পাল আমার মায়েরও নাম । আমি আগ্রহান্বিত হই । ওনার বর্ণিত কাহিনি থেকে জানতে পারি , উনি যে মায়া পালের কথা বলছেন , তিনি আমারই মা। আমি স্তম্ভিত হয়ে যাই । উনি আমার মাকে ফুসলিয়ে নিয়ে চলে গিয়েছিলেন , অন্ধ্রপ্রদেশের জঙ্গলের ভিতরকার উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলে ; তারপর সেখানে আমার মাকে উনি খুন করে লোপাট করে দিয়েছিলেন। আমি ওনাকে জানতে দিইনি যে উনি যাঁর কাহিনি বলছেন , তিনি আমার মা। আমার তখন মাত্র এক বছর বয়স।, যে সময়ে উনি আমার মাকে নিয়ে ইলোপ করেছিলেন । ওনার কাহিনি আমি পুরোটা শুনতে চাইনি । ঘৃণা হয়েছিল আমার । কিন্তু ওনার ভাইরাল ফিভার আবার রিল্যাপ্স করে । তা থেকে ওনার এডিইএম , মানে অ্যাকিউট ডিসএমিনেটেড এনসেফ্যালোমায়েলাইটিস দেখা দেয় । এই রোগ বিরল। আমার মতে ওনার পাপের উচিত শাস্তি । এই রোগে মস্তিষ্কে আর স্পাইনাল কর্ডে ইনফ্লামেশান হয় । অর্থাৎ ওই দুটি অংশে মায়েলিন—নার্ভ ফাইবারের বাইরে রক্ষাকারী আস্তরণ — নষ্ট হতে থাকে । যেকোনো ভাইরাল ফিভার এডিইএম ট্রগার করতে পারে। কেন করে তার কোনো নির্দিষ্ট কারণ নেই । রোগি সকলপ্রকার সেনসেশান হারিয়ে ফেলতে থাকেন : অসহ্য ব্যথা এবং ক্র্যাম্প আরম্ভ হয় ;প্রস্রাব বন্ধ হয়ে যায় । ক্রমশ কোমরের তলাকার অংশে প্যারালিসিস দেখা দেয়। কয়েক দিনের ভেতর রোগি কোমায় চলে যায়।
—রোগিকে কি কোনো ভাল হাসপাতালে ভর্তি করা উচিত ছিল না ডক্টর বিনোদিনী পাল ? জিগ্যেস করলেন আইজি, অর্থাৎ রাঘবেন্দ্র সিংহ , যাঁর অধস্তন ইন্সপেক্টর বারিদবরণ মণ্ডল সর্বপ্রথম এই কেসের তদন্তে নেমেছিল আর হাল ছেড়ে কেস বন্ধ করে দেবার প্রস্তাব করেছিল।
—ছিল । কিন্তু সে কাজ তো আমার নয় । আমি কেন নিজের টাকাকড়ি খরচ করে অমন সমাজ-সেবা করব ! তাহলে তো প্রতিটি রোগির দায়িত্ব আমাকে নিতে হয়। আমি প্রতিদিন প্রচুর রোগি দেখি । সবায়ের জন্য আমি দাতব্য খুলিনি । প্রায় দাঁত চেপে সংলাপ উচ্চারণ করলেন বিনোদিনী।
রিমা খান জিগ্যেস করল, ডক্টর পাল, আমার দুটি প্রশ্ন আছে এই সূত্রে । প্রথম এই যে, যেহেতু এই ফিভার ভাইরাস থেকে হয়, ভাইরাসটি কি কোনোক্রমে অন্যের দেহে চালান করা যায় ? দ্বিতীয় প্রশ্ন হল, ওনাকে তখন হাসপাতালে নিয়ে গেলে কি উনি সেরে যেতেন ? রিমার প্রশ্নে ডিজি পবিত্র মুখোপাধ্যায় প্রীত হলেন, ওনার মৃদু মাথা নাড়া দেখে রিমাও বেশ লুকোনো গর্ব বোধ করল।
—যেতেন হয়ত, কিন্তু সে-কাজ আমার নয়, আগেই বলেছি। অত্যন্ত ক্রুদ্ধ কন্ঠে বললেন বিনোদিনী পাল। রিমার প্রথম প্রশ্নটা চেপে গেলেন ডাকতার মহাশয়া।
—উনি কোমায় আক্রান্ত হয়ে পড়ে রইলেন, আর আপনি সদর দরজার গোদরেজ ল্যাচ টেনে বন্ধ করে দিলেন ! তারপর গেটে তালা দিয়ে বেরিয়ে গেলেন । ততোধিক রাগতস্বরে বললেন, এসপি নারায়ণ ঘোষ । রিমার চোখেমুখেও ক্রোধ । ওর ক্রোধ এই জন্যে যে এই কেসের কেন্দ্রিয় চরিত্র একজন মহিলা , এমন ঞইলা যিনি বাড়ির বাইরে কাজ করেন, গৃহবধু নন, ডাকতারি পেশায় যাঁর পুরুষ ডাকতারদের চেয়ে তুলনামূলকভাবে বেশি নামডাক। প্রথম প্রশ্নের উত্তর না দেয়ায় রিমা আঁচ করল যে বিনোদিনী পাল ভাইরাসটি প্রেমিক কংকালের দেহে ঢুকিয়ে থাকবেন। অন্য কেউ এই ভাইরাসের কারণে এডিইএম রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকবে ; কিংবা রোগের বীজ কোথাও সংরক্ষিত ছিল বা আছে।
—বলুন, চুপ করে রইলেন কেন ? জানতে চাইলেন রাঘবেন্দ্র সিংহ, আইজি, যিনি রিমার কাজের দরুণ এই মুহূর্তে কিঞ্চিদধিক চাকুরিজীবি-সুলভ ঠ্যাংদুলুনি-গোমর বোধ করছেন। পুরুষ পিটিয়ে রিমা ওনাকেও দুর্নামের ভাগিদার করেছে। ইংরেজি মিডিয়া তো রিমাকে ভারতের ‘ডার্টি ফেয়ারি’ নাম দিয়েছিল এক সময় ; দেখাদেখি বাংলা মিডিয়া, বিশেষ করে ইলেকট্রনিক মিডিয়া ওর নাম দিয়েছে ‘নোংরা পরি’ । রিমা সম্পর্কে জব্বর একখানা প্রোগ্রামও করেছিল সর্বাধিক প্রচারিত চ্যানেল , বিদেশি চ্যানেলগুলো থেকে রোমাঞ্চকর দৃশ্য চুরি করে ঢুকিয়ে।
রিমা বলল, ডক্টর পাল, প্রেমিক কংকাল আপনার মাকে নিয়ে পালাননি । আপনার মা-ই ওনাকে প্রোপোজাল দেন ইলোপ করার জন্য। আমি নিজে গিয়েছিলাম কর্ণাটকের সীমান্তে অন্ধ্রপ্রদেশের ব্যারেটাইস মাইনস থানায় , যেখানের লক আপে মায়া পালের আত্মহত্যার পর প্রেমিক কংকালকে হেফাজতে নিয়ে রাখা হয়েছিল। কেননা ওই থানার অফিসার ইনচার্জেরো সন্দেহ ছিল যে আপনার মাকে প্রেমিক কংকাল খুন করে কাঁঠাল গাছে টাঙিয়ে দিয়েছিলেন। সেখানকার নথিপত্র দেখে যে তথ্য আমি এনেছি, তা হল যে প্রেমিক কংকাল আর আপনার মা সেখানে সুখি সাংসারিক জীবন কাটাচ্ছিলেন, সাংসারিক মানে ওই অঞ্চলের উপজাতি পরিবার যেভাবে জীবন কাটায়। আপনার মা, যাঁকে অগ্রমগাগি আউটার এরিয়ার তুরপু উপজাতির মানুষ সাক্ষাৎ ঈশ্বরী মনে করতেন, সেখানকার গ্রামবাসীদের সাক্ষ্য এবং থানার নথি অনুযায়ী, গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন মায়া পাল।
আরও ক্রুদ্ধ, ডাকতার পাল ফুঁসে উঠলেন, বিশ্বাস করি না আপনাদের বানানো গল্প। আপনাদের যদি আমাকে ক্রিমিনাল বলে মনে হয় তাহলে আমায় গ্রেপ্তার করুন আর ফৌজদারি মামলা করুন খুনের । আমার কিছু এসে যায় না । আমি শেষ পর্যন্ত আমার মাকে খুঁজে পেয়েছিলাম, আর আমার মায়ের হত্যাকারীকেও। আমার জীবনের প্রধান লক্ষ ছিল যে আমি আমার মাকে একদিন খুঁজে বের করবই , মায়ের অপমানের প্রতিশোধ নেবোই। আর দয়া করে ওই স্কাউন্ড্রেলটাকে বার-বার প্রেমিক-প্রেমিক বলে উল্লেখ করবেন না । লোকটা মোটেই প্রেমিক ছিল না । জানেন, আমি ওনার কাছে জানতে চেয়েছিলাম যে মায়া পালের সঙ্গে কত বছর তিনি সেই গ্রামে কাটিয়েছিলেন । উনি যা উত্তর দিয়েছিলেন তা মুখে আনতেও আমার লজ্জা করছে।
সবাই নিশ্চুপ। কিছুক্ষণ পর বিনোদিনী বললেন, উনি বলেছিলেন, সেখানে কোনো বাড়িতে ঘড়ি বা ক্যালেন্ডার ছিল না, সম্পূর্ণ অশিক্ষিত দলিতদের বসতি । উনি মাসের হিসাব রাখতেন একটি কাঁঠাল গাছে ছুরি দিয়ে দাগ কেটে । আমার মায়ের প্রতিটি পিরিয়ড বা মেন্স উনি গাছে মার্ক করে রাখতেন । উনি আমার মাকে নিয়ে ওই অঞ্চলে ছিলেন, ওনার মার্কিং অনুযায়ী, সাড়ে তিন বছর।
—কিন্তু আপনি আপনার প্রফেশানাল এথিক্স ভুলে গিয়েছিলেন । ক্রোধে অন্ধ হয়ে মৃত্যুর পথে যেতে দিয়েছিলেন একজন রোগিকে, বললেন ডিজি। তাঁর ভাবপ্রখাশে কোনো তারতম্য নেই। তোরপর যোগ করলেন, প্রেম বা আপনার কোনো প্রেমিক সম্পর্কে তো আমরা জানতে চাইছি না ; কংকালটিকে আইডেনটিফাই করার জন্য ইনভেস্টিগেটিং অফিসার রিমা খান একটা নম-ডি-প্লুম দিয়েছেন। মানুষটি এবং কংকালটির মধ্যে একটা আইনগত পার্থক্য আছে।
ডক্টর বিনোদিনী পালের ক্ষোভে দুঃখে কান্নায় কন্ঠরুদ্ধ। শ্লেষ্মামাখা স্বরে বললেন, বললাম তো, গ্রেপতার করুন আমাকে । আমি আমার মায়ের আত্মার শান্তির জন্য যা করণীয় তা-ই করেছি।
ডিজি বললেন, আমরা ইনডিয়ান মেডিকাল অ্যাসোশিয়েশানকে যাবতীয় তথ্য পাঠিয়ে দেবো , আপনার রেজিস্ট্রেশান রদ করার জন্য সুপারিশ করব । যা করার তারাই করবে।
রিমা বলল, স্যার, মাঝখানে কথা বলার জন্য ক্ষমা চাইছি ; আপনি আমার ফাইনডিংসের প্যারা বত্রিশ আর তেত্রিশ দেখুন স্যার । আরও কয়েকটি জিগ্যাস্য রয়ে গেছে । সে-কটা কি উথ্থাপন করব ?
ডিজি বললেন, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই, কী সেগুলো ? ইনক্রিমিনেটিং কিছু পেয়েছিস ?
নারায়ণ ঘোষ অনুমোদনের সুরে বললেন, হ্যাঁ স্যার, ওটা তো অনেক বেশি জরুরি ; বিনোদিনী দেবীর কী বলার আছে এ-ব্যাপারে তা তো জানি না । পয়েন্ট দুটো দেখেছি। ইন ফ্যাক্ট, রিমা যে পিঁপড়ের প্রসঙ্গ তুলেছে, সেই সূত্রেই কংকালের কথা জানা গিয়েছিল, মানে পুলিস অ্যাডমিনিস্ট্রেশান জেনেছিল।
ডিজি বললেন, স্ট্রেঞ্জ, আগের অফিসাররা এই পয়েন্টটা লেখেননি নিজেদের ইনভেস্টিগেশান রিপোর্টে। বোঝা গেল যে ডিজি একই সঙ্গে বিস্মিত, বিব্রত ও ক্রুদ্ধ । ওকে, রিমা, বল, তোর কী বলার আছে ।
ডক্টর বিনোদিনী পালের দিকে তাকিয়ে রিমা খান বলল, অনেকটা জেরার সুরে, ডক্টর পাল, আপনি জানেন নিশ্চয়ই যে একটি পিকনিক পার্টির ছোট্ট একটি মেয়ে, তখন তার বয়স তিন বছর ছিল, এখন তের বছর, সে তার ভাইয়ের সঙ্গে খেলার সময়ে তাদের বল কুড়োতে প্রেনমিক কংকালের বাংলোর পাঁচিলের ধারে গিয়েছিল। মেয়েটিকে পিঁপড়ের ঝাঁক আক্রমণ করে । তার হাতে আর পায়ে সে-দাগ এখনও আবছাভাবে রয়ে গেছে । ইন ফ্যাক্ট তার পিঁপড়ে-ভীতি সারাতে মনোবিজ্ঞানীর পরামর্শ নিতে হয়েছিল পরিবারটিকে । এলাকার লোকেদের মুখে ঘটনাটি শুনে আপনি চেম্বারে রোগিদের বসিয়ে রেখে থানার ওসির ডাকে বাচ্চাটির জন্য তৎক্ষণাত ওষুধ দেবার অছিলায় ছুটে ছিলেন ঘটনাটি চেপে দেবার জন্য। পরিবারটি আপনার দ্রুত ঘটনাস্হলে পোঁছে চেম্বারে এনে ওষুধপথ্য করার কারণে কৃতজ্ঞ হয়েছিল। মনে পড়ছে কি ?
ডক্টর বিনোদিনী পালের কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না । কেবল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন রিমার দিকে । যেন প্রতিরোধ কমে আসছে তাঁর।
রিমা বলল, স্যার, রিপোর্টের তেত্রিশ নম্বর প্যারায় দেখুন । ডক্টর পাল কিছিদিন প্রেমিক কংকালের বাগানের পরিচর্যা করার ভার নিয়েছিলেন। প্রেমিক কংকালকে কী বুঝিয়েছিলেন, তা আমরা জানি না। তবে প্রেমিক কংকালের মনে সহানুভূতির ভালোরকম কর্নার তৈরি করে ফেলতে সফল হয়েছিলেন। বাগানের তদারকি ডক্টর পাল কোনো মালিকে দিয়ে করাননি ; নিজেই করতেন । তখনই উনি প্ল্যান আঁটেন । বাগানে উনি ডরিলাস ল্যাবিয়াটাস নামের একপ্রকার কারনিভোর পিঁপড়ের আনাগোনা দেখে পিঁপড়ের কলোনিটার কেন্দ্র খুঁজে পান বাঙলোটার বাইরে । ওগুলো আরও কোনো ভয়ানক জাতের মাংসখোর পিঁপড়েও হতে পারে , আমি কয়েকটা স্যাপল মুখ্য সরকারি এনটোমলোজিস্টকে পাঠিয়েছিলাম ; উনি জানিয়েছেন যে ওগুলো ডরিলাস ল্যাবিয়াটাস , ট্রপিকাল কান্ট্রিজে হয় , এদেশেও হয় । ওনার ফাইনাল রিপোর্ট চার্জশিট দাখিল করা পর্যন্ত পেয়ে যাব । পিঁপড়ের কলোনিটা আর নেই। ডক্টর পাল নিয়মিত পেস্টিসাইড প্রয়োগ করে পিঁপড়েদের নিশ্চিহ্ণ করে দিয়েছেন। অর্থাৎ প্রমাণ মুছে ফেলতে চেষ্টা করেছেন । ডক্টর পালের দুর্ভাগ্য যে বাঙলোর বাগানের মধ্যে কয়েকটা পিঁপড়ের অবশেষ মাটির সঙ্গে মিশে থেকে গেছে, সম্পূর্ণ অবলুপ্ত হয়নি, দশ বছর পরেও।
এডিজি অধৈর্য হয়ে বললেন, তা না হয় হল, এত ডিটেইলসে যাচ্ছিস কেন ? টু দি পয়েন্ট আয় না ।
রিমা বলল, উনি চিনির আর মুর্গির মাংসের কিমার সাহায্যে পিঁপড়েদের কলোনিটাকে বাঙলোর বাগানের ভেতর পর্যন্ত নিয়ে আসেন। প্রেমিক কংকাল তখন ভাইরাল ফিভারে । পিঁপড়েগুলোকে বিনোদিনী দেবী বাঙলোবাড়িটার আরও ভেতরে প্রবেশের জন্য ব্যবস্হা করেন । ড্রইং রুমের ভেতর পর্যন্ত নিয়ে যান এবং তার পর প্রেমিক কংকালের ঘরে তাদের চালিত করেন। প্রেমিক কংকালকে পিঁপড়ে দিয়ে মারা ওনার উদ্দেশ্য ছিল না , তা সম্ভবও ছিল না , এবং সম্ভব হলেও তা ছিল সময়-সাপেক্ষ। উনি বাজার থেকে মুর্গির ছাঁট মাংসের কিমা করিয়ে প্রেমিক কংকালের ঘরে রাখা আরম্ভ করেন । প্রেমিক কংকাল তখন বিনোদিনী দেবীর ওপর প্রতিটি কাজের জন্য নির্ভর করছেন ; বিছানায় শয্যাশায়ী প্রেমিক কংকালের এ ছাড়া উপায়ও ছিল না । আমার মনে হয় তাঁর মনে হচ্ছিল ডক্টর পাল তাঁর শেষ বয়সের নারী, একজন মহিয়সী সেবিকা । আমার রিডিং অনুযায়ী প্রেমিক কংকালকে একজন নারীসঙ্গ-কাঙাল বলা যায়। উনি লোকজন চাকর-বাকর পছন্দ করতেন না । ডক্টর পালের সুবিধাই হল । পিঁপড়েগুলো মুর্গির ছাঁট মাংসে অভ্যস্ত হলে ডক্টর পাল প্রেমিক কংকালের ভাইরাল ফিভার রিল্যাপ্স করাবার ব্যবস্হা করেন । স্বাভাবিক যে প্রেমিক কংকালের খাবারও উনি নিয়ন্ত্রণ করতেন । প্রেমিক কংকাল যাতে বিছানা থেকে ওঠার সব ক্ষমতা হারিয়ে ফ্যালে সেদিকে ওনার নজর ছিল।
ডক্টর বিনোদিনী পাল মেঝের দিকে তাকিয়ে চুপম করে থাকলেও বোঝা যাচ্ছিল যে তিনি ক্রোধ চেপে রাখতে পারছেন না।
ডক্টর ওহদেদার, যিনি সন্মতিসূচক মাথা নাড়ছিলেন, বললেন, আই অ্যাগ্রি, ইট ইজ পসিবল ।
বত্রিশ নম্বর প্যারায় দেখুন স্যার, রিমা বলল সমবেত উর্ধতন অফিসারদের , সেখানে ডক্টর পালের একটি পোষা কুকুরের রেফারেন্স আছে । একজন মহিলা কী করে নিজের বাড়ির পোষা কুকুরের সঙ্গে এভাবে ব্যবহার করতে পারেন, তা আমরা কল্পনাও করতে পারি না । ওনার কুকুরকে উনি আদর করে রাসকেল বলে ডাকতেন। ঠিক না ? ডক্টর পাল ? আপনার চেম্বারে রাসকেলের ফোটো টাঙিয়ে রেখেছেন ।
বিনোদিনী পাল অবাক চোখে মাথা তুলে তাকালেন , রিমার মুখের দিকে।
রিমা বলল, মনে পড়ে কি গরিব, শাঁখা-সিঁদুর পরা, সস্তা প্রিন্টেড শাড়িতে এক যুবতী তার স্বামীকে নিয়ে আপনার কাছে গিয়েছিল, অসহ্য পিঠ ব্যথার যন্ত্রণা নিয়ে ? ভালো করে দেখুন , আমিই সেই ঘোমটা-দেয়া বউ, আর আমার স্বামী সেজে গিয়েছিল আমার সাবইন্সপেক্টর রজন মণ্ডল ।
উর্ধতন অফিসারদের দিকে মুখ ঘুরিয়ে রিমা বলল, সাধারণ কুকুর নয় স্যার, পিট বুল, পিওর ফেরোশাস ব্রিড , ওই ব্রিডের একজন ব্রিডারই আছেন এই শহরে । ডক্টর পাল কর্তৃক তাঁর কাছ থেকে শাদা-কালো পিট বুল কুকুর বাচ্চা কেনার রেকর্ডের কপি আর রেজিস্ট্রেশান নম্বর আমার রিপোর্টের সাতান্ন নম্বর প্যারায় আছে ।
এসএসপি ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন তুললেন, কুকুর ? বেশ ইনটারেসটিং ! কুকুর তো মানুষের বেস্ট ফ্রেন্ড । আমার কুকুরটার শরীর খারাপ হলে আমার ছেলেরও মন ভিষণ খারাপ হয় । ইন ফ্যাক্ট আমরা তো লাভলিকে কখনও বলি না যে সে কুকুর । লাভলির কিছু হলে বাড়িসুদ্ধ সবাই চিন্তিত হই। হোয়াট ডিড শি ডু উইথ দি ডগ ? পিঁপড়ে আর কুকুর ? বল বল, সরি টু ইনটারাপ্ট ।
রিমা বলল, উনি ওনার পিট বুল কুকুরকে প্রথমে অর্ধভূক্ত রাখতে আরম্ভ করেন, তারপর , প্রেমিক কংকাল এডিইএম-এ আক্রান্ত হলে, কুকুরটার খাওয়া আচমকা প্রায় বন্ধ করে দেন। ঠিক বলছি তো ডক্টর পাল ?
বিনোদিনী পালের কোনো প্রতিক্রিয়া চোখে পড়ল না কারোর ।
রিমা ওর বক্তব্য বজায় রাখল , উনি অর্ধভূক্ত মাংসখোর কুকুরটাকে এনে বেঁধে দিলেন কোমায় আক্রান্ত প্রেমিক কংকালের ঘরে । এমন জায়গায় বাঁধলেন যাতে কুকুরটার নাগালের মধ্যে থাকে প্রেমিক কংকাল । রোগিকে পাহারা দেবার জন্য উনি কুকুরটাকে আনেননি সেখানে । তাঁর উদ্দেশ্য ছিল ভয়ানক । নৃশংস বলা যায়। ইতিমধ্যে পিঁপড়েগুলো আক্রমণ করেছিল প্রেমিক কংকালকে , কেননা প্রেমিক কংকালের দেহে ওষুধ মাখাবার নাম করে ডক্টর পাল মিষ্ট রসের আর মুর্গির ছাঁট মাংসের প্রলেপ দেয়া আরম্ভ করেছিলেন। পিঁপড়েরা প্রেমিক কংকালের দেহে ক্ষত তৈরি করে দিচ্ছিল । ক্ষুধার্ত কুকুরটার পক্ষে, জোয়ান পিট বুল কুকুর, টাটকা তাজা মাংসের লোভ সংবরণ করা অসম্ভব ছিল। প্রেমিক কংকাল তো কোমায় ; ছটফট করার ক্ষমতাও তার নেই । কুকুরের আর পিঁপড়ের খাদ্য হতে থাকলেন কংকাল প্রেমিক । তা , বোধহয়, পৈশাচিক আনন্দে উপভোগ করতেন ডক্টর পাল । আমার সন্দেহ, প্রেমিক কংকালের দেহে এমন কিছু মাখানো হচ্ছিল, যে কুকুরটাও ক্রমশ অসুস্হ হয়ে পড়ে । বহুকাল যাবত একই অবস্হায় ধুলোর আস্তরণে প্রেমিকের কংকাল এমন অবস্হায় ছিল যে টক্সিকোলজিস্ট উপরিতলের বায়োকেমিকাল অ্যানালিসিসে কিছু খুঁজে পান নি । দ্বিতীয় ইনভেস্টিগেটিং অফিসার রমেন বসু কুকুরের দেহাবশেষের একটা রিপোর্ট নিয়েছিলেন বিশেষজ্ঞ ভেটেরেনারিয়ান ডক্টর কাকলি সোমের , যিনি কুকুরটার নেক্রপসি করেন ; উনি কুকুরের কংকাল আর তার ছালের অবশিষ্টাংশ আমাদের মালখানায় প্রিজার্ভ করার ব্যবস্হাও করেছিলেন। এই যে ইনিই কাকলি সোম, উপস্হিত একজন বৃদ্ধার দিকে নির্দেশ করল রিমা । তারপর বলল, বসু সায়েব রিটায়ার করেছেন তিন বছর আগে । আমি ওনাকে কনসাল্ট করেছিলাম। উনিও আমার ফাইন্ডিংসকে সমর্থন করেছেন । ওনার কাছ থেকে একটা লেটার রিপোর্টের সঙ্গে এনক্লোজার হিসাবে দিয়েছি স্যার । ভেটেরিনারিয়ানের নেক্রপসি রিপোর্টও এনক্লোজার হিসাবে দিয়েছি।
ডক্টর বিনোদিনী পাল বসে আছেন ; মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই কী চলছে ওনার মনে ।
এ তো একেবারে রোমহর্ষক ঘটনা বলতে যা বোঝায়, তা-ই , বললেন ডিজি । ডিটেকটিভ নিশীথ রায় কিংবা হৃজু বোসকে বলব তেড়ে একখানা গপপো লিখতে , কোনো পুজো সংখ্যায় । পুলিসের চাকরিতে একটা বিশেষ জ্ঞান হয়েছে আমার । তা হল এই যে ঠান্ডা মাথার খুনিরা সুপার ইনটেলিজেন্ট হয় । ওই ইনটেলিজেন্স সমাজে প্রয়োগ করলে বরং সমাজের উন্নতি হতো। এনি ওয়ে, বল, তারপর ?
এবার রিমা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, বলল, হ্যাঁ স্যার, আধখাওয়া প্রেমিক কংকালকে খেল কুকুর , আর পরে সেই মুমূর্ষু কুকুরকে খেল মাংসাশী পিঁপড়েরা, যেগুলো ইতিমধ্যে প্রেমিক কংকালের মাংসের স্বাদে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল। পিঁপড়েদের কলোনিটা নিশ্চিহ্ণ না হলে হয়তো মাংসের ট্রেস পাওয়া যেত তাদের ভাঁড়ার-টানেলে।
ম্যাডাম ইনভেসটিগেটর, রিমাকে উদ্দেশ্য করতে বিনোদিনী দেবী বললেন, আপনার কাছে কোনো প্রমাণ আছে কি যে কুকুরটা আমার ? কী-ই বা প্রমাণ আছে যে পিঁপড়ের কলোনি বিস্তার আমিই ঘটিয়েছিলাম। অযথা গাঁজাখুরি গল্প ফাঁদছেন স্রেফ একটা লম্পটকে মহান প্রমাণ করার খাতিরে। হয়তো প্রোমোশান পাবার চেষ্টা করছেন কাল্পনিক ঘটনা জুড়ে জুড়ে ; ক্রিমিনাল না পেয়ে আমাকে ভুল বুঝিয়ে ডেকে এনে আমাকেই দোষারোপ করে ফাঁসাতে চেষ্টা করছেন।
জবাবে রিমা ফাইলের পাতা উল্টে , বিনোদিনীর সামনে মেলে ধরে বলল, আছে, এই যে, আপনি পিট বুলের বাচ্চা কিনেছিলেন , রেজিস্ট্রেশান করিয়েছিলেন, তার রেকর্ডের সার্টিফায়েড কপি । কলকাতায় তো সচরাচর বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারে পিট বুল কুকুর পুষতে দেখা যায় না। আপনি হয়তো মনের মধ্যে কোনো এক পুরুষকে পিট বুল দিয়ে আক্রমণ করাবার পরিকল্পনা গড়ে উঠেছিল, যে পুরুষটি আপনার জীবন থেকে আপনার মাকে সরিয়ে নেবার জন্য দায়ি । তাই কি ডক্টর পাল ?
ডিজি বিনোদিনী পালকে প্রশ্ন করলেন, ডক্টর, আপনার মা চলে যাবার পর, আপনি কার কাছে মানুষ ? আই মিন কে আপনার প্রতিপালন করলেন । স্কুল কলেজে পড়ানো, ডাকতারি পড়ানো, এম ডি হবার জন্য পড়ানো , এগুলো তো কেউ আপনার মায়ের বিদায়ের পর দায়িত্ব নিয়ে করে থাকবেন ?
বার বার বলবেন না যে আমার মা স্বেচ্ছায় চলে গিয়েছিলেন । ওই স্কাউন্ড্রেলটা ওনাকে কিডন্যাপ করে বন্দি করে রেখেছিল অন্ধ্রপ্রদেশের জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে । যে শাস্তি পাওয়া দরকার তা পেয়েছে ক্রিমিনালটা । অপরাধ তো ওই লোকটার , আমার নয় । আমার বিরুদ্ধে আপনাদের কাছে কোনো প্রমাণ নেই । আমাকে মানুষ করেছেন আমার বাবা আর ঠাকুমা-ঠাকুর্দা ।
রিমা খান ঘরের বাইরে গিয়ে একটি কিশোরী আর তার সঙ্গী মহিলাকে নিয়ে পুনঃপ্রবেশ করে বলল, ডক্টর পাল, দেখুন তো এনাদের চেনেন কিনা ? এই কিশোরীকেই জঘন্যভাবে পিঁপড়ের ঝাঁক কামড়ে ছিল । মনে আছে ?
কিশোরীর সঙ্গী মহিলা বললেন, ইনি তো সেই ডাকতার । ওনার সেবায় তখন ঘুণাক্ষরেও ওনার উদ্দেশ্য টের পাইনি। ছি ছি, মানুষ এরকম হয় । একটা বুড়ো অথর্ব লোক, কোথায় তার সেবা-শুশ্রুষা করবে, তা নয় ডাকতার হয়ে তাকে খুন করার পরিকল্পনা করলেন ! ছি-ছি । আমার তো ভাবতেও ঘেন্না করছে।
বিনোদিনী উঠে দাঁড়ালেন । তখন থেকে যা নয় তাই বলে যাচ্ছেন আপনারা । আমি এই মহিলাকে চিনি না , কোথা থেকে কাউকে ধরে এনে অবিরাম মনগড়া অভিযোগ আরোপ করে যাচ্ছেন।
কিশোরীর সঙ্গী মহিলা বললেন, ডাকতার পাল, অমন অপমানজনক কথা বলবেন না , আমরা পয়সাঅলা নই বটে কিন্তু আত্মসন্মান আছে । এই যে ফাইল, আমার মেয়ের মেডিকাল ফাইল , ওর প্রথম প্রেসক্রিপশানটাই আপনার ।
ফাইলটা নিয়ে রিমা প্রেসক্রিপশানটা দেখাল ডিজিকে । মাথা নাড়লেন ডিজি। মহিলাকে বললেন, যদিও তাঁর লক্ষ্য ছিল বিনোদিনী পাল, আমরা ডক্টর পালের বিরুদ্ধে মেডিকাল নেগলিজেন্স আর মার্ডারের কেস করছি , আপনাকে তাতে সাক্ষ্য দিতে হতে পারে । মহিলা মাথা নাড়লেন , বললেন, হ্যাঁ, দেবো, ওই পিঁপড়ের আতঙ্ক আমার মেয়েকে এখনও ভোগায় । পোকামাকড় দেখলেই ওর ভয়তরাসে শরীর খারাপের অবস্হা হয়।
রিমা বিনোদিনীর মুখের কাছে মুখ নামিয়ে বলল, বিনোদিনী দেবী, আপনি কংকাল প্রেমিকের বাড়ি থেকে তাঁর মোবাইল, কমপিউটার, য়ভক্তিগত টেলিফোনের খাতা, একটি চামড়ার ব্যাগ, নিবেশের কাগজপত্র এবং আরও অনেক কিছু সরিয়েছিলেন। সেগুলো আপনার বাড়িতে আছে কিনা জানার জন্য আপনার বাবার বাড়িতে একটি পুলিস টিম ঠিক এক্ষুনি রেইড করায় ব্যস্ত । যদিও আমরা আপনার বিরুদ্ধে যাবতীয় প্রমাণ সংগ্রহ করেছি । তবু, কংকাল প্রেমিকের যে-কোনো একজন আত্মীয়কে পাওয়া গেলে ওনার উত্তরাধিকারীর হাতে তাঁর কংকালটি এবং স্হাবর-অস্হাবর সম্পত্তি তুলে দেয়া যাবে ।
বিনোদিনী পাল রাগতস্বরে বললেন, আমি ওসব নিবেশের বা অন্যান্য কাগজপত্র সরাইনি, ওধরণের কিছু ছিল না , ওনার ব্যাঙ্ক লকারে হবে। ভবানীপুরের স্টেট ব্যাঙ্কে ওনার লকার আছে একবার বলেছিলেন।
ভবানীপুর ? রিমা নিজেকেই বলে উঠল। আরে, ওখানেই তাহলে মিলি নামের মেয়েটিকে, এখন সে হয়ত যৌবনের পরের বয়সে, পেয়ে যাব তাকে ।
হ্যাঁ, নিরঞ্জনবাবু বলেছিলেন একবার যে মিলি নামের কেউ একজন পদ্মপুকুরের পাশে থাকত, তাঁর স্কুলের বন্ধু, বললেন বিনোদিনী ।
রিমা বলল, যাক, মিলিকে তাহলে পেয়ে যাব , ওনাকে দরকার । এই কেসের ব্যাপারে নয়, অন্য কারণে ।
এডিজি বললেন, আমরা আপনাকে গ্রেপ্তার করতে বাধ্য হচ্ছি ডক্টর পাল । রিমার দিকে ফিরে বললেন, নতুন করে একটা এফ আই আর দর্জ করতে । উর্ধতন অফিসাররা একে-একে বেরিয়ে গেলেন । মহিলাও বেরিয়ে গেলেন কিশোরী মেয়ের সঙ্গে । ডিজি ঘর থেকে বেরোতে-বেরোতে পেছন ফিরে রিমাকে বললেন, তোর সাসপেনশান রিভোকেশান আর প্রোমোশান আর নতুন পোস্টিঙের অর্ডার দিন-পনেরো পরে এসে অফিস থেকে কালেক্ট করে নিস ।
ডিজিকে ধন্যবাদ জানিয়ে রিমা একগোছা জেরক্স কাগজ আর কয়েকটা ফোটোগ্রাফ ডক্টর পালের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, বিনোদিনী দেবী, এগুলো কংকাল প্রেমিকের তেলেগু লেখার বাংলা, অগ্রমগাগি আউটার এরিয়ায় আপনার মায়ের নামে আম্মা মন্দিরের ফোটো । আপনার কোনো উকিল থাকলে তাঁকে খবর দিন । ম্যাজিস্ট্রেট আপনাকে কত দিনের জন্য হাজতে পাঠাবেন জানি না ; আমরা রিমান্ড চাইব না । হাজতে বা আদালতে বসে এগুলো পড়লে আপনার মায়ের আর প্রেমিক কংকালের অলৌকিক ভালোবাসার কথা জানতে পারবেন । যদি জামিনে ছাড়া পান তাহলে একবার ওই অঞ্চলটি ঘুরে আসবেন , সেখানের মানুষ আজও আম্মা আর মায়ালিঙ্গার প্রেমের গল্প করে । প্রেম ব্যাপারটা যে কী তা আমি জানি না । আপনিও জানেন না বলেই মনে হয়। কিন্তু এই অদ্ভূত কেস থেকে প্রেম সম্পর্কে আমার একটা মোটামুটি ধারণা হয়েছে , আর তা হল আত্মত্যাগের ।
রিমা বলা বজায় রাখল, আপনার দাদু-ঠাকুমা-বাবা কেবল অজানা এক কিডন্যাপারের কাহিনি শুনিয়ে থাকবেন আপনাকে । আপনার মায়ের সম্পর্কে কোনো কথাই কি তাঁরা আপনার সঙ্গে শেয়ার করেননি ? আপনার মা মায়া পাল আপনার প্রথম জন্মদিনের পরের দিনই বাড়ি ছেড়ে চলে যান । কেন জানেন ? আপনার দাদু-ঠাকুমা-বাবা আপনাকে নিজেদের মতো ননভেজিটেরিয়ান তৈরি করতে চাইছিলেন , আর আপনার মা আপনাকে নিজের মতো করে গড়তে চাইছিলেন , একজন বিশুদ্ধ শাকাহারী। আপনার জন্মদিনের উৎসবে আগত নিমন্ত্রিতদের সামনেই তাঁরা আপনার মাকে অকথ্য ভাষায় তিরস্কার করেছিলেন , অপমান করেছিলেন। সে-শপমান নিশ্চয়ই অসহ্য ছিল, নয়তো নিজের এক বছরের মেয়েকে ছেড়ে দিয়ে চলেই বা যাবেন কেন ?
পড়ে দেখুন, প্রেমিক কংকালের স্মৃতিচারণ। ওতে লেখা আছে যে আপনার মা বিশুদ্ধ শাকাহারী ছিলেন। তিনি চামড়ার জুতো পরতেন না, ইন ফ্যাক্ট চামড়ার কোনো দ্রব্য ব্যবহার করতেন না ; সিল্কের শাড়ি পরতেন না, কেননা একটা সিল্কের শাড়ি তৈরি হয় অজস্র পলুপোকা মেরে ; মুক্তোর গয়না পরতেন না ; শীতের দিনে সিনথেটিক উলের পোশাক পরতেন ; বোন চায়নার কাটলারি ব্যবহার করতেন না ; মাছ মাংস ডিম দুধ খেতেন না । আর আপনি আপনারই পোষা পেডিগ্রিপ্রাপ্ত কুকুরকে মেরে ফেললেন, পিঁপড়ের কলোনি নিশ্চিহ্ণ করলেন , এবং একজন বৃদ্ধকে পাঠিয়ে দিলেন মৃত্যুর মুখে । তাছাড়া প্রেমিক কংকালকে কুকুর দিয়ে খুবলে খাওয়াবার তো প্রয়োজন ছিল না ; উনি তো বিনা চিকিৎসায় নিজেই মারা যেতেন । বাবা তো বেঁচে আছেন । ওনাকে জিগ্যাস করবেন যে আপনার মায়ের সঙ্গে ওনাদের সূক্ষ্ম সাংস্কৃতিক অবনিবনা হতো কিনা, দৈনন্দিন জীবনে মতের তুমুল সংঘর্ষ হতো কিনা । হয়তো তাঁরা আপনার মাকে মানসিকভাবে অসুস্হ মনে করতেন , খোঁজ নেবেন।
ডক্টর পাল হাত বাড়িয়ে কাগজের গোছাটা নিলেন।
রিমা খান একটা প্যাকেট দিলে ডক্টর পালকে । বলল, এতে আপনার মায়ের একগোছা চুল আছে । আপনি এতই অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন যে প্রতিশোধের স্পৃহায় বাঙলোর স্টাডির দেরাজে সযত্নে রাখা এই প্যাকেটটা আপনার নজরে পড়েনি । প্রেমিক কংকাল এই চুলের গোছা অতি আদরযত্নে সংরক্ষিত রেখেছিলেন , ভালোবাসার পাত্রীর স্মৃতিচিহ্ণ হিসাবে । আমাদের মালখানায় সিজারের আইটেমের সঙ্গে ছিল , তা থেকে কয়েক গাছা আপনার জন্যে এনেছিলাম । আমি চুলের গোছাটা রেখে নিয়েছি, মামলায় দরকার হবে । আপনার মনে আছে নিশ্চয় আপনার ক্লিপের প্রসংশা করে আমি আপনার কাছ থেকে ক্লিপটা চেয়ে নিয়েছিলাম, তাতে দুয়েকটা ছুল ছিল বলে ? প্রেমিক কংকালের শোবার ঘরের ড্রেসিংটেবিলের হেয়ারব্রাশেও আপনার কয়েকটা চুল থেকে গিয়েছিল। আমরা আপনার আর মায়া পালের চুলের ডিএনএ টেস্ট করিয়েছি। ওটা আপনারই মায়ের চুল।
প্যাকেট আর জেরক্সের গোছা নিয়ে অঝোরে কাঁদতে থাকলেন বিনোদিনী পাল, এম ডি ।
Tagged ডিটেকটিব উপন্যাস |
১৪. মলয়ের সঙ্গে বিনোদিনী
বহুকাল পর, আমার বন্ধু মলয় রায়চৌধুরী যখন অফিসের কাজে কর্ণাটকের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে অন্ধ্রপ্রদেশে জমিহীন কৃষকদের সম্পর্কে একটা স্টাডি করতে গিয়েছিলেন, তাঁর সঙ্গে বিনোদিনী পালের দেখা হয়েছিল, বলতে গেলে আচমকাই । মলয়বাবুর কাছ থেকে বিনোদিনীর দেয়া একপ্রস্হ কাগজ পেয়ে আমি তো থ।
ডিটেকটিভ উপন্যাসটি লেখার আগে , হার্ট স্পেশালিস্ট এক বন্ধুর বাড়িতে বিনোদিনী পালের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল। কথা প্রসঙ্গে তিনি জানতে পারেন যে আমি লেখালিখির ব্যবসা করি ; রিমা খানের সরবরাহ করা তথ্যে নির্ভর করে গল্প-উপন্যাস লিখেছি তাও জানিয়েছিলুম ওনাকে। পুজো সংখ্যার জন্য একটা ডিটেকটিভ উপন্যাসের প্লট খুজছি শুনে তাঁর কাছ থেকে থেকে তাঁর মায়ের অন্তর্ধান এবং মৃত্যুর কাহিনী শুনেছিলুম । রিমা খানের দেয়া তথ্যের সঙ্গে বুনে নিয়েছিলুম ওনার দেয়া তথ্য। ওপরে সেই গল্পটাই আপনারা এতক্ষণ পড়লেন। বিনোদিনী আত্মিক নিরাময়ের জন্য কাহিনীটি বলেছিলেন আমায়।
আমি গল্পটায় একটু মশলাফোড়ন দিয়েছি।
মলয় রায়চৌধুরীর কাছ থেকে জানতে পারি যে বুড়ি বিনোদিনী পাল বর্তমানে অন্ধ্রপ্রদেশের কর্ণাটক সীমান্তে তাঁর মায়ের মন্দিরের পাশে গ্রামবাসীদের জন্য একটা দাতব্য চিকিৎসালয় চালান ; যদিও এলাকাটাকে আর গ্রাম বলা চলে না । তা রুপান্তরিত হয়েছে খনিশহরে । মলয় অন্ধ্রপ্রদেশে খনিশ্রমিকে রূপান্তরিত জমিহীন কৃষকদের পুনর্বাসনের সমস্যা নিয়ে একটা স্টাডি করতে গিয়েছিলেন। মলয় রায়চৌধুরী আমার বন্ধু শুনে উনি, বিনোদিনী পাল, লোকায়ুক্ত জাস্টিস রঙ্গনাথনের একটি রিপোর্টের কয়েকটি পৃষ্ঠা আমাকে দেবার জন্য দেন। বিনোদিনী অনুরোধ করেছিলেন যে রিপোর্টে দেয়া তথ্য অনুযায়ী আমি যেন আমার ডিটেকটিভ উপন্যাসটিতে প্রয়োজনীয় রদবদল করে নিই ।
জাস্টিস রঙ্গনাথন তাঁর রিপোর্টে জানিয়েছেন যে বিনোদিনী পালের মা মায়া পালকে ষড়যন্ত্র করে খুন করিয়েছিল খনিজবস্তু পাচারকারী মাইনিং মাফিয়ারা । মাইনিংয়ের ঠিকাদাররা গ্রামটাকে আর তার আশেপাশের জঙ্গলকে দখল করতে চেয়েছিল কিন্তু তাদের চেষ্টা প্রতিহত হচ্ছিল মায়া পালের স্কুলের কারণে। যে লোকটি খুন করে লাশ টাঙিয়েছিল সে লোকায়ুক্তের পুলিশের হাতে ধরা পড়ে, আর এখন সে জেল খাটছে । মাইনিং মাফিয়ারাই বিনোদিনী পালের মায়ের মৃত্যুর খবর অন্ধ্র পুলিশকে দিয়েছিল বলে অত তাড়াতাড়ি জিপ নিয়ে পৌঁছে গিয়েছিল পুলিশের ইন্সপেক্টর রামাইয়া । রেকর্ডে কারচুপি করার অপরাধে চাকরি খোয়াতে হয়েছে ইন্সপেক্টর রামাইয়াকে । আসল পোস্টমর্টেম রিপোর্ট পাওয়া গিয়েছিল রামাইয়ার গ্রামের বাড়িতে ; তাতে দেয়া তথ্য অনুযায়ী ভ্যাজাইনা সোয়াইব থেকে প্রমানিত হয়েছিল যে অজ্ঞান অবস্হায় মায়া পালকে তিনজন রেপ করেছিল । আজ্ঞান অবস্হাতেই মায়া পালকে তারা কাঁঠাল গাছে টাঙিয়ে দিয়েছিল । ভিসেরা রিপোর্ট অনুযায়ী মায়া পালকে ক্লোরোফর্ম করা হয়েছিল । খুনি নিজের অপরাধের স্বীকৃতি জনৈক ম্যাজিস্ট্রটের সামনে দর্জ করেছিল এবং তাতে সে বলেছিল যে নিরঞ্জন দত্তকেও ক্লোরোফর্ম করেছিল তারা কয়েকজন লোক মিলে । বাদবাকি অপরাধীরা ফেরার ।
ডিটেকটিভ উপন্যাসটার প্রথম সংস্করণ উৎসর্গ করেছিলুম রিমা খানকে । রিমার কাছ থেকে বহু উপন্যাসের প্লট পেতুম। দ্বিতীয় সংস্করণটা আর তাঁকে দেয়া যাবে না। উনি অবসর নেবার বছরেই মারা যান ; অবিবাহিত ছিলেন ।
Tagged ডিটেকটিভ উপন্যাস |
পৃষ্ঠা
ক্যাটাগরিসমূহ
আর্কাইভস
Blogroll
RSS Feeds
মেটা :
- Get link
- X
- Other Apps
Comments
Post a Comment